বাঙালির জীবনে অন্যতম উৎসব হালখাতা৷ যদিও নববর্ষে দিনে অর্থনীতিকে ভিত্তি করা বাংলায় এই উৎসবের এখন আর সে জৌলুশ নেই৷ বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়ার পাশাপাশি ১এপ্রিল থেকে অর্থবর্ষের বাধ্যবাধকতা পয়েলা বৈশাখের উৎসবের গুরুত্ব কমিয়েছে৷একইসঙ্গে কম্পিউটারের প্রসারে প্রচলিত হিসাবরক্ষার লালরঙের সেই হাল খাতা প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে৷
তবু এতদিনের প্রথা মেনে বেশ কিছু জায়গায় এবার হবে হালখাতা৷পুরনো বছরের সকল কিছুকে বিদায় জানিয়ে নতুন বছরকে মানুষ বরণ করে নেয়। তেমনি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান পুরোন বছরের সকল দেনা-পাওনা পরিশোধ করে পুরাতন বছরের হিসাবের খাতা বন্ধ করে নতুন বছরের হিসাবের খাতা খুলতেই “হালখাতা” উৎসব । এদিন ব্যবসায়ীরা তাদের খদ্দেরদের নিমন্ত্রণ জানিয়ে মিস্টিমুখ করানোর পাশাপশি নতুন বছরের লেনদেন শুরু করা হয়৷
শোনা যায় আগেকার দিনে ব্যবসায়ীরা একটিমাত্র মোটা খাতায় তাদের যাবতীয় হিসাব লিখে রাখতেন। বৈশাখের প্রথম দিনে এই খাতাটি হালনাগাদ করা হতো। তবে এই উৎসব শুধুমাত্র ব্যবসায়ীদের এমনটা ভাবাও ঠিক নয়৷ কারণ এক সময় এই উৎসবটি পালন করা হতো আর্তব উৎসব বা ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে। এর আসল উদ্দেশ্য ছিল কৃষিকাজের সাথে যুক্ত ব্যক্তিদের নিকট থেকে কর আদায় করা।
যা পরবর্তীকালে ব্যবসায়ীদের “হালখাতা” রূপান্তরিত হয়েছে। আধুনিক যুগ শুরু হওয়ার পূর্বে আর্তব উৎসব পালনের সময়ে ঋতুর উপর নির্ভর করে কৃষকরা হিসাব করতেন। সেসময় ভারতবর্ষে মোগল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর আরবি পঞ্জিকা অনুসারে বিভিন্ন কৃষিজ পণ্যের খাজনা আদায় করা হতো। আরবি পঞ্জিকা অনুযায়ী আরবি সন চাঁদের ওপর ভিত্তি করে গণনা করা হতো। কৃষি ফলনের সঙ্গে অমিল হওয়ায় সরকাররা কৃষকদের বাধ্য করত তাদের কথামতো খাজনা দিতে। মোগল সম্রাট আকবরের দৃষ্টিতে তা অমানবিক ও অবিচার হিসেবে মনে হয়।
তিনি সুষ্ঠুভাবে খাজনা আদায়ের নিমিত্তে বাংলা সনের প্রবর্তন করেন এবং প্রাচীন পঞ্জিকা সংস্কারের আদেশ দেন। তার আদেশ অনুসারে তৎকালীন বাংলার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতেহউল্লাহ সিরাজি সৌর সন ও আরবি সনের ওপর ভিত্তি করে বাংলা সন প্রবর্তন করেন। ইতিহাস মতে ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের (আনুমানিক) ১০ ও ১১ মার্চ থেকে বাংলা সনের গননা শুরু হয়। সম্রাট আকবরের সময়ে এই গণনা পদ্ধতি প্রচলিত হয় এবং সে সময় এই পদ্ধতির নাম ছিল ফসলি সন।
পরবর্তী কালে এটিকে বাংলা সন বলে নামকরণ করা হয় ৷ তখন থেকেই ১লা বৈশাখ উদযাপন শুরু হয়। তখন খাজনা, মাশুল, শুল্ক পরিশোধ করা হতো চৈত্র মাসের শেষ দিনে। জমির মালিকগণ এসকল খাজনা, মাশুল, শুল্ক গ্রহণ করতেন। একটি খাতায় এসকল খাজনা, মাসুল ও শুল্ক পরিশোধকারীদের নাম লিখে রাখা হতো। সেই খাতাতেই হালনাগাদ হিসাব তুলে রাখা হতো। আজকের আধুনিক “হালখাতা” সেকালের সেই খাজনা, শুল্ক ও কর পরিশোধকারীদের নাম লিখে রাখার খাতার বর্তমান সংস্করণ বলে ধরা হয়। সেসময় জমির মালিকরা এই দিনে কৃষকদের মিষ্টি মুখ করাতেন যা বর্তমানেও প্রচলিত রয়েছে। তাই বাঙালির অর্থনৈতিক জীবনের এটি উৎসব হলেও একে পুরোপুরি ব্যবসাভিত্তিক উৎসব বলে ধরা উচিত নয়৷ ব্যবসার পাশাপাশি এই উৎসব কৃষিভিত্তিক বলে মনে করা হয়৷
এই দিনে সিদ্ধিদাতা গণেশ ও বিত্তের দেবী লক্ষ্মীর পূজা হয়ে থাকে। সারাটি বছর যেন আজকের দিনের মতো নগদ আয় হয় সেই প্রত্যাশায় এই পূজা হয়। দেবতার চরণে দেওয়া সিদুর ও চন্দন নতুন বছরের খাতায় লাগিয়ে তারা নতুনভাবে হিসাব শুরু করতেন। কিন্তু কয়েক বছর আগেও যারা ১লা বৈশাখকে ভিত্তি করে সারা বছরের লেনদেনের হিসাব রাখতেন তাঁরাই এখন ১এপ্রিল থেকে ৩১ মার্চকে বছর ধরে আয় ব্যয়ের হিসাব রাখেন৷কারণ এই নির্দেশিত সময়ের ভিত্তিতেই তো আয়কর দিতে হয় এখন৷কোনও রকম ঋণ পেতে হলেও ১এপ্রিল থেকে বছর শুরু ধরে নিয়ে আয় ব্যয়ের হিসাব দাখিল করতে হয়৷
তাই কেউ কেউ এখন এপ্রিলের প্রথম দিনেও লক্ষ্মী গণেশের পুজা সারছেন৷ তবু বাঙালির ঐতিহ্য বজায় রাখতে এখনও অনেকে পয়লা বৈশাখে হালখাতার অনুষ্ঠান চালিয়ে যাচ্ছেন৷ নববর্ষের দিনে কালীঘাট কিংবা দক্ষিণশ্বরে লম্বা লাইন পড়ছে লালরঙের খাতাটির পুজো সারার জন্য৷কম্পিউটারের জন্য যার এখন কোনও অস্তিত্ব নেই সেটাকেই যেন খোঁজার চেষ্টা চলে৷ বাঙালিআনা বজায় রাখতে ব্যবসায়ীর দোকান বা অফিসে লক্ষ্মী গণেশের পুজোও চলছে৷ তবে একটা প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে প্রযুক্তি এবং অর্থনীতি চাপ সামলে বাঙালির জীবনে হালখাতা কতদিন বজায় থাকবে৷