জিয়াগঞ্জে খুন হয়েছে একটি পরিবার। পরিবারের কর্তা প্রাথমিক শিক্ষক। তাঁর আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী। তাঁদের পাঁচ বছরের সন্তান। মোট চারজন। প্রত্যেকের গলার নলি কেটে নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে। বিজয়া দশমীর সন্ধ্যেয়।
আততায়ীর খোঁজ করছে পুলিশ। এই ধরনের অস্বাভাবিক নৃশংসতার নানা মোটিভ থাকতে পারে। সব দিকই নিশ্চয় খতিয়ে দেখবে পুলিশ। খুনী একজন হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। এতগুলি খুন একার কাজ নয়। নিখুঁত পরিকল্পনা রয়েছে এর পেছনে। আত্মরক্ষার্থে কিমবা প্রবল বাকবিতণ্ডায় উন্মত্ত ক্রোধের বশে এমনটা ঘটে গেছে- এমন ভাবার কারণ সম্ভবত নেই। সেক্ষেত্রে খুনীদের চরমতম শাস্তি নিশ্চিত করতেই হবে পুলিশ প্রশাসন ও বিচার বিভাগকে।
নিহতদের পরিবারের কেউ বেঁচে নেই। সাক্ষী কেউ নেই। তবুও এই খুনের ন্যায্য বিচার হওয়া জরুরি। নিহতদের প্রতি এই সমাজের এইটুকু অন্তত দায় থেকেই যায়। দায় ভাবুন কিমবা সম্মান। আর যাই হোক আমরা এখনও সমাজবদ্ধ জীব।
পুলিশের ওপর আস্থা রাখতেই হবে। ইতিহাস যাই বলুক, এছাড়া আমাদের আর কোনও উপায় নেই। পুলিশ খুনীদের চিহ্নিত করুক, তাদের হেফাজতে নিক এবং বিচার বিভাগের হাতে তুলে দিক। তদন্ত শেষ হওয়ার আগে কোনও সম্ভাবনার কথা পুলিশ কেন হাওয়ায় ভাসিয়ে দেবে? এতে তদন্ত বিঘ্নিত হয় না কি?
কোনও কোনও মহলে এই মর্মান্তিক ঘৃণার্হ দুঃখজনক ঘটনাটিকে ঘিরে রাজনৈতিক এবং সাম্প্রদায়িক চাপানউতোর শুরু হয়েছে। নিহতের রাজনৈতিক পরিচয় প্রকাশ্যে এসেছে। সেই পরিচয়কে পুঁজি করে রাজনৈতিক খুনের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার তোড়জোড় চলছে। অপরপক্ষ পুলিশের ভাসিয়ে দেওয়া পারিবারিক সম্পত্তি নিয়ে বিবাদের তত্ত্ব আঁকড়ে ধরতে বদ্ধপরিকর।
হতাশার বিষয় এই যে, এদেশে প্রায় প্রতিটি খুনেই নিহতের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক পরিচয় সর্বাধিক গুরুত্ব পেয়ে থাকে। এই পরিচয়ই পরবর্তী গণপ্রতিক্রিয়া, আবেগের গণহিস্টিরিয়ার নির্ণায়ক উদ্দীপক হিসেবে চিহ্নিত হয়। ‘অল অর নান’ থিয়োরি এক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। হয় সুনামি নয় মরুভূমি।
নিহত এবং খুনী এই পরিচয়টুকুই কিন্তু সংবিধানগতভাবে ন্যায্য এবং অভিপ্রেত নয়? নিহত আরএসএস কর্মী না দলিত না মুসলিম – এইগুলি বিচার্য বিষয়ই নয়। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এইগুলিই সবচাইতে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
দিনকয় আগে, আসামে এক নাবালিকা অপহরণ ও আটকের ঘটনায় কয়েকজন মহিলাকে থানায় ধরে নিয়ে গিয়ে বেধড়ক পেটানো হয়। মহিলাদের ওপর থানায় কর্তব্যরত পুলিশ কর্মচারীদের বর্বরোচিত লাঠির ঘায়ের নমুনা সেন্সরড ফোটোর বয়ানে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে, প্রতিবাদে গর্জে ওঠে মানুষ। কেউ কেউ সেই সেন্সরড অংশটুকু তুলে দিয়ে গণআক্রোশে ঘৃতাহুতির চেষ্টা চালান।
থানার পুলিশের হাতে লাঠি থাকে, আমরা বলি রুলবাড়ি। ছিঁচকে চোর থেকে পাড়ার মস্তান, অবরোধের মাঝে পড়ে যাওয়া অফিসফেরতা কারও সাতে পাঁচে না থাকা অসহায় সাধারণ মানুষ, বৃদ্ধ – সকলেরই এই রুলের বাড়ির অভিজ্ঞতা অল্পবিস্তর রয়েছে। পুলিশ ফুলের তোড়া হাতে শৃঙ্খলা রক্ষা করতে পারে না। ঐ মহিলাদের পরিবারের যে ব্যক্তি নাবালিকা অপহরণের জন্য দায়ী ছিলেন, তিনি এই পুলিশি নির্যাতনের খবর পেয়েই অপহৃতাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন। এবং খবরে প্রকাশ এই মহিলারাও ঐ অপহরণ ও আটকের ঘটনায় প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন।
এখানে ফের উল্লেখ করা প্রয়োজন, আক্রান্ত এবং আক্রমণকারীর পরিচয়ে বাড়তি রঙ চড়ানোর কোনও প্রয়োজন নেই। প্রতিটি থানায় এমন পুলিশি রগড়ানির ঘটনা রুটিনমাফিক ঘটে চলে। অপরাধী অপরাধী, অপরাধী মহিলা হলে থানায় বিশেষ খাতির পায় কি? নারকীয় ঘটনাবলীর নজির ভিন্ন কথাই বলে। এই রাজ্যে স্রেফ হেলমেট না পরার অপরাধে বাইক আরোহীকে রাস্তাতেই পিটিয়ে মেরে ফেলেছে সিভিক পুলিশ! ফার্স্ট, সেকেন্ড, থার্ড ডিগ্রির ঘটনা রটনা নয় মোটেই। তবে কেন খবর হল এমন!
যাঁরা এই ঘটনাগুলিকে খবর করেন, ভাইরাল করেন, তাঁরা কি অসাম্প্রদায়িক? যাঁরা প্রতিটি ঘটনাকে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে একটিতে গর্জে ওঠেন, আরেকটিতে বালিতে মুখ গুঁজে সময় গোণেন, তাঁরা কি সাম্প্রদায়িক নন? এই দ্বিচারিতা এবং সুযোগসন্ধানী প্রতিবাদবিলাসিতাই এদেশে মানুষে মানুষে ভেদাভেদের মুখ্য কারণ। এঁরাই সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলিকে উৎসাহিত করছেন। মদত জুগিয়ে চলেছেন জ্ঞাতসারে কিমবা অজ্ঞাতসারে।
এদেশে প্রতিটি রাজনৈতিক সংগঠন প্রবল সাম্প্রদায়িক। অস্বীকার করলেই সত্যিটা মিথ্যে হয়ে যায় না। কারণ আমরা প্রতিটি মানুষই প্রবল সাম্প্রদায়িক। মানুষে মানুষে মিলগুলি নয়, ভেদাভেদগুলিকেই প্রাধান্য দিতে আমরা অভ্যস্ত। এর খেসারত দিয়েই আসছি আমরা, ভবিষ্যতে আরও অধিক মূল্য চোকাতে হবে। অপরাধীর রঙ নয়, অপরাধটুকুকেই গুরুত্ব দেওয়া হোক। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হোক। তাতেই সামাজিক সুরক্ষা বাড়বে, আপামর জনগণ স্বস্তি পাবেন।