দেশভাগ এবং বাঙ্গালি বুদ্ধিজীবীর আত্মপ্রতারণা

ইংরেজি হলোকাস্ট শব্দটির সঙ্গে শিক্ষিত বাঙ্গালি সম্যক পরিচিত। মাধ্যমিক-উত্তীর্ণ যে কোনও কিশোরও বলে দেবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলার যে ইহুদি নিধনযজ্ঞ চালিয়েছিলেন তাকে বলা হয় হলোকাস্ট। কিন্তু একটা কথা খুব কম বাঙ্গালিই জানেন, হলোকাস্টের ইতিহাস জার্মান জাতির পক্ষে যতই আত্ম-অবমাননাকর হোক, সেই ইতিহাস অস্বীকার করা বা গোপন করা আজকের জার্মানিতে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অর্থাৎ কোনও জার্মান নাগরিক নাৎসি জার্মানির ইতিহাস অস্বীকার, বিকৃত বা গোপন করলে তার কাজ সে দেশের আইন অনুযায়ী অপরাধ হিসেবে বিবেচনাযোগ্য এবং শাস্তিযোগ্য।
জার্মানি এবং জার্মান জাতির প্রখর ইতিহাস চেতনার সম্পূর্ণ উল্টোদিকে অবস্থান পশ্চিমবঙ্গের সিংহভাগ বাঙ্গালি বুদ্ধিজীবীর। কারণ, ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত দেশভাগের যন্ত্রণাক্লিষ্ট ইতিহাস তারা গোপন করেছেন এবং কালক্রমে বাঙ্গালিকে প্রায় ভুলিয়ে ছেড়েছেন। যার ফলে, ১৯৪৭ এবং ১৯৫০ সালে যারা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে শরণার্থী হয়ে পশ্চিমবঙ্গে এসেছিলেন তাদের বর্তমান প্রজন্ম রাতারাতি ছিন্নমূল হবার যন্ত্রণা অনুভব করতে পারেন না। যেসব শরণার্থী এখনও জীবিত তারা যখন ফেলে আসা দেশে তাদের গোলাভরা ধান, জমিজায়গা, ঘরবাড়ি এবং অত্যন্ত উন্নত এক জীবনযাপনের গল্প বলেন তখন এই ইতিহাসবোধহীন প্রজন্ম উপহাস করে। স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর নেহরুবাদী লেখক-সাহিত্যিক-ঐতিহাসিকরা যে বিকৃত ইতিহাসের জন্ম দিয়েছেন তারই সূত্র ধরে এই প্রজন্ম বিশ্বাস করে, দেশভাগ স্বাধীনতা প্রাপ্তির প্রক্রিয়ায় একটি স্বাভাবিক অঙ্গ। এর মধ্যে যেটুকু অস্বাভাবিকতা আছে। তার জন্য দায়ী শুধু ব্রিটিশরা। ভারতের অঙ্গচ্ছেদ করার জন্য ব্রিটিশ সরকারই হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে। কংগ্রেসের প্রাধান্য খর্ব করার জন্য মুসলিম লিগের প্রতিষ্ঠায় ইন্ধন জোগায়। স্বয়ংসম্পূর্ণ ইতিহাস না থাকার ফলে এই প্রজন্ম জানেই না, ১৯৪৭ এবং ১৯৫০ সালে (তারপর ১৯৬৪, ১৯৯২, ২০০১ এবং ২০০৫ সালে) পূর্ব-পাকিস্তানে হিন্দুদের হত্যা করা হয়েছিল সরকারি তত্ত্বাবধানে। আয়ুব খান মন্ত্রীসভা এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল। নির্বিচারে বাঙ্গালি হিন্দুদের মারার জন্য কাজে লাগানো হয়েছিল পেশোয়ারের বাসিন্দা পশ্চিম পঞ্জাবের পঞ্জাবি মুসলমানদের। স্বল্প পরিসরে হিন্দুহত্যার সেই রক্তাক্ত ইতিহাস লেখা সম্ভব নয়। যারা জানতে চান তারা তথাগত রায়ের ‘যা ছিল আমার দেশ’ এবং প্রফুল্লকুমার চক্রবর্তীর ‘প্রান্তিক মানব’বইদুটি পড়ে নিতে পারেন।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালি বুদ্ধিজীবীদের সিংহভাগ এই মর্মান্তিক ইতিহাস গোপন করলেন কেন? কারণ তারা জানতেন। এইইতিহাস প্রকাশিত হলে গান্ধী-নেহরু এবং কংগ্রেসের কুকীর্তি ফাঁস হয়ে যেত। এবং গান্ধী নেহরু দেশ স্বাধীন করেছে—এই জাতীয় মিথ ধুলোয় মিশে যেত। এই দুই নেতা অচিরেই নায়ক থেকে খলনায়কে পরিণত হতেন। ১৯৪৭-১৯৬৭, এই কুড়ি বছর একচ্ছত্র ক্ষমতাভোগী কংগ্রেসের ভিত আলগা হয়ে যেত অনেক আগেই। এই কারণেই গান্ধীবাদী এবং নেহরুবাদী ঐতিহাসিকেরা দেশভাগের ইতিহাস গোপন করেছেন। পরবর্তীকালে মার্কসবাদী লেখকেরা এই ইতিহাসকে আরও দুর্ভেদ্য এক অন্ধকারে নিক্ষেপ করেছেন।
না, ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালিদের মধ্যে দেশভাগ। নিয়ে যারা লিখেছেন তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য— নীরদ সি চৌধুরী, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, তথাগত রায়, প্রফুল্লকুমার চক্রবর্তী প্রমুখ। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর পূর্ব-পশ্চিম উপন্যাসে লিখেছেন, পূর্ব পাকিস্তানে মুসলিম লিগের শাসনকালে চাকরিক্ষেত্রে মুসলমান যুবকদের অগ্রাধিকার দেওয়া হতো। হিন্দু যুবকেরা তুলনামূলক ভাবে অধিকতর যোগ্য হয়েও চাকরি পেতেন না। আই সি এস অশোক মিত্র দেশভাগ নিয়ে গুরত্বপূর্ণ লেখালেখি করেছেন। কিন্তু ব্যতিক্রম, ব্যতিক্রমই। সে কখনও নিয়ম হতে পারে না। সিংহভাগ বুদ্ধিজীবীর আত্ম-প্রতারণার জন্য এ রাজ্যে দেশভাগ নিয়ে ইতিহাস রচনার আবহ তৈরি হয়নি। যা হয়েছে বাংলাদেশে। সেখানে হাসান আজিজুল হক, সেলিনা হোসেন, তসলিমা নাসরিন প্রমুখ বুদ্ধিজীবী দেশভাগ নিয়ে চর্চা করেছেন। এখনও করছেন। কোনও দেশ বা জাতি তার যন্ত্রণার ইতিহাস ভোলে না। ইজরায়েল, আর্মেনিয়া, স্পেন কেউ ভোলেনি। ভুলেছে তারাই যারা বহিঃশত্রুর আক্রমণে বিধ্বস্ত, পরাধীন। উদাহরণস্বরদপ, ইজিপ্ট, পারস্য মেসোপটেমিয়া এবং গ্রিসের নাম করা যেতে পারে। সুতরাং সেই সংগত প্রশ্নটির মুখোমুখি আমাদের হতেই হবে। আমরা বাঙ্গালিরা স্বাধীন না পরাধীন? জীবিত না মৃত?
সন্দীপ চক্রবর্তী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.