এই তো সে দিনের কথা! ষোলো সালের বিধানসভা ভোট সবে হয়েছে। পুরুলিয়ার ঝালদা পুরসভা দখল করে নিল তৃণমূল। অথচ একজনও নির্বাচিত কাউন্সিলর ছিল না তাদের। কংগ্রেসের বোর্ড। কিন্তু রাতারাতি সব তৃণমূলে। বলা হল, উন্নয়নের স্রোতে ওঁরা গা ভাসিয়েছেন। শুধু ঝালদা কেন, উত্তরবঙ্গের কত পুরসভা, কত পঞ্চায়েত এমনকী বিধানসভায় বাম-কংগ্রেসের কত আসন এ ভাবেই চলে গেল উন্নয়নের গ্রাসে!

নেপাল মাহাতো ঝালদার কংগ্রেস বিধায়ক। এমনিতে ঠাণ্ডা স্বভাব। তাঁর রাগ হয়নি? বিধানসভার লবিতে বসে গজ গজ করতে শুনেছি। সেই পুরুলিয়ায় রাহুল গান্ধী সভা করতে এলেন। অথচ দিদি সম্পর্কে আশ্চর্যরকম নীরব! প্রদেশ কংগ্রেস দফতরে কান পাতুন। শুনবেন, রাগে কিড়মিড় করছেন সোমেন মিত্র, ওঁরা বাংলায় পার্টিটাই তুলে দেবে!

দিদিকে নিয়ে কেন চুপ ছিলেন রাহুল?

পরে আসছি সে কথায়। আগে দিদির কথা বলি। এবং তিনি আবার কংগ্রেস নিয়ে বেমালুম চুপ। রোজ নরেন্দ্র মোদীকে শাপ-শাপান্ত করছেন, আর বলছেন উত্তরপ্রদেশে মায়াবতী-অখিলেশ জিতবেন, অন্ধ্রে চন্দ্রবাবু, ওড়িশায় নবীন। শুধু আঞ্চলিক দলের কথা। মোদীকে সরিয়ে তাঁরা সরকার বানাবেন।

তা হলে মানে কী দাঁড়াল!

সম্ভবত তা এই যে রাহুল সার বুঝেছেন কংগ্রেসের একার দ্বারা হবে না। মোদীকে হঠাতে আঞ্চলিক দল ভরসা। তাই দিদিকে চটানো যাবে না। আর দিদির লোকেরা ভাবছেন, কংগ্রেস বেশি দূর যাবে না। একশ আসনের আশপাশে থাকবে। এবং আঞ্চলিক দল এমন সংখ্যক আসন পাবে যে, কংগ্রেসের সমর্থনে জোট সরকার গড়তে পারবে।

ঠিক যেমন, ১৯৯৬ সালের ১ জুন থেকে ১৯৯৮ সালের মার্চ পর্যন্ত হয়েছিল। কংগ্রেসের সমর্থনে যুক্তফ্রন্ট সরকার। প্রথমে ১১ মাস এইচ ডি দেবগৌড়া প্রধানমন্ত্রী। তার পর তাঁকে সরিয়ে পরের ১১ মাস প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ইন্দ্রকুমার গুজরাল। ওই ২২ মাস কী পরিমাণ অস্থিরতা তৈরি হয়েছিল, দেশ জানে। অর্থনীতির কী হাল ছিল, তাও অজানা নয়।

সুতরাং এ বার মৌলিক প্রশ্ন, নির্বাচনের ভোট গ্রহণ প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার আগেই রাহুল কিংবা দিদি যে অবস্থান তুলে ধরছেন তাতে মানুষ ভয় পাবে না তো! কারণ, রাজনৈতিক অস্থিরতা মানেই তো অর্থনৈতিক অস্থিরতা। এটা ঠিক, গত পাঁচ বছরে নরেন্দ্র মোদী শাসনে বড় কোনও সাফল্য নেই। অর্থনৈতিক সাফল্যও বিশেষ নেই। এক সময় যাঁরা মোদীর অর্থনীতি নিয়ে উচ্চকিত ছিলেন, বলতেন মোদীনমিক্স, তাঁরাই পরবর্তী কালে নোটবন্দির মতো পদক্ষেপকে হারাকিরি বলেছেন। তবু অর্থনীতি একেবারেই রসাতলে গেছে, বলা যায় কি? পণ্য পরিষেবা কর তথা জিএসটি-র বাস্তবায়নের মতো সংস্কার হয়েছে। রাজ্যের রাজস্ব তাতে বেড়েছে। কর ফাঁকি কমেছে। পরিকাঠামো ক্ষেত্রে কিছু বিনিয়োগ হয়েছে।

বড় কথা হল, যে সমস্ত আঞ্চলিক দল কেন্দ্রে সরকার গঠনের কথা বলছেন, তাঁদের কারও ইস্তাহারে কিন্তু সর্বভারতীয় স্তরে অর্থনৈতিক উন্নয়নের কোনও দিশা নেই। কেউ সে কথা বলছেনও না। কারও বিদেশনীতি, শিক্ষা ব্যবস্থা-সমাজ ব্যবস্থা নিয়ে দর্শনও সুস্পষ্ট নয়। স্পষ্ট বলতে যা আছে, তা হল ভাবনাচিন্তাহীন কিছু খয়রাতি প্রকল্পের কথা। কেউ মুখে না বলুক, প্রত্যেকের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্খাটাই সেখানে বড়। এমনকী কংগ্রেসের ইস্তাহারের নেপথ্যে যে ভাবনা রয়েছে তার পক্ষে বিপক্ষে যাই মত থাকুক, সেই সময়টুকু ব্যয় করেনি তৃণমূল বা সমাজবাদী পার্টি।

তা হলে এই আঞ্চলিক দলগুলি মিলে কি সুস্থির সরকার দিতে পারবে? হয়তো পারবে। কিন্তু এখনই তাঁদের কথা থেকে সে রকম কোনও ইঙ্গিত কি পাচ্ছে জনতা?

ভারতে জোট সরকার যে স্থিরতা দিতে ব্যর্থ হয়েছে এমনও নয়। অতীতে অটলবিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বে পাঁচ বছর সুস্থির সরকার দিয়েছে এনডিএ। সেই সরকারের কিছু ভাল কাজ তো রয়েছেই। পরবর্তী কালে দেড়শ-র কাছাকাছি আসন পেয়ে বামেদের ও আঞ্চলিক দলের সমর্থন নিয়ে প্রথম ইউপিএ সরকার চালিয়েছেন মনমোহন সিংহ। পরে ফের দ্বিতীয় ইউপিএ সরকার চালিয়েছেন তিনি। তবে সেই জোট রক্ষার মুখ্য ঝক্কি অবশ্য তাঁকে কোনওদিনই পোয়াতে হয়নি। উদয়াস্ত সে সব সামাল দিয়ে গিয়েছেন তৎকালীন সরকারের নম্বর টু প্রণব মুখোপাধ্যায়।

এখন দেখে নেওয়া যাক, প্রণব মুখোপাধ্যায় মিলিজুলি তথা জোট সরকার নিয়ে কী বলেছিলেন?

২০১২ সালে দেশের রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হন প্রণববাবু। ২০১৪ সালে লোকসভা ভোটের আগে ২৬ জানুয়ারি জাতির উদ্দেশে বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, “এ বছর লোকসভার ষোড়শ সাধারণ নির্বাচন। একটা ভঙ্গুর সরকার, যা কিছু সুবিধাবাদী স্বেচ্ছাচারীর পণবন্দি, তা কখনও সুখকর পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে না। ২০১৪ সালে তা হলে বিপর্যয় হবে। আমরা প্রত্যেকে ভোটার, আমাদের প্রত্যেকের গভীর দায়িত্ব রয়েছে, আমরা দেশকে অবনমনের পথে ঠেলতে পারিনা। তাই আত্মমন্থন ও করে দেখানোর সময় আসন্ন।”

( জাতির উদ্দেশে রাষ্ট্রপতির বক্তৃতার সেই অংশ- “This year, we will witness the 16th General Election to our Lok Sabha. A fractured government, hostage to whimsical opportunists, is always an unhappy eventuality. In 2014, it could be catastrophic. Each one of us is a voter; each one of us has a deep responsibility; we cannot let India down. It is time for introspection and action.”)

সুবিধাবাদী আঞ্চলিক দলের জোট সরকারের পায়ে কত ভাবে বেড়ি পরাতে পারে তার অভিজ্ঞতা প্রণববাবুর মতো ইদানীং কালে আর কারও নেই। প্রথম ইউপিএ জমানায় ভারত-মার্কিন পরমাণু চুক্তি সাক্ষরের সময় বামেদের তীব্র আপত্তি ও সমর্থন প্রত্যাহার, শরিক দলের নেতাদের দুর্নীতি ছিল বড় মাথা ব্যাথা। আবার দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের আমলে যে নীতিপঙ্গুত্ব নিয়ে তীব্র সমালোচনা হয়েছে, তার দায় তো শরিক দলগুলিরই। জমি অধিগ্রহণ আইনের সংশোধন, খুচরো ব্যবসা প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ, ভরতুকি ব্যবস্থার সংস্কার ইত্যাদিতে বার বার বাধা দিয়েছেন শরিক নেতারা। তার ফলে পদে পদে বিপদে পড়েছেন মনমোহন। তাতে আখের ক্ষতি হয়েছে দেশের। অর্থনীতির। প্রণববাবু যাকে বিপর্যয় বলতে কুন্ঠা করেননি।

সুতরাং ঘুরে ফিরে সেই এক প্রশ্নই তুলে আনছি, রাহুল-মমতার কথায় মানুষ আশঙ্কায় ভুগতে শুরু করবেন না তো! ওঁদের এই অবস্থানে হিতে বিপরীত হবে না তো!

দেখা যাক!

শঙ্খদীপ দাস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.