রবীন্দ্রনাথ (Rabindranath) ও স্বদেশ প্রেম যেন সমার্থক শব্দ। অনুরূপভাবে স্বয়ংসেবক এবং দেশপ্রেম যেন সমার্থক শব্দ। বাংলায় রবীন্দ্র জয়ন্তী ঘরে ঘরের উৎসব । প্রতিটি পরিবারই রবীন্দ্রনাথের কবিতা ,গল্প, সংগীত নিয়ে মাতোয়ারা। বর্তমান সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘরের বাচ্চাদের রবীন্দ্র সংগীত পরিবেশন বা কবিতা পরিবেশন, পাড়ার মোড়ে মোড়ে রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন ,বাংলার সমাজ জীবনের অঙ্গ হয়ে উঠেছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদ, দেশ প্রেম, স্বদেশী জাগরণে ধারণা বা কংগ্রেসের দ্বিচারিতা সম্পর্কে তার মনোভাব নিয়ে কোন পারিবারিক বা পাড়াতুতো আলোচনা হতে দেখা যায় না। কেনই আলোচনা হয় না, কাদের ষড়যন্ত্রের রবীন্দ্রনাথের (Rabindranath) স্বদেশপ্রেমের ধারণাগুলি সাধারণ মানুষের রবীন্দ্রচর্চা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। কংগ্রেস ও বামপন্থীরা দীর্ঘদিন ধরেই রবীন্দ্রনাথকে কবিতা, গান এবং আবৃত্তিকার হিসাবেই দেশ তথা বাংলার মানুষের মনে প্রোথিত করা ষড়যন্ত্র চালিয়ে গেছে। কিন্তু আমাদের প্রয়াস হওয়া উচিত রবীন্দ্রনাথের দেশপ্রেমের ভাবনা, স্বদেশী জাগরণের ধারণা সমগ্র সমাজের মধ্যে পৌঁছে দেওয়া। আমরা চাই রবীন্দ্রনাথের নামের পূর্বে দেশ-প্রেমিক শব্দটি যুক্ত হোক। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন পাশ্চাত্য সমাজ এবং ভারতীয় সমাজের চরিত্র একেবারেই পৃথক। পাশ্চাত্যে রাষ্ট্র সমাজ কে নিয়ন্ত্রণ করে, সমাজ গঠনে রাষ্ট্রের ভূমিকা অগ্রগণ্য। কিন্তু ভারতীয় সভ্যতা সমাজ কেন্দ্রিক, সমাজ যা চিন্তা করে সমাজ যা ভাবে রাষ্ট্র চরিত্র তেমনভাবেই প্রতিফলিত হয়। সমাজই রাষ্ট্রকে পরিচালিত করে। সেই কারণেই ভারতবর্ষে এতবার বিধর্মী আক্রমণ হওয়া সত্বেও ভারতবর্ষের রাষ্ট্রীয় চরিত্রের পরিবর্তন সম্ভব হয়নি। সনাতন ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতি রাষ্ট্রীয় চরিত্রকে সর্বদা পরিচালিত করেছে। সংঘ অনুরূপভাবে এই ধারণার উপর পরিচালিত হয় যে ভারতবর্ষের শক্তির আধার হল ভারতীয় সমাজ বা হিন্দু সমাজ। সমাজ শক্তিশালী হলে রাষ্ট্র শক্তিশালী হবে। ভারতবাসীর মূল দায়িত্ব হল সনাতন ভারতীয় সভ্যতা এবং সংস্কৃতির মন্থন করে তার উপর ভিত্তি করে বর্তমান সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা পরিচালিত করা এবং ভবিষ্যৎ ভারত গঠন। বিশ্ব গুরু হিসেবে ভারতবর্ষকে প্রতিষ্ঠা করা। রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন পাশ্চাত্য রাষ্ট্রগুলির একটা লক্ষ্য আছে, সেই লক্ষ্য হলো সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্রসার। তেমনি ভারতবর্ষেরও একটি লক্ষ্য আছে ,সেই লক্ষ্য হলো সমগ্র বিশ্বকে নৈতিক শিক্ষার পাঠ পড়ানো। বিশ্ব যখনই সংকটে পড়েছে ভারত বর্ষ তার নৈতিক বল বৃদ্ধির অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। বর্তমানকালে সমগ্র পৃথিবী কোরোনা সংকটে ভুগছে তখন ভারতবর্ষ হাইড্রোক্লোরোকুইন নামক সঞ্জীবনী পাশ্চাত্য দেশগুলিকে প্রদান করে চলেছে।
সংঘ চিন্তায় দেশকে মাতৃরূপে বন্দনা করা হয়। অনুরূপভাবে রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং দেশকে মাতৃরূপে বন্দনা করতেন তার একাধিক প্রমাণ পাওয়া যায়। যেমন 1886 সালে কলকাতার জাতীয় কংগ্রেসের দ্বিতীয় অধিবেশনে রবীন্দ্রনাথ স্বরচিত ”আমরা মিলেছি আজ মায়ের ডাকে গানটি গেয়ে শোনান ”। 1896 সালের কলকাতা কংগ্রেসে তিনি বন্দে মাতারাম গানটি নিজের সংযোজিত সুরে গেয়ে শোনান। তখন থেকে তার দেওয়া সুরে গানটি গাওয়া হয়ে আসছে। 1904 সালে কলকাতায় শিবাজী উৎসব একটি স্মরণীয় ঘটনা। উৎসবের প্রধান অঙ্গ ছিল শক্তিরূপিণী ভবানীর পূজা। মুঘল আধিপত্য থেকে দেশকে স্বাধীন করার জন্য যে ব্রত শিবাজী গ্রহণ করেছিলেন সেই আদর্শের পুনরুজ্জীবন ছিল উৎসবের লক্ষ্য। সেই উপলক্ষে আয়োজিত একটি সভায় রবীন্দ্রনাথ তার ”শিবাজী উৎসব” প্রবন্ধটি পাঠ করেন। সুতরাং দেশকে মাতৃরূপে বন্দনা বা শিবাজীর মত মহান আদর্শকে অনুসরণ করা রবীন্দ্র চিন্তায় যেমন প্রতিফলিত হয় তেমনি রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের বিচারধারারও মূলভিত্তি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অখন্ড ভারতবর্ষের সমর্থক ছিলেন সেই কারণেই বঙ্গভঙ্গের তীব্র বিরোধিতা করে 1905 সালে 16 ই অক্টোবর বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী সহযোগিতায় রাখি বন্ধন উৎসব আয়োজন করেন এবং ফেডারেশন হল (মিলন মন্দির) গ্রাউন্ডে আনন্দমোহন বসুর সভাপতিত্বে এক জনসভায় কবি প্রতিজ্ঞা পত্র পাঠ করেন। সেইদিন বাগবাজারের পশুপতি বোসুর গৃহপ্রাঙ্গণে এক বিশাল জনসমাবেশ রবীন্দ্রনাথের আবেগময় ভাষণের ফলে জাতীয় ভান্ডারে 50 হাজার টাকা সংগৃহীত হয়েছিল। এই সময় স্বদেশী শিল্প বাণিজ্যের প্রসার কল্পে রবীন্দ্রনাথের সম্পাদনায়” ভান্ডার” নামে একটি পত্রিকা প্রকাশনা শুরু হয়। স্বদেশী আন্দোলনের সময় বক্তিতা, গান ,প্রবন্ধ রচনা মধ্যে দিয়ে জনচেতনা সৃষ্টির সঙ্গেই তিনি জাতীয় শিক্ষার প্রবর্তনে সক্রিয় হন। বিশেষ করে যখন বঙ্গভঙ্গের সপ্তাহ খানেক পর বাংলা সরকারের চিফ সেক্রেটারি কার্লাইল স্কুল কলেজের অধ্যক্ষ দের কাছে ছাত্রদের স্বদেশী আন্দোলনে যোগদান নিষিদ্ধ করেন। রবীন্দ্রনাথ সেই সময়ে জাতীয় বিদ্যালয় স্থাপনের জন্য দেশবাসীকে উদাত্ত আহ্বান জানান। মনে রাখা দরকার স্বদেশী আন্দোলনের সময় হিন্দু ধর্মের সঙ্গে জাতীয় আন্দোলন অচ্ছেদ্য ভাবে যুক্ত হয়ে পড়েছিল।বঙ্কিমচন্দ্র, অরবিন্দ প্রমূখ রাষ্ট্রদর্শনের মত রবীন্দ্রনাথ মাতৃত্বের ব্যঞ্জনায় দেশের উপর পরমত্ব আরোপ করেছিলেন। পরিশেষে বলা যায় আধ্যাত্মিক সামাজিক ও স্বদেশিক চিন্তায় প্রত্যক্ষভাবে পিতার ও পারিবারিক পরিবেশের প্রভাবে তার মন গোড়ে ওঠে। কৈশোরে অগ্রজদের সঙ্গে হিন্দু মেলায় যেতেন। 14 বছর বয়সে লেখা কবিতা “হিন্দুমেলার উপহার“হিন্দু মেলায় ( ১৮৭৫) পঠিত। এই আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে বামপন্থীরা ও কংগ্রেস রবীন্দ্রনাথকে দীর্ঘদিন ধরে হিন্দু ও সংঘ বিরোধী ঘরানায় প্রতিষ্ঠিত করার যে চেষ্টা করেছেন তা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। দেশ মাতৃকার প্রতি প্রেমই হল সংঘ ও রবীন্দ্রনাথের চিন্তার মিলন সেতু।
উত্তম অধিকারী (Uttam Adhikary)