পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুসলমান প্রীতির কথা এপার বাঙ্গলা, ওপার বাঙ্গলা—দু’পারেই সুবিদিত। এমনকী বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশি নাগরিক (বৈধ অথবা অবৈধ)-দের নিয়েও তার সমব্যথী মানসিকতার কথাও কারও অজানা নয়। এজন্য রাজ্যের বিরোধী দলনেতা-নেত্রীরা তাঁকে ‘বেগম’ বলে ঠাট্টা করতেও ছাড়েন না। দুর্মুখরা আরও এক পা এগিয়ে বলেন, তিনি নাকি দীর্ঘদিন ধরেই ফন্দি আঁটছেন, এপার বাংলা আর ওপার বাংলার মিলন ঘটিয়ে একটি পৃথক দেশ গঠনের যে দেশের প্রধান হবেন তিনিই। তাঁর দল এবং সরকার ব্যবহৃত ‘বিশ্ববাংলা’ লোগোটি নাকি সেই ভবিষ্যতের অখণ্ড বাঙ্গলা দেশেরই প্রতীক। আর এসব নিয়েই বাজার গরম করতে মেতে রয়েছেন কিছু অতি উৎসাহী অকালপক্ক বঙ্গসন্তান, যাঁরা বাঙ্গলা ভাষা এবং বাঙ্গলাকে বাঁচাতে ‘দিদির ওই দুঃস্বপ্ন সমান স্বপ্নটিকে বাস্তবায়িত করতে উঠে পড়ে লেগেছেন। সোশ্যাল মিডিয়াতে তার ছাপ স্পষ্ট। অভিযোগ, অনুমান কিংবা অনুভব যেমনই হোক না কেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে হাজার সমালোচনাতেও পিছু হঠবার পাত্রী নন, তা এবার হাতে নাতে প্রমাণ হয়ে গেল যখন দেখা গেল, শুধু বলিউড বা টলিউডের তারকাদের ভোটযুদ্ধে নামিয়েই তিনি সন্তুষ্ট নন, একেবারে খোদ বাংলাদেশ থেকে ডেকে এনেছেন তার মুসলমানি ভাই ফিরদৌস আহমেদ আর গাজি নূরকে। না ভোটে প্রার্থী করেননি ঠিকই, কিন্তু ওই দুই বাংলাদেশি অভিনেতাকে খুল্লামখুল্লা নামিয়ে দিয়েছেন এ রাজ্যের ভোটের প্রচারে এবং তা দেশের সমস্ত প্রচলিত এবং সাংবিধানিক আইনকানুনকে রীতিমতো বুড়ো আঙুল দেখিয়েই।
ফিরদৌসকে তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে এরাজ্যে আনা হয়েছিল রায়গঞ্জে তৃণমূল প্রার্থী কানহাইয়ালাল আগরওয়ালের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারের উদ্দেশে। ফিরদৌসকে আনার কারণ ছিল মূলত দুটি। প্রথমত, বাঙ্গলা সিনেমার দৌলতে ফিরদৌস এ রাজ্যে একজন জনপ্রিয় নায়ক চরিত্র। অঞ্জন চৌধুরীর পৃথিবী আমারে চায় কিংবা বাসু চ্যাটার্জির ‘হঠাৎ বৃষ্টি’, ‘চুপিচুপি’, ‘টক ঝাল মিস্টি’, অতি সাম্প্রতিক ছায়াছবি ‘খোকাবাবু’ সহ বাঙ্গলা সিনেমায় তিনি বাঙ্গালি দর্শকের মনোরঞ্জন করেছেন। নির্বাচনী প্রচারে তাকে আনার খরচও তেমন কিছু আহামরি নয়। দ্বিতীয়ত, যেহেতু ফিরদৌস সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত, তাই মুসলমান প্রধান রায়গঞ্জ-সহ কয়েকটি নির্বাচনী আসনে তাঁকে দিয়ে প্রচারের পরিকল্পনা ছিল তৃণমূল কংগ্রেসের। রায়গঞ্জ ছিল মূল লক্ষ্য কারণ রায়গঞ্জে হিন্দু মুসলমান ভোট ৫০ : ৫০ হলেও এবারে ওই কেন্দ্রে হাওয়া পুরোপুরি বিজেপির পক্ষে। এমনকী সংখ্যালঘু ভোটেরও একটা বড়ো অংশ আসবে বিজেপিতেই, শোনা যাচ্ছে এমনটাই। তার ওপর আছেন সিপিএমের বামপন্থী মুসলমান প্রার্থী মহম্মদ সেলিম এবং কংগ্রেস প্রার্থী, রায়গঞ্জের প্রিয় বউমা দীপা দাসমুন্সী। এরা থাবা বসিয়েই বসে আছেন সংখ্যালঘু ভোটে। তৃণমূলের কর্মীরা মুখ কালো করে ঘুরছেন। ভেবেছিলেন ফিরদৌসকে ঘুরিয়েই আলোয় ভরবেন রায়গঞ্জ। তারপরের গন্তব্য ছিল বসিরহাট যেখানে মুসলমান তারকা নুসরত জাহানকে প্রার্থী করেছেন ‘দিদি।
নির্বাচন কমিশন সে আশায় জল ঢেলে দিয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক জানিয়েছে, আইনত ভারতবর্ষের ভিসা প্রদান বিধিতে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা আছে—“A foreigner can’t come to India and campaign for a political party।” স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক স্পষ্টতই জানিয়েছে ফিরদৌস কলকাতায় পা রেখেছিলেন বিজনেস ভিসা নিয়ে। অর্থাৎ তিনি অভিনয়ের শুটিংয়ের অজুহাত দেখিয়ে ভিসা নিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছিলেন। তার পর তিনি সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে নির্বাচনী প্রচারে অংশ নেন। তাকে প্রচার করতে দেখা যায় হেমতাবাদ, বাঙালবাড়ি, নওদা, বিষ্ণুপুর, খাড়াইকুড়া ও চইনগর অঞ্চলে। অতএব তৎক্ষণাৎ তার ভিসা বাজেয়াপ্ত করা হয়, তাকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয় এবং কলকাতার ফরেন রিজিওনাল রেজিস্ট্রেশন অফিস (এফআরআরও) ও বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনারের অফিসের নির্দেশ ফিরদৌসকে ভারত ছেড়ে চলে যাবার নির্দেশ দেওয়া হয়। ওই দিন (১৬ এপ্রিল ২০১৯) ফিরদৌস বাংলাদেশে ফিরে যেতে বাধ্য হন। তার ভিসার মেয়াদ ছিল ২০২২ সাল পর্যন্ত।
এখানেই শেষ নয়, এর পরেই খবর আসে, কলকাতার জি টিভিতে অনুষ্ঠিত সিরিয়াল ‘রানি রাসমণি’র রাজা রাজচন্দ্র চরিত্রাভিনেতা বাংলাদেশের বাগেরহাট নিবাসী গাজি আবদুল নূর দমদম লোকসভা কেন্দ্রের তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী অধ্যাপক সৌগত রায়ের পক্ষে নির্বাচনী প্রচার করছেন এবং তৃণমূল নেতা ও সারদা চিটফান্ড কাণ্ডে অভিযুক্ত প্রাক্তন মন্ত্রী মদন মিত্রের গাড়িতে করে তিনি বিভিন্ন জায়গায় প্রচার করছেন। তার ছবি-সহ অভিযোগপত্র নির্বাচন কমিশন জমা দেওয়া হয়। তাকেও বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হবে বলেই জানা গেছে। কিন্তু এক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খবরটি হলো, গাজি আবদুল নূর সাংবাদিকদের কাছে কবুল করে নিয়েছেন, তাকে নির্বাচনী প্রচারের কথা না জানিয়েই গাড়িতে তোলা হয়েছিল। মদন মিত্র তাকে নিয়ে কোথায় চলেছেন, তা তার জানাও ছিল না। এ তো মারাত্মক অভিযোগ!
জাতীয় নাগরিক পঞ্জিকরণ নিয়ে গোটা দেশের রাজনীতিই যখন সরগরম তখন স্বাভাবিকভাবেই ফিরদৌস এবং গাজি নূরকে ঘিরে বাঙ্গলার রাজনীতিও বেশ উত্তপ্ত। খুব স্বাভাবিকভাবেই বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতা কৈলাস বিজয়বর্গীয় দাবি তুলেছেন, “এতকাল বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীরা চোরাপথে ভারতে ঢুকত। এখন তৃণমূল সরাসরি তাদের ভারতে ঢুকিয়ে নিচ্ছে। বাংলাদেশের নাগরিকদের নিয়ে তৃণমূল নির্বাচনী প্রচার চালাচ্ছে। ভারতের নিরাপত্তার প্রশ্নে এটি একটি অশনিসংকেত। রাজ্যের বিজেপি নেতা রাহুল সিংহও দাবি করেছেন, “ফিরদৌস এবং গাজি নূরের আইনভঙ্গের ঘটনায় দেশের সার্বভৌমত্ব ক্ষুন্ন হয়েছে। ভিসার শর্ত ভঙ্গ করার জন্য এনআইএ তদন্ত করক। সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে কোনও আপোশ করা যায়। না।”বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষও খুব পরিষ্কার ভাবেই বলতে বাধ্য হয়েছেন, “এভাবে ভারতে একটি রাজনৈতিক দলের প্রচারে বিদেশি তারকা আসতে পারেন? তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আইন মানেন না। ভোটার কম পড়লে তিনি রোহিঙ্গাদেরও ডেকে আনতে কসুর করবেন ।”
কিন্তু দিদি মুখে কুলুপ এঁটেছেন। যা বলছেন সব তার আর এক মুসলমান ভাই ফিরহাদ হাকিম। তার বক্তব্য, “অকারণে জল ঘোলা করছে বিজেপি। কে কার হয়ে প্রচার করছে, তা নিয়ে কারও কিছু আসে যায় না।”
প্রশ্ন হলো, যদি আসে যায়ই না, তাহলে ফিরদৌসকে ডেকে আনা হলো কেন? কেন গাজি নূরকে কিছুই না জানিয়ে ‘কিডন্যাপ’ করে এনে প্রচারে নামিয়ে দেওয়া হলো ? কীসের স্বার্থে? কার স্বার্থে? আপাতদৃষ্টিতে ব্যাপারটা সহজ সরল মনে হলেও, বিষয়টাকে অত সরলীকৃত করে দেখা সম্ভব নয়। কে বলতে পারে, বিজনেস ভিসা নিয়ে দুবৃত্তরা এরাজ্যের নির্বাচনে অংশ নেবে না ? কে বলতে পারে, ইতিমধ্যে আইনি এবং বেআইনি পথে কত অনুপ্রবেশকারী ঢুকে গেছে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে, যারা এসেছেন তৃণমূলের হয়ে ভোট লুট করতে, বোমা ছুড়তে, গুলি করতে ? তৃণমূল এবার নির্বাচনের অনেক আগেই আঁচ পেয়েছিল যে এরাজ্যের মুসলমান ভোটররা তাদের রাজনৈতিক অবস্থান বদলাচ্ছেন। তারা বুঝেছেন, মুসলমান হিসেবে নয়, তাঁদের ভারতে থাকতে হলে ভারতীয় হতে হবে। সাম্প্রদায়িক মনোভাব ত্যাগ করে ভারতীয় জাতীয়তাবোধ উদ্বুদ্ধ হতে হবে। তারা এটাও মেনে নিয়েছেন, ভারতের অর্থনীতি ও সমাজনীতির স্বার্থে জাতীয় নাগরিক – পঞ্জিকরণের কাজ হওয়া উচিত। তাতে তাদের সায় আছে ভারতীয় হিসেবেই। তৃণমূল কংগ্রেস বা কংগ্রেস এ দেশীয় মুসলমানদের নিজ স্বার্থে ব্যবহারের জন্য বিদেশি মুসলমানদের বেআইনি ভাবে প্রশ্রয় দিচ্ছে। এবার এই ভয়ানক খেলা বন্ধ হওয়া দরকার।
আর তাই, দেশীয় মুসলমান জনগোষ্ঠীর ওপর ভরসা না করে তৃণমূল কংগ্রেস এখন বাংলাদেশি নাগরিকদের আমন্ত্রণ করে ডেকে আনছে। কারণ দলনেত্রী এখনও ঘুমঘোরে— স্বপ্ন দেখছেন, অখণ্ড বাংলা বিশ্ববাংলা’ গড়ে উঠেছে। তিনিই রাষ্ট্রপ্রধান। বিশ্বের নবীনতম রাষ্ট্রের প্রথম রাষ্ট্রনায়িকা। তার জন্য আইন ভাঙতে হয় ভাঙবেন।
ভাঙছেনই তো! প্রতিনিয়তই। তিনি যদি ভারতীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাসী হতেন, তিনি যদি ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় বিশ্বাসী হতেন, যদি তিনি সত্যিই ভারতীয় হতেন এবং ভারতীয় জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ হতেন, তাহলে প্রধানমন্ত্রীকে সম্মান জানাতেন। আয়ুষ্মন ভারত প্রকল্পকে অসম্মান করতেন।
। কেন্দ্রীয় পুলিশ বাহিনী, সেনাবাহিনী, সিবিআই অফিসারদের সম্মান জানাতেন, রাজ্য পুলিশ আর কেন্দ্রের পুলিশের মধ্যে ধ্বস্তাধস্তি, হাতাহাতি হতে দিতেন না। কেন্দ্রীয় প্রকল্পগুলিকে নিজের দেওয়া নামে চালাতেন না। সবচেয়ে বড়ো কথা— তাঁর বাড়িতে একজন বিদেশিনীকে ভাইপো-বউ হিসেবে বসিয়ে রাখতেন না যিনি ক্ষেত্রবিশেষে নিজের পিতৃপরিচয় পাল্টাতেও দ্বিধা করেন না।
ফিরদৌস ও গাজি আবদুল নূরের ঘটনা পর্বতশিখরে তুষারবিন্দুর মতোই। কেন্দ্রের নজর এড়িয়ে এমন আরও কত বেআইনি অনুপ্রবেশকারী এ রাজ্যের আনাচে কানাচে বাসা বেঁধেছে, এখনই তার তদন্ত হওয়া দরকার। এটা প্রয়োজন দেশের ও দশের নিরাপত্তার স্বার্থে, স্বাধীন ও সর্বসম্মত নির্বাচনের স্বার্থে এবং সর্বোপরি শৃঙ্খলমুক্ত ভারতমাতার সম্মানে।
সুজাত রায়
2019-04-26