গত দু’টো ভোটের অভিজ্ঞতায় ভয় পেয়েছিলাম, তাই লিখেছি না ফিরলে ভাববেন না মানসিক অবসাদ

চাকরিজীবনে নয় নয় করে দশটা ভোট করেছি। কিন্তু এমন কখনও মনে হয়নি। এমন ভয় নিয়ে কখনও যাইনি। মাথার মধ্যে খালি ঘুরছিল চোদ্দর লোকসভা আর গতবারের পঞ্চায়েতের সেই বীভৎস অভিজ্ঞতার কথা।

মানকরে দায়িত্ব পড়েছিল চোদ্দর ভোটে। বাড়ি থেকে জেনে গিয়েছিলাম সব বুথে কেন্দ্রীয়বাহিনী থাকবে। কিন্তু গিয়ে দেখি সবই শুধু কথার কথা। যে ঘোষণা করেছিল নির্বাচন কমিশন, তা বাস্তবায়িত হয়নি। বুথের ভিতরে ছিলাম আমরা আর দরজায় গোড়ায় দাঁড়িয়ে ছিল লাঠিধারী পুলিশ। অথচ আগের রাতেই কেন্দ্রীয়বাহিনী এসে ঘুরে গিয়েছিল। কিন্তু ভোটের দিন তাঁরা ‘নিরুদ্দেশ।’ বুথ থেকে কয়েকশো মিটার দূরে গ্রামের একটি গাছতলায় বসে কানে ওয়াকম্যান লাগিয়ে, ঠ্যাং ছড়িয়ে বসে আছেন তাঁরা।

পঞ্চায়েত নির্বাচনের অভিজ্ঞতা আরও ভয়াবহ। ভাতারের একটি বুথে দায়িত্ব পড়েছিল গতবার গ্রামের সরকার নির্বাচনের ভোটে। কিন্তু পৌঁছে বুঝতেই পারছিলাম না এটা বর্ধমানের ভাতার নাকি কাশ্মীরের কোনও সীমান্ত লাগোয়া গ্রাম। মুহুর্মুহু বোমার শব্দ। ঘুমোতে পারিনি। আতঙ্ক নিয়েই রাত কেটেছিল। পরের দিন সকালে ভোট করাতে বসেছিলাম আমি এবং সঙ্গে থাকা ভোটকর্মীরা। কিন্তু ওখানে তো সবটা জানতে পারিনি। বাড়ি ফিরে শুনেছিলাম রায়গঞ্জে ভোটের ডিউটি করতে গিয়ে প্রিসাইডিং অফিসার রাজকুমার দাসের অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা। মন থেকে কিছুতেই মেনে নিতে পারিনি।

এটা কী হচ্ছে! একজন ভোটকর্মী ভোট করতে গেলেন, আর তাঁর দেহ মিলল ১৫ কিলোমিটার দূরে রেললাইনের ধারে! তা নিয়ে সরকারের শীর্ষ আধিকারিকদের বক্তব্য শুনে আঁতকে উঠেছিলাম। ভিতরে জাঁকিয়ে বসেছিল ভয়। এই লোকসভায় ডিউটির চিঠি আসার পর ই-মেল করে বাতিলের আবেদন জানিয়েছিলাম। কিন্তু সেটা গৃহীত হয়নি। তাই যাওয়ার আগে ফেসবুকে একটি দীর্ঘ পোস্টে নিজের কথা লিখে গিয়েছিলাম।

আমার বক্তব্য ছিল একেবারে স্পষ্ট। আমার যদি কিছু হয়, তাহলে হয়তো মানসিক অবসাদ বা ওই জাতীয় কোনও তত্ত্ব হাজির করা হতে পারে। তাই ওপেন ফোরামে জানিয়েছিলাম, আমার কোনও মানসিক অবসাদ নেই। পরিবারের সঙ্গে কারও বিতণ্ডাও নেই যে, আমায় মেরে ফেলা হবে। কারণ প্রথম দু’দফায় একাধিক হিংসার ঘটনা দেখেছি সংবাদমাধ্যমে। মনে হয়েছিল, কমিশন যা বলছে, বাস্তবে তা হচ্ছে না। ফাঁক থেকে যাচ্ছে। আমি লিখেছিলাম এই কারণে যে, আমার কোনও দুর্ঘটনা ঘটে গেলে হয়তো বিশেষ পর্যবেক্ষক অজয় নায়েক মানসিক অবসাদের কথা বলে দেবেন। তাই আগে থেকেই সেলফ স্টেটমেন্ট করে গিয়েছিলাম।

ভোট করে বাড়ি ফিরে আবার সোশ্যাল মিডিয়াতে জানিয়েছিলাম সুস্থ ভাবে বাড়ি ফিরেছি। এ বার একটুও অসুবিধে হয়নি। একটুও না। কিন্তু এই যে মানসিক পরিস্থিতি আমার মতো অনেকের তৈরি হয়েছে, এই যে গণতন্ত্রের উৎসবে অংশগ্রহণ করতে আমার মতো অনেককেই আতঙ্ক গিলে খাচ্ছে, এটা বোধহয় কোনও ভাবেই কাম্য নয়। অবসান হোক এমন পরিস্থিতির। যাতে নির্ভয়ে ভোট করাতে যেতে পারি পরের বার।  আর যেন একজনকেও রাজকুমার রায় না হতে হয়। আমাদেরও পরিবার আছে। স্ত্রী-সন্তান আছে।

আশিস দত্ত

মতামত লেখকের ব্যক্তিগত। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.