সময়টা রামচন্দ্র, সীতা আর লক্ষ্মণ-এর বনবাসের কাল। তাঁরা যখন চিত্রকূট পাহাড়ে অবস্থান করছিলেন, তখনই ভরত এসে পিতা দশরথের মৃত্যু সংবাদ জানিয়ে গেলেন। অশৌচ আর শোক নিয়ে পাহাড়, জনপদ পেরিয়ে তাঁরা যখন ফল্গু নদীর ধারে গয়াভুমিতে এসে পৌঁছলেন; তখন পিতার উদ্দেশ্যে পিণ্ডদানের সময় হল। কিন্তু বনবাসী ভিক্ষাজীবী রাম-সীতাদের কাছে যথেষ্ট চাল ও ফলের উপকরণ ছিল না, যা দিয়ে রাজা দশরথকে পিণ্ড দেওয়া যায়। তাই রাম লক্ষ্মণকে পাশের গ্রাম থেকে কিছু ভিক্ষা করে আনতে আদেশ দিলেন। ভিক্ষাপাত্র নিয়ে লক্ষ্মণ চলে গেলেন। কিন্তু সময় বয়ে গেল, অনেক দেরি হয়ে গেল; তবু লক্ষ্মণ ফিরলেন না। খুব চিন্তা হতে লাগল রামের। ভাই কোন বিপদে পড়ল কি না, পিণ্ডদানের সময়ও বয়ে যাচ্ছে–এসব চিন্তা। রাম আর থাকতে পারলেন না। তিনি নিজেই বেরুলেন লক্ষণের খোঁজে। কিন্তু রাম সেই যে গেলেন, তিনিও আর ফিরলেন না। সময় বয়ে যেতে লাগল।
বেলা গড়িয়ে দুপুর হল। রাম বা লক্ষ্মণ কেউই তখনও ফিরলেন না। ফল্গুর তীরে কেয়া ফুলের একটি ঝাড়, তাতে নব প্রস্ফুটিত শিবপ্রিয়া ফুল ছড়িয়ে দিচ্ছে সুবাস, তারই পাশটিতে বসে একা সীতা। স্বামী ও দেবরের দেরি দেখে তাঁর তখন যেন চিন্তার শেষ নেই। তারই মধ্যে সময় গড়িয়ে চলেছে অশুভ ক্ষণের দিকে, এরপর আর দেরি করলে পিণ্ড দান করা যাবে না। পিণ্ডদান না করতে পারলে পিতৃলোকে দশরথকে অতৃপ্ত অভুক্ত হয়ে ভোগ করতে হবে নরকযন্ত্রণা! তাই তিনি শতেক চিন্তার মাঝেও কুলবধূ হিসেবে শ্বশুরের উদ্দেশ্যে যথাসময়ে পিণ্ডদান করাটাকেই উপস্থিত কর্তব্য বলে মনে করলেন। সামান্য যেটুকু মুষ্ঠিপরিমাণ চাল ছিল, আগুন জ্বেলে তাই দিয়ে অন্ন রান্না করে ফল্গুর পবিত্র জলে নেমে তিনি আবাহন করলেন দশরথের বিদেহী আত্মাকে। সীতার আন্তরিক আবাহনে পিণ্ড পাবার পরম আকুতি নিয়ে পিতৃলোক থেকে ছুটে এলেন দশরথ। চরাচরে ভেসে উঠল তাঁর দুইখানি হাত। সেই দুই হাত তিনি প্রসারিত করলেন পিণ্ডগ্রহণের পরম প্রত্যাশায়। সহজ অর্তিতে সীতা তাঁর হাতে তুলে দিলেন ইহকালের আহার পরকালের পাথেয়। তা গ্রহণ করে আকাশ থেকে দশরথ যেন দৈববাণীর মতো জানালেন, তিনি ধন্য, তিনি তৃপ্ত। সেই তৃপ্তি নিয়ে দশরথ চলে গেলেন, অদৃশ্য হল তাঁর দুই হাত। চোখে আনন্দের অশ্রু নিয়ে ফল্গুর জলে পা ছুঁইয়ে আকাশের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন সীতা। এই তৃপ্তি তো শুধু একা দশরথের নয়, এ যে তাঁরও তৃপ্তি! এমনি করে কতকাল গত হল, তখন সেখানে একই সঙ্গে হাজির হলেন রাম ও লক্ষ্মণ।
কাছেপিঠে তেমন সমৃদ্ধ কোন গ্রাম ছিল না, তাই আহার ও পিণ্ডদানের জন্য পর্যাপ্ত চাল ও পথের গাছ থেকে ফল সংগ্রহ করতে বেশ সময় লেগেছে তাঁদের। ফিরে এসেই রাম খুব তাড়া দিতে লাগলেন পিণ্ডের আয়োজন করার জন্য, কারণ অশুভ লগ্ন শুরু হতে আর দেরি নেই। সীতা জানালেন তিনি পিতাকে যথাসময়ে পিণ্ডদান করেছেন এবং পিতা নিজের হাতে সেই পিণ্ড গ্রহণ করে খুব তৃপ্ত হয়েছেন। কথাটা রাম বা লক্ষ্মণ কারুরই একেবারেই বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হল না। এই কদিনে শোকে অধীর হয়ে কতবার তাঁরা পিতাকে আবাহন করেছেন, কই পিতা তো তাঁদের দর্শন দেননি। নিজের সন্তানের ডাকে সাড়া না দিয়ে, কুলবধুর ডাকে সাড়া দেবেন–এটা কি বিশ্বাস করা যায়? তাঁরা বলেই বসলেন, তুমি যে সত্যি বলছ, তারই বা প্রমাণ কি? সে তো তোমার ভ্রমও হতে পারে! সীতা খুব আহত হলেন, স্বামী বা দেবর কেউই তাঁকে বিশ্বাস করেন না! অথচ একই সাথে তাঁরা একই উদ্দেশ্যে সংসার ছেড়ে বনবাস বরণ করে নিয়েছেন। তবুও বিশ্বাস হয় না? তাঁর কর্তব্যকর্মের প্রমাণ কীভাবে দেবেন? তখনই তাঁর মনে হল, এই যে ফল্গুধারা, ওই যে গাভীটি চরছে, ওই যে কেয়ার ঝাড়, ওই যে পাকের আগুন ধিকি ধিকি জ্বলছে–এরা তো তাঁকে দেখেছে পিতাকে পিণ্ড দিতে। এদের সততাই তাঁর প্রমাণ। তখন তিনি ফল্গু নদীকে বললেন, ‘হে পবিত্র অম্বু ফল্গুধারা, তুমি তো দেখেছ পিতাকে পিণ্ড গ্রহণ করতে। দয়া করে তুমি সেই সত্য জানাও এঁদের!’ গাভীটিকে অনুরোধ করলেন, ‘হে ভগবতী, তোমার মুখ ও অঙ্গ অতি পবিত্র, সেই পবিত্র মুখে এঁদের জানাও সত্যটা কি!’ অগ্নিকে বললেন, ‘হে অগ্নি, তুমি তো দেবমুখ, এই মুখে বলো, যা কিছু সত্যি সব বলো।’ কেয়াকে বললেন, ‘হে কেতকী, তুমি, তোমার ফুল তো সত্য-শিব-সুন্দরের পরম প্রিয়; হে শিবপ্রিয়া, এবার বলো যা দেখেছ, যা কিছু সত্যি!’ কিন্তু ফল্গু, গাভী, অগ্নি ও কেয়ার কী যে মতিচ্ছন্ন হল, তারা বেমালুম মিথ্যে বলে বসল, না, তারা কেউই সীতাকে পিণ্ডদান করতে দেখেনি! তাদের এই মিথ্যাচারে মর্মাহত সীতা আর একটা কথাও বললেন না। মিথ্যাচারীর অপবাদ সয়ে রাম ও লক্ষ্মণের সমস্ত শ্লেষ গায়ে নিয়ে মাথা নীচু করে পিণ্ডদানের জন্য পাক করতে বসলেন। তিনি চুপ রইলেন বটে, কিন্তু তাঁর অন্তরে অদ্ভুত যাতনা হতে লাগল, চোখ বেয়ে ঝরতে লাগল অবিরল জলধারা।
কলাপাতায় পিণ্ড সাজিয়ে রাম বসলেন পিতাকে আবাহন করতে। সেই আবাহনের সূচনাতেই আকাশ ঘোর হয়ে উঠল; শোনা গেল দশরথের কণ্ঠে দৈববাণীর মতো স্বীকারোক্তি–‘বৎস রাম, আমি তো বধূমাতার হাতে পিণ্ড পেয়ে তৃপ্ত, আবার আমায় কেন আবাহন করে কষ্ট দিচ্ছ পুত্র!’ এই কথা শুনে রাম ও লক্ষ্মণ দুজনেই খুব লজ্জায় পড়ে গেলেন। পিতা ও সীতার কাছে নিজেদের বেশ অপরাধী বলে মনে হতে লাগল! আর ঠিক তখনই সীতার অন্তরের সব বাঁধ ভেঙে গেল, অন্যায় অপমান সইবার শক্তি যেন তাঁর নষ্ট হয়ে গেল, তাঁর মধ্যে কুলবধূর ব্রিড়া নয়, জেগে উঠল জনকনন্দিনীর প্রবল ক্রোধ—সেই ক্রোধে তিনি অভিশাপ দিয়ে বসলেন তিন মিথ্যেচারিণীকে। ফল্গুকে অভিশাপ দিলেন, তার স্রোত বাইরে নয়, মাটির অন্তরে প্রবাহিত হবে! গাভীকে অভিশাপ দিলেন যে, তার লেজ পবিত্র হলেও, তার মুখ হবে বড় অপবিত্র! আগুনকে অভিশাপ দিলেন, সে দেবতাদের মুখ হয়েও মিথ্যে যখন বলেছে, তখন সেই মুখ খাদ্যাখাদ্য শুদ্ধশুদ্ধ বিচার না-করে সর্বভূক হবে! আর কেয়াকে অভিশাপ দিলেন, তার যে সুগন্ধী ফুল শিবের অত্যন্ত প্রিয় ছিল, আজ থেকে সেই ফুলে শিব আর পুজো নেবেন না। এই ফুলে পুজো দিলে শিবই হবেন অর্ঘ্যদাতার সর্বনাশের কারণ!
রামায়ণের সেই যুগ থেকেই সীতার অভিশাপের কারণে শিব আর কেয়া ফুলে পুজো নেন না।