।।তৃতীয়।।
এমন একদিন, যেদিন ভান্ডার তন্ডুল শূন্য, স্থির হয়েছে সন্তানেরা রাতে অর্ধাহারে করবেন এবং পরদিন অনশনে থাকবেন। অথচ , সেদিন অপরাহ্ণে এক বৃদ্ধ ব্রাম্ভন অভ্যাগত এসে উপস্থিত হলেন । শাশুড়ি মাতা বিনীতভাবে তাকে নিজেদের দুরাবস্থার কথা এবং অতিথি আপ্যায়নের অপারগতার কথা জানানোর ফাঁকে…পুত্র বধূ তাকে ডেকে বললেন ” ক্ষুধাতুর, ক্লিষ্ট বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ অতিথিকে ফেরানো যাবে না ….আপনি ওর পাদ্যার্ঘ ও আসনের ব্যবস্থা করুন। আমি অন্য আয়োজন দেখছি…”
এই বলে তিনি হাতের একগাছি পিতলের পৈচা এক প্রতিবেশীর কাছে বন্ধক রেখে এক সের চাল সংগ্রহ করলেন। তারপর মুদির দোকানে কিছু চালের বিনিময় ডাল সংগ্রহ করলেন। তারপর রান্না করে অথিতি সেবার ব্যবস্থা করলেন।
তাদের একখানি শোবার ঘর ছিল মাত্র। সেই কারণে প্রতিবেশী কারো গৃহে অতিথির রাত্রি বাসের ব্যবস্থা করলেন। সে পর্ব শেষ হলো ….পর দিবসের প্রভাতে অতিথি এই পরিবারের কল্যাণের জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে গেলেন ।ভগবতী দেবীর সেবা ধর্মে বিবরণ দিতে গেলে মহাভারত হয়ে যায় । তবু দু একটি নমুনা দিতে বড় ইচ্ছে করে….
বামনি নামক এক পুকুরে রোজ স্নান করতে যেতেন ভগবতী দেবী।
একদিন স্নান করে ওঠার পথে পেলে এক পুঁটুলি, তাতে কিছু টাকা পয়সা ও গুটিকয় সোনার গয়না।
ভগবতী পড়লেন মহা চিন্তায়।
কাছেপিঠে তো আর কেউ নেই। তা হলে? কী করবেন এটি নিয়ে?
সময় কাটতে লাগল। পুঁটলি আগলে বসে রইলেন ভগবতী। সকাল গড়িয়ে বিকেল এল।
অনেক পরে এক ব্রাহ্মনের উদয় হল। রীতিমতো কাঁদতে কাঁদতে তিনি পুকুরপাড়ে এসে পৌঁছলেন। তার মুখে সব শুনে ভগবতীর বুঝতে অসুবিধে হল না যে, ওই পুঁটলিটা ব্রাহ্মণেরই। পুঁটলির ভিতর গচ্ছিত ছিল তাঁর মেয়ের বিয়ের জিনিসপত্র। হারানো সেই পুঁটলি হাতে পেয়ে ব্রাহ্মণের যেন ধড়ে প্রাণ এল। স্বস্তি পেলেন ভগবতী। কথায় কথায় শুনলেন, এই পুঁটলির চিন্তায় দিনভর কিছু খাননি ব্রাহ্মণ। ভগবতী তখন তাঁকে নিয়ে গেলেন নিজের বাড়ি।
শুধু তাই-ই নয়, খাওয়া-দাওয়ার পর ব্রাহ্মণকে বললেন, ওই পরিমাণ টাকায় আপনার মেয়ের বিয়ে কী করে সম্ভব?
শুনে ব্রাহ্মণ মৌন। তাঁর মুখ দেখে সব বুঝলেন ভগবতী। নিজের সঞ্চয়ের কুড়িটি মুদ্রা ব্রাহ্মণকে দান করলেন তিনি।
বিদায় নিলেন ব্রাহ্মণ।
দীনদুঃখীর কষ্ট কিছুতেই সইতে পারতেন না ভগবতী।
১৮৭৫ সাল, দেশ জুড়ে অনাবৃষ্টি, খরা। মাটি ফেটে চৌচির, এক টুকরো ফসল উৎপন্ন হয় নি। চারিদিকে অন্নাভাব ভগবতীদেবী সে বার খুলে বসলেন অন্নসত্রতলা।
প্রতিদিন সকাল থেকে রাত সেখানে এসে ভিড় জমাতে লাগলেন নিরন্ন মানুষের দল। সকলকে যত্ন-আত্তি, সেবা না করে ভগবতীর যেন শান্তি নেই। হিন্দু পেট্রিয়ট পত্রিকার একটি প্রতিবেদনে ছাপাও হয়েছিল সে কথা। সেখান থেকেই জানা যায়, সেই বছর ভগবতীদেবী প্রতি দিন বাড়িতে চার-পাঁচ’শ লোকের খাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন।
প্রয়োজনে অকাতরে টাকা ধার দিতেও কসুর করতেন না তিনি। তবে সময়ে সময়ে তা আবার সংসারে বিপদও ডেকে আনত।
একবার বাড়িতে টাকা নেই, চালও বাড়ন্ত। ভগবতীদেবী বেরোলেন গাঁয়ের পথে— টাকা আদায় করতে। সকলেই খাতির-যত্ন করতে শুরু করলেন, মিষ্টি কথা বলতে থাকলেন।
ওঁদের কথাতে ভগবতী বেমালুম ভুলে গেলেন টাকার কথা। উল্টে অভ্যাসমতো বলে দিলেন, ‘‘ও বেলা বাড়িতে আসিস, প্রসাদ নিতে।’’
একবার স্কুল-ইনস্পেক্টর প্রতাপনারায়ণ সিংহ এসেছেন বাড়িতে। সেকালে সব বাড়িতে গিয়ে সবাই শালপাতায় খাওয়া-দাওয়া করতেন। বড় পরিবারে অত বাসনকোসন কোথায় মিলবে, তাই। খাওয়ার জন্য থালা-বাটি তখন রীতিমতো বিলাসিতা।
প্রতাপবাবুর জন্য কিন্তু ভগবতী খুঁজে পেতে কোথা থেকে ঠিক জোগাড় করে আনলেন একটি থালা। তাতেই সাজিয়ে দিলেন তাঁর খাবার। অতিথি যে নারায়ণ! তাঁর জন্য কোনও কিছুই দুর্মূল্য নয়।
ভগবতী দেবী বুদ্ধিমতীও ছিলেন….
সেই যে হ্যারিসন সাহেব খেতে এসেছিলেন.. এসে তিনি ভগবতীদেবীকে পরীক্ষার নিমিত্ত জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে “আপনার গৃহে কি পরিমান ধন আছে?” তাতে দেবী কিছুক্ষন হেসে ছিলেন মনে মনে…তারপর স্মিত হাস্যে বললেন ” আমার গৃহে চার ঘড়া ধন আছে…”
হ্যারিসন অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন ” কোথায়?”
ভগবতী দেবী নিজের চার পুত্রের দিকে আঙ্গুল তুললেন…হ্যারিসন হতভম্ব হয়ে মাকে দেখতে লাগলেন।
একবার শীতে মায়ের জন্য লেপ পাঠানোর মনস্থ করেন বিদ্যাসাগর। একখানা লেপ পাঠালে মায়ের প্রয়োজন মিটবে না । জেনেই তিনি ছয় খানি লেপ পাঠালেন বীরসিংহের বাড়িতে ।
কদিন বাদে মায়ের চিঠি এল, তাতে লেখা ছিল , “তোমার পাঠানো লেপগুলি শীতে বিপন্ন লোককে দিয়ে ফেলেছি ।আমাদের ব্যবহারের জন্য পুনরায় লেপ পাঠাও।
উত্তরে রসিক পুত্র লিখেছিলেন , ” ঐরূপ ভাবাপন্ন লোকদিগকে ও বাড়ির লোকদিগকে দিয়া তোমার নিজের জন্য একখানি লেপ রাখিতে হইলে সর্বসমেত কয়খানি লেপ পাঠাইব লিখিবে । তোমার পত্র পাইলে আবশ্যকমত লেপ পাঠাইব ।
ক্রমশঃ
দুর্গেশনন্দিনী