নতুন ভারত গড়তে অর্থনীতিতে প্রয়োজন যুগোপযোগী আরও সংস্কার

অর্থনীতিতে বড়োসড়ো পরিবর্তন আনার যে সংস্কারগুলি বাজপেয়ী জমানায় শুরু হয়েছিল তারা ২০০৪ সালে প্রবল সম্ভাবনা ও ফলদায়ী হয়ে ওঠার ইঙ্গিত দেওয়ার সময়ই অপ্রত্যাশিতভাবে বাজপেয়ী সরকার ভোটে হেরে যায়। বিকল্প হিসেবে ইউপিএ সরকার ক্ষমতায় আসতেই যাবতীয় সংস্কার প্রক্রিয়া থমকে দাঁড়াল। এর পর আবার ইউপিএ-২ সরকার ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের পর অর্থনীতির গঠনমূলক বৃদ্ধির পরিপন্থী এমন কতকগুলি ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করল যা ইন্দিরা গান্ধী জমানার কথা মনে পড়ায়।
২০১৪-য় নরেন্দ্র মোদী এনডিএ সরকার গঠনের পর অর্থনীতি আবার সময়োপযোগী সংস্কার অভিমুখী হলো। সরকার তিনটি অতি প্রয়োজনীয় সংস্কারের সাহস দেখাল। কেননা এগুলি অর্থনীতির পুষ্টিকরণে সহায়ক হলেও রাজনীতিগত ভাবে বেশ কঠিন। (১) Insolvency Bankruptcy Code, (২) GST, (৩) Dircet Benefit Transfer (নির্দিষ্ট ব্যক্তির ব্যাঙ্ক খাতায় তার প্রাপ্য চলে যাওয়া)। একই সঙ্গে পরিকাঠামো উন্নয়নের ক্ষেত্রেও সরকার জোর দেয়। এরই ফলস্বরূপ ইউপিএ-র শেষ দু’বছরে গড়ে ৫.৯ শতাংশ অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হারকে পেছনে ফেলে বর্তমান সরকার বিগত পাঁচ বছরে বৃদ্ধির হারকে গড়ে ৭.৫ শতাংশে টেনে নিয়ে গেছে।
ভারতের নির্বাচকমণ্ডলী আবার ২০১৪-র মতনই বিপুল সমর্থন দিয়ে নরেন্দ্র মোদীকে ক্ষমতায় এনেছে। নিজেদের মনোমত ও আত্মতৃপ্তিদায়ক কিছু হিসেব-নিকেশের ভিত্তিতে মিডিয়ার পণ্ডিতরা অবশ্য সম্ভাব্য ত্রিশঙ্কু সংসদের তত্ত্ব খাড়া করছিলেন। এই হিসেবের। মূলে ছিল জাতপাত, ধর্ম ও বিশেষ অঞ্চল ভিত্তিক নানান জটিল ভোটের হিসেব নিকেশ। কিন্তু আপামর সাধারণ ভারতবাসী এই ধরনের কূট-কাচালি বানচাল করে। তাদের ভাগ্যের ও দেশের ভবিষ্যত নির্মাণের ভার নরেন্দ্র মোদীর হাতেই নিশ্চিন্তে সঁপে দিয়েছেন।
২০২৪ সালে যে এই ধরনের ফলাফল হতে পারে এমন আশা করা আদৌ যুক্তিসঙ্গত নয়। সেই কারণে আগামী পাঁচ বছর সরকারের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই অন্তবর্তী বছরগুলিতেই দরকার যে কাজ করবে তার ওপর নির্ভর করবে তার ভাগ্য। প্রথমেই জোর দিতে হবে আমলাতান্ত্রিকতার কাদা আর বালির পাহাড়ে আটকে পড়া অর্থনীতির চাকাকে ওঠানোর। দু’ অঙ্কের জিএসটি বৃদ্ধি সম্ভব করতে গেলে এটি আবশ্যিক শর্ত।
তা এটা কি করে সম্ভব হবে? মনে রাখতে হবে একটি প্রধান আপ্তবাক্য যে বেসরকারি পুঁজিপতিরাই অর্থনীতির যথার্থ চালিকাশক্তি। সরকার কখনই নয়। আমাদের দেশে সকলের মধ্যেই অল্পবিস্তর একটা বদ্ধমূল ধারনা আছে যে যা কিছু জনগণের সরকার তার সবকিছুই সরকার করে দেবে। আর ভাগ্যের পরিহাসে আমাদের সরকারি আমলারাও এমনটা ভাবতে ভালোবাসেন যে কেবল তারাই পারেন দেশের যে কোনো সমস্যার সমাধান করতে।
এই ধারনা ও ব্যবস্থায় পরিবর্তন সর্বাপেক্ষা জরুরি। সরকার দেশে বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার সহায়ক একটি পরিমণ্ডল তৈরি করে দেবে। এই কাজটা করতে দেশের আইন, কানুন, পরিচালন পদ্ধতি প্রতিটি ক্ষেত্রেই সময়োপযোগী পরিবর্তন আনা সরকারের কর্তব্য। এমন পরিবেশ তৈরি করে দেওয়ার পর উদ্যোগপতিদের কাজই হবে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় গতি আনা। নতুন উদ্যোগ তৈরি করা, যাতে দ্রুত চাকরি তৈরি হয়। বলা দরকার যে সমস্ত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা উৎপাদন প্রক্রিয়া দেশের মানুষের সরাসরি কোনো কাজে লাগে না তা থেকে সরকারকে বেরিয়ে আসতে হবে।
অবশ্যই, ব্যবসায়িক উদ্যোগের কোনটা প্রত্যক্ষ সরকারি নিয়ন্ত্রণে থাকবে কোনটা বেসরকারী মালিকানার অধীনে যাবে তা নির্ধারণ করতে ব্যাপক ও কঠিন সংস্কার প্রক্রিয়া গ্রহণ করা জরুরি এত বড়ো ধরণের সংস্কার কি পাঁচ বছরের সময়সীমায় করা যাবে?
মোদী সরকারের প্রথম পাঁচ বছরে প্রশাসনিক ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী তার নিজের নিদের্শ ও নজরদারির মাধ্যমে আমলাদের ওপর প্রয়োজন মাফিক সীমিত নির্ভরতার মাধ্যমে একটি সফল মডেল তৈরি করতে সক্ষম হন। এক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল বিভিন্ন দপ্তরে কয়েকজন সচিবকে নিয়ে এক একটি গ্রুপ তৈরি করা। তাদের ওপর প্রজেক্ট তৈরি করার, তার সফল রূপায়ণের পথনির্দেশ করার ভার দিয়ে অর্থনীতির নানা গুরত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে সেগুলিকে প্রত্যক্ষ সাফল্যের সঙ্গে প্রয়োগ করানোর। সবচেয়ে চমকপ্রদ বিষয় হচ্ছে আমলারা প্রজেক্টগুলির প্রেজেন্টেশন তৈরি করার পর প্রধানমন্ত্রী নিজে তার সমগ্র মন্ত্রীসভা সমেত এই ধরনের প্রকল্পগুলির ফলিত সাফল্য নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করতেন। এই দীর্ঘ চর্চার পর বিষয়গুলি চূড়ান্ত হয়ে গেলে পরের বছর যে যে ক্ষেত্রগুলির জন্য প্রকল্প চিহ্নিত হয়েছে। সেখানেই এগুলির বাস্তব রূপায়ণ হতো।
এই ধরনের কাজের ধারার বড়ো সুবিধে হচ্ছে যে আমলারা উপলব্ধি করতে পারে যে, তারা মন্ত্রীদের সঙ্গে যৌথভাবে প্রকল্পগুলির দায়িত্বভার বহন করছেন। এগুলির সফল রূপায়নের ক্ষেত্রেও তারা তাই নিষ্ঠাভরে এগুলির সাফল্য নিশ্চিত করার চেষ্টা করত। কিন্তু রেডিকাল রিফর্মস্ বা খোলনলচে পাল্টানো চরিত্রের সংস্কার কার্যকর করার ক্ষেত্রে একটা অসুবিধেও আছে। আমলারা চরিত্রগতভাবে সাবধানি তারা নানাবিধ প্রকল্প ও সাধারণ উদ্যোগ। ইত্যাদির মধ্যেই কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। কিন্তু তারা যখন কোনো নীতিগত পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয় তা সাধারণত হয়। আংশিক বা পুরনোটির ওপর কিছুটা ঘষামাজা মাত্র।
বড়ো ধরনের সংস্কারের ক্ষেত্রে আমরা একটু অন্যরকমের প্রকরণের রাস্তা বলছি। প্রাথমিকভাবে সরকার অন্তত আধ ডজন বিশেষ ক্ষেত্রকে চিহ্নিত করুক যেখানে মৌলিক সংস্কার করা হবে। এগুলি হওয়া উচিত শ্রম আইন, জমি আইন, উচ্চশিক্ষা, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, বিলগ্নীকরণ, ব্যাঙ্কিং সংস্কার ও কেন্দ্র পরিচালিত সর্বভারতীয় প্রকল্পের ক্ষেত্রে। এই প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই এই সংক্রান্ত বিষয়ের ওপর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ও স্বচ্ছ ধারণা রয়েছে এমন একজন আমলাকে মাথায় বসিয়ে একটি সময় বেঁধে দিতে হবে। দু’ মাসের সময়সীমার মধ্যেই প্রত্যেকটি ক্ষেত্রের প্রধানরা নিজের নিজের ক্ষেত্রের নির্দিষ্ট রোড ম্যাপ তৈরি করে যাতে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের মৌলিক সংস্কার নির্দিষ্ট সময়ে কার্যকরী করা যায় তার দিশা দেখাবেন।
প্রধানমন্ত্রী অবশ্যই এই প্রকল্পগুলি যাতে গতি পায় তার জন্য নিয়ম করে তদারকি করবেন। মাঝে মাঝেই কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে রিপোর্ট নেবেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে প্রত্যেকটি প্রকল্পের প্রধানদের যেন সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে তাদের কাজের ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি হলে বা চটজলদি পরিবর্তন জরুরি হয়ে পড়লে তা দ্রুত একের সঙ্গে এক’ হিসেবে বিনিময় করার সুযোগ থাকে। আমাদের আমলাতান্ত্রিক কাঠামোয় কোনো দপ্তর, অধিকর্তা বা বিভিন্ন মন্ত্রকের কাছ থেকে বহু সময়ই ‘রোড বল্ক’ খাড়া হয়ে যায়।
প্রত্যেক প্রকল্প প্রধানের উপদেষ্টা হিসেবে থাকবেন যে বিষয়ে কাজের পরিকল্পনা করা হচ্ছে সেই সংক্রান্ত নিবিড় জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার অধিকারী একজন বিশেষজ্ঞ। এক্ষেত্রে তরুণ ও প্রতিভাবান একদল পেশাদারকে বিভিন্ন প্রকল্প প্রধান ও তার উপদেষ্টাকে সাহায্যের জন্য নিয়োগ করা যেতে পারে। নীতি আয়োগ ও রাষ্ট্রীয় উচ্চতর শিক্ষা অভিযানের ক্ষেত্রে সম্প্রতি আমলাতন্ত্রের বাধ্যবাধকতার সঙ্গে সম্পর্কহীন তরুণ পেশাদারদের একটি দল চমৎকার কাজ করেছে। এরা বিভিন্ন মন্ত্রক ও প্রকল্প প্রধানদের মধ্যে সেতুর কাজ করে দ্রুততার সঙ্গে প্রকল্পের রূপরেখা চূড়ান্ত করেছিল।
প্রত্যেক প্রকল্প প্রধানের অধীনে এ সংক্রান্ত নির্দিষ্ট বাজেটের টাকার পূর্ব অনুমোদন থাকা উচিত। সেই টাকা তিনি যেন স্বাধীনভাবে প্রয়োজনানুযায়ী খরচ করতে পারেন। প্রত্যেকটি খুঁটিনাটি খরচের ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত বারবার অধিকর্তার কাছ থেকে অর্থ দপ্তরের অনুমোদন নেওয়ার বদলে এই কাজ সংক্রান্ত অর্থনৈতিক আগাম তিন মাসের সম্ভাব্য খরচের অনুমোদন আগেই করিয়ে রাখতে হবে। যাতে অযথা সময় না নষ্ট হয়।
আজ অবধি লাগু থাকা প্রশাসনিক ক্ষেত্রকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা আমলাতান্ত্রিক আইন কানুনের সীমানা অতিক্রম করে আমাদের কাজ করতে হবে। আমাদের প্রবীণ আধিকারিকদের সততার ওপর পূর্ণ বিশ্বাস ন্যস্ত করতে হবে। যে নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত কাজগুলি দেশহিতে দ্রুত রূপায়নের জন্য হাতে নেওয়া হবে তা সফল করার ক্ষেত্রে আরও যে ধরনের স্বাধীনতার প্রকল্প প্রয়োজন হতে পারে তার নিশ্চয়তা যোগানোর ওপরই প্রকল্পের দ্রুত সাফল্য নির্ভর করবে।
অরবিন্দ পানাগড়িয়া
(লেখক প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.