সংস্কার ভারতীর ‘নটরাজ বন্দনা’ অনুষ্ঠানে সম্মানিত লেটো সম্রাট হরকুমার গুপ্ত

শ্রীগুরু পূর্নিমা উপলক্ষে…… সিউড়ী: সংস্কার ভারতীর ‘নটরাজ বন্দনা’ অনুষ্ঠানে সম্মানিত লেটো সম্রাট হরকুমার গুপ্ত।
নেই কোনো বিশেষ প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা। নেই ছকে বাঁধা পান্ডুলিপি বা বই। কোনোরূপ লিখিত সংলাপেরও প্রয়োজন হয় না। কেবলমাত্র সহজাত কাব্য রচনার দক্ষতা ও নাট্যবোধের দৌলতেই হঠাৎ যে কোন বিষয় নির্বাচন করে মুখে মুখেই তৈরী হয় গান তার সঙ্গে সুর ও সংলাপ।আর পুরুষ মানুষরাই মহিলা সেজে মঞ্চ মাতায কন্ঠ স্বর বদল করে। যা বাংলার বিলুপ্ত প্রায় লেটো গান হিসাবেই সমাদৃত । রাঢ বাংলার লোকসংস্কৃতির অন্যতম প্রাচীন ধারা এই লেটো গান । যা আজ ক্রমশ হারিয়ে যেতে বসেছে। তবে বীরভূমের মহম্মদবাজারের খড়িয়া গ্রামের বৃদ্ধ শিল্পী হরকুমার গুপ্ত আজও বুকে আঁকড়ে রেখেছেন সেই প্রাচীন লেটো গানের ধারা। দল নিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছেন এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত।


শ্রী গুরু পূর্ণিমা তিথি কে শিল্পী সম্মাননা দিবস হিসাবে উৎযাপন করলো সংস্কার ভারতী সিউড়ি শাখা।শনিবার বিকালে সিউড়ি শিক্ষক ভবনে “নটরাজ বন্দনা” শীর্ষক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সংস্কৃতির আদি গুরু নটরাজ বন্দনায় অংশ নেয় শাখার সদস্যরা । সংগীত, নৃত্য, কবিতায় সাংস্কৃতিক অর্ঘ্য নিবেদিত হয়। অনুষ্ঠানে নটরাজ প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন করেন বিশিষ্ট অতিথি বর্গ। প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সূচনা করেন লেটোসম্রাট হরকুমার গুপ্ত, সভানেত্রী স্বপ্না চক্রবর্তী বিশেষ অতিথি সংস্কৃতি ব্যক্তিত্ব মানস চক্রবর্তী প্রমুখরা। গত ১৫ বছর ধরে এই শ্রীগুরু পূর্নিমা তিথি কে সামনে রেখে প্রচারের আলোয় না থেকেও শিল্প ক্ষেত্রে যারা নীরবে কাজ করে যাচ্ছে এমন বাক্তিত্বদের সম্মাননা জানানো হয়। অনুষ্ঠানে লেটোসম্রাট হরকুমার গুপ্তকে সম্মাননা জ্ঞাপন করল সংস্কার ভারতী।প্রবীণ লেটোশিল্পী হরকুমার গুপ্ত আজীবন জড়িয়ে আছেন লেটো গানের সঙ্গে। বাঁচিয়ে রেখেছেন মাটির গন্ধ মাখা এই লোক সংস্কৃতিকে। সেই লেটোগুরু হরকুমার গুপ্তের হাতে মানপত্র ও উপহার তুলে দেন স্বপ্না চক্রবর্তী। তিনি বলেন, “যে সমস্ত প্রতিভাধর শিল্পী দীর্ঘদিন ধরে সংস্কৃতির ক্ষেত্রে নীরবে কাজ করে যাচ্ছেন, একই সঙ্গে নতুন প্রজন্মকে সেই শিল্প কলায় উদ্বুদ্ধ করছেন তাদের কে খুঁজে বের করে শ্রদ্ধা জানানই আমাদের মূল লক্ষ্য।সেই লক্ষ্যে নিরবে কাজ করে চলেছেন হরকুমার গুপ্ত। তাই এহেন শিল্পী কে সন্মাননা জানিয়ে আমরা ধন্য হলাম।

সম্মাননা পেয়ে শিল্পী হরকুমার গুপ্ত বলেন,” দীর্ঘ ৫০ বছরের বেশী সময় ধরে লেটো জগতের সঙ্গে যুক্ত আছি। হারিয়ে যেতে বসা লেটো গান কে নতুন প্রজন্মের কাছে বাঁচিয়ে রাখতে এখনও নিয়মিত ক্লাস করি। নিজে অভিনয় করেছি । জেলায় ভিন রাজ্যে লেটো গান করেছি। তবে সংস্কার ভারতীর এই সম্মান আমার কাছে পরম প্রাপ্তি।”

লেটো গান নিছকই গান বললে ভূল বলা হবে। একে হাস্যরস মেশানো নাটক বলাই শ্রেয়। যার মধ্য দিয়ে শানিত হয় সামাজিক ভন্ডামীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ব্যাঙগারথক প্রতিবাদ। ছড়িয়ে পড়ে নানান সামাজিক বার্তা। এক সময় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছোট বেলায় বদরী করিম চাচা লেটো গানের দলে যুক্ত ছিলেন। সেই হারিয়ে যেতে বসা লেটো গান কে বাঁচিয়ে রাখতে গ্রামের নতুন প্রজন্ম কে লেটো সেখানোয মেতে থাকেন বৃদ্ধ হর কুমার গুপ্ত।
সেই ছোট্ট বয়স থেকেই এই লেটো গানের সাথে নিজেকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছেন হরকুমার গুপ্ত। লেটো শিল্পী হিসাবে যাকে একনামে চেনেন জেলা তথা রাজ্য বাসী। ন্যুব্জ শরীরেও নিত্যনতুন সৃষ্টির আকাঙ্খায় আজও মশগুল বৃদ্ধ হরকুমার। দমাতে পারে নি তাঁর বয়স। তাই ইদানীং চারপাশে চলা অনভিপ্রেত ঘটনাবলীর প্রেক্ষিতে হরকুমার গলা আজও সমান ঝাঁজালো,, ‘‘বাবাগো! ছাড়পোকা কামড়াই দিলে গো/ কিচির মিচির আওয়াজে ঘুম আসে না গো!’’ শুধু তাই-ই নয় , নারী নির্যাতন, পণ প্রথা, মানুষের মানুষে ভেদাভেদের বিরুদ্ধে সূর সপ্তমে চড়ান হরকুমার ও তাঁর দলবল – লেটো গানের মাধ্যমেই।


শিল্পী হরকুমার গুপ্তের কথা থেকে জানা যায়, প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের ইলামবাজারের দ্বারোন্দা গ্রামেই ছিল শিল্পীর বাড়ি। মা-বাবা-চার ভাইবোনের সংসারে তখন অভাবে থালায় পান্তা ভাত ও ভাগাভাগি করে খেতে হযেছে । পকেট মাত্র ১ টাকা নিয়ে ১২-১৩ বছরের কিশোর হর গুপ্ত কাজের খোঁজে বেরিয়ে পড়েন বাড়ি থেকে। একাজ-ওকাজ করতে করতে শেষমেশ ঠাঁই হয় লেটোর দলে।তখন বীরভূমের একাধিক জায়গায় লোটোর নাম করা দল ছিল। তারপর থেকে লেটোই তাঁর ধ্যানজ্ঞান। ১৯৭৯ সালে তৈরীর করেন ‘শ্রীদূর্গা লেটো আসর।’’ জেলা, রাজ্যের হেন কোনো প্রান্ত নেই যেখানে লেটো শোনান নি হরকুমার গুপ্তের দল। পেয়েছেন অজস্র সম্মান, পদক, সম্বর্ধনা। দেওয়ালে ঝুলিয়ে রেখেছেন মুখ্যমন্ত্রী সই করা স্বীকৃতিপত্র।

শিল্পীর আক্ষেপ ,‘‘ রক-ব্যান্ড আর পাশ্চাত্য সংস্কৃতির করাল গ্রাসে বিপর্যস্ত লোকস:স্কৃতি। লেটো গান আজ বিবর্তিত হতে বসেছে পঞ্চরসে! গভীর রাত পর্যন্ত হিন্দি চটুল গান, সঙ্গে অশ্লীল নাচে সংবলিত তথাকথিত পঞ্চরসেই আজ আগ্রহ বেশী। শিল্পীরাও দুটো বাড়তি পয়সার জন্য ঝুকছে সেদিকে।’’

তবে সেই ধরনের কোনো প্রবনতার সাথে আপস করেন নি ও মরে গেলেও করবেন না বলে সাফ জানান শিল্পী। বহু কষ্ট, অভাব, দুর্দশা, অনটনকে নিত্যসঙ্গী করে আজও জীবন এগিয়েছে হরকুমারের। ‘‘কিন্তু সেসব ঢাকা পড়ে গিয়েছে মানুষের হাততালিতে,’’

কথা বলতে বলতে চোখের কোন চিকচিক করে ওঠে  শিল্পীর । কিছু দিন আগে লোকসংস্কৃতির গবেষক ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য কর্তৃপক্ষের ডাকে শিল্পী হর গুপ্ত সাতদিনের শিবির করে এসেছেন কোলকাতার রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের । 

তাঁর লেটো গানের দলের সদস্য আমির আলি, জটাই ভুঁইমালি, তুলসী ভুঁইমালির গান, অভিনয়, চন্ডী বাউরীর তবলা আর প্রশান্ত দাসের বাঁশি জমিয়ে দেয় মানুষের ভীড়। স্বামী মারা যাওয়ার পর শ্রীদূর্গা লেটো আসরে নাম লিখিয়েছেন জ্যোৎস্না বেগম। আর শিবু দাস ও সুবোধ বাদ্যকরের উপর ভাড় পরে প্রতি পালায় মেয়ে সাজার। লেটোর অন্যতম বৈশিষ্ঠ্য হল ছেলেরা মেয়ে সেজে অভিনয় করে। রং মেখে সেজগুজে মঞ্চে ওঠলে তখন ধরার উপায় থাকে না এঁরা পুরুষ।
নটরাজ বন্দনা অনুষ্ঠানে প্রস্তাবিত ভাষন দেন সুদীপ কুমার চট্টোপাধ্যায়। সমগ্র অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন শুভঙ্কর দত্ত। রাষ্ট্র বন্দনার মাধ্যমে অনুষ্ঠান শেষ হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.