‘ঘেউ ঘেউ’ বলেছিলেন মমতা, স্যাট বলেছিল ‘দয়ার দান’, ডিএ নিয়ে কী কী যুক্তি ছিল রাজ্যের

হার মানতে হল রাজ্য সরকারকে। মহার্ঘ ভাতা (ডিএ) আদৌ রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের প্রাপ্য নয় বলেই মনে করত রাজ্য সরকার। এবার সেই দাবি নাকচ হয়ে গেল স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ট্রাইব্যুনাল। শুক্রবার এই রায়ের পরে রাজ্য সরকারের সব যুক্তিই কার্যত খণ্ডন করে দিল স্যাট।

রাজ্যে ডিএ-র দাবি নিয়ে বিতর্ক কম হয়নি। তৃণমূল কংগ্রেস প্রভাবিত সরকারি কর্মীদের এক সভায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, “ঘেউ ঘেউ করবেন না। তাহলে কিছুই দেব না। ডিএ যখন দেওয়ার তখন দেব।” এর পরে স্যাটে যখন মামলা হয় তখন তা গ্রহণই করতে চায়নি ট্রাইব্যুনাল। বলেছিল, এনিয়ে মামলা হবে না কারণ, ডিএ সরকারের দয়ার দান।

রাজ্যের সরকারি কর্মচারীদের সংগঠন ‘কনফেডারেশন অব স্টেট গভমেন্ট এমপ্লয়িজ’-এর সাধারণ সম্পাদক মলয় মুখোপাধ্যায় বকেয়া ডিএ নিয়ে ২০১৬ সালে মামলা করেছিলেন স্টেট আডমিনিস্ট্রেটিভ ট্রাইব্যুনালে (স্যাটে)। স্যাট রায় দেয়, ডিএ হল রাজ্য সরকারের দয়ার দান। সরকার চাইলে তা দিতে পারে। স্যাটের এই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে ওই সংগঠন কলকাতা হাইকোর্টে আপিল মামলা করে। মূল মামলার সঙ্গে যুক্ত হয় রাজ্যের অর্থ দফতরের এক কর্মচারীর করা আরও একটি মামলা। এ ছাড়া রমাপ্রসাদ সরকার নামে এক আইনজীবী সরকারি কর্মচারীদের ডিএ পাওয়ার অধিকার নেই বলে আরও একটি মামলা করেন।

প্রথমে তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি নিশীথা মাত্রের ডিভিশন বেঞ্চে শুরু হয় ডিএ-র আপিল মামলার শুনানি। পরে তা যায় বিচারপতি দেবাশিস করগুপ্তর ডিভিশন বেঞ্চে। মলয় মুখোপাধ্যায়ের আইনজীবী সর্দার আমজাদ আলি শুনানির শুরু থেকে বিভিন্ন নথি কোর্টের কাছে তুলে ধরে বোঝান, ডিএ পাওয়ার আইনগত অধিকার রয়েছে রাজ্যের সরকারি কর্মচারীদের। কারণ এই নিয়ে সরকার রুল আনে। ফলে তা কখনওই সরকারের দয়ার দান হতে পারে না।

২০১৮ সালের ৩১ অগস্ট ডিএ মামলায় রায় দেয় কলকাতা হাইকোর্ট। বলে ডিএ হল সরকারি কর্মচারীদের আইনগত অধিকার। বিচারপতি দেবাশিস করগুপ্তর ডিভিশন বেঞ্চ স্যাটের রায়ের সমালোচনা করে কোর্ট গাইডলাইন বেঁধে দেয় স্যাটকে।

এক নজরে দেখে নেওয়া যাক কেন্দ্রীয় হারে ডিএ না দেওয়ার পক্ষে কী কী যুক্তি ছিল রাজ্য সরকারের–

১) ডিএ বা মহার্ঘ ভাতা পাওয়া কোনও আইনগত অধিকার বা বাধ্যতামূলক নয়। সরকার তা দেয় কৃপা করে (ex-gratia)।

২) সরকারি কর্মচারীদের যেটা অধিকারই নয়, সেটা নিয়ে মামলা করারও কোনও অবকাশ নেই। ফলে সরকার কাকে কত শতাংশ ডিএ দিচ্ছে (দিল্লির বঙ্গভবন বা চেন্নাইয়ে কর্মরত এ রাজ্যের সরকারি কর্মচারীরা), তা নিয়ে আলোচনা হওয়াটাও অপ্রাসঙ্গিক। কারণ এটা সম্পূর্ণ সরকারের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে।

৩) কেন্দ্রের সমান ডিএ পাওয়ার অধিকার প্রসঙ্গে বক্তব্য ছিল, কেন্দ্র তার নিজের মতো করে কর্মচারীদের ডিএ দিচ্ছে। রাজ্য রাজ্যের মতো করে।

৪) ২০০৯ সালে রাজ্য সরকার ‘রিভিশন অফ পে অ্যান্ড আলায়েন্স’ বা ‘রোপা রুল’ আনে। এই রুলে পে-স্কেল থেকে পে-স্ট্রাকচার সিস্টেমটা দেখা হয়। মামলাকারী সংগঠন এমন কোনও নথি আদালতে পেশ কর‍তে পারবে না যেখানে উল্লেখ রয়েছে ডিএ পাওয়া তাদের আইনগত অধিকার। রাজ্য সরকার ১৯৫২ সাল থেকে তার কর্মচারীদের ডিএ দিয়ে আসছে স্রেফ নৈতিক বাধ্যবাধকতার কারণে।

৫) ‘রোপা রুল’ মেনে বছরে দু’বার (জানুয়ারি এবং জুলাই) ডিএ কেন দেওয়া হচ্ছে না, মামলাকারী সংগঠন প্রশ্ন তুলেছে। তাই যদি হবে, ২০০৯ ‘রোপা রুল’ আসার পরে কেন তাহলে মামলা করা হল না? কেন বলা হল না, ওই আইন মানছে না সরকার বা আইনটা নিখুঁত নয়? তাহলে সরকার তো প্রয়োজনে সংশোধনী আনতে পারত।

৬) কনজিউমার প্রাইস ইনডেক্স বা বেতন কমিশনের সুপারিশ প্রসঙ্গে এজি-র যুক্তি, সুপারিশ মানে সেটা মানা বাধ্যতামূলক নয়৷ ফলে সেখানে আইনগত অধিকারের প্রশ্ন আসার কথাও নয়।

রাজ্যের যাবতীয় যুক্তই অবশ্য খণ্ডন হয়ে গিয়েছে ট্রাইব্যুনালে। এখন হাতে তিন মাস সময়। তার মধ্যে রাজ্যকে জানাতে হবে ডিএ নিয়ে নীতি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.