প্রশ্নটা অনেকদিন ধরেই মনে উঠছিল কিন্তু উত্তর পাইনি। আচার্য শঙ্কর (Acharya Shankar) দেশের উত্তর দক্ষিণ পশ্চিম তিন প্রান্তে মঠ স্থাপন করেছিলেন। এই হিসেবে পূর্ব প্রান্ত আসামেও এক মঠ হওয়া উচিৎ ছিল। কিন্তু এর বদলে ওড়িষা কেন বেছে নিয়েছিলেন তিনি?
উত্তর পেয়েছিলাম যখন প্রথম কামাক্ষা মন্দিরে যাই। কাহিনীটা শুনিয়েছিলেন মন্দিরের এক পান্ডা। আগে জানা ছিল না এই কৌতূহল উদ্দীপক ঘটনা। তাই আজ আচার্যের শুভ জন্মতিথিতে বলি সেই অজানা ঘটনার কথা। আর এই কাহিনীর সাথে জড়িয়ে রয়েছে ঠাকুর-স্বামীজির এক রহস্য

বেদান্ত প্রচারে তখন শঙ্করাচার্য (Shankaracharya) এসেছেন ভারতের পূর্ব প্রান্ত আসামে। দেশের সর্বত্র বড়-বড় তার্কিক, দার্শনিক, ধর্মাচার্যরা তাঁর কাছে পরাজয় মেনে স্বীকার করে নিয়েছেন বেদান্তের সত্যকে। ঐ সব প্রান্তে মঠ স্থাপন করে ভারতের সাংস্কৃতিক ও ভৌগোলিক ঐক্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তিনি।
আসামে তখন তন্ত্রের আধিপত্য। এক তান্ত্রিক সাধুর নাম ঐ অঞ্চল জুড়ে। তাঁকে তর্কে না হারালে বেদান্ত প্রচার সম্ভব নয়। আচার্য তাঁকে আহ্বান জানালেন কিন্তু ঐ সাধু রাজি নন। শুধু তাই নয়, তিনি মারণ উচাটন শুরু করলেন মন্ত্রতন্ত্রের মাধ্যমে, শঙ্করাচার্যের উপর। আচার্য অসুস্থ হয়ে পড়লেন, অসহ্য রোগে আক্রান্ত হলেন তিনি। শিষ্যরা বললেন তাঁকে পাল্টা শক্তি প্রয়োগ করে নিজেকে সুস্থ করে তুলতে ও ঐ তান্ত্রিককে অভিশাপ দিতে। আচার্য রাজি নন। বললেন, সাধনার শক্তি দিয়ে এমন কাজ করা অনুচিত।
রোগ বেড়েই চলে। শঙ্করাচার্য তখন কামাক্ষা মন্দিরে গিয়ে গভীর ধ্যানে বসলেন। মা আবির্ভূত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কি চাও বৎস? আচার্য হাত জোড় করে প্রার্থনা করলেনঃ মা, আমার এই ব্রত কি সফল হবে না? মা উত্তর দিলেন, এ অঞ্চলে তন্ত্রকেই থাকতে দাও তুমি এখন। আচার্যের প্রশ্নঃ কিন্তু আমার উপর যে আদেশ বেদান্ত প্রচারের তা কি পূর্ণ করতে পারব না?
মা কামাক্ষা হেসে উত্তর দিলেন, পারবে। আজ থেকে এক হাজার বছর পরে ভগবান বিষ্ণু অবতার রূপে আবির্ভূত হবেন পৃথিবীতে। তুমি তাঁর সহচর হয়ে জন্মাবে, বেদান্ত প্রচার করবে সারা বিশ্বে। আমিও তখন যাবো তোমাদের দুজনকে সাহায্য করতে।

এই পর্যন্ত বলে পান্ডা থামলেন। কিছু পরে আবার বলতে শুরু করলেন — শঙ্করাচার্যের জন্ম অষ্টম শতাব্দীতে। প্রায় হাজার বছর পর আবির্ভূত হন শ্রীরামকৃষ্ণ। মায়ের নতুন তীর্থ দক্ষিণেশ্বর। বাকী অঙ্কটা এবার আপনিই মিলিয়ে নিন।
পান্ডা হেসে চুপ, আমি স্তব্ধ।
কিছুক্ষণ পরে জিজ্ঞেস করলাম, ঠিক আছে, কিন্তু আসাম না হোক বঙ্গে কেন আচার্য স্থাপন করেন নি পূর্বপ্রান্তের মঠ?
পান্ডার উত্তর — ঐ উদ্দেশ্যেই শঙ্করাচার্য এরপর গিয়েছিলেন বাঙলার গঙ্গাসাগরে কপিল মুনির আশ্রমে। দেখেন যোগীরাজ শাস্ত্র পড়াচ্ছেন তরুণ ব্রহ্মচারী ও সন্ন্যাসীদের। এক কোণায় বসে অপেক্ষা করতে লাগলেন আচার্য। ক্লাস শেষ হলে যোগীরাজ আমন্ত্রণ জানালেন তাঁকে। জিজ্ঞেস করলেন আগমনের উদ্দেশ্য।
উত্তর পেয়ে তিনি হেসে বললেন, তর্কে আমার আপত্তি নেই। তবে তার আগে আমার তিনটি প্রশ্নের উত্তর দিন আপনি।
প্রথম প্রশ্নঃ কে তর্ক করবে?
দ্বিতীয় প্রশ্নঃ কার সাথে তর্ক করবে?
তৃতীয় প্রশ্নঃ কি বিষয়ে তর্ক হবে?
অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন আচার্য। যোগীরাজ হাসলেন। হেসে ফেললেন শঙ্করাচার্যওঃ সত্যিই তো! কে, কার, কি, সবই তো ব্রহ্ম। যোগীরাজ ও আচার্য, দুজনই ব্রহ্ম; দুই ব্রহ্ম আলোচনা করবেন ব্রহ্ম বিষয়ে?
আচার্য নমস্কার করলেন যোগীরাজকে। বললেন, আপনার মতো সিদ্ধযোগী থাকতে এখানে আলাদা মঠের প্রয়োজন নেই।
এরপর শঙ্করাচার্য যান মহাতীর্থ পুরী’তে। মঠ স্থাপন করেন। বলতে থাকেন পান্ডা — আর তাই দেশের উত্তর, দক্ষিণ, পশ্চিম প্রান্তে শঙ্কর মঠ থাকলেও পূর্বপ্রান্তে তা ওড়িশা’য়।

স্বামী সোমেশ্বরানন্দ (Swami Someshwarananda)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.