EXCLUSIVE: তৃণমূল জমানায় সরকারি হাসপাতালে নিম্ন মানের ওষুধ সরবরাহ হয়েছে, সন্দেহ সিএজি-র

পশ্চিমবঙ্গের সরকারি হাসপাতালগুলিতে বিনা পয়সায় বা ন্যায্য মূল্যে ওষুধ সরবরাহ করা হয় বলে বারবার দাবি করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই সব ওষুধের গুণমান নিয়ে বড় প্রশ্ন তুলে দিল কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটরস জেনারেলের রিপোর্ট (সিএজি)।

সিএজি-র ওই রিপোর্ট সদ্য বিধানসভায় পেশ হয়েছে। তাতে স্পষ্ট অভিযোগ করা হয়েছে, রাজ্যে যে ড্রাগ কন্ট্রোল অথরিটি রয়েছে, তা একেবারেই অকেজো। ফলে সরকারি হাসপাতালে যে ওষুধ সরবরাহ করা হচ্ছে তা ঠিক মতো পরীক্ষা করা হচ্ছে না। বহু ক্ষেত্রে নিম্ন মানের ওষুধ সরবরাহ করা হচ্ছে বলে সন্দেহ সিএজি-র। এমনকী এ-ও দেখা গিয়েছে, নিম্ন মানের ওষুধ সরবরাহ করার জন্য যে সংস্থাকে চিহ্নিত করা হয়েছিল, তাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া দূরস্থান, তাদের লাইসেন্সও রিনিউ করা হয়েছে।

উদাহরণ দিয়ে রিপোর্টে সিএজি জানিয়েছে, লক্ষ্মী ফার্মাসিউটিক্যালস প্রাইভেট লিমিটেড নামে একটি সংস্থার তৈরি প্যারাসিটামল ৫০ এমজি, ভিটামিট বি কমপ্লেক্স ট্যাবলেট, স্যালবুটামল সালফেট ট্যাবলেট, হ্যালাজোন ট্যাবলেট ইত্যাদি পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছিল তা নিম্ন মানের (নন স্ট্যান্ডার্ড কোয়ালিটি)।

২০১২-১৩ সালে এই অনিয়ম ধরা পড়েছিল। কিন্তু রাজ্যে ড্রাগ কন্ট্রোল কর্তৃপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে শো-কজ নোটিস জারি করা ছাড়া আর কিছুই করেনি। ২০১৫ সালে তাদের একটি ওষুধকে সেন্ট্রাল ড্রাগস ল্যাবরেটরি নিম্ন মানের বলে ঘোষণা করে। তার পর তাদের প্রতিষ্ঠানে হানা দিয়ে দেখা যায় ৮ লাখ সন্দেহজনক ওষুধের মধ্যে ৭ লক্ষ ১৭ হাজারই বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে সরবরাহ করা হয়ে গিয়েছে।

সিএজি রিপোর্টে বলা হয়েছে, এর থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার। তা হল, যে প্রতিষ্ঠানের ওষুধকে নিম্ন মানের বলে চিহ্নিত করা হয়েছে, তাদেরই কাজ চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এমনকী ২০১৫ সালে তাদের লাইসেন্সও রিনিউ হয়েছে, যার মেয়াদ ছিল ২০১৭ সাল পর্যন্ত। এবং এর মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।

সিএজি জানিয়েছে, ২০১২ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে ৩২টি ওষুধকে নিম্ন মানের বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩১টি ওষুধেই যে উপাদান যে পরিমাণে থাকার কথা, তা সেই পরিমাণে নেই। একটি ওষুধে স্টেরয়েড পাওয়া গিয়েছে। ১১টি ওষুধের প্রস্তুতকারক সংস্থার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ২১টি ওষুধের ক্ষেত্রে প্রস্তুতকারক সংস্থার বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি।

সিএজি জানিয়েছে, অডিটে দেখা গিয়েছে জেলা স্তরে ড্রাগ কন্ট্রোল অথরিটিতে যে সংখ্যক ইনস্পেক্টর থাকার কথা, বহু জেলায় তা নেই। রাজ্যের ড্রাগ কন্ট্রোল অ্যান্ড রিসার্চ ল্যাবরেটরির অবস্থা আরও খারাপ।

প্রথম কথা হল, এই স্টেট ল্যাবরেটরিটি ন্যাশনাল অ্যক্রিডেশন বোর্ড ফর টেস্টিং অ্যান্ড ক্যালিব্রেশন অব ল্যাবরেটরিস থেকে স্বীকৃতই নয়। সে জন্য কোনও উদ্যোগও তারা নেয়নি। তাদের পরিকাঠামো ও লোকবলের অভাবও রয়েছে।

যেমন, ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষার জন্য চোদ্দ সালের মার্চ মাসে ২ কোটি টাকা দিয়ে পরীক্ষণ-যন্ত্র কেনা হয়। কিন্তু অপারেটিং সফ্টওয়্যার ও প্রযুক্তিবিদের অভাবে ২০১৭ সাল পর্যন্ত তা কাজেই লাগানো যায়নি। অথচ ওষুধের মধ্যে কোনও ধাতু রয়েছে কি না, রাসায়নিক পরীক্ষার জন্য এই যন্ত্রের ব্যবহার অপরিহার্য।

এখানেই শেষ নয়। সিএজি-র রিপোর্টে আরও ভয়ঙ্কর তথ্য উঠে এসেছে। বলা হয়েছে, ২০১২ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৭ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত ৯৬১৭টি ওষুধের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল। সময়ের মধ্যে পরীক্ষা না করায় ২১৯০টি নমুনা তথা ওষুধ ‘এক্সপায়ার’ করে যায়। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, লোকবলের অভাবেই এমন ঘটনা ঘটেছে।

প্রশ্ন হল, ওই ল্যাবের লোকবল কত?

রিপোর্টে বলা হয়েছে, ল্যাবরেটরিতে সায়েন্টিফিক অ্যাসিসট্যান্ট, ল্যাবরেটরি অ্যাসিসট্যান্ট-সহ মোট ৯৬ জন থাকার কথা। কিন্তু রয়েছেন ৫৬ জন। তার মধ্যে ১৬ জন ঠিকা কর্মী। আরও মারাত্মক হল, ল্যাবরেটরি অ্যাসিস্ট্যান্ট, সিনিয়র সায়েন্টিফিক অফিসার এক জনও নেই।

পর্যবেক্ষকদের মতে, সার্বিক এই ছবিটা শুধু স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর ভয়ঙ্কর অবস্থা জানান দিচ্ছে তা নয়, এও স্পষ্ট যে এ ব্যাপারে সরকার কতটা উদাসীন।

এ ব্যাপারে রাজ্যের স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “আমি জানি না। এ ব্যাপারে কিছু জানি না। কিছু জিজ্ঞাসা করার থাকলে অফিসারদের জিজ্ঞাসা করুন।” মতামত জানতে রাজ্যের স্বাস্থ্য সচিব রাজীব সিনহার সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করা যায়নি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.