পরিবর্তনের পরিবর্তন? দশ বছরের মাথায় বড় বিপর্যয় তৃণমূলের#ELECTIONRESULTS2019

মাত্র তিন বছর আগে বাংলায় একাই দু’শ পার করেছিলেন দিদি। বাংলায় প্রবল গেরুয়া ঝড়ে সেই সাফল্য কোথায় যেন উবে গেল! পরিবর্তনের পর এই প্রথম বাংলায় বড় ধাক্কা খেল তৃণমূল।

এখনও পর্যন্ত যা হিসাব তাতে তাদের দখলে থাকা ১৪ টি আসন হাতছাড়া হতে চলেছে তৃণমূলের। তুলনায় হাতে আসছে এ যাবৎ অধরা মাত্র দুটি আসন। এবং কোথায় আসন (পড়ুন জমি) হারাচ্ছে তৃণমূল? উত্তরবঙ্গ, পাহাড়, গ্রাম, জঙ্গলমহল। একদা যেখান থেকে বাংলায় পরিবর্তনের যাত্রা শুরু করেছিলেন দিদি।

এই ফলাফলে দিদি যে ভারাক্রান্ত, তা বিষ্যুদবার কালীঘাটের ছবিটাই জানান দিয়েছে। গত দুই লোকসভা ভোট ও বিধানসভা ভোটের পর কালীঘাটের ছবিটা এতদিনে খুব চেনা হয়ে গেছিল রাজ্যের মানুষের কাছে। ঢোল, কত্তাল, আবির মায় একাকার…। কিন্তু বিষ্যুদবার কোথায় কী?

অথচ ষোলোর ভোটে সাফল্যের পর এ বার দিদির প্রত্যাশা ছিল আকাশছোঁয়া। সে ব্যাপারে রাখঢাকও ছিল না তাঁর। গত বছর দলের শহীদ সমাবেশের মঞ্চ থেকেই তিনি বলেছিলেন, বাংলায় এ বার ৪২ এ ৪২ চাই। শুধু তা না, দিদি এও বলেছিলেন,-বাংলাই এ বার পথ দেখাবে দিল্লিকে। জাতীয় রাজনীতিতে তাঁর সেই উচ্চাকাঙ্খা আরও প্রকট হয়ে গিয়েছিল, যখন ১৯ জানুয়ারি ব্রিগেডে বিরোধী দলগুলির সমাবেশ ডেকেছিলেন তিনি।

সে দিক থেকে লোকসভা ভোটের ফলাফল তৃণমূলের জন্য ঘোর অস্বস্তির বইকি। কিন্তু কেন এমন হল?

তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের মতে, ভরাডুবির কারণ বহুবিধ। একে তো দেশজুড়ে যে মেরুকরণের আবহ তৈরি হয়েছিল তার আঁচ থেকে বাংলাও মুক্ত থাকেনি। রাজ্যে তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু তোষণের অভিযোগ নতুন নয়। প্রচার মঞ্চে রোজ পাঁচ মিনিট করে মন্ত্রোচ্চারণ করেও সেই ভাবমূর্তি কাটানো যায়নি। তবে দলের উপরের সারির একাধিক নেতার কথায়, বাংলার ভোটে এ বার জাতীয় ইস্যুতে ভোট হয়নি। ভোট হয়েছে স্থানীয় বিষয়ে। নিচুতলায় তৃণমূলের একাংশ নেতার আচরণ, ঔদ্ধত্য, দুর্নীতি ও জুলুমে মানুষ অতীষ্ঠ। এবং সেই প্রতিষ্ঠান বিরোধী ভোটের বারো আনা গিয়েছে বিজেপি-র দিকে।

দলের এক শীর্ষ নেতার কথায়, বাংলায় ষোলোর ভোট থেকেই প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়া জোরালো ছিল। কিন্তু বিরোধী ভোটের ভাগাভাগির ফলে সুবিধা পেয়ে যাচ্ছিল তৃণমূল। কিন্তু এ বার সেই রক্ষাকবচটাও দুর্বল হয়ে গেল। তৃণমূলকে যাঁরা পর্যুদস্ত করতে চেয়েছেন, তা তাঁরা বাম সমর্থক হোন বা কংগ্রেসের, এককাট্টা হয়ে ভরিয়ে দিয়েছেন বিজেপি-র ব্যালট বাক্স।

ভোট শতাংশের হিসাবই বলছে, বামেদের একটা বড় ভোট চলে গেছে গেরুয়ায়। একই ভাবে কংগ্রেস ভোটেও ধস নেমেছে। হিসাব মতো ষোলোর ভোটের তুলনায় প্রায় কুড়ি শতাংশ ভোট কমেছে বামেদের। একই ভাবে কংগ্রেসের ভোটও তিন বছর আগের তুলনায় ৬ শতাংশ কমেছে। ভোট বিশেষজ্ঞদের মতে, বাম কংগ্রেসের এই ২৬ শতাংশ ভোটের সিংহভাগ হিন্দু ভোট গেছে বিজেপি-র দিকে। আর সংখ্যালঘু ভোট গিয়েছে তৃণমূলে। তা ছাড়া একদা তৃণমূলের কিছু সমর্থক বা ভোটারও শাসক দলের উপর কিছুটা অসন্তুষ্ট হয়ে ছাপ দিয়েছেন পদ্মফুলে।

তবে ময়নাতদন্তে নেমে আরও দুটি কারণকে পরাজয়ের জন্য দায়ী করছেন তৃণমূল নেতৃত্ব। এক, পঞ্চায়েত ভোট। ৩৪ শতাংশ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তৃণমূলের জিতে যাওয়া। দলের নেতারাই বুঝতে পারছেন, পঞ্চায়েত ভোটে যাঁরা ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেননি, তাঁদের ভোট এ বার তৃণমূলের বিরুদ্ধেই পড়ছে। সর্বোপরি পারস্পরিক রেষারেষি ও কোন্দলের জেরে কোথাও কোথাও অন্তর্ঘাত হয়েছে বলেও দলের শীর্ষ নেতৃত্বের আশঙ্কা।

এখন প্রশ্ন হল, কী বলা যাবে একে? বাংলায় ফের পালাবদলের ইঙ্গিত?

তৃণমূলের অনেকের মতে, লোকসভা ভোটে যা সম্ভব হল বিজেপি-র পক্ষে তা বিধানসভায় সম্ভব হবে না। পুলওয়ামা, বালাকোটে প্রত্যাঘাতের ঘটনাকে সামনে রেখে যে মেরুকরণের খেলা খেলেছেন মোদী বা রাজ্যের ভোটে সম্ভব নয়। তা ছাড়া রাজ্যস্তরে বিজেপি-র সংগঠনও পোক্ত নয়।

তবে পর্যবেক্ষকরা সেই সম্ভাবনার কথা উড়িয়ে দিচ্ছেন না। তাঁদের মতে, তৃণমূলের সামনে এখন বড় চ্যালেঞ্জ হবে দলের ভাঙন ঠেকিয়ে রাখা। কারণ, ধরে নেওয়া যেতে পারে বাংলায় রক্তের স্বাদ পেয়ে আরও আগ্রাসী হবে বিজেপি। তৃণমূলে তারা ভাঙন ধরানোর চেষ্টাও করবে। উপরের তলায় তো বটেই, নিচুতলায় সেই ভাঙন ঠেকাতে না পারলে বিপদ হতে পারে একুশে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.