পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতির পতনের ইতিহাস : কিভাবে একটা রাজ্যের জিডিপি শেয়ার দেশের 40% থেকে 3% এ নেমে এলো – প্রথম পর্ব

( স্বাধীনতার সময় পশ্চিমবঙ্গ (West Bengal) দেশের 40% জিডিপি দিত l সারা দেশ থেকে মানুষ কলকাতায় আসতো নিজের ভাগ্য ফেরাতে l আজ 3% l দেশ যেখানে আজ উন্নতির শিখরে, সেখানে একটা রাজ্য কিভাবে পিছিয়ে গেল? 73 বছরের ইতিহাসের বিশ্লেষণ ও সংকট থেকে বেরিয়ে আসার উপায় নিয়ে ধারাবাহিক l )

বাংলা সম্ভবত একমাত্র রাজ্য যে স্বাধীনতাত্তর ভারতে প্রায় সর্ববিষয়ে বাকিদের তুলনায় পিছিয়ে পড়েছে l আর্থিক স্বাস্থ্য, শিল্প, পরিকাঠামো, গড় আয়, চাকরির সংখ্যা তথা মানে পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতের প্রায় সব রাজ্যের চেয়ে পিছিয়ে l প্রথম সারির মেধাবী এবং উদ্যোগী মানবসম্পদ রাজ্য ছাড়া l ব্যাঙ্গালোর থেকে ক্যালিফোর্নিয়া দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বাঙালী ইঞ্জিনিয়াররা l বাঙালী ডাক্তার ওয়াশিংটন থেকে টোকিও হয়ে দিল্লি তে রাজত্ব করছে l তার সঙ্গে নির্মাণশিল্পের শ্রমিক, দিল্লির রিকশাওয়ালা, বাসন মাজার লোকও পাঠাচ্ছে এই রাজ্যই l প্রভাব পড়েছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি ও ক্রীড়া ক্ষেত্রে l যে রাজ্য প্রথম IIT / IIM পেয়েছিল, সেই রাজ্যের আজ IIT খড়্গপুর বা IIM কলকাতার একটি ছেলের জন্যও যোগ্য চাকরি নেই l ব্র্যান্ড হিসেবে বাঙালির অবস্থা তলানিতে l একসময় ইউসুফ খান , বলরাজ দত্ত, বসন্তকুমার পাডুকোন, বেগম মুমতাজ জাহান, মেহজাবিন বানুর বলিউডে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে দিলীপ কুমার, সুনীল দত্ত, গুরু দত্ত, মধুবালা, মিনা কুমারী নাম নেন l অথচ রণিত বাসুরায় নিজেকে রণিত রয় বলছেন ( যদিও সাম্প্রতিক কালে ‘বোস রায় ‘ লেখেন ) l যে কলকাতায় একসময় সারা এশিয়া এমনকি ইউরোপ থেকে মানুষ আসতো পড়াশুনা করতে, সেই শহর আজ উচ্চমানের স্কুল শিক্ষার জন্য রাজস্থানী ( FIITJEE, AAKASH, ALLEN ) কিংবা তেলেগু ( নারায়ণ ও চৈতন্য স্কুল ) প্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভর করছে l একসময় হিন্দি সিনেমায় ডাক্তার বলতে বাঙালী দেখাত l অথচ, আজ বাঙালী ডাক্তার দেখাতে ভেলোর, চেন্নাই, ব্যাঙ্গালোর এমনকি ভুবনেশ্বর ( এইমস ) যাচ্ছে l

এই অধঃপতনের ব্যাখ্যা চাইলে বামপন্থীরা জহরলাল নেহেরু, দেশভাগ ও সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়কে প্রধান ভিলেন বানান l জ্যোতিবাবুকে ভিলেন ধরেন কংগ্রেস, তৃণমূল ও বিজেপি l সম্প্রতি তৃণমূল ভিলেন বানাচ্ছে সব অবাঙালিকে এবং এক আঞ্চলিকতাবাদের মধ্যে নিজের ব্যর্থতা ঢাকার চেষ্টা করছে l কিন্তু এতবড় বিপর্যয় ও ব্যর্থতার কারণ কি?

সবচেয়ে বড় যে ক্ষতি এই রাজ্যের হয়েছে, তা হল মেধা পাচার l যারা এখনো মাতৃভূমি আঁকড়ে পরে আছেন, তাদের জীবন এতো কঠিন যে সত্যি অনুসন্ধান করার ইচ্ছে বা উপায় তাঁদের নেই l সবাই তার নিজের রাজনৈতিক আনুগত্যকে ধারে রাখতে তার দলের মতের সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে চলে l কিন্তু ইতিহাস কি আবার ভুল লিখবে? সত্যের মুখোমুখি হওয়া যাক একবার l সত্য যদি না অনুসন্ধান না করি, তাহলে আগামী অনেক 34 বছর অপেক্ষা করতে হবে এই সমস্যার সমাধানের জন্য l অমিত মিত্রের (Amit Mitra) মতো একজন যোগ্য অর্থমন্ত্রী পাওয়ার পরও আমরা গত নয় বছরে একটি শিল্প আনতে পারিনি, মেধা পাচার রুখতে পারিনি l অবস্থা কতটা করুন হলে এই রাজ্যের মানুষ কাশ্মীরে আপেল কুড়োতে গিয়ে গুলি খায় ভাবা যায়? কোন মারাঠি না গুজরাটি যাবে কাশ্মীরে আপেল কুড়োতে? অমিত মিত্রের ব্যর্থতার কারণ, তার দলের ভুল দর্শন ও লক্ষ্যহীনতা l নরসিমা রাওয়ের নেতৃত্বে মনমোহন সিং দুর্দান্ত কাজ করে ইতিহাস তৈরি করলেন l আবার সেই মনমোহন সিং প্রধানমন্ত্রী হিসাবে অপদার্থতার ইতিহাস বানালেন l এর কারন নরসিমা রাও একজন দার্শনিক যিনি জানতেন সমস্যা কি এবং তার সমাধান l মনমোহন অন্যদিকে একজন শিক্ষিত মানুষ যার কারুনৈপুণ্য ( Craftsmanship ) আছে, কিন্তু ধীশক্তি ছিল না, দর্শন ছিল না, লক্ষ্য ছিল না l আর বাংলার পুনরুজ্জীবনের পরিকল্পনা স্থির করতে গেলে নিরপেক্ষভাবে এর ইতিহাস, মানুষের চরিত্র, সমাজ ব্যাবস্থা সত্যানুসন্ধান করতে হবে l যে শিল্প কানপুরবাসীকে সাফল্য দেবে, তা উত্তর কলকাতা, বালুরঘাট, বাঁকুড়া বা জলপাইগুড়ির যুবককে দেবে না l

দেশভাগের পর, ব্রিটিশ শাসন চলে গেলেও ব্রিটিশ মালিকানাধীন শিল্প ও বাণিজ্য শাস্ত্রীজির মৃত্যু পর্যন্ত কলকাতায় ছিল l নেহেরুকে যতই গালাগালি দি, উনি ভালোবেসে হোক বা দেশের অর্থব্যাবস্থাকে বাচাতে হোক, কলকাতার পাশে সম্পূর্ণ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন l প্রথম IIT, ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউট তথা IISWBM, IIM, বেশকিছু শিল্পনগরী তথা দুর্গাপুর, হলদিয়া, কল্যাণী, সল্টলেক, খড়্গপুর, একটি বন্দর তথা হলদিয়া, বেশ কিছু বড় জলপ্রকল্প তথা তিস্তা, জলঢাকা, ফারাক্কা, দামোদর, কংসাবতী বাংলার ভাগ্যে জোটে l পশ্চিমবঙ্গ এমনিতেই খনিজ সম্পদ ( Natural Resources ) ও জলসম্পদ ( Water Resources )সয়ংসম্পুর্ন ছিল l তার পরেও কেন্দ্র ঝুকি নিয়ে ও আন্তর্জাতিক নিয়ম ভেঙে তিস্তা ও ফারাক্কা ব্যারেজ বানিয়ে এই রাজ্যের জন্য অতিরিক্ত জলসম্পদ জোগাড় করেছে, বাংলাদেশকে বঞ্চিত করে l ফলে, শুধু মাসুল সমীকরণ দেখিয়ে কেন্দ্রের বঞ্চনার কুমির ছানা দেখিয়ে নিজের ব্যর্থতা ঢাকার চেষ্টা এবার বন্ধ করা উচিৎ l মাসুল সমীকরণ উঠেছে 27 বছর l এই 27 বছর ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য কম l প্রথম মেট্রো রেল ও কেবল সাসপেন্ডেড ব্রিজ পায় পশ্চিমবঙ্গ l কয়েক বছরেই বাঙালী দেশবিভাগের পীড়া থেকে বেরিয়ে উত্তম সুচিত্রার সিনেমাকে বাক্স অফিসে সুপারহিট বানিয়ে দিল l যাদবপুরকে বিশ্ববিদ্যালয় তকমা দিল কেন্দ্র l 1966 পর্যন্ত দক্ষিণ ভারত, পাঞ্জাব, বিহার, ওড়িশা, উত্তরপ্রদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ কলকাতায় এসে তাদের জীবিকা নির্বাহ করতো l শিবপুর, যাদবপুরের ছেলেরা তো বটেই পলিটেকনিক, ITI এর ছেলেরাও সবাই বাড়িতে বসে ভাত খেত ও সপ্তাহান্তে উত্তম সুচিত্রা ভানুদের সিনেমা l হঠাৎ 1967 এ যাদবপুর, শিবপুর, খড়্গপুরএর ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেল l ইঞ্জিনিয়াররা ব্যাংক, মিলিটারিতে যাওয়া শুরু করলো, কিংবা আমেরিকা l 1967 স্বাধীনতাত্তোর বাংলার ইতিহাসে সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বছর l কি ঘটলো এই বছর? কিভাবে এর দাম দিল বাঙালী? এতো কিছু দেবার বদলে 1966 থেকে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কি কেড়ে নিয়েছিলেন এই রাজ্য থেকে, যা এই রাজ্যের মেরুদন্ড পুরো ভেঙে দিল? শুধু কি প্রধানমন্ত্রী দ্বায়ী ছিলেন? নাকি আরও বড় ষড়যন্ত অপেক্ষা করছিল 1967 র বাংলার জন্য? আলোচনা হবে পরের সংখ্যায় l

( চলবে )

(লেখক বহুজাতিক পরামর্শদাতা সংস্থা URS কনসাল্টিং ইন্ডিয়ার ভূতপূর্ব চিফ জেনারেল ম্যানেজার)

সুদীপ্ত গুহ (Sudipta Guha)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.