মালদহ জেলার ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় স্থান গৌড়, আদিনা ও পাণ্ডুয়া সম্পর্কে প্রায় সকলে অবগত থাকলেও আরেক ঐতিহাসিক স্থান ‘পাতাল চণ্ডী’ আজও আমাদের কাছে অজানা। এই শীতের মরসুমে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনেক পর্যটক যখন বনভোজনের জন্য গৌড়, আদিনা ডিয়ার ফরেস্ট কিংবা অন্যত্র যাওয়ার মনস্থ করেছেন, তখন গৌড়ের গাইড বুকে থাকা গাছপালায় ঘেরা প্রাচীন পাথরের উপরে অবস্থিত পর্যটন স্থান। পাতালচণ্ডীর যাওয়ার কথা একবার ভেবে দেখতে পারেন। নিশ্চিতভাবেই এই পাতালচণ্ডীর ঐতিহাসিক পটভূমি রয়েছে।
প্রাচীন সেন বংশের কুলদেবী ছিলেন মা চণ্ডী। সেন বংশের রাজা তৃতীয় বিগ্রহ পালের পুত্র রাম পাল তৎকালীন রামাবতীতে নিজের রাজধানী নির্মাণ করেন। তাঁর উত্তরসূরি লক্ষ্মণ সেন রামাবতী থেকে দক্ষিণ দিকে নির্মাণ করেন নিজের রাজধানী লক্ষ্মণাবতী। এই লক্ষ্মণাবতীই আজকের গৌড়। লক্ষ্মণাবতীর চারিদিকে তিন চারটি চণ্ডীমন্দির নির্মাণ করেন। দক্ষিণ দিকের এই মন্দিরটির নামই হচ্ছে পাতাল চণ্ডী। এছাড়া পূর্ব দিকে রয়েছে জহুরা চণ্ডী, পশ্চিমে দুয়ারবাসিনী। উত্তরের চণ্ডীমন্দিরটির এখন অস্তিত্ব নেই বলে অধ্যাপিকা সুস্মিতার গবেষণায় জানা যায়। সেন রাজারা এই পবিত্র পাতালচণ্ডী পীঠকেই প্রাচীনকালে গৌড়ের রক্ষাকর্ত্রী হিসেবে মনে করতেন। বিশ শতকের প্রথমার্ধে কার্জনের ভারত ভ্রমণের সময় গৌড়ের যে ম্যাপ তৈরি করেছিলেন তাতে পাটল চণ্ডী বা পাতাল চণ্ডীর উল্লেখ ছিল বলে ঐতিহাসিক ড. তুষার কান্তি ঘোষের বই থেকেও পাওয়া যায়। তাঁর মতে পাটল চণ্ডী আসলে মা দুর্গার আরেক রূপ। মুসলমান শাসনের সময় এই চণ্ডী মন্দিরগুলো ধ্বংস করা হয়েছিল।
গৌড় পুণ্ড্রবর্ধনের অজস্র ভক্ত আজ ধনে সমৃদ্ধ, শিক্ষাদীক্ষায় উন্নত। সেই ভক্তরা আজ এই পীঠটিকে নতুন করে গড়ে তোলার ব্রত নিয়ে এগিয়ে এসেছেন। মালদা থেকে কালিয়চক অভিমুখে ৩৪ নং জাতীয় সড়কের কাটাগড়ের কাছে ইংরেজ আমলের একটি নীলকুঠির ধ্বংসাবশেষ রয়েছে, যেটি এখনও ইংরেজদের নীল চাষিদের উপর অত্যাচারের কাহিনি মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু এই প্রাচীন সৌধটি রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ভগ্নদশায় পরিণত হয়েছে। এই সৌধটি গড়িয়া ইট বা ছোটো ছোটো ইট দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। গৌড় নগরীর উপকণ্ঠে কালাপাহাড়ের গড় রয়েছে। কাটাগড় থেকে এক কিলোমিটার দুরে মাটির রাস্তা দিয়ে আম বাগানের মধ্যে দিয়ে গিয়ে বিশাল জলাশয়ের উপরে পাথর দিয়ে বাঁধানো এই পাতাল চণ্ডী মন্দিরটি পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। এই জলাশয়টি এক সময়ে গঙ্গার সঙ্গে যুক্ত ছিল এবং বড়ো বড়ো নৌকা এখানে নোঙর করা হতো। প্রমাণ স্বরূপ বড়ো বড়ো জাহাজ বাঁধার লোহার শিকল পাথরের মধ্যে আজও গাঁথা রয়েছে। ইংরেজ আমলে এই গঙ্গানদী দিয়েই নীল ও অন্যান্য পণ্য রপ্তানি হতো বলে ঐতিহাসিকের মত। স্থানীয় মহিলারা আজও বাড়িতে বিয়ে, অন্নপ্রাশন ও অন্যান্য মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান শেষে মুকুট ও পূজার দ্রব্য ভাসাতে পাতাল চণ্ডীর বড়ো জলাশয়ে আসেন। এই স্থানটি থেকে কৃষকরা মটি খুঁড়ে বেশকিছু প্রাচীন মূর্তি পেয়েছে যার মধ্যে কষ্টি পাথরের প্রতিহারী মূর্তি রয়েছে। পাতাল চণ্ডী মন্দিরের একাংশে রয়েছে কালী বিগ্রহ ও চণ্ডীমণ্ডপ। মন্দিরটি বিশাল ঝিল বা জলাশয় বেষ্টিত হলেও বর্তমানে গঙ্গার একটি ক্ষীণধারা এখান থেকে এক কিলোমিটার দূরে মধুঘাট নামক স্থান দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। মূল গঙ্গা এখান থেকে ২২ কিলোমিটার দূর দিয়ে বয়ে চলেছে। বিরাট জলাশয়, শান্ত ও নিরিবিলি প্রাকৃতিক পরিবেশ, কানে আসে পাখির ডাক। আশেপাশে কোনো বাড়ি ঘর না থাকায়, কিছুক্ষণ থাকলেই যে কারো মন অনাবিল আনন্দে ও শান্তিতে ভরে উঠবে। দুই কিলোমিটার দূরে অবস্থিত আশেপাশের গ্রাম গোপীনাথপুর, ব্যাসপুর, মধুঘাট ও সুজাপুর থেকে হাজার হাজার মানুষ বাসন্তী পূজা উপলক্ষ্যে চৈত্র মাসে সমবেত হন এই প্রাচীন ও ঐতিহাসিক মন্দিরে। চারদিন ধরে চলে মেলা, বাউল গান ও পূজা। বহু সাধু সন্ন্যাসী ও অতিথির আগমনে গমগম করে স্থানটি। এই ঝিলটিকে বর্তমানে কিছু দুষ্কৃতীরা নিজেদের নামে রেকর্ড করে নেওয়ায় উচ্চ ন্যায়ালয়ের মামলা চলছে। পাতাল চণ্ডী কল্যাণ সমিতি এই ঝিলটিকে তাদের মন্দিরের জায়গা বলে মনে করে এবং নিজেদের দখলে রেখেছে।
এছাড়া প্রতি অমাবস্যায় এবং বৈশাখ মাসের শনি, মঙ্গলবার এখানে ধুমধাম সহকারে চণ্ডী বা কালীপূজা হয়ে থাকে। মালদা শহরের ও আশেপাশের অনেক ভক্ত সেই সময়ে উপস্থিত থাকেন। কাঁচা রাস্তা থাকায় বর্ষাকালে পর্যটকদের এখানে আসতে অসুবিধা হয়। মালদা শহরের ও কাঞ্চনতার, খাসিমারী ও কমলাবাড়ি এলাকার বেশ কয়েকজন প্রকৃতিপ্রেমী ও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ পাতাল চণ্ডী কল্যাণ সমিতি নামক একটি সংস্থা তৈরি করে ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় এই পাতাল চণ্ডীকে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছেন। বিশাল জলাশয়টিকে সংস্কার করে মাছ ধরা, মাছ চাষ ও বোটিংয়ের ব্যবস্থা করার জন্য কেন্দ্রের প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। এখান থেকে খুব সহজেই গৌড় যাওয়া যায়। তার জন্যেই সরকারি ভাবে রাস্তা তৈরি করার তোড়জোড় শুরু করেছে পাতাল চণ্ডী কল্যাণ সমিতি। তাছাড়া কাটাগড় থেকে পাতাল চণ্ডী মন্দির পর্যন্ত কাঁচা রাস্তাটি পাকা করার জন্য প্রশাসন টাকা বরাদ্দ করেছে বলে জানানো হলেও রাস্তার জমি পাওয়া নিয়ে সমস্যা দেখা দিয়েছে। সরকারি ভাবে প্রচারের আলোয় এনে ইতিহাস প্রসিদ্ধ এই স্থানটি পর্যটন মানচিত্রে যাতে খুব সহজেই জায়গা করে নিতে পারে, তার জন্য সবরকমের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। প্রসঙ্গত, এই পাতাল চণ্ডীকে মালদা জেলা হেরিটেজ কমিটি ‘হেরিটেজ সাইট’ হিসেবে ইতিমধ্যেই ঘোষণা করেছে।
কিন্তু সরকারি উদাসীনতায় পাতালচণ্ডী তার গুরুত্ব হারাচ্ছে এবং প্রাচীন উঁচু গড় অবহেলার কারণে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। মালদা শহর থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে এমন একটি মনোরম, দূষণমুক্ত ও শান্ত পরিবেশ একদিকে পর্যটকদের যেমন আকৃষ্ট করতে সক্ষম, তেমনি গোশালা তৈরি করে খাঁটি দুধ ও ঘিয়ের চাহিদা পূরণ করতে ও দরিদ্র ব্যক্তিদের কর্মসংস্থান করতে নির্মাণে পাতাল চণ্ডী এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। পাতালচণ্ডী কল্যাণ সমিতি আজ জল-জঙ্গল- জমি সংরক্ষণ করে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করার মহৎ প্রচেষ্টকে বাস্তবায়ন করতে সকলের সহযোগিতা কামনা করছে।
তরুণ কুমার পণ্ডিত