গেরুয়া ঝড়ে টালমাটাল সবুজের দম্ভ

পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে একটা কথা খুব চলে। সিপিএমকে শেষ করেছিল জঙ্গলমহল আর মমতাকে শেষ করবে পাহাড়। গত কয়েক বছর ধরেই মমতার প্রতি পাহাড়ের মানুষের একটা বীতশ্রদ্ধার ভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এবারের লোকসভা নির্বাচনে সেটি আরও স্পষ্ট হলো। দার্জিলিং বিজেপির ছিলই। আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি আর কোচবিহারও এবার ঝুলিতে চলে এল।
২০১৩ সাল থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পাহাড়ে বিমল গুরুঙ্গকে জনবিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করছেন। গুরুঙ্গের আপত্তি অগ্রাহ্য করে জনজাতিদের নিয়ে একের পর এক বোর্ড গঠন করেছেন। মমতা বুঝতেই পারেননি পাহাড়ের মানুষ তার এই বিভাজননীতি মোটেই পছন্দ করছেন না। তাই বিমল গুরুঙ্গ অন্তরালে থেকেও ‘হিরো’হয়ে যান এবং যার প্রভাব এবারের নির্বাচনে খুব ভালোভাবেই পড়েছে। জয়ী হয়েছেন বিজেপি প্রার্থী রাজু বিস্ত। অন্যদিকে এই ফল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চোখের মণি বিনয় তামাংয়ের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ চূড়ান্ত অনিশ্চিত করে তুলেছে। বিনয় তামাং জিটিএ চেয়ারম্যানের পদ ছেড়ে দার্জিলিং বিধানসভার উপনির্বাচনে তৃণমূল সমর্থিত নির্দল প্রার্থী হয়েছিলেন। হেরেছেন ৪৬ হাজার ২৮৫ ভোটে। জয়ী হয়েছেন বিজেপি সমর্থিত জিএনএলএফ প্রার্থী নীরজ জিম্বা।
বিমল গুরঙ্গের অদৃশ্য উপস্থিতি টের পাওয়া গেছে আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি এবং কোচবিহারেও। তরাই-ডুয়ার্সে সাড়ে তিন লক্ষ গোখার বসবাস। শোনা যাচ্ছে বিমল গুরুঙ্গের অপমানের বদলা নিতে এবং নরেন্দ্র মোদীর উন্নয়নের বার্তায় ভরসা রেখে তারা বিজেপিকে ভোট দিয়েছেন। শুধু গোখারা নন, তরাই-ডুয়ার্স চা-বলয়ে বসবাসকারী প্রতিটি জনজাতি সম্প্রদায় এবার তৃণমূলের দিক থেকে মুখফিরিয়ে নিয়েছে। প্রবল গেরুয়া ঝড়ের প্রভাবে পড়েছে কোচবিহারের কৃষিপ্রধান অঞ্চলগুলিতেও। তৃণমূলের নেতাকর্মীদের দাম্ভিক আচরণ, স্বজনপোষণ দুর্নীতির বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন সাধারণ মানুষ। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে পঞ্চায়েত নির্বাচনে ভোট দিতে না পারার ক্ষোভ। কোচবিহারে তিন শতাধিক বুথে রিগিং করেও রেহাই পায়নি তৃণমূল।
রায়গঞ্জে এবার অন্য ছবি দেখা গেছে। বিজেপি প্রার্থী দেবশ্রী চৌধুরী লড়াই শুরুই করেছিলেন সাম্ভাব্য বিজয়ী হিসেবে। পুঁজি ছিল লাখ দুয়েকের ভোটব্যাঙ্ক।ইন্ধন জুগিয়ে ছিল দাড়িভিটে স্কুলছাত্র হত্যার ঘটনা। দেবশ্রী একটানা জাতীয় নিরাপত্তা এবং দেশভক্তির কথা বলে গেছেন। পাশাপাশি উসকে দিয়েছেন দাড়ি ভিটে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্বৈরাচারী ভূমিকার কথা। অন্যদিকে রায়গঞ্জের বিদায়ী সাংসদ সিপিএমের মহম্মদ সেলিম এবারের নির্বাচনে বিন্দুমাত্র প্রভাব বিস্তার করতে পারেননি। কংগ্রেসের দীপা দাসমুন্সীর ক্ষেত্রেও একই কথা বলা চলে। দেবশ্রীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় মূলত তৃণমূলের কানাইয়ালাল আগরওয়ালের। কানাইয়ালালের মূল পুঁজি ছিল মুসলমান ভোট। ইসলামপুর (মুসলমান ভোট ৭২ শতাংশ), গোয়ালপোখরের দুটি ব্লক (মুসলমান ভোট ৭৪ শতাংশ ও ৬৪ শতাংশ) এবং হেমতাবাদ (মুসলমান। ভোট ৫০ শতাংশ) তৃণমূলকে লিড দিয়েছে। একথা বলার উদ্দেশ্য একটাই, এবারের নির্বাচনে মুসলমানরা তৃণমূলকে ঢেলে ভোট দিয়েছে। এবং যে ২২টি আসন তারা পেয়েছে তার প্রতিটি ক্ষেত্রেই নির্ণায়ক ভূমিকা নিয়েছে মুসলমানরা।
ঝাড়গ্রাম পুরুলিয়া ও পশ্চিম মেদিনীপুরের পঞ্চায়েত ভোট যে ইঙ্গিত দিয়েছিল লোকসভা নির্বাচনে সেটাই সত্যি হয়ে দাঁড়াল। উন্নয়নের জোয়ারে ‘জঙ্গলমহল হাসছে’- এই চটকদারি স্লোগান দিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চেয়েছিল শাসকদল। কিন্তু মিথ্যে স্লোগান মন ভরেনি মানুষের। ভয়ংকর রকমের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব এবং সঠিক নেতা নির্বাচনের অক্ষমতা কাল হয়েছে শাসকদলের। ২০১৪ সালে নির্বাচনে তৃণমূলের উমা সোরেন ঝাড়গ্রাম কেন্দ্র থেকে তিন লক্ষ ভোটে জয়ী হয়েছিলেন। এবারের তৃণমূল প্রার্থী বীরবাহা সোরেন সেই লিড ধরে রাখা দুরের কথা। এগারো হাজার ভোটে হেরেছেন। বিজেপি প্রার্থী কুনার হেমব্রমের শিক্ষিত ও পরিশীলিত ভাবমূর্তি মানুষকে আকৃষ্ট করেছে। তৃণমূল আশা করেছিল সিপিএম প্রার্থী দেবলীনা হেমব্রম বিজেপির ভোট কাটতে না পারুন নিজেদের ভোটব্যাঙ্ক ধরে রাখতে পারবেন। হয়েছে তার উল্টো। বিজেপির ভোট যেমন বেড়েছে সিপিএমের ভোট লক্ষণীয় ভাবে কমেছে। সামাগ্রিকভাবে এবারের নির্বাচনে বাম ভোটাররা বিজেপিকে ভোট দিয়েছেন। যার ফলে বিজেপির ভোট শতাংশ ২০১৪ সালের ১৭ শতাংশ থেকে বেডে ২০১৯-এ ৪০ শতাংশে পৌঁছে গেছে। মার্কসবাদী কর্মী-সমর্থকেরা জানেন তৃণমূলের অত্যাচারের হাত থেকে তাদের রক্ষা করার ক্ষমতা বর্তমান সিপিএমের নেই। তৃণমূলের প্রতিদ্বন্দ্বী এখন বিজেপি। ক্ষমতার লড়াইও এই দুই দলের মধ্যে। তৃণমূল যদি বেশি আসন ফেয়ে আরও শক্তিলী হয়ে ওঠে তা হলে তাদের বিপদ আরও বাড়বে। তাই তারা ভোট দিয়েছেন বিজেপিকে। বিজেপির রাজ্য সভাপতি এবং মেদিনীপুর কেন্দ্রের প্রার্থী দিলীপ ঘোষের নানা সময়ে লড়াই সাধারণ মানুষকে তো বটেই, বাম । ভোটারদেরও সাহস জুগিয়েছে। ভোটের আগে তরুণ প্রজন্মের ভোটারদের মুখে। শোনা গেছে, এই তৃণমূলকে যদি কেউ জব্দ করতে পারে, তা বিজেপি। তাই তৃণমূল। বিরোধী সমস্ত ভোট, এমনকী বামেদের ভোটের অধিকাংশ পড়েছে বিজেপির ঝুলিতে। পুরুলয়াির ক্ষেত্রে ছবিটা একটু অন্যরকম। পঞ্চায়েত নির্বাচনে নিজের মতামত প্রয়োগ করতে না পারার পাশাপাশি একাধিক বিজেপি কর্মীর খুন হওয়া সাধারণ মানুষের মনে আতঙ্কের ভাব সৃষ্টি করেছিল। বিশেষ করে সেই সময়, যখন মাওবাদীদের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই করছিলেন বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা। ফলে বিজেপি প্রার্থী। জোতির্ময় সিংহ মাহাত বিপুল ভোটে জয়লাভ করেছে। এবারের নির্বাচনে আরও একটি বিষয় স্পষ্ট। নরেন্দ্র মোদী যেসব জায়গায় সভা করেছেন সেখানকার বিজেপি প্রার্থীরা ভালো ফল করেছেন। বস্তুত প্রচারে ঝড় তুলে নরেন্দ্র মোদী একাই পশ্চিমবঙ্গের রং পালটে দিয়েছিলেন। মোদীর প্রতি আমবাঙ্গালির সেই বিশ্বাসেরই প্রতিফলন ঘটেছে ইভিএমে।
নরেন্দ্র মোদীর সভার কথা যখন উঠলই তখন বনগাঁ কেন্দ্রের কথা বলতেই হবে। মতুয়া সম্প্রদায়ের দীর্ঘদিনের দাবি ভারতীয় নাগরিকত্বের। ঠাকুরনগরের সভায় নরেন্দ্র মোদী এ ব্যাপারে স্পষ্ট প্রতিশ্রুতি দেন। তিনি বলেন নাগরিকত্ব বিল সংসদে পাশ হলে বাংলাদেশ থেকে আসা হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-বৌদ্ধ-শিখ-পারসি ধর্মাবলম্বী প্রতিটি মানুষকে নাগরিকত্ব দেবে। ভারত সরকার। সেই সঙ্গে ফেরত পাঠানো হবে বাংলাদেশ থেকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী মুসলমানদের। এই প্রতিশ্রুতি পাওয়ার পর মতুয়া সম্প্রদায়ের মানুষের আর কোনও দ্বন্দ্ব ছিল না। বিজেপি প্রার্থী শান্তনু ঠাকুরের জয় ছিল সময়ের অপেক্ষা। তবে বনগাঁয় যাই। হোক তৃণমূল কংগ্রেস জবরদস্ত ধাক্কা খেয়েছে হুগলিতে। এই লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত সিঙ্গুর ২০১১ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ক্ষমতায় আসতে সাহায্য করেছিল। কিন্তু নিজের রাজনৈতিক আখের গোছাতে সিঙ্গুরকে ব্যবহার করা ছাড়া তিনি আর কিছুই করেননি। উপরন্তু, ভোট গ্রহণের কয়েকমাস আগে টাটা গোষ্ঠীর কর্ণধার রতন টাটা পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলে ৬০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের ঘোষণা করে সিঙ্গুরের মানুষের বহুদিনের একটি ইচ্ছে পূরণের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। উল্লেখ্য, সিঙ্গুরের মানুষ অনেকদিন ধরেই চাইছেন টাটারা ফিরে আসুন। এই উত্তপ্ত পরিবেশে সিঙ্গুর বিধানসভা কেন্দ্রে তৃণমূল হেরেছে ১০,০০০ ভোটে। আসানসোলে বাবুল সুপ্রিয় ছিলেন বিজেপির অন্যতম হেভিওয়েট প্রার্থী। রায়গঞ্জের দেবশ্রীর মতো বালুলও নির্বাচনী লড়াই শুরু করেছিলেন সম্ভাব্য বিজয়ী হিসেবে। প্রতিদ্বন্দ্বী মুনমুন সেন কোনও সময়েই দাগ কাটতে পারেননি। তার ওপর নানারকম ছেলেমানুষী মন্তব্য করে মিডিয়ার কাছে হাসির খোরাক হয়ে উঠেছিলেন। খুব সহজেই জিতেছেন বাবুল। প্রায় সব বিধানসভা কেন্দ্রেই অনায়াস জয় এসেছে।
বর্ধমান-দুর্গাপুরের প্রার্থী সুরিন্দার সিংহ আহলুওয়ালিয়া অবশ্য বাবুলের মতো স্বস্তিতে ছিলেন না। একে তো তার পুরনো লোকসভা কেন্দ্র দার্জিলিং অন্য প্রার্থীকে দেওয়া হয়েছে। তার ওপর বর্ধমান-দুর্গাপুর কেন্দ্রটি বামদুর্গ নামে এক সময় পরিচিত ছিল। হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পর শেষপর্যন্ত আহলুওয়ালিয়াজী জেতেন। বারাকপুরের প্রার্থী অর্জুন হিংহের কাজটিও খুব সহজ ছিল না। তাঁকে হারাবার জন্য তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা ভোটের দিন সকাল থেকেই অশান্তি শুরু করেছিল। দুষ্কৃতীদের তাড়া করতে গিয়ে অর্জুন একবার পড়েও যান। কিন্তু হাল ছাড়েননি। শেষ পর্যন্ত ১৩,১৯০ ভোটের ব্যবধানে জেতেন।
এবারের নির্বাচনে একটি চমকপ্রদ তথ্য উঠে এসেছে। একদা বামদুর্গ নামে পরিচিত পশ্চিমবঙ্গের বামভোট অধিকাংশ বিজেপির ঝুলিতে গেছে। তৃণমূলের বিক্ষুব্ধ অংশের ভোটও পেয়েছে বিজেপি। ফলে বিজেপির ২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনে পাওয়া ১০ শতাংশ ভোট ২০১৯ সালে পৌঁছে গেছে। ৪০ শতাংশ। অন্যদিকে তৃণমূলের ৪৫ শতাংশ ভোট কমে হয়েছে ৪৩ শতাংশ। ব্যবধান মাত্র ৩ শতাংশের। লোকসভা নির্বাচনের বিধানসভাওয়াড়ি ফলাফলে চোখ রাখলে বোঝা যাচ্ছে, বিজেপি মোট ১২৯টি বিধানসভা আসনে জিতেছে। তৃণমূলের জয় ১৫৮টি আসনে। আগামী বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা যে প্রবল সেকথা বলাই বাহুল্য। নির্বাচনের আগে মমতা স্লোগান দিয়েছিলেন, ২০১৯ বিজেপি ফিনিশ। এখন তিনি বুঝতে পারছেন বিজেপির নয় তাঁর নিজের রাজনৈতিক ভবিষ্যতই প্রশ্নচিহ্নের মুখে। এখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানো শুধু কঠিন নয়, একরকম অসম্ভব।
চন্দ্রভানু ঘোষাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.