রাষ্ট্রবিজ্ঞান বলে সংবাদমাধ্যম হলো গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ। আর নির্বাচন হলো গণতন্ত্রের শ্রেষ্ঠ ভিত্তি। সুতরাং নির্বাচন কালে সংবাদমাধ্যমের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকবেই। কিন্তু তারা কী ভুমিকা পালন করছে বিশেষত এই পশ্চিমবঙ্গে তা মানুষ খুব ভালোভাবেই দেখতে পাচ্ছেন। বেশ কয়েক বছর আগে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের সরকার্যবাহ সুরেশ যোশী স্বস্তিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গের সংবাদমাধ্যম বামপন্থী নীতি-ভিত্তিক, সংবাদমাধ্যমের পক্ষে এই প্রবণতা গণতন্ত্রের পক্ষে ভালো নয়। কথাটা যে কতটা খাঁটি বর্তমান সময়ে তা টের পাওয়া যাচ্ছে।
পৃথিবীর সমস্ত সভ্য গণতান্ত্রিক দেশে রাজনীতির দুটি অভিমুখ থাকে। একদিকে থাকেন জাতীয়তাবাদীরা, অন্যদিকে আন্তর্জাতিকতাবাদীরা। ব্রিটেনে রয়েছে কনজারভেটিভ ও লেবার পার্টি। অমেরিকায় রিপাবলিকান-ডেমোক্র্যাট। এদের বাইরেও আঞ্চলিক কিংবা জাতীয় সত্তা নিয়ে আরও কিছু দল রয়েছে। কিন্তু একটা ব্যাপারে সমস্ত দল এককাট্টা হয়ে যায়, তা হলো দেশের স্বার্থ রক্ষা। দেশের স্বার্থে আঘাত পড়লে কোনও সংবাদমাধ্যম চুপ করে বসে থাকে না। তারা জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক কোন মতাদর্শে বিশ্বাসী, সেটা তখন গৌণ হয়ে যায়। ভিন্ন মতাদর্শের সরকারের পাশে দাঁড়াতেও তারা দ্বিধা করে না।
সংবাদমাধ্যম কেন বিশেষ কোনও মতাদর্শের দ্বারা পরিচালিত হবে, অন্তত গণতন্ত্রের পক্ষে এই লক্ষণ যে তেমন সুখকর নয় একথা বলাই বাহুল্য। কিন্তু উদারনৈতিক ভাবনায় এই চিন্তা ক্ষতিকর নয় যে সংবাদমাধ্যম রাজনৈতিক মতাদর্শের বহির্ভূত থাকবে। ভারতের ক্ষেত্রে বিষয়টি অত্যন্ত জটিল। অমেরিকা বা ইংল্যান্ডের মতো দেশ যেখানে শিক্ষিত লোকের হার বেশি, তার তুলনায় ভারতে প্রথাগত ভাবে শিক্ষার হার যে অনেক কম তা অনস্বীকার্য। এক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমের আরও যত্নবান হওয়া প্রয়োজন। মানুষকে সচেতন করতে সংবাদমাধ্যমকে গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে অধিক যত্নশীল হতে হবে এটাই কাম্য।
এ তো গেল জ্ঞানের কচকচির কথা। ভারতের বাস্তব পরিস্থিতিটা কিন্তু খুব ভয়ংকর। এখানে প্রথাগত ভাবে শিক্ষাহীনের থেকে অর্ধশিক্ষিতরা অতি ভয়ংকর। ভারতবর্ষে ‘উস্কানি’ নামক বস্তুটি এদের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়। এবং এদের প্রচারের হাতিয়ার বেশ কিছু চিহ্নিত প্রচারমাধ্যম। বিষয়টি গোড়া থেকে বলতে হবে। পুরো ইতিহাসে এই স্বল্প পরিসরে ঢোকা সম্ভব নয়। খুব সংক্ষেপে এই কথাটি স্বস্তিকার পাঠকদের জেনে রাখা প্রয়োজনীয় যে, মানবেন্দ্রনাথ রায় (নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য) তাসখন্দে গিয়ে যে-যুবকদের সংগ্রহ করেছিলেন ভারতীয় বিপ্লব পরিচালনার জন্য তারা প্রত্যেকেই ছিলেন জেহাদি আদর্শে উদ্বুদ্ধ।
কমিউনিস্ট-জেহাদি যোগের সঙ্গে আরও একটি বিস্ফোরক তথ্য হলো ব্রিটিশ সরকার যেহেতু ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে তাদের স্বার্থসিদ্ধির যুদ্ধে নেমেছিল, জেহাদি কমিউনিস্টরা কখনই অন্তর থেকে তাগিদ অনুভব করেনি ব্রিটিশদের ভারত থেকে উৎখাত করতে। যে কারণে তারা ১৯৪২-এর ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনকে সাবোটেজ করবার যাবতীয় ষড়যন্ত্র তৈরি করেছিল। পাকিস্তানের দাবির অত্যুগ্র সমর্থক কমিউনিস্টরা স্বাধীনতার পরও দেশবাসীর সঙ্গে কী চূড়ান্ত বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল তার উদাহরণ তো ১৯৬২-র ভারত-চীন যুদ্ধ, যেখানে চীনের পক্ষাবলম্বন করেছিল কমিউনিস্ট পার্টির বড়ো একটি অংশ, নতুন দলই তৈরি হয়ে গিয়েছিল কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া(মার্কসিস্ট) নামে। পরে এই দলটিও ভেঙে তৈরি হলো সিপিআই (এমএল), অর্থাৎ যাদের নকশাল বা মাওবাদী নামে দেশবাসী জানে। দেশের মনীষীদের মূর্তি ভেঙে অপমান আর লুঠতরাজ, গুন্ডামি ও খুনখারাবি ছাড়া ভারতীয় গণতন্ত্রে যাদের আর কোনও অবদান নেই।
এই ইতিহাস সবাই জানেন। আরও বিস্তারিত ভাবেই জানেন। কিন্তু কথাগুলো বলতে হলো আজকের সংবাদমাধ্যমের চরিত্রটি বোঝাবার জন্য। একটি সংবাদমাধ্যমের সম্পাদকীয় স্তম্ভের ওপর লেখা থাকে জাতীয়তাবাদের মূলমন্ত্র, আর তার সম্পাদকীয় ও উত্তর সম্পাদকীয় প্রবন্ধগুলি নকশালি ধ্যানধারণায় পরিপূর্ণ। কেমন সেই ধ্যানধারণা? যেমন ধরুন ভারতবর্ষ আদতে একটি খেতে না পাওয়ার দেশ, ‘বুর্ঝোয়া’ শব্দটি এখন গালাগাল বাচক, তাই এই শব্দটি পত্রিকার পাতায় ব্যবহার হয় না। কিন্তু তা না হলেও প্রবন্ধগুলিতে লোক খেপানোর রসদ যথেষ্ট থাকে এবং প্রবন্ধ লেখকদের প্রত্যেকেরও ‘নকশাল ব্যাকগ্রাউন্ড’ রয়েছে।
যে সংবাদমাধ্যম একটি বিশেষ মতাদর্শের দ্বারা পরিচালিত হয়, এবং যে মতাদর্শের দীর্ঘ ঐতিহ্য আছে দেশ বিরোধিতার, তাদের কথার বিন্দুমাত্র দামও কি সাধারণ মানুষের কাছে রয়েছে? সংসদীয় গণতন্ত্রে একটি নিরপেক্ষ সংবাদমাধ্যমের এই অধিকার অবশ্যই আছে কোনও দলের বিরোধিতা করার। কিন্তু একটি বিশেষ মতাদর্শের বা গোষ্ঠীর মুখপত্র হিসেবে কাজ করলে সেই নিরপেক্ষতা বজায় রাখা সম্ভব হয় কি? খেটে খাওয়া সাংবাদিকদের অবস্থাটা ‘কর্তার ইচ্ছায় কর্ম’-এর মতো। পূর্ব ভারতের তথাকথিত ‘এক নম্বর দৈনিক’ ওই বাজারি পত্রিকার নীতিই হলো সরকার বিরোধিতার মোড়কে দেশবিরোধী ভাবনায় উস্কানি দেওয়া। টাকার লোভে এদের সাংবাদিককুলও সেইভাবে দিনকে রাত আর রাতকে দিন করে। এটা করতে গিয়ে তাদের একের পর এক সংস্থায় তালা পড়েছে, শয়ে শয়ে কর্মী ও সাংবাদিক ছাঁটাই হচ্ছেন, তবু ভারত বিরোধিতায় তারা অনড়। কারণটা কী? শহুরে নকশালরা সুখের পালঙ্কে শুয়ে নিরীহ গরিব-গুর্বো মানুষকে খেপিয়ে তুলছে, আজকের ভারতবর্ষে এটি প্রমাণিত সত্য। এই বাজারি পত্রিকাটিকে দেখলে সেটি আরও ভালাভাবে বোঝা যায়। এই পত্রিকার শীর্ষ পদাধিকারীরা ( যাঁরা আবশ্যিক ভাবে নকশাল) তারা বহাল তবিয়তে আছেন, আর চাকরি হারাচ্ছেন সাধারণ কর্মচারীরা (প্রেস কর্মী থেকে সহ সম্পাদক অবধি)। দেশবাসী মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছেন, একের পর এক সংস্থায় তালা ঝুলছে। নিজের ভালো তো পাগলেও বোঝে। তা সত্ত্বেও দেশের খেয়ে, দেশের পরে সেই দেশেরই বিরোধিতা কী কেবল অন্ধ আদর্শের টানে। আদর্শটি এতই বিপথগামী যে তার জন্য ত্যাগ স্বীকার আজকের দিনে দাঁড়িয়ে কেউ করবেন তা পাগলেও বিশ্বাস করবে না। তবে কি এই বাজারি পত্রিকার বিদেশি জোগানদার রয়েছে? সব দেশেরই কৌশল থাকে বিপক্ষে নিজেদের লোক ঢুকিয়ে রাখা। এদেশের আরবান নকশালরা এই ভাবে পাকিস্তান-চীনের কাজ সহজ করে দিয়েছে। বাজারি পত্রিকাটিও তার ব্যতিক্রম নয়। এদের চীন প্রীতি, অধুনা পাকিস্তান ও রাশিয়া প্রীতি বুঝিয়ে দেয় টাকার জোগানদার কারা। এই যদি পরিস্থিতি হয় তবে তো বলতেই হবে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম গণতন্ত্রের কাঠামোটি ঘুণে ভর্তি, যে-কোনও মুহূর্তে ভেঙে পড়ে বিপর্যয় ঘটবে।
বাজারি পত্রিকার কথা ছেড়ে দিন, এবার অন্যান্য পত্রিকার প্রসঙ্গে আসুন। বাজারি পত্রিকার পরেই যে পত্রিকার স্থান সেই ‘এই সময়’ পত্রিকাটির সম্পাদক বহুদিন যাবৎ জেলের ঘানি টানছেন, চিটফান্ডের কারণে। তৃণমূলের পৃষ্ঠপোষকতায় চিটফান্ডগুলি রাজ্যের সাধারণ গরিব মানুষের টাকা লুঠ করেছেন, তৃণমূলের প্রচার কৌশলের অন্যতম মুখ ছিলেন তারা। এদের পরিচালিত সংবাদমাধ্যমগুলি গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভের মর্যাদা যেভাবে ভূলুণ্ঠিত করেছে, তার রেশ আজও চলছে। এখন চিটফান্ড নেই, কিন্তু তৃণমূল প্রশাসন এমনভাবে পুরো বিষয়টি সাজিয়েছে যাতে সংবাদমাধ্যমগুলি তাদের মুখাপেক্ষী থাকতে বাধ্য হয়। সেই বিজ্ঞাপন হোক কিংবা প্রচার এজেন্সি—তৃণমূল ব্যতীত গতি নেই।
এখানকার সংবাদপত্রগুলির আর একটা বিষয় খেয়াল করে দেখবেন। ‘ভারতমাতা কী জয়’ স্লোগানে এদের তুমুল আপত্তি। একে এরা বিজেপির স্লোগান বলে দেগে দিতে চেয়েছে। আসলে মাকে বন্দনা করার কথা বিশেষ এক সম্প্রদায়ের কাছে হারাম, তাই সেকুলার সাজার মহৎ বাসনায় তাদের উচ্চারণের অযোগ্য কথা সংবাদ – মাধ্যমগুলির কাছে বিষবৎ পরিত্যজ্য। এ রাজ্যের ওই বিশেষ সম্প্রদায়ের কাছে ভারতবর্ষ মাতৃভূমি নয়, আরব তাদের পিতৃভূমি। এই সম্প্রদায়ও গত এক দশকে মূল ধারার সংবাদপত্র পরিচালনায় নাম লিখিয়েছে এবং এর পিছনে পেট্রো-ডলারের মদতও আজ প্রমাণিত সত্য। ফলে বোঝাই যাচ্চে গণতন্ত্রের বিপদটা আজ ঠিক কোথায়।
শুধু বাণিজ্যিকীকরণের দোহাই দিয়ে সংবামাধ্যমের নৈতিক অবক্ষয় চাপা দিলে সেটা উটের বালিতে মুখ গুঁজে থাকার নামান্তর হবে। সমস্যা খুব গভীর, সমাধান অজানা। শুধু সচেতন থাকাটাই আপাতত প্রাথমিক কর্তব্য বলে বোধ হয়।
অভিমন্যু গুহ