যিনি আত্মহত্যা করেছিলেন তাঁর নাম ডক্টর সুভাষ মুখোপাধ্যায়। জন্ম ১৬ই জানুয়ারি, ১৯৩১, হাজারিবাগে। কলকাতা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ থেকে ১৯৫৫ সালে শারীরবিদ্যা ( Physiology) তে স্নাতক হন। এরপর ১৯৫৮ খ্রীষ্টাব্দে এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই reproductive physiology তে ডক্টরেট এবং ১৯৬৭ খ্রীষ্টাব্দে এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে reproductive endocrinology তে আরও একটি ডক্টরেট ।
Cryobiologist সুনীত মুখার্জী এবং gyneocologist সরোজকান্তি ভট্টাচার্য সহযোগী করে কোনো আধুনিক গবেষণাগার আর যন্ত্রপাতি ছাড়াই ডক্টর সুভাষ মুখোপাধ্যায় জন্ম দিলেন এশিয়ার প্রথম তথা পৃথিবীর দ্বিতীয় টেষ্ট টিউব বেবি দুর্গা ওরফে কানুপ্রিয়া আগরওয়ালের। ১৯৭৮ সালের ৩রা অক্টোবর। পৃথিবীর প্রথম টেষ্ট টিউব বেবি লুইজি ব্রাউনের জন্মের মাত্র ৬৭ দিন পরে।
কি আশা করা যেতে পারত ? আদ্যন্ত দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদে বিশ্বাসী পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থী সরকার ডক্টর সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে সসম্মানে বরন করে নেবে !!
না, বন্ধু না। তেমন কিছুই হল না । তবে কি হল? পাগল ডাক্তার বলে তাকে কেবল অপমানই করা হল না, একঘরে করে দেওয়া হল। এমন একটি যুগান্তকারী আবিষ্কারের জন্য তিনি অসংখ্য আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান মঞ্চ তথা সভায় বক্তব্য রাখার আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন। বাম সরকার তার একটিতে হাজির হতে দেয় নি। বিদেশ ভ্রমণের সমস্ত কার্যক্রম কঠোর হাতে আটকে দেওয়া হয় পুলিশি খাতায় অপরাধী সাজিয়ে ।
১৮ই নভেম্বর, ১৯৭৮। মহানুভব এবং বিজ্ঞানমনস্ক বাম সরকার একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করেন। উদ্দেশ্য ? ডক্টর সুভাষ মুখোপাধ্যায় নামক একজন “convict” (বাংলায়? হ্যাঁ ঠিক বলেছেন আসামী) কে উচিত শিক্ষা দেওয়া। কমিটিতে কে কে ছিলেন? দেখে নেবেন সেই সব দলদাস “বিজ্ঞানী ” “ডাক্তার ” এবং “বুদ্ধিজীবীর” নাম। এই আসামীর বিরুদ্ধে কি কি অভিযোগ ছিল? দেখা যাক —
১) এই পাগলটা বলে কিনা টেস্ট টিউব বেবী বানিয়েছে। সর্বহারার মহান দেশ সর্বশক্তিমান সোভিয়েত ইউনিয়নও পারল না, আমেরিকা , ব্রিটেন , ফ্রান্স, জার্মানি পারল না । আর এই লোকটা কিনা বানিয়ে ফেলল । তাও যদি আমাদের দলের কেউ হত!
২) আলিমুদ্দিন, রাইটার্সকে না জানিয়েই প্রেসে বলে দেওয়া হল ? কী দুঃসাহস! এটা রীতিমত বিধিভঙ্গ ! এটা চলতে দেওয়া যায় না ।
৩) ডাক্তারবাবুর খুব পাখনা গজিয়েছে বুঝি । এত মাথা উঁচু করে চলা কিসের ? এত আস্পর্ধা হয় কি করে ? এই রকম ভাটের বিজ্ঞানী পার্টি অনেক দেখেছে । কত নামী দামী ডাক্তার পার্টিকে তোয়াজ করে জানা আছে ? ওদের ল্যাব দেখেছিস? চোখ ছানাবড়া হয়ে যাবে বুঝলি! ওরা কেউ পারল না আর ইনি পেরে গেলেন ! এবার আমাদের বোঝাও দেখি কেমন করে পারলে !
এই কমিটির শীর্ষে কে ছিল জানেন? এক রেডিও ফিজিসিস্ট। বাকিরা? একজন সাইকোলজিস্ট, একজন নিউরোলজিস্ট, আর একজন ফিজিসিস্ট। বলাই বাহুল্য আধুনিক প্রজনন প্রযুক্তি নিয়ে এদের এক ছটাকও বিদ্যা ছিল না।
পোশাকি নাম দাশগুপ্ত কমিটি । কমিটিতে ছিলেন ডঃ মৃণালকান্তি দাশগুপ্ত ( Radio Physics & Electronic Department , Calcutta University ) , প্রফেসর ডি,এন কুন্ডু ( Director , Saha Institute Of Nuclear Physics ) , ডাক্তার জে,সি, চট্টোপাধ্যায় ও ডাক্তার কৃপা মিনা ( দুজনেই Gynecologist ), প্রফেসর অজিত মাইতি ( Neurophysiologist , Calcutta University ) এবং প্রফেসর অচিন্ত্য মুখোপাধ্যায় ( Head Physiology , Presidency College )
তারপর শুরু হল হেনস্থা আর অপমান! প্রশ্নের পর প্রশ্ন। হাস্যকর, অমানবিক। পার্টি আপিসে যেমন হয়। এক পিস নমুনা শোনা যাক ।
তা, ডাক্তারবাবু আপনি ভ্রুণগুলো কোথায় স্টোর করেন?
কেন এমপুলের ভেতর!
এম্পুল সিল করেন কিভাবে?
হতবাক ডক্টর মুখোপাধ্যায় শুধু একবারই উচ্চারণ করতে পেরেছিলেন — Pardon!
না মানে সিল করার সময় এমব্রায়োগুলো মরে যায় না?
সব তথ্য প্রমাণ বিচার বিবেচনা করে কমিটি বিজ্ঞানমনস্ক রায় দিলেন — এই লোকটি পাগল এবং যা দাবি করছে সব বোগাস!
এর মাত্র ৬৭ দিন আগেই ইংল্যান্ডের ওল্ডহ্যাম জেনারেল হসপিটালেই জন্ম নিয়েছে বিশ্বের প্রথম টেষ্ট টিউব বেবি লুইজি ব্রাউন। না এই বিজ্ঞানমনস্ক বাম নেতৃত্বের কেউই সে খবর রাখতেন না।
অপমানিত , লাঞ্ছিত ডাক্তার মুখোপাধ্যায় ১৯৮১ সালের ১৯ শে জুন শেষমেশ আত্মহত্যা করলেন। স্তব্ধ হয়ে যাওয়া অনন্তের এপার থেকে একজন নারী দেখল একটি সিলিঙ ফ্যান থেকে তাঁর প্রিয়তম স্বামীটির মৃতদেহ মাটি ছোঁওয়ার চেষ্টা করছে।
তারপর কেটে গেল পাঁচটি বছর । ১৯৮৬ সালের ১৬ই অগাস্ট ভারতের দ্বিতীয় টেস্ট টিউব বেবি জন্ম নিল। নাম হর্ষবর্ধন রেড্ডি। কৃতিত্ব ডক্টর টি সি আনন্দকুমারের। দ্বিতীয় নয়, সরকারীভাবে হর্ষই তখন ভারতের প্রথম টেষ্ট টিউব বেবি। সম্মান আর সম্বর্ধনার ঝড় বয়ে গেল। একটার পর একটা সম্মেলনে ছুটে যাচ্ছেন আনন্দকুমার। আমাদের সেই “পাগলা” ডাক্তারটি তখন ঘুমিয়ে। অনন্তের ওপার থেকে তিনি তখনও অপেক্ষা করছেন।
১৯৯৭ সালে এইরকমই একটি বিজ্ঞান সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য ডক্টর আনন্দকুমার কলকাতায় এলেন। “পাগলা” ডাক্তারের স্ত্রী এবং সহযোগী বিজ্ঞানীরা টি সি আনন্দকুমারের হাতে সমস্ত কাগজপত্র তুলে দিলেন। ” পাগলার” কাগজপত্র, গবেষণা লব্ধ জ্ঞান যা তিনি লিপিবদ্ধ করে গেছিলেন- সমস্ত ।
আনন্দকুমার সত্যিই একজন বড় মাপের মানুষ ছিলেন। বিজ্ঞানমনস্ক বাম ছিলেন না। সবকিছু পড়ে বুঝলেন । তৎক্ষণাৎ সেই সময়ের ‘ Prime Minister in waiting ‘ কে নোট পাঠিয়ে দেখা করার সময় চাইলেন । সময় পেলেন । ডক্টর আনন্দকুমার বিরোধী দলনেতা তথা ‘ Prime Minister in waiting ‘ কে অনুরোধ করলেন ব্যাক্তিগত প্রভাব খাটিয়ে যেন তিনি সংসদ এবং Indian Medical Association বিষয়টি জানান । নাহলে বাম সাংসদরা বাঁধা দেবে । সবরকম সহযোগীতা করেছিলেন সেই বিরোধী দলনেতা । এরপর বিশ্বের বিজ্ঞানীদের সামনে ডক্টর আনন্দকুমার নতমস্তকে ঘোষণা করলেন তিনি নন, ডক্টর সুভাষ মুখোপাধ্যায়ই এই কৃতিত্বের দাবিদার। দুর্গা ওরফে কানুপ্রিয়া আগরওয়াল তাঁর ২৫ তম জন্মদিনে মিডিয়ার সামনে এলেন। বাংলা জানল, ভারত জানল, বিশ্ব জানল। সৃষ্টি জানালো তার স্রষ্টার কথা। তখন কোথায় তার স্রষ্টা ।
তাই এই বিশেষ প্রজাতির বামগুলো যখন “বিজ্ঞান “ “বিজ্ঞান” বলে চিৎকার করে তখন হাসি পায় । সেই কমরেডদের অনেকেই এখনও জীবিত। আর একজনও হাসেন। কে বলুন তো? সিমবায়োসিসের এম বি এ এবং মর্গ্যান স্ট্যানলির ভাইস প্রেসিডেন্ট কানুপ্রিয়া ‘ দূর্গা আগরওয়াল ।।
আর সেই বিরোধী দলনেতা তথা Prime Minister In Waiting নাম কিছুটা পরিচিত — অটলবিহারী বাজপেয়ী।