মাস খানেক আগে একটি চিঠি পাই। আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন এক সৎ ব্যক্তিত্ব-সম্পন্ন অবসর প্রাপ্ত ইতিহাসের অধ্যাপকের লেখা চিঠি। চিঠি না বলে প্রতিলিপি বলা ভালো। বোঝা যায় এরকম অনেককেই পাঠিয়েছেন। বিগত অর্ধশতক ধরে বাংলার বুদ্ধিজীবী মহলে কি রকম দলাদলি – পারস্পরিক ঈর্ষা আর আধিপত্যবাদী মানসিকতা চলত, তার একটি উদাহরণ এই চিঠি ।
ইন্সটিটিউশন অফ হিস্টরিক্যাল স্টাডিজ – এর স্থাপক ড. শিবপদ সেনের উদার মনের পরিচয় দিয়েছেন পত্র লেখক। তিনি পরিচয় না থাকা সত্ত্বেও সম্পাদিত ‘ কোয়ার্টার্লি রিভিউ অফ হিস্টরিকাল স্টাডিজ’ পত্রিকায় তাঁর প্রবন্ধ ছাপিয়েছিলেন। মানুষটি অন্য মতের গবেষকদের লেখা নির্দ্বিধায় ছাপাতেন। তাঁর অধীনে গবেষণা করে পি-এইচ-ডি উপাধি পান মার্কসবাদী শিক্ষাবিদ সুমিত সরকার। উক্ত পত্রের লেখক, মাননীয় অধ্যাপকের নাম নিচ্ছি না। বস্তুত এই সব মার্কসবাদীদের দল পরতন্ত্র মানসিকতা সর্বজন বিদিত। এঁরা কংগ্রেস শাসিত পর্বে শিক্ষা ক্ষেত্রে দন্ড মুন্ডের কর্তা ছিলেন। কংগ্রেস আমলে শিক্ষা ও সংস্কৃতির শতকরা নব্বইটি পদ ছিল এদের হাতের মুঠোয়। পশ্চিম বঙ্গে বাম শাসনে বিষয়টি জঘন্য চেহারা নেয়। উক্ত অধ্যাপক এই চক্রের দ্বারা পিষ্ট হয়েছেন। এই চিঠিখানা তার প্রমাণ।
গত শতকের ৭০ ও ৮০ এর দশকে বরুণ দে নামক এক ব্যক্তি বাংলার বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে কর্তালি করেছেন। তাঁর বহু সমর্থক ছিলেন। উক্ত সুমিত সরকার, বিহারের সুরেন্দ্র গোপাল, গৌতম চট্টোপাধ্যায় প্রভৃতি ছিলেন বরুণ বাবুর অনুগত। সকল পশ্চিমবঙ্গে, দেশের অন্যত্রও এঁরা প্রচুর অকর্ম করেছেন। এঁরা ওই নির্বিরোধ ড. শিবপদ সেনকে মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সি.আই.এ এর চর বলে প্রচার করতে থাকেন। সুমিত বাবু ছিলেন সেই মিথ্যা প্রচারকের দলে প্রথম সারিতে। মাত্র ৬২ বছর বয়সে ড. সেনের মৃত্যু ঘটে। এই পত্রে উক্ত অধ্যাপক লিখেছেন: ‘ড. সেনের অকাল মৃত্যুর জন্য বরুণ দে, সুমিত সরকার, গৌতম চট্টোপাধ্যায়রা দায়ী’। একথার সত্য মিথ্যা বিচার আমরা করতে বসি নি। আমরা দেখাতে চাইছি এইসব বিচিত্র আক্রমণাত্মক বুদ্ধিজীবীদের ঘেরাটোপে কেমন করে আমাদের দেশের বিদ্যাঙ্গন কলুষিত হয়েছে।
বাম আমলে কথা চালু হয়ছিল রাজ্যে উপাচার্য স্থির হয় নন্দনের ফুটপাথে । সে সময় জীবনে একদিনও স্নাতকোত্তর স্তরে পড়ানোর অভিজ্ঞতা না থাকলেও রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হয়ে যেতেন শুধুমাত্র দলীয় আনুগত্যের কারণে। আনুগত্য প্রকাশের জন্য কেউ কেউ বামপন্থীদের হয়ে ভোটে দাঁড়িয়ে যেতেন । নতুন শাসক এসেছে এখনও একই ঐতিহ্য সমানে চলছে। একটু পার্থক্য আছে। বাম আমলে শিক্ষা ক্ষেত্রে শাসন করতেন যারা তারা অন্তত শিক্ষিত হতেন। নতুন পরিবর্তনের আমলে দেখা গেল দামাল তাজা তাজা নেতারা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তালি করার আসনগুলি অলংকৃত করতে থাকল। কংগ্রেস আমলে বিভিন্ন কমিটিতে নির্বাচিত হতেন বামপন্থীরা তাদের ইতিহাস নির্মাণে মুসলমানরা আক্রমণকারী – লুন্ঠনকারী- নারী লাঞ্ছনাকারী ও মঠ-মন্দির ধ্বংসকারী নয় – তারা মহা মানবিক। এখন তৃণমূল কংগ্রেসের আমলে তৃণমূলীভবন ঘটেছে – সব বাম রাজনৈতিক বুদ্ধিজীবীরা জার্সি বদল করেছেন। যারা বাম রাজত্বেও সাহস করে আপত্তি জানিয়েছেন – তাদের সম্মান বজায় রেখে কাজ চালাতে পারেন নি।
এসেছে আরেক প্রবণতা । আমাদের ঐতিহ্যশালী উচ্চবিদ্যাচর্চা ক্ষেত্রগুলি দখল হয়ে গেছে ঘাস-ফুলে পরিণত বামপন্থীদের দ্বারা । তারা কেউ কেউ আগের মতই যোগ্য। ত্রিপুরা ত্থেকে এসে বাম-রাজনীতি করতে করতে ‘পরিবর্তিত’ বুদ্ধিমান মানুষ হয়ে গেলেন এস.এস.সি চেয়ারম্যান। তারপর হয়ত উপাচার্য ।
অযোগ্যদের উচ্চাসনে বসানোর চেয়ে ভয়ঙ্কর যোগ্যদের সম্মান থেকে বঞ্চিত করা। শুধু মাত্র দৃষ্টিকোণ জাতীয়তাবাদী হওয়ায় স্যর যদুনাথ সরকার, রমেশচন্দ্র মজুমদারকে প্রান্তিক করেছেন এই সব দুষ্টদের চক্র। উক্ত চিঠির শেষে শ্রদ্ধেয় ঐতিহাসিক লিখেছেন- “ এরা যদুনাথ সরকারকে ঐতিহাসিক মনে করে না। নির্লজ্জের মত তাঁর বাড়িটা দখল করে বসে আছে”। এরকম অন্যায় অনাচার আজ শিক্ষা ক্ষেত্রে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে । এখানে কোন পরিবর্তন হয় নি।