রাজ্যের সর্বনাশের ইতিহাস

কুড়ি মে সারা দেশ এবং পৃথিবীর মানুষ দেখেছে উড়িষ্যা, পশ্চিম বাংলা জুড়ে আমপানের ঝঞ্ঝা। বিরাট বিরাট গাছ উপড়ে মানুষ, বাড়ী, গাড়ী, বাসের উপর আছড়ে পড়ে দুমড়ে ধংস করে দিয়েছে মানুষের প্রাণ, আশ্রয়, সম্পদ আর রোজগারের উপায়। প্রচন্ড গতিতে ঝড় বহু ছোট ছোট দুর্বল বাড়ীর চাল উড়িয়ে নিয়ে গেছে। গৃহহীন হয়েছেন, প্রান হারিয়েছেন অনেক মানুষ। ঝড় শেষ হওয়ার আগেই পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী তার নবান্নের উপরতলায় সাংবাদিকদের ডেকে বলেছেন ‘সর্বনাশ হয়ে গেছে’। 

এই রাজ্যের সর্বনাশের ইতিহাসটা একটু দেখে নেওয়া যাক। 

২০০০ সালে পশ্চিমবাংলার নেত্রী বলেছিলো CPM জল ছেড়ে বন্যা করার পর ত্রাণ ছড়িয়ে ভোটে জেতে। ২০০৯ সালে এই বন্যা, সাইক্লোন দেখিয়ে RSP র মন্ত্রী সুভাষ নষ্কর কেন্দ্রের AIBP ফান্ড থেকে ৫০০০ কোটি টাকা অনুমোদন করে আনে। কিন্তু তার মধ্যে প্রায় ১৩০০ কোটি করদাতাদের টাকা নয় ছয় করার পরে কাজ বিশেষ এগোয় না। কারন ততদিনে বাম জমানার মৃত্যূ ঘন্টা বাজতে শুরু করেছে, জমি অধিগ্রহন করে বাঁধ বানানো যায় নি। কিছুদিন পরই ২০১১ এ CPM কে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে মাননীয়ার সরকার বাংলার মসনদে বসলো। যে জমি অধিগ্রহণের বিরোধীতা করে সিংহাসনে বসা, বন্যা, সাইক্লোন রোধে বাঁধ বানাতে সেই জমি অধিগ্রহণ চলতে পারে? না। অর্থাৎ বাঁধ দেওয়া বন্ধ্ করো। কুড়ি তারিখে আমপানের প্রথম ধাক্কায় সুন্দরবনে একের পর এক নড়বড়ে মাটির বাঁধ ফেটে গেছে। হুহু করে নোনা জল ঢুকে চাষের জমি, মাছের পুকুর, বাড়ী ঘর দোর ভাসিয়ে দিয়েছে। 

কিন্ত পশ্চিমবাংলায় এত বাড়ীর দেওয়াল ধসে গেলো কেন? এত চাল উড়ে গেলো কেন? দেওয়াল ধসে, চাল উড়ে এত মানুষের মৃত্যূ হলো কেন?

প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা খাতে গত কয়েক বছরে কেন্দ্রীয় সরকার ২৫ হাজার কোটি টাকারও বেশী পশ্চিমবাংলায় পাঠিয়েছে এবং সরকারী নথি অনুযায়ী অন্তত ১৫ লক্ষ পাকা বাড়ী তৈরী হয়েছে। এই সংখ্যা দুটোই ভারতবর্ষের অন্য যেকোন রাজ্যের থেকে অনেক বেশী। 

পশ্চিম বাংলার মানুষ ভালোভাবেই জানে যে এই রাজ্যের সর্বগ্রাসী দুর্নীতি আর তীব্র রাজনৈতিক অসহিষ্ণু পরিবেশে সততার সঙ্গে খবর পরিবেশন করা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু এই অবস্থাতেও বহুদিন ধরেই খবর আসছিলো যে সততার প্রতীক তৃণমূলের নেত্রী নেতাদের বড় অংকের টাকা তোলা না দিয়ে নিজের বাড়ীর একটা ইঁটও গাঁথা সম্ভব না। বাড়ী বানানোর জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের সাহায্য যদিও একলাখ কুড়ি হাজার টাকা, পশ্চিমবাংলার শাষক দল গরীব মানুষের পাওনা থেকে চল্লিশ হাজার পর্যন্ত টাকা ভয় ভীতি দেখিয়ে লুট করে নিয়েছে বলে অভিযোগ।  কিছু সংখ্যক দলদাস, পেটোয়া, হার্মাদগোষ্ঠী ও ভাড়াটে গুন্ডা বাহিনী ছাড়া রাজ্য জুড়ে এই বিপুল লুটের হাত থেকে প্রায় কেউ রেহাই পায়নি। চোখ কান খোলা রাখা বহু মানুষ অভিযোগ করেছেন, বাংলার গরীব ও গৃহহীনদের জন্য বরাদ্দ ঐ পঁচিশ হাজার কোটি কেন্দ্রীয় অনুদানের থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করেছে মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বাধীন এই তৃণমূল দল। এই টাকা যদি লুট না হতো তবে বাড়ীগুলোর দেওয়াল আর কিছুটা শক্ত হতো, পলকা উড়ে যাওয়া চাল গুলোর বদলে এর একটু শক্ত পোক্ত চালের ব্যবস্থা করা যেত। পশ্চিমবাংলার বেশ কিছু মানুষ ধসে যাওয়া দেওয়ালের তলায় পড়ে, উড়ে আসা চালের আঘাতে বেঘোরে মারা পড়তো না। 

এরাজ্যের শাষক একজন, নেতৃত্বে একজন, দল ও সরকার একজনের অঙ্গুলি হেলনেই চলে। পশ্চিমবাংলার মানুষ শাষকের দুঃশাষনের চাপে,  সর্বগ্রাসী দুর্নীতির চাপে দলিত, নিষ্পেষিত। তবে রাজ্য জুড়ে এই পাহাড় পরিমান দুর্নীতি না থাকলে আমপান ঝড় এতটা প্রাণঘাতী হতো না।বাংলার হাজার হাজার মানুষকে গৃহহীন, পথের ভিখিরী হতে হতো না। 

পশ্চিমবাংলার মানুষের ধারনা তৃণমূল দলের দুর্নীতিকে একটু লাগাম  পরানো গেলে লক্ষ লক্ষ গরীব মানুষের বাসস্থান গুলোর ভিত, দেওয়াল আর মাথার উপর চাল এত সহজে ধসে পড়তো না, এতগুলো মানুষের প্রাণ যেত না। পশ্চিম বাংলার মানুষের ক্ষোভ, ক্রোধ রাজ্য জুড়ে দেখা যাচ্ছে। কলকাতার রাস্তা থেকে গ্রামের পথে ঘাটে মাঠে ছড়িয়ে পড়ছে। তাদের চোখে আগুন আর গলায় হুঙ্কার। আজ তাদের দুর্দশার জন্য বাংলার জনগন শাষকের দুর্নীতিকেই প্রধান কারন হিসাবে দেখছে। এই ক্রোধ আর ক্ষোভের বহিপ্রকাশ হয়তো গনতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই হবে, পরের বছর, ২০২১শে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.