ভারতবর্ষে জাতীয় ভাষা বলে কিছু হয় না। জাতীয় ফুল হয়, জাতীয় পশু হয়, এমনকী জাতীয় ক্লাবও হয় কিন্তু জাতীয় ভাষা নৈব নৈব চ। কারণ হলো ভারতবর্ষে ‘নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান’। এই বিবিধের মাঝেই ভারত মহান। তবে জাতীয় ভাষা না থাকলেও ভারতে সরকারি ভাষা রয়েছে। সর্বসাকুল্যে এই সরকারি ভাষার সংখ্যা ২২টি। বহুকাল ভারতে ইংরেজ উপনিবেশ ছিল। এই ঔপনিবেশিক মানসিকতা ত্যাগ না করতে পারার জন্যই আজও অধিকাংশ ভারতবাসীর কাছে ইংরেজিই প্রথম ভাষা। এর বাইরেও আঞ্চলিক ২১টি ভাষা রয়েছে। উত্তর-পূর্বে নাগাল্যান্ডে তাও, মেঘালয়ে খাসি, মিজোরামে মিজো, সিকিমে নেপালী, অরুণাচল প্রদেশে নিশি, মণিপুরে মণিপুরি, অসমে অসমীয়া, পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরায় এবং আন্দামান নিকোবরে বাংলা, দাদরা-নগর হাভেলিতে ভিলি; গুজরাট, দমন-দিউতে গুজরাটি; বিহার, চণ্ডীগড়, ছত্তিশগড়, দিল্লি, হরিয়ানা, হিমাচল প্রদেশ, ঝাড়খন্ড, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ উত্তরাখণ্ডে হিন্দি, কর্ণাটকে কন্নড়, জম্মু-কাশ্মীরে কাশ্মীরি, গোয়ায় কোঙ্কনি, কেরলে মালয়ালম, ওড়িশায় ওড়িশি, পঞ্জাবে পঞ্জাবি, তামিলনাড়ুতে তামিল ভাষা সরকারি ভাষার মর্যাদা পেয়েছে। অর্থাৎ নিয়মানুসারে সরকারি কাজও এখানে নির্দিষ্ট আঞ্চলিক ভাষায় সম্পন্ন হতে পারে যদিও কার্যক্ষেত্রে অনেকসময়ই তা হয় না।
এখানে হিন্দির গুরুত্বটা তবে কোথায় ? উপরের তালিকাতেই স্পষ্ট ভারতবর্ষের একটি বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষ হিন্দি ভাষাভাষী যা পরিসংখ্যান অনুযায়ী গোটা দেশের এক চতুর্থাংশ মানুষ অর্থাৎ ২৫ শতাংশ লোকই হিন্দিভাষী, এলাকার হিসেবে ধরলে ৪৪ শতাংশ ভারতবাসী হিন্দি সরকারি ভাষা-অঞ্চলে থাকে চলতি কথায় হিন্দি-বলয় বলা যেতে পারে, সেখানে বাস করেন। স্বাভাবিকভাবেই অন্যান্য সরকারি ভাষার চেয়ে হিন্দি বেশি বলবান। তাই ইংরেজি ভাষার পরে হিন্দির প্রচলনই সবচেয়ে বেশি, সরকারি ও বেসরকারি কাজে। সংসদের কাজকর্মও তাই হিন্দিতে হয়। ঔপনিবেশিক ভাষাকে সরিয়ে দেশীয় ভাষাকে তার জায়গা দিতে গেলে হিন্দিকে স্বাভাবিকভাবেই প্রাধান্য দিতে হবে। সেই কারণেই কেন্দ্র সরকার তার নয়া খসড়া শিক্ষা-নীতিতে হিন্দিকে গুরুত্ব দিয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত হিন্দিকে আবশ্যিক করতে চেয়েছিল। আপাতত ঐচ্ছিক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এতে আঞ্চলিক ভাষার গুরুত্ব বিন্দুমাত্র কমবে না। কিন্তু ছাত্র-ছাত্রীরা ইংরেজির সঙ্গে হিন্দিতেও পারদর্শী হয়ে উঠলে, তাদের কেরিয়ারেও তারা উপকৃত হবে, এই মাত্র। এই ধরনের কেরিয়ারিস্টিক অ্যাপ্রোচে বাধা দিলে পরিণাম কতটা ভয়াবহ হয়, বাম আমলে প্রাথমিকে ইংরেজি উচ্ছেদেই তার প্রমাণ। ২১টি ভারতীয় ভাষা সরকারি মর্যাদা পেলেও আরও বহু ভারতীয় ভাষা-উপভাষা রয়েছে, এমনকী আন্দামান নিকোবরের মতো জায়গায় যেখানে বাঙ্গালিদের সঙ্গে সমসংখ্যক তামিলভাষীও বাস করেন, সেখানে একটি ভাষাকে বেছে নিয়ে সরকারি স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে যেমন বাঙ্গলাকে। এতে তামিলের গুরুত্ব কোনওভাবেই হ্রাস পায়নি আন্দামানে। ফলে বৈশ্বিকীকরণের যুগে ভারতবর্ষে ভারতায়নের সুযোগ ঘটেছে, বাঙ্গলার বাইরে সুদূর তামিলেও যেমন বাঙ্গলাভাষী এলাকা গড়ে উঠতে পারে, দক্ষিণ ভারতীয়রাও বাঙ্গলায় জাঁকিয়ে বসতে পারেন, এই পরম্পরা বহুদিন ধরেই চলেছে।
মুম্বইতে একবার বিহারী খেদাওয়ের ডাক উঠেছিল, ‘আমচি মুম্বই’বাসীই তাদের শুভবুদ্ধি দিয়ে তা প্রতিহত করেন। হিন্দি ভাষায় সর্বমান্যতা নিয়ে স্বাধীনতার পরই দক্ষিণভারতে বিশেষত তামিলনাড়ুতে প্রশ্ন উঠেছিল। আজ সেখানকার বহু মানুষ হিন্দির মাধ্যমে সর্বভারতীয় স্তরে সংযোগ স্থাপন করেন। এমকে স্ট্যালিনের মতো নেতারা স্কুলে হিন্দি আবশ্যিক করার যে বিরোধিতা করছেন তা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এটা সবাই বোঝে। এই স্ট্যালিন নির্বাচনের ফল ঘোষণার আগেই রাহুল গান্ধীকে প্রধানমন্ত্রীর সিংহাসনে বসিয়ে দিয়েছিল।
আসলে গণ্ডগোলটা অন্যত্র, হিন্দির বানানে, ই-কার সরিয়ে উ-কার বসালেই হিন্দু। এতকাল নেহরুবাদী মৌরসীপাট্টায় হিন্দুদের ‘সেকুলার’ বলা হতো, মোদী-অমিত শাহ এসে সেই মৌরসীপাট্টার ঘুঘুর বাসা ভেঙে দিয়েছেন, এমন কী ‘লেফট-লিবারাল’ বাংলা (তা সে বাম আমলই হোক, বা তৃণমূল এদের ছদ্মবেশ বাঙ্গালি চিনে নিয়েছে এতদিনে)-য়ও সেই ঘুঘুরা এতদিনে ফাঁদে পড়েছেন, ফলে নিতান্ত একটি ‘কেরিয়ারিস্টিক অ্যাপ্রোচ’-কে কেন্দ্র করে জাতি-দাঙ্গা পরিস্থিতি বাঁধিয়ে গৃহযুদ্ধের পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। কারণ ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে মুসলমান তোষণকারী বা যে গোরু দুধ দেয় তার পদাঘাত সহ্য-কারী নেত্রী দেখে নিয়েছেন ৩০ শতাংশের দুধ আর তার ক্ষমতা-কায়েমের পক্ষে উপযোগী নয়, বাকি ৭০ শতাংশের মধ্যে কিছু ‘লেফট লিবারাল’ বাদ দিলে বাকিদের সমর্থনও পাওয়া দরকার যেটা ২০১৯-তে জোটেইনি, ২০২১-এও আর জুটবে না। তাই তাকে দেখতে হচ্ছে তারই ‘খেয়ে-পরে’ কীভাবে হিন্দুরা আঞ্চলিকতা, প্রাদেশিকতা আর ভাষাগত সংকীর্ণতা উপেক্ষা করে এককাট্টা হচ্ছে— এই হিন্দু-ফোবিয়া থেকে পালাতে হিন্দি-ফোবিয়ার আশ্রয় না নিয়ে নবান্ন যে অচিরেই তাকে আশ্রয় ছাড়া করবে, তার থেকে ভালো আর কেইবা বোঝেন। তাই বাঙ্গালি সেন্টিমেন্টের দোহাই দিয়ে বাঙ্গলার মানুষকে তিনি বোকা বানাতে চাইছেন। কিন্তু বাঙ্গালি জানে ভারতবর্ষের জাতীয় সংগীত আর জাতীয় স্তোত্র দুটিই বাঙ্গালি-রচিত, বাঙ্গলার ‘মাতৃ ভাষা’ সংস্কৃত থেকে উৎসারিত। আরবীয় সংস্কৃতির দালালি আসলে এই জাতীয়তাকে আঘাত করার জন্যই, এটা সচেতন বাঙ্গালি বুঝে গিয়েছেন।
বিশ্বামিত্র
2019-06-06