শ্রীগৌড়ীয় বৈষ্ণব সাহিত্যাকাশে মহাপ্রভু শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যদেব এক উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্ক। তাঁর আবির্ভাবের পূর্বে ধর্মান্ধতা, ভেদবুদ্ধি এবং কুসংস্কারাচ্ছন্নতায় ভারতবাসীর জীবন বিপর্যস্ত ছিল। বুদ্ধদেব এসে যদিও অহিংসার বাণী প্রচার করেছিলেন তবুও পরবর্তীকালে নাস্তিক্যবাদ, সৌরতন্ত্র, হীনযান, মহাযান, বজ্রযানাদি প্রভৃতি কূট নিয়মে মানব সমাজে কল্যাণের পথ আস্তে আস্তে রুদ্ধ হয়ে যায়। তৎপরবর্তীকালে শঙ্করাচার্যের অদ্বৈতবাদ, রামানুজাচার্যের বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ, নিম্বার্কের দ্বৈতাদ্বৈতবাদাদি প্রতিষ্ঠিত হলেও সমাজের নিম্নশ্রেণীর সাধারণ মানুষেরা ছিল এইসব বিষয় থেকে বহু দূরে। আর শূদ্র জাতীয় সাধারণ নিম্নশ্রেণীর মানুষ ছিল সমাজে ঘৃণিত, অবহেলিত, উপেক্ষিত এবং লাঞ্ছিত। তাদের জীবন ছিল ভারবাহী পশুর মতো, গলায় ঘন্টা বেঁধে তাদের পথ চলতে হতো। ওই সময় সমাজে কৌলিন্য প্রথার প্রবর্তন হলে উচ্চ শ্রেণীর নিষ্পেষণে শূদ্র জাতীয় সাধারণ মানুষ প্রবলভাবে হাঁপিয়ে উঠলো। অনন্তর তুর্কির আক্রমণে জাতীয় জীবন বিপর্যস্ত হলো, আর মঠ-মন্দিরাদি প্রতিষ্ঠান সমূহ ধ্বংস হতে লাগলো। জনজীবন ভীষণভাবে দুর্বিষহ হয়ে উঠলো। বিদেশিদের আক্রমণে ভারতবাসীর জীবনে বিপর্যয় নেমে এলো। ভয়ে, লোভে দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করতে লাগলো। সমাজের এই প্রকার দুরবস্থা দর্শন করে শান্তিপুর নাথ শ্রীঅদ্বৈতাচার্য সনাতন বৈদিক সমাজকে সংকটময় পরিস্থিতি হতে রক্ষা করার জন্য তুলসী-গঙ্গাজলে ভগবদারাধনায় নিযুক্ত হলেন। তাঁর ঐকান্তিক প্রার্থনা ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সন্নিধানে উপনীত হলে ১৪০৭ শকের (১৪৮৬ খ্রি:) ফাল্গুনী পূর্ণিমায় সন্ধ্যাকালে তিনি শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য রূপে শচীদেবী ও জগন্নাথ মিশ্রের পুত্ররূপে নবদ্বীপে আবির্ভূত হন। সুমহান ব্যক্তিত্বের জনক শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভুর আবির্ভাব বিশেষ এক তাৎপর্যমণ্ডিত যুগান্তকারী ঘটনা।
ভারতীয় সংস্কৃতি ও সভ্যতার অবক্ষয়ের দিনে গভীর অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়ে সহস্র সূর্যের মতো দশদিক আলোয় উদ্ভাসিত করে শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যদেব আবির্ভূত হয়েছিলেন। তাঁর আবির্ভাবে সমাজ জীবনে ধর্ম, দর্শন, সমাজনীতি, রাজনীতি ও সাহিত্য ক্ষেত্রে এক বিশেষ বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে। তিনি ছিলেন এক মহান বিপ্লবী সমাজ সংস্কারক। সমাজের ভয়ানক দুঃসময়ে তিনি মানব জাতির কল্যাণের জন্য কলির যুগধর্ম হরিনাম সংকীর্তন প্রচার করেন। জাতি-ধর্ম-বর্ণ- শ্রেণী নির্বিশেষে আপামর জনসাধারণকে ঐক্যবোধে উদ্দীপিত করে বৈদিক সাম্যবাদ প্রকাশের মাধ্যমে তৎকালীন সমাজ সংস্কারের উজ্জ্বল বিজয় পতাকা তিনি ঊর্ধ্বে উড্ডীন করেন। ব্রাহ্মণ্য স্মৃতিশাস্ত্র প্রবর্তিত সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে কোনো ভেদ নেই। চণ্ডাল যদি হরিভক্তি পরায়ণ হয়, তবে সে ব্রাহ্মণ অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ। হরিভক্তি পরায়ণ যবন হরিদাসকে তিনি আচার্যত্ব দান করলেন। খোলাবেচা দরিদ্র শ্রীধর হতে গজপতি রাজা প্রতাপরুদ্র পর্যন্ত, মহাপাপী জগাই-মাধাই হতে রাজমন্ত্রী রূপ-সনাতন পর্যন্ত আপামর মানুষকে তিনি শ্রীহরিনাম সংকীর্তনের মাধ্যমে একত্রিত করে মানবতার স্বাভাবিক মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনেন। ধনী-নির্ধন, ব্রাহ্মণ- চণ্ডাল, ম্লেচ্ছ, উচ্চ-নীচ সমাজের সকল স্তরের মানুষকে তিনি মানবতার এক আসনে বসবার সুযোগ দান করলেন শ্রীহরিনাম সংকীর্তন আন্দোলনের মাধ্যমে। অবহেলিত, অপমানিত, লাঞ্ছিত, ঘৃণিত, কলুষিত মূঢ় ম্লান সমাজকে প্রেম, স্নেহ-ভালোবাসার মন্ত্র দিয়ে তিনি ভারতীয় বৈদিক সংস্কৃতি ও সনাতন ধর্মকে রক্ষা করলেন।
শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভু জানতেন– জাতিভেদ ও অস্পৃশ্যতা, পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষ ও কলহে শতধা বিভক্ত কলুষিত সমাজের মধ্যে একটা স্থায়ী কল্যাণকর পরিবর্তন আনতে হলে নতুন দৃষ্টিতে ধর্ম সংস্থাপন করতে হবে। আর সেই দৃষ্টি হলো স্নেহ-প্রেম ও অহিংসার দৃষ্টি। তিনি সর্বপ্রথম অহিংসার পথে আইন অমান্য আন্দোলন প্রবর্তন করেন। তৎকালে নবদ্বীপের শাসক চাঁদকাজী আদেশ জারি করেছিলেন— নগরে বা গৃহে কেউ হরিনাম সংকীর্তন করলে সে দণ্ডনীয় হবে। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যদেব সদলে হুংকার দিয়ে সেই দিনই সন্ধ্যাকালে চাঁদকাজীর অঙ্গনে গিয়ে উচ্চস্বরে শ্রীহরিনাম সংকীর্তন করতে লাগলেন। শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যের ভাবমণ্ডিত ও গম্ভীর মুখমণ্ডল, অহিংসা প্রেমের নির্ঝর, অপার করুণাপূর্ণ দৃষ্টি দর্শন মাত্রেই চাঁদকাজী মুগ্ধ, অভিভূত এবং ভীত হয়ে তাঁর শ্রীচরণে ক্ষমা প্রার্থনা করে শ্রীহরিনাম সংকীর্তন করার জন্য ঢালাও অনুমতি প্রদান করলেন। তারপর বললেন—আমার বংশে কেউ যদি হরিনাম সংকীর্তনে বাধা দেয় আমি তাকে কঠিন শাস্তি দেব।
শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যদেব সুকোমল প্রেমিক হৃদয় হলেও জীবের মঙ্গলের জন্য আত্মসংযম ও ত্যাগ বৈরাগ্যের দ্বারা সংসার বন্ধন ছিন্ন করে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। তাঁর সংযম, তিতিক্ষা, সৌন্দর্য, সুতীক্ষ্ণ প্রতিভা, অনন্য সুলভ পাণ্ডিত্য প্রকর্ষ, স্বভাব সুলভ কোমল বাক্যালাপ, বিনয় গর্ভ অমায়িক ব্যবহার ইত্যাদি দিব্যগুণাবলী সকল জাতীয় লোকের চিত্তাকর্ষক ছিল। এ জন্যই তাঁর প্রবর্তিত ধর্মে তৎকালীন সমাজের সকল শ্রেণীর লোকই সমভাবে আকৃষ্ট হয়েছিল। আজকের দিনে শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যদেবের প্রবর্তিত আদর্শ অত্যন্ত প্রয়োজন। ফাল্গুনী দোলপূর্ণিমায় তাঁর শুভ আবির্ভাব দিবসে আমরা সকলে তাঁর কাছে প্রার্থনা জানাই। তিনি আমাদের সকলের প্রতি শুভ দৃষ্টিপাত করুন।
শ্রীতারকব্রহ্ম দাস ব্রহ্মচারী