বিশ্বব্যাপী চলেছে রবীন্দ্র-পূজন।
সারা বছরই রবীন্দ্রচর্চা,গবেষণা চলে।তবুও তাঁর আবির্ভাব দিবসে রবীন্দ্রনাথকে আমরা বড্ড নিজের ভাবি।বসুধার প্রান্তে প্রান্তে,প্রত্যেক বিশ্ববাসী নিজ নিজ হৃদয়ে জাগ্রত করেন কবিকে।অন্তত একবারও হলে গুনগুন করে গেয়ে ওঠেন রবীন্দ্রনাথের কোনো গানের চরণ।অজান্তেই আবৃত্তি,উচ্চারণ করে বসেন তাঁর কবিতার কোনো পংক্তি।সবকিছুই যে তাল-লয় মেনে,তা হয়ত নয়। নিজের মতো করেই!
রবীন্দ্র-পূজন ‘গঙ্গা জলে,গঙ্গা পূজার‘ মতো নয়।এ-পূজনের নৈবেদ্য-পুষ্প-নির্মাল্য-শঙ্খ-ঘন্টা-কাঁসর সবকিছুই ‘রবীন্দ্র-নীরে,রবীন্দ্র-পূজন‘।কভু-বা রবীন্দ্র-গবেষকদের তথ্য-তত্ত্বের সংযোজন ঘটিয়ে পূজনকে করা হয় আরও সৌন্দর্য-মধুর।
রবীন্দ্র-মননে সর্বদাই জাগরূপ থাকত ভারতাত্মার অমৃতময় রূপ।তাঁর যে-কোনো সৃষ্টির দিকেই দৃষ্টি দেওয়া যাক না কেন,সেই ভারতাত্মাই শুরু ও শেষ কথা।
সকলেই হয়ত জানেন যে,শিশুকালে তিনি ঔপনিষদিক পরিমণ্ডলে বড়ো হয়েছেন।বেদমন্ত্রের মন্দ্রিত উচ্চারণ,উপনিষদের মহাবানী আর সামবেদের সঙ্গীতে প্রভাত হত মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়িতে।দেশচর্চা,মানব কল্যাণ-চিন্তন সর্বোপরি ভারতবর্ষের স্বর্ণাভ-ঐতিহ্য শিখন ছিল ঠাকুর বাড়ির প্রাত্যহিক কর্মসূচি।
এই পরিবেশেই শিশু-রবির মনোভূমি পোক্ত হয়।মনন-দ্রষ্টা ঋষি পিতৃদেব রবির মন ঠিকই পাঠ করেছিলেন।তাই রবিকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন ভারতদর্শনে।ঋষিতুল্য পিতার সান্নিধ্য,হিমালয়ের অপার সৌন্দর্য-দুর্গমতা আবার বীরভূমের রুক্ষ-শুষ্ক প্রকৃতি,দরিদ্র মানুষের অসহায়তা সবকিছুই রবির মনোজগতে স্থায়ী শিলালিপি অঙ্কিত করে দেয়।যা তাঁর সৃষ্টিকে বহু ধারায় প্রবাহিত করে।
মানব জাতির পক্ষে রবীন্দ্রনাথকে জানা এখনও শেষ হয় নি।তাঁকে জানার,বোঝার,অনুভব করার প্রচেষ্টা আবহমান কাল ধরে হয়ত চলবে।
যতটুকু জানা গিয়েছে,তারই মধ্যে আমাদের পদচারণা।তা থেকেই রবীন্দ্র মনন-মণিষার অন্বেষণ।
রবীন্দ্রনাথের সাথে ঘটে যাওয়া কতিপয় বিষয় নিয়ে আলোকপাত করেছেন স্বনামধন্য রবীন্দ্র-গবেষক তথাগত রায়।শ্রীরায় রবীন্দ্রনাথ ও শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মধ্যেকার গভীর নৈকট্য,স্নেহ-শ্রদ্ধার বিষয়ে আলোকপাত করেছেন।
১৯৩২ সাল।শ্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় (Shri Shyamaprasad Mukherjee) কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেটরের গুরুদায়িত্ব পেলেন।উল্লেখ্য যে,এই বিশ্ববিদ্যালয়েই তাঁর পিতা “বাংলার বাঘ” অভিধায় ভূষিত শ্রী আশুতোষ মুখোপাধ্যায় উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেছেন নিষ্ঠার সাথে।পরবর্তী সময়ে শ্যামাপ্রসাদও উপাচার্য হয়েছিলেন।
শ্যামাপ্রসাদ সেনেটর নির্বাচিত হয়েই রবীন্দ্রনাথকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে যুক্ত করার উদ্যোগ নিলেন।সেনেট-বৈঠকে প্রস্তাব পাশ করালেন যে,বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্রনাথকে আমন্ত্রণ জানানো হবে।এবং তিনি স্নাতকোত্তর পর্যায়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক বক্তৃতা দান করবেন।সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তাঁকে সাম্মানিক অধ্যাপক রূপেও আমন্ত্রণ করা হবে।কিন্তু,তৎকালে প্রচলিত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধিতে এটা করা সম্ভব ছিল না।কেন না,কবির বয়স তখন একাত্তর বছর।শ্যামাপ্রসাদ ছিলেন দৃঢ়চেতা লক্ষ্যভেদী।
রবীন্দ্রনাথ (Rabindranath) বাধ্যবাধকতার বিষয়টি শুনলেন।সবকিছু জেনেও কবি তাঁর থেকে বয়সে চল্লিশ বছরের ছোট শ্যামাপ্রসাদের আমন্ত্রণ ফেরালেন না।তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাত্যহিক কাজে সক্রিয় হলেন।রবীন্দ্র-শ্যামাপ্রসাদ সম্পর্কের এই-যে পথচলা শুরু হল,তা কবি আমৃত্যু টিকিয়ে রেখেছিলেন।দিনে দিনে তা গভীর থেকে গভীরতম হয়েছিল।
১৯৩৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গঠিত হয় “আন্তর্জাতিক সঙ্ঘ”।বিশ্ব- শান্তির লক্ষ্য নিয়ে এই সঙ্ঘ গঠন করা হয়।সঙ্ঘের কর্মসূচি পরিচালনার জন্য অর্থ দান করেন আমেরিকা নিবাসী বিশ্বপ্রেমিক-মানবপ্রেমিক আঁন্দ্রেউ কার্নেগী (ANDREW CARNEGIE)।
বিশ্বশান্তির উদ্দেশ্যে গঠিত ” আন্তর্জাতিক সঙ্ঘ” প্রতিষ্ঠা উপলক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের “CULTURAL ASSOCIATION“কবিকে সংবর্ধনা জানায়।
পৃথিবী তখন এক অস্থির সময়ের মধ্য দিয়ে চলছিল।১৯১৮-তে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে।ভারতে ব্রিটিশ শাসনের নখ-দন্তের নগ্নরূপ প্রকাশ্য ভাবে জ্বাজল্যমান।নতুন নতুন বিধি নিষেধ আরোপ হচ্ছে ভারতবাসীর উপর।প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জয়ী ও পরাজিত কোনো পক্ষেরই যুদ্ধক্ষুধা মেটেনি।এই বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে রবীন্দ্রনাথ সংবর্ধনা উপলক্ষ্যে খন্ডিত ভারত,বিখন্ডিত বিশ্বের দিকে তাকিয়ে বললেন,”মানবিক মূল্যবোধ” বিষয়ে।
২৯ জুন কবির কাছে একটি স্বরণীয় দিন।কেন না,এই দিনেই জন্মগ্রহণ করেন “বাংলার বাঘ” শ্রী আশুতোষ মুখোপাধ্যায় (Shri Ashutosh Mukherjee)।”বাঘ” ও “সূর্য”-র সম্পর্ক ছিল খুবই ঘনিষ্ঠ। ১৯৩৫ সালের ২৯ জুন আশুতোষের জন্মদিনে দক্ষিণ কলকাতার হাজরা পার্ক একালায়(এখন যতীন দাশ পার্ক) প্রতিষ্ঠিত হল একটি UNDERGRADUATE কলেজ,হল ও পাঠাগার।বলাই বাহুল্য যে,এসব কর্মকান্ডে শ্যামাপ্রসাদ সক্রিয় ভাবে যুক্ত ছিলেন।কবি এই ঘটনা নিয়ে বিশেষ কবিতা লিখে তাঁর আশীর্বচন পাঠান।
তখন প্রাদেশিক সরকারের শিক্ষামন্ত্রী আজিজুল হক।শ্রী হক ছিলেন নদীয়ার শান্তিপুরের মুসলিম নেতা।তিনি শ্যামাপ্রসাদের নাম উপাচার্য হিসেবে মনোনিত করেন।শ্যামাপ্রসাদের নিকট থেকেই রবীন্দ্রনাথের বিষয়ে তিনি আগ্রহী হন।১৯৩৮ সালে উপাচার্যের দায়িত্ব নিয়েই শ্যামাপ্রসাদ শিক্ষা বিষয়ক কর্মসূচিতে কবিকে বেশি করে যুক্ত করতে চাইলেন।শ্যামাপ্রসাদ “শিক্ষা সপ্তাহ” কর্মসূচি চালু করলেন প্রাদেশিক সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৬ সালে।”শিক্ষা সপ্তাহ” বিষয়ে আলোচনায় রবীন্দ্রনাথ মত দেন যে,শিক্ষা সংক্রান্ত জনপ্রিয় গ্রন্থ প্রকাশ করার জন্য।কবির এই প্রস্তাব প্রাদেশিক বঙ্গ সরকারের মনোপুত হল না।ফলস্বরূপ,সামান্য কয়েকটি গ্রন্থ প্রকাশ পায়।যেগুলির মধ্যে রবীন্দ্রনাথের লেখাও একটি ছিল।
১৯৩৬ সালে উপাচার্য হিসেবে শ্যামাপ্রসাদ রবীন্দ্রনাথকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক সমাবর্তনে আমন্ত্রণ জানালেন।এটা ছিল খুবই অভূতপূর্ব ঘটনা।কেন না,তৎকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে যুক্ত নন,এমন কাউকে সমাবর্তনে আমন্ত্রণ জানানো যেত না।সেই হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন “বহিরাগত”!কিন্তু,সেবার রবীন্দ্রনাথ সমাবর্তনে যেতে পারেন নি।তিনি তখন বিশ্বভ্রমণে ছিলেন।তিনি বিনীত ভাবে উপাচার্যকে অক্ষমতার কথা জানিয়েও দেন।পরের বছরের জন্য তিনি আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন।তিনি উপাচার্য শ্যামাপ্রসাদকে লেখেন যে,” যদি তুমি বহিরাগত আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে ঐতিহ্য ভাঙতে চাও,তবে সমাবর্তনের আরেকটি ঐতিহ্যও তোমাকে ভাঙতে হবে।সেটা হল ইংরাজির পরিবর্তে আমাকে বাংলায় ভাষণ দেবার অনুমতি দিতে হবে।”বিশ্ববিদ্যালয় কবির এই মত মেনে নেয়।তিনি পরের বছর সমাবর্তনে বাংলাতেই ভাষণ দেন! এটা ১৯৩৭ সালে দাঁড়িয়ে ছিল অকল্পনীয় !সমাবর্তনের অতিথিদের মধ্যে অনেকেই বাংলা জানতেন না।তবুও শোনার পর তাঁদের অনুভব হয়েছিল যে “কিছু একটা গুরুত্বপূর্ণ” ঘটনা ঘটেছিল!
পরবর্তীকালে মেকলে( Macaulay) তাঁর ‘HISTORY OF ENGLAND‘ বইয়ে লেখেন,” ভারতীয়ত্ব হল রক্তে,রঙে।কিন্তু ইংরেজত্ব হল স্বাদে,মতে,নীতিতে এবং বোধে।”
স্যার জন আন্ডারসন ছিলেন ব্রিটিশ শাসিত বাংলার শক্তিশালী গভর্নর ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য।তিনি সেদিন সমাবর্তনে উপস্থিত ছিলেন।তিনিও শ্যামাপ্রসাদের সাথে সহমত পোষণ করেন।
তখন বাংলায় মুসলিম লীগ নির্ভর প্রাদেশিক সরকার ক্ষমতায়।১৯৩৭ সালের সমাবর্তনে সেদিন মুসলিম পড়ুয়া ও মুসলিম মন্ত্রীরাও উপস্থিত ছিলেন।তাঁরা এই ঘটনার মধ্যে অন্য রঙ খুঁজে পেলেন!লীগ সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়াতে শুরু করল।তাঁরা রবীন্দ্রনাথে পৌত্তলিকতা আবিষ্কার করল! যদিও অনেক মুসলিমই রবি-ভক্ত ছিলেন।
এই “পৌত্তলিক” কবি-গীতিকারের লেখা ও সুরারোপ করা গান পার্শ্ববর্তী মুসলিম দেশ বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত! রবীন্দ্রনাথই একমাত্র কবি-গীতিকার যাঁর গান ভারত ও বাংলাদেশ দুই রাষ্ট্রের জাতীয় সঙ্গীত।আর কেউ নেই রবীন্দ্রনাথের মত।
কাজী নজরুল ইসলামও ছিলেন মুসলমান।অথচ শ্যামাপ্রসাদ তাঁকে ধর্মীয় নিষ্ঠুরতা থেকে অনেকবার রক্ষা করেছেন।তাঁকে দারিদ্র্যের কশাঘাত,অসুখ থেকে বাঁচিয়েছেন।নজরুলকে যোগ্য সম্মান জানিয়েছেন শ্যামাপ্রসাদ।
শ্যামাপ্রসাদ ও রবীন্দ্রনাথের মধ্যে শেষ সাক্ষাৎ হয় ১৯৪০ সালের অগষ্ট মাসে।কবি তখন শান্তিনিকেতনে।অসুস্থ।সেই অবস্থায় শান্তিনিকেতনে গিয়ে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি চাইল কবিকে সাম্মানিক ডি.লিট.প্রদান করবে।এবং বিশেষ সম্মাননা-অনুষ্ঠান আয়োজিত হবে।
রবীন্দ্রনাথ ১৯১৩ সালে নোবেল সম্মানে ভূষিত হন।১৯১৫ সালে ব্রিটিশ সরকার কবিকে “নাইটহুড” খেতাব দিয়ে সম্মান জানায়।কিন্তু ১৯১৯ সালে অমৃতসরের গণহত্যার প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ সে-খেতাব বর্জন করেন।এই ঘটনা অব্যবহিত পরপরই অন্যান্য দেশ কবিকে নিজ নিজ রাষ্ট্রীয় সম্মান জানাতে থাকে।এই পরিসরেই ইংল্যান্ড নিজকৃত পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে চাইল অক্সফোর্ডের মাধ্যমে।কিন্তু অসুস্থ রবীন্দ্রনাথ আবারও অসম্মতি জানালেন।শেষ পর্যন্ত সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণানের অনুরোধে তিনি রাজি হলেন।
এই লৌহদৃঢ়তার পরতে পরতে রবীন্দ্রনাথের স্বাজাত্যবোধ,স্বাভিমান,বৈভবশালী ভারত গঠনের চিন্তন ফল্গু ধারার মতো বয়ে চলত।পল্লী উন্নয়ন,কৃষকের মঙ্গল সাধন,দেশজ শিল্প-চিকিৎসা,জৈবচাষ বিষয়ে তিনি ছিলেন তীব্র উৎসাহী।তৎকালে প্রচলিত নিরস শিক্ষা ব্যবস্থার তিনি ছিলেন ঘোরতর বিরোধি।তিনি চেয়েছিলেন স্বনির্ভর,স্বয়ং সম্পূর্ণ পল্লী উন্নয়ন।কৃষকের উন্নয়ন।কৃষির উন্নতি সাধন।
শিলাইদহে তিনি গেলেন জমিদারি দেখাশুনার কাজে।পৈতৃকসূত্রে তিনি জমিদারের উত্তরাধিকারি ছিলেন ঠিকই।কিন্তু গ্রামে গিয়ে তিনি দরিদ্র মানুষদের অসহায়তা প্রত্যক্ষ করলেন।জমিদারের প্রতি পল্লীবাসীর ভয়ের দিকটিও অনুভব করলেন।প্রকৃতি নির্ভর চাষের কারণে কৃষকরা অনিশ্চয়তায় ভুগতেন প্রতিনিয়ত।খরা-বন্যা-ঘূর্ণি ঝড়ে ফসল নষ্ট হলেই কৃষকের দুর্দশার সীমা পরিসীমা থাকত না।চড়া সুদে মহাজন বা অনুরূপ কোনো সুদখোরের নিকট থেকে তাঁরা ধার নিতে বাধ্য হতেন।যা পরিশোধ করা হয়ত এক পুরুষে সম্ভব হত না।রবীন্দ্রনাথ এই দিকটা লক্ষ্য করে চাষিদের নিয়ে তৈরি করলেন সমবায় ব্যাঙ্ক।এটাই সমবায় ব্যাঙ্কের সূত্রপাত।স্বাধীন ভারতও এই সমবায় ব্যবস্থা চালু করে।কৃষকদের সাথে আন্তরিক ভাবে মিশে মিশে তাঁদেরই একজন হয়ে উঠলেন।জমিদার-প্রজার মানসিক দূরত্ব ঘুচিয়ে দিলেন।
পাশাপাশি তিনি শিক্ষা-স্বাস্থ্য-গ্রামীণ স্বনির্ভর অর্থনীতি নিয়েও চিন্তা করেন।কলেরা-আন্ত্রিকের মত ছোঁয়াচে রোগ বিষয়ে তিনি সচেতনতার প্রসার ঘটান।একই সাথে ইনফ্লুয়েঞ্জা-ম্যালেরিয়া নিরাময়ে তিনি স্বদেশী চিকিৎসাও প্রয়োগ করতেন।এবং সুফলও পেতেন।
গ্রামীণ মায়েদের বিভিন্ন হাতের কাজের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন।যাতে দুর্দিনে-অভাবে-দুঃসময়ে সংসারের হাল ধরতে পারেন মায়েরা।
তিনি গৃহবন্দি-নিরস বিদ্যালয় শিক্ষা পছন্দ করতেন না।তিনি চাইতেন শিশু শিখবে আনন্দের মধ্য দিয়ে।গুরু মহাশয়ের বেতের তলা দিয়ে নয়।শিশু শিখবে প্রকৃতির মধ্যে থেকে।পাখির কূজনের সাথে।বাতাসের শব্দের সাথে।ঝিঁঝিঁর ডাকের ছন্দে।অর্থাৎ শিক্ষা ব্যবস্থা হবে শিশুকেন্দ্রীক।সৌভাগ্য আমাদের যে,স্বাধীনতা লাভের ছয় দশক পরে এসে ভারতে শিশুকেন্দ্রীক শিক্ষা প্রণালি চালু হয়েছে।যে শিক্ষার শিশুর সার্বিক বিকাশ সাধন হবে।তার মধ্যে দেশপ্রেম,স্বাজাত্যবোধ,স্বাভিমান জাগ্রত হবে।রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ কর্তৃক গৃহীত “শিশু সংস্কার” প্রকল্প যা রবীন্দ্রনাথেরই অনুসরণ।এই সবকিছুরই সার্থক প্রয়োগ রবীন্দ্রনাথ ঘটিয়েছিলেন শান্তিনিকেতন-শ্রীনিকেতন এলাকায়।বৈশ্বিক ভাবনায় জারিত তাঁর শিক্ষা-চিন্তনের রূপায়ন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়।
পল্লী উন্নয়ন করতে গিয়ে কবিকে অনেক কুকথা শুনতে হয়েছে।মানসিক আঘাতও সহ্য করতে হয়েছে।অনেকে তাঁকে “শহরের পোষ্যপুত্র” বলেও কটাক্ষ করেছেন।পল্লী বা গ্রাম সম্বন্ধে তাঁর কোনো ধারণাই নেই–একথাও তাঁকে শুনতে হয়েছে নানা সময়ে।
তাঁর সৃষ্ট সাহিত্য-শিল্প গুণমান,মৌলিকতা নিয়েও অনেক কাছের জন রবীন্দ্রনাথকে আহত করেছেন।তাঁর বিরোধিতা করার জন্য বিরুদ্ধ গোষ্ঠিও তৈরি হয়েছিল।রবীন্দ্র-বিদূষণ হয়েছে যথেচ্চ হারে।তবুও তিনি তাঁর স্বাভাবিক ঔপনিষদিক ঔদায্যবশত কাউকে সামান্যতম প্রত্যাঘাত করেন নি কখনো।
তিনি চাক্ষুস করেছেন দুই মহাযুদ্ধ কালে মানুষের মৃত্যুমিছিল।মনুষ্যত্বের অবমাননা।খরা-বন্যা-দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষের হাহাকার।প্রত্যক্ষ করেছেন ম্যালেরিয়া-ইনফ্লুয়েঞ্জা-কলেরা-প্লেগের মহামারী-মড়ক।একজন মনুষ্যত্বের সেবক,দেশপ্রেমিক,মানবতাবাদী ব্যক্তির কাছে এ-সকল আঘাত যে কী ভয়ানক তা আমরা কল্পনাও করতে পারব না।
শুধু এই-ই নয়।একে একে তাঁকে অতি প্রিয়জনদের মৃত্যুও দেখতে হয়েছে।তবুও তিনি ভেঙে পড়েন নি।”আঘাতে আঘাতে” তিনি “সত্যকে” চিনেছেন।সকল বিষ পান করে তিনি নীলকন্ঠ হয়েছেন।কিন্তু মানুষের জন্য তিনি অমৃত বিলিয়ে গেছেন।
সুজিত চক্রবর্তী