গ্রাম বাংলার হিন্দুদের বঙ্গ জীবনের অঙ্গ হিসাবে লৌকিক সংস্কৃতি , দেব দেবী , লোকাচার, ব্রত , পার্বন অশেষ গুরুত্ব সেই কোন প্রাচীন কাল থেকে বহন করে এসেছে। তার ফল স্বরূপ , ক্ষয়িষ্ণু হিন্দুত্ব কোথাও গিয়ে পায় অশেষ শক্তি

এরম এক (দুই) লৌকিক দেবী হলেন জঞ্জালি – অঞ্জলি। মলয় পুর গ্রামের এক আশ্চর্য লৌকিক দেবী। বিরল বললেও অত্যুক্তি হবে না । কারণ বঙ্গদেশে আর কোন স্থানে এই নামে বা এরম কোন জোড়া দেবীর সন্ধান পাওয়া যায় না

বিষহরি মনসার বৌদ্ধ প্রভাব জাত নাম হলো যাঙ্গুলি। তিনি বৌদ্ধ তন্ত্রের দেবী স্বয়ং বিষবিদ্যা। সবুজ তারা ও হলুদ তারা বর্গের দেবের মধ্যে যাঙ্গুলি অন্যতম। এই যাঙ্গুলি উচ্চারণ থেকে আসতে পারে জঞ্জালি। আর অঞ্জলী নাম এসেছে জঞ্জালি শব্দের সঙ্গে উচ্চারণগত সাদৃশ্য রাখার প্রবণতায়

এই জঞ্জালি আর অঞ্জলীর বিগ্রহ বলতে কৃষ্ণবর্ণের দুটো প্রস্তরখন্ড। তারা পরস্পরের ভগিনী রূপে কল্পিত হয়ে থাকেন । মন্দিরের গর্ভগৃহে দক্ষিণ দিকে বড় বোন জঞ্জালি আর উত্তর দিকে ছোট বোন অঞ্জলীর অধিষ্ঠান। এছাড়া তাদের সঙ্গে রয়েছে তাদের নয় পুত্র। তাদের নয়টি পুত্র সকলেই নুড়িপাথর এ বিরাজিতা। মলয়পুর গ্রামের বর্গক্ষেত্র সম্প্রদায়ের বিশিষ্ট ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি মধুসূদন পন্ডিত এই যুগ্ম দেবীকে এক ঝোপ জঙ্গলের মধ্য থেকে খুঁজে পেয়ে স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে ঘরের চালার মাটির মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত করেন।

এমন লৌকিক দেবী কেন সুনিশ্চিতভাবে কিছু বলতে পারা যায় না…. সবটাই ক্ষেত্র সীমায় আশা শহরবাসী গবেষকের পরিশীলিত ভাবনা মাত্র

আসলে সাপের বিভিন্ন উপদ্রব থেকে রক্ষা পেতে মলয়পুর এর বর্গ ক্ষত্রিয় সম্প্রদায়ের স্ব সৃষ্ট লৌকিক দেবী এই জঞ্জালি অঞ্জলি। তার আরাধনা করা হয় মনসা পূজার মন্ত্রে। তিনি সর্প ভয় বিনাশিনী এক বিশুদ্ধ গ্রাম্য দেবী। লোক সাধারণের লোকায়ত প্রয়োজনে সম্পূর্ণ লোক মানষ থেকে জাত এই যুগ্ম দেবী আচার বিচারে বিশ্বাসে ভাবনায় অকৃত্রিম লৌকিক দেবী।

পুরান , বেদ এ এই দেবীর কিছু ছিটেফোঁটাও নেই এবং কৌলিন্য তো নেই। তবুও ইনি লৌকিক মাতার আসনে বসে আছেন।

খড়ের চালের মন্দির ভগ্নপ্রায় হলে তার গা ঘেঁষে নির্মীয়মান মন্দির এর কাজ চলছে। ঢিমেতালে মন্দিরের শীর্ষে খোদাই করা রয়েছে দেবীর নাম মা_জনাঞ্জালি

জঞ্জালি- অঞ্জলীর ব্যাকরণ লৌকিক ভাবে এক। তাই নিয়ে অবশ্য গ্রাম্য সাধারন ভাবিত নন ।লোক বিশ্বাসে অটুট লোকধর্মের শিকল পাতা থেকে উপড়ে ফেলা সম্ভব হবে না। বরং ধারা-উপধারা অনুসরণ করে সর্পিল গতিতে এই দেবী নিয়ে মলয়পুর এর গ্রাম্য লোক সমাজে রয়েছে বিচিত্র সব লোক কাহিনী।

হুগলি (Hooghly) জেলার মলয়পুর সাতাশ পাটি গ্রাম । এই গ্রাম 27 টি জাতি বা সম্প্রদায়ের পাড়া আছে । বর্গ ক্ষত্রিয়দের বসবাস সাঁকো পথে চাষের নালী পেরিয়ে, ধর্মরাজের মন্দির ক্ষুদিরায়তলায়।

এদিকের বারো ঘর বর্গক্ষত্রিয় পন্ডিত বসবাস করছেন জঞ্জালি অঞ্জলি মন্দির এর আশেপাশে। দেবীর সেবায়ত বর্গক্ষেত্রিয় পণ্ডিতদের কোন কারণে যদি কোন সমস্যা হয়, তাহলে খুদি রায় সম্প্রদায়ের সেবায়েত ডোম পণ্ডিতরা এসে পুজো করে যান।ধর্মরাজের সেবায়েতের মত এরা তামার বালা বা উপবিত ধারণ করেন না। এরা দীক্ষা নেন। দীক্ষিত যে কেউ সেবায়েত হতে পারেন।

তথাকথিত নিন্ম সম্প্রদায় গুলির মধ্যে একই ধর্মাচরণে সূত্র গড়ে ওঠায় এখানে হিন্দু ধর্মের এক ঐক্য মণ্ডিত গ্রাম , এক সম্প্রীতির পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। এই গ্রাম যথেষ্ট সমৃদ্ধ। মন্টেশরী নদীর ভাঙ্গনে বারকতক এই গ্রাম বন্যায় প্লাবিত হলেও কৃষি উৎপাদনে শিক্ষায় ও ব্যবসায় গ্রামের পরিবেশ উন্নত। বেশিরভাগ মানুষের জীবিকা কৃষিকাজ ।গ্রামে তপশিলি জাতিদের বসবাস ।

একসময় এখানে উগ্রক্ষত্রিয়দের আধিপত্য ছিল। তারা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। এখন বিভিন্ন পাটিতে বর্গক্ষত্রিয়দের বসবাস বেশি লক্ষ্য করা যায় ।

জঞ্জালি অঞ্জলি দেবীর নির্মীয়মান মন্দির সমতল ছাদের দালান আকৃতির মন্দির ।এখনো পলেস্তারা পড়েনি । মন্দিরের মাথায় রথের চূড়া সদৃশ্য একটি ছোট চূড়া রয়েছে । গর্ভগৃহের মধ্যস্থলে একটি কাঠের সিংহাসনের উপর আছে জঞ্জালি অঞ্জলীর সিন্দুর ও লাল পাড় কাপড় জড়িত শিলাখণ্ড।

দুটি শাড়ি দিয়ে ঘোমটার মত করে শিলা দুটিকে জড়িয়ে রাখা আছে। চাঁদ মালা ঝোলে এক পাশে ।ডানদিকে ছোট্ট একটি সিংহাসনে তাদের নয় পুত্র কে দেখতে পাওয়া যায় । এ ক্ষেত্রে বিষয়টি লক্ষণীয় মা মনসার পুত্র আস্তিক । কিন্তু মনসা স্বরূপ জঞ্জালি অঞ্জলীর নয়টি পুত্র সন্তানের নাম অজ্ঞাত।

1 কিলোগ্রাম সিদ্ধ চাল, মরসুমী ফল, আর বাতাসা দিয়ে সকাল 11 টায় প্রতিদিন নিত্য পূজা হয়। সন্ধ্যায় শীতল পূজা প্রদানের ব্যবস্থা নেই। শনিবার করে বেশি যাত্রীরা আসেন। আশ্বিন মাসের দুর্গা নবমীতে পাঠা বলি হয় 30 টি। এছাড়াও ভক্তরা মানসিক করে পাঠা বলি দেয় । বলি কার্যকরের গোবিন্দ পন্ডিত । অতীতে বলি কার্য করতেন মাখনলাল পন্ডিত।

যেদিন বলি হয় সেদিন দুপুরে ষোড়শোপচারে পুজো হয় দেবীকে সমাংস রুধির নিবেদন করা হয় । দশহরা তিথিতে অবশ্য সেবায়তের তরফ থেকে একটি পাঠা বলি দেওয়া হয় । তবে পহেলা মাঘ এর পুজোয় পশুবলি নিষিদ্ধ। সেদিন ভোগের পূজা হয় দেবীকে মাছ পোড়া ,বেগুন পোড়া ,আর নিরামিষ তরকারি রান্না করে দেওয়া হয় ।সেদিন ঢাক বাজে ।দাসপাড়া থেকে আসে ঢাকিরা। এছাড়া কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর দিন সিদ্ধ চালের ভাত , গুড় , দুধ, নারিকেল ও পায়েস নিবেদন করা হয়।

নিত্য শীতল পুজো না হলেও রথযাত্রার , দোলপূর্ণিমা , চৈত্র সংক্রান্তিতে শীতল পুজো হয়। পূজার কাজে স্থানীয় দুলুই পুকুরের জল ব্যবহৃত হয় । পহেলা মাঘ উপস্থিত হলে ভক্তদের মধ্যে ভোগ বিতরণ করা হয় । ঐদিন সুদূর খানাকুল, হরিপাল, বর্ধমান থেকে বহু ভক্ত যাত্রী আসে।

দোল পূর্ণিমার দিন পূর্বে এখানে মেলা বসতো । 1980 সালের সামাজিক অস্থিরতার ফলে এখানে মেলা বন্ধ হয়ে যায় । এখন মেলা না হলেও ফাগুন মাসে শুক্লপক্ষে শনি মঙ্গলবার মন্দির চত্বরে দই খই ভিজিয়ে খাওয়া পার্বণ পালিত হয় । এর নাম খইয়ে-দইয়ে।

একে গ্রাম্য ভাষায় খইঢেরা উৎসবও বলে । এই দিন গ্রামে উনুন জ্বলে না। গ্রামের মহিলারা এতে অংশ নেন।

মলয়পুর আকাশে বাতাসে ঘুরে বেড়ায় বিশেষ লোকোকথা। সেই অনুযায়ী জঞ্জালি অঞ্জলীকে জোড়া বস্ত্র দিয়ে পুজো দিতে হয় । জোড়া বস্ত্র ছাড়াও আরো বিভিন্ন জিনিস দিয়ে পূজো দেন ভক্তরা। কিন্তু সমস্ত কিছু জোড়ায় জোড়ায় দিতে হয়।

লৌকিক বিশ্বাস এর এক শক্ত স্থান মলয়পুর সর্পদেবী জঞ্জালি অঞ্জলীর মন্দির । বিশ্বাসে তারা সেখানে তাদের সব বিপদের তারন হার করেছে এই দেবীকে। একবার এই শীতে ঘুরে আসুন সেই মলয় পুর গ্রামে দেবীর থানে। তারকেশ্বর স্টেশন থেকে বর্ধমান গামী বাসে মলয়পুর। বাস স্টপ থেকে তারপর দশমিনিট হাঁটা।

রচনায় দুর্গেশনন্দিনী (Durgeshanandini)

তথ্যঃ হুগলি জেলার লৌকিক দেবদেবী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.