বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ভ্রাতৃসম সুকুমারকে দেখতে গিয়েছিলাম উত্তর কলকাতার জেবি রায় আয়ুর্বেদিক হাসপাতালে। এটি পূর্ব ভারতের একমাত্র প্রতিষ্ঠান যেখানে স্নাতক স্তরে সাড়ে চার বছরের আয়ুর্বেদ পাঠক্রম পড়ানো হয়। এর উদ্ভব ও হাসপাতালের অতীতে ডুব দিতে গিয়ে একটা অজানা অধ্যায় খুলে গেল।
১৯৭০-এর শেষভাগে এক চিকিৎসককে আমরা দেখতে পাই যিনি প্রথাগত পাশ্চাত্য চিকিৎসাশাস্ত্রে শিক্ষিত হয়েও আয়ুর্বেদ সাধনায় মনোনিবেশ করেন। বিস্মৃতির অতলে থাকা ওই চিকিৎসকের নাম যামিনীভূষণ রায়, যামিনী কবিরাজ হিসাবে যিনি নাম করেছিলেন। ১ জুলাই বিধান রায়ের মত তাঁরও জন্মদিন।
অবিভক্ত বাংলার খুলনা জেলার পয়োগ্রামে যামিনীভূষণের জন্ম। বাবা ছিলেন কবিরাজ পঞ্চানন রায়। শিক্ষার জন্য তাঁকে কলকাতায় পাঠানো হয়। ভবানীপুরের সাউথ সুবার্বন হাইস্কুলে থেকে মাত্র ১৪ বছর বয়সে বিদ্যালয়ের পঠন পাঠন শেষ করে ভর্তি হন সংস্কৃত কলেজে। কিন্তু স্নাতক স্তরের পড়াশোনা শেষ হবার আগেই ইচ্ছে হয় ডাক্তারি পড়বেন। ভর্তি হয়ে যান কলকাতা মেডিকেল কলেজে। বাবা কবি চিন্তামনি পঞ্চানন রায়ের কাছে চলতে থাকে আয়ুর্বেদ শিক্ষা।
১৯০৫ সালে এমবি পাস করেন যামিনীভূষণ। চূড়ান্ত পরীক্ষায় পান স্বর্ণপদক। ইতিমধ্যে স্নাতকোত্তর পাঠের জন্য ভর্তি হন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯০৬ সালে তিনি সিদ্ধান্ত নেন পাশ্চাত্য চিকিৎসা করবেন না। বহন করবেন বাবার এবং দেশীয় চিকিৎসার ঐতিহ্য। মেডিকেল কলেজের শিক্ষকরা সম্ভাবনাময় চিকিৎসককে পশ্চিমী চিকিৎসায় থেকে যাওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু তিনি শিক্ষা নিতে শুরু করেন প্রখ্যাত কবিরাজ মহামহোপাধ্যায় বিজয়রত্ন সেনের কাছে। শুভাকাঙ্খীদের বলেছিলেন, জীবন কাটাতে না পারি তাহলে পাঁচন বিক্রি করে পয়সা রোজগার করব।
মাসে ৪০ টাকা বেতন একটি মাড়োয়ারি হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত হন। আয়ুর্বেদিক উন্নততর কাজকর্মের জন্য সরকারি আনুকূল্য পাননি। গরীব রোগীদের বিনা পয়সায় চিকিৎসা করতেন। আবার জমিদার ও বিভিন্ন প্রদেশের রাজ পরিবারের কাছ থেকে সেই আমলে পারিশ্রমিক নিতে এক হাজার টাকা। এইভাবে অর্থ সংগ্রহ করে ‘বৈদ্যরাজ ফার্মেসি’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করেন। সেখানে তিনি ও তাঁর সহকর্মীরা আধুনিক পদ্ধতিতে আয়ুর্বেদিক ওষুধ তৈরি করতে শুরু করেন। জোর দেন ড্রাগ স্ট্যান্ডার্ডাইসেশনের উপর। ১৯১৬ সালে ২৯ নম্বর ফরিয়াপুকুর স্ট্রিটে একটি ভাড়া বাড়িতে অষ্টাঙ্গ আয়ুর্বেদ কলেজ ও হাসপাতাল শুরু করেন। যামিনী ভূষণ ছিলেন এই প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ। এই কলেজ-হাসপাতালের ক্রিয়া-কলাপ মহাত্মা গান্ধীকে আকৃষ্ট করে। এর পর গান্ধীজী কলকাতায় এসে রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রিটে জেবি রায় আয়ুর্বেদিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালুর শিলান্যাস করেন। ২০১৬ সালে তাদের শতবর্ষ হয়।
যামিনী ভূষণ হাসপাতাল তৈরীর জন্য ১২ বিঘা জমি দান করেছিলেন পাতিপুকুরে। যেখানে বর্তমানে যক্ষা হাসপাতাল অবস্থিত। ওই হাসপাতালের শিলান্যাস করেছিলেন রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায়। ১৯২৬ সালের আগস্ট মাসে তিনি তাঁর কলেজের উন্নয়নের জন্য দান করেন দু লক্ষ টাকা। মাত্র ৪৭ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়। (তথ্যের জন্য অবন্তিকা পাল/ ‘বঙ্গদর্শন’-এর কাছে ঋণী)।