আঠাশে জুন, দুপুর ১২টা নাগাদ তৃপ্তিদির ফোন এল। তৃপ্তিদি বিদ্যার্থী পরিষদের পুরোনো কার্যকর্তা। এখন সল্টলেক আমরি হাসপাতালে আছেন। তপনদার মনে হচ্ছে কোভিড পজিটিভ! শুনেই তপনদাকে ফোন করলাম। আমি কিছু প্রশ্ন করার আগেই বললেন, “রিপোর্ট এখনও আসেনি, এলেই তোমাকে জানাচ্ছি।” তপনদা জানানোর আগেই জেনে গেলাম, রিপোর্ট পজিটিভ। তপনদার ইচ্ছে আমরিতেই ভর্তি হবেন। কিন্তু ওরা বলছে বেড নেই, একবার মালিকপক্ষের কেউ বা সিনিয়র ডাক্তাররা বলে দিলে যদি হয়। এর জন্য কোভিড টেস্ট রিপোর্ট লাগে। একজন অসুস্থ রোগীকে ফোন করব? ভেবেচিন্তে তপনদার জামাইবাবু শ্যামলদা, মানে শ্যামল পাঁজাকে ফোন করলাম। কিন্তু, হোয়াটস্যাপটা তপনদা নিজেই পাঠালেন। ফোনও করলেন, “টেস্টের আগের দিনের প্রেস্ক্রিপশনটা পাঠিয়েছি, দেখে নাও।” দেখলাম সেই সঙ্গে কোন হাসপাতালে কত বেড খালি আছে, তার একটা তালিকাও তপনদা পাঠিয়েছেন। চেষ্টা শুরু হল। আমরির ডাক্তারবাবু এনকে সিং টেস্ট রিপোর্ট নিয়ে তদারকি শুরু করলেন। মালিকপক্ষের কাছে অনুরোধও পোঁছল। একটু পরেই অবশ্য শ্যামলদার ফোন এল, মেডিকাতে ভর্তির ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছে, অনলাইন পেমেন্টও করা হয়েছে। ওরা অ্যাম্বুল্যান্স পাঠাচ্ছে।
প্রথম দিকে চিকিৎসায় ভালো সাড়া দিচ্ছিলেন তপনদা। প্রাক্তন বিদ্যার্থী পরিষদের কার্যকতা অধুনা ভারতীয় জনতা পার্টির নেতা শমীকদার সঙ্গে মেডিকার কয়েকজন ডাক্তারবাবুর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। শমীকদাই তপনদার স্বাস্থ্যের খবর সকাল-বিকেল নিতেন। একটু ভালো আছেন শুনে তপনদার সঙ্গে ফোনে সামান্য কথাবার্তাও বলতাম। কিন্তু, এরপরই হঠাৎ স্বাস্থ্য খারাপ হতে থাকে। তপনদার ছায়াসঙ্গী প্রকাশদা হাসপাতালে ভর্তির সময় কাগজপত্র সইসাবুদ করেছিলেন। প্রকাশদা বললেন, ‘তপনদার ফুসফুসে একটা সমস্যা ছিলই, নিজের বিষয়ে চরম উদাসীন ছিলেন তপনদা। সেই ফুসফুসের সমস্যাই কাল হল। অবস্থা ক্রমে অবনতি হচ্ছিল। ৪ জুলাই সকালে খুব ইচ্ছে করল একবার কথা বলতে। ফোন করে জিজ্ঞাসা করলাম, কেমন আছেন? তপনদার গলা ধরে এসেছিল। বললেন, ‘শেষ অবস্থা, মা কালীর হয়তো তাই ইচ্ছা।’ আমার মুখে আর কথা নেই। প্রকাশদার সঙ্গে কথা হল, প্রকাশদাও সেদিন দুবার কথা বলেছিলেন। তপনদার যে অডিও রেকর্ডিংটাতে উনি বাবা, মা, স্বামীজি, ডাক্তারজি, গুরুজির কথা বলেছেন, সেটা ওইদিন সকালেরই। সেদিনই ভেন্টিলেটরে নেওয়া হয়েছিল তপনদাকে। সেখান থেকে আর বের করা যায়নি। দুই বাংলার হিন্দুদের হৃদয়সম্রাট চলে গেলেন চিরতরে।
১৯৯৮ সালে ২৪ পরগনা বিভাগের বিভাগ প্রচারক হয়ে এলেন তপনদা। তপনদা ততদিন পর্যন্ত আমাদের কাছে মিথ ছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যায় অসাধারণ ফল করার পরে জরুরি অবস্থার মধ্যে প্রচারক হিসাবে বের হয়েছেন। বিদ্যার্থী পরিষদের কার্যকর্তা হিসাবে তাঁর কথা তখন সারা ভারতের জাতীয়তাবাদী মানুষ জেনে গিয়েছেন। তপনদা শ্রুতিধর ছিলেন। তখন গ্রাম থেকে আসা স্বয়ংসেবকরা হিন্দি কম বুঝতেন। কোনও অখিল ভারতীয় কার্যকর্তা একঘণ্টা ভাষণ দিলেন হিন্দিত, তপনদা কাগজ-কলম ছাড়াই শুনতেন, তারপর লাইনের পর লাইন হুবহু বাংলা অনুবাদ করতেন সকলের বোঝার জন্য। কিশোর বা যুবক স্বয়ংসেবকদের কাছে তপনদা ছিলেন আইকন, রোল মডেল।
তপনদা ২৪ পরগনা বিভাগে এসে প্রথমেই সুন্দরবনের লাগোয়া জায়গাগুলোতে নজর দিলেন। দরিদ্র, অসহায় হিন্দু, কাজ নেই, চাষ নেই, গ্রামের পর গ্রাম পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে রাজোর বাইরে চলে যায় তখন। মাসের পর মাস বাইরে থাকে তারা। আর অসহায় পরিবারের মহিলারা জেহাদি দুষ্কৃতীদের যৌন লালসার শিকার হত। ততদিনে বামফ্রন্ট উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনায় জেহাদি মৌলবাদের কাছে মাথা বিক্রি করে দিয়েছে। নামেই জেলা চালাতেন সোনারপুর বা বাঘাযতীন থেকে, হুকুম যেত কিন্তু হাকিম নড়ত না।
তাপস বারিক বাসন্তীতে প্রচারক হয়ে এলেন। তার আগে মাতলা নদীর ওপাশে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের (আরএসএস) কাজ খুব সামান্যই ছিল। বাসন্তী চার্চের পাশে একটা ভাঙা বাড়িতে কার্যালয় হল। তাপসদার হাতে জাদু ছিল। সম্পূর্ণ নতুন একটা দল যোগ দিল। আর্থসামাজিকভাবে একেবারে পিছিয়ে পড়া সমাজ থেকে। ভূমিহীন প্রান্তিক চাষি পরিবার থেকে, কাঁকড়ামারা পরিবার থেকে, মৎসজীবীদের ছেলেরা, যারা মাছের আড়তে ভোর থেকে বরফ ভাঙে, এমন ছেলেরা দিনরাত সঙ্ঘের কার্যালয়ে থাকত। গান হত, স্তোত্র পাঠ হত, কাউকে হাসপাতালে নিতে হবে শুনলে সব বন্ধ করে ছুটত ছেলেরা। আর তপনদা এলে তো একেবারে চাঁদের হাট বসে যেত। তপনদা মানুষকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতে পারতেন। অনেক পরে বুঝেছি, মানুষ আদর্শের জন্য যখন প্রাণ দিতে প্রস্তত থাকে, তখন কোনও মানুষের ‘ভালোবাসা’ থাকে। অগ্নিযুগেও বোধহয় তাই হত। ভাষণ শুনে বা সাহিত্য পড়ে হয়তো অনেকটা মন তৈরি হয়, কিন্তু জীবনপণ করে মানুষ কেবল ভালোবাসা থেকে।
তপনদা অসাধারণ পণ্ডিত ছিলেন। বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে কথা বলতে যথেষ্ট সাবলীল ছিলেন। দারুণ শক্তিশালী কলম ছিল তাঁর (মাঝে মাঝে ঠাট্টা করে বলতেন, আমার লেখা লিফলেট নিয়ে দশ খণ্ডের বই বের করা যাবে)। কিন্তু শহর কলকাতায় বড় হওয়া এই অতি-পণ্ডিত মানুষটি আক্ষরিক অর্থেই নিরক্ষর ওই বাদাবনের মানুষদের সঙ্গে মিশে যেতেন। ক্যানিং থেকে পাঠানখালি, জয়নগর থেকে কইখালি কিংবা টাকি থেকে ন্যাজাট কি হিঙ্গলগঞ্জ, সর্বত্র ছেলেরা তপনদার জন্য অধীর হয়ে থাকত।
তখন ক্যানিংয়ের মাতলা নদীর উপর ব্রিজ হয়নি, বাসন্তীতেও ফেরি পারাপার ছিল, ন্যাজাটের রাস্তা আজকের থেকেও অনেক খারাপ ছিল। কিন্তু, তপনদা যে পায়ে সর্ষে নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। সেই সময়ই একটা জিনিস নজরে এল। বাগদা, বনগাঁ, গাইঘাটা, স্বরূপনগর, বাদুরিয়া, বসিরহাট, হাসনাবাদ, সন্দেশখালি, হিঙ্গলগঞ্জ, ক্যানিং, বাসন্তী হয়ে গোসাবা পর্যন্ত যে ১৫০ কিলোমিটারের মতো ভারত ও বাংলাদেশের সীমান্ত বরাবর অঞ্চল, এটি মূলত তপশিলি জাতির হিন্দুদের বাস। মাঝে হিঙ্গলগঞ্জ, ন্যাজাট এমন কয়েকটি জায়গায় তপশিলি উপজাতির হিন্দুরাও আছেন। এই সম্পূর্ণ অঞ্চলটি সীমান্ত সম্পর্কিত যাবতীয় অপরাধের স্বর্গরাজ্য। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, এইসব থানাতে লিস্ট অফ ক্রিমিনালে কিন্তু তপশিলি জাতির বা উপজাতির হিন্দুদের নাম প্রায় নেই বললেই চলে। মানে সীমান্ত অপরাধের সঙ্গে তপশিলি জাতি বা উপজাতির হিন্দুরা জড়িত নয়। কোথাও কোথাও সংগঠিত হয়ে এরা চোরাচালান আটকে দেওয়ার কাজও করেছে। সীমান্ত অপরাধ আর জেহাদি মৌলবাদের সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠ। সম্ভবত সীমান্তের দুই দিকেই। আর সেই কারণে তপশিলি হিন্দুদের সাহসী প্রতিবাদী ছেলেদের নিয়ম করে খুন করা হয়। বছরে দুই-তিনবার দু-চারজন করে হতেই থাকে।
এই সমাজবিরোধীদের সহজ শিকার গরিব ঘরের তপশিলি জাতি ও উপজাতির মেয়েরা। বেশির ভাগ সময় হতভাগিনীদের পরিবারের লোকেরা সমাজবিরোধীদের ভয়ে পুলিশে অভিযোগ পর্যন্ত জানাত না। একবার গণধর্ষিতা হওয়া মেয়েকে এরা লাগাতার যৌন শোষণ করত। তপশিলি জাতি ও উপজাতিদের সুরক্ষার যে আইন সারা ভারতবর্ষে চলে, কোনওদিন শিডিউল কাস্ট অ্যান্ড শিডিউল ট্রাইবস (প্রিভেনশন অফ এট্রোসিটিস), ১৯৮৯ আইনে একজন অপরাধীর বিরুদ্ধেও প্রশাসন মামলা শুরু করেনি।
কলাহাজরাতে জামাইষষ্ঠীর দিনে ভয়ানক নরসংহার হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। আরতি মণ্ডল নামে তপশিলি পরিবারের এক গৃহবধূকে প্রকাশ্য দিবালোকে ধর্ষণ করে হত্যা করেছিল মৌলবাদীরা। আরতি মণ্ডলের হত্যাকারীদের কোনও শাস্তি হয়নি। সেই আগুন ধিকিধিকি করে সুন্দরবনের প্রতিটি শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের বুকে জ্বলত। তপনদা আর ড. প্রদ্যুত নস্কর কলাহাজরাতে গিয়ে আরতি মণ্ডলের স্মৃতিসৌধ স্থাপন করলেন ১৯৯৯ সালে। ২০০০ সালে সোনাখালিতে সোনালি মান্ডি (নাম পরিবর্তিত) নামে তপশিলি উপজাতি একটি মেয়েকে জেহাদি মৌলবাদীরা গণধর্ষণ করে। ততদিনে তিন নম্বর সোনাখালির মোকামবেড়িয়া গ্রামে নিয়মিত শাখা শুরু হয়ে গিয়েছে। এক-একদিন ৫০ জন জন যুবকের শাখা হচ্ছে। আর তাঁদের সবাই তপন ঘোষের চেলা। তপনদার প্রতিবাদের শিক্ষা তাঁদের রক্তে ততদিনে ঢুকে গিয়েছে। সেখানে তখন নেতৃত্ব দিচ্ছে লালু। লালুর মানে অভিজিৎ সরদার। তপশিলি সম্প্রদায়ের হতদরিদ্র ঘরের ছেলে। অসম্ভব মেধাবী। ওই আর্থসামাজিক অবস্থায় ওই অজগ্রাম থেকে পড়াশোনা করে বিএসসি পাশ করেছে। তিন নম্বর সোনাখালির ছেলেরা প্রতিবাদ শুরু করল। বাসন্তী ট্রাঙ্ক রোড অবরোধ হল, বাসন্তী থানা ঘেরাও হল, দাবি একটাই–তপশিলি উপজাতির গরিব মেয়েটির ধর্ষণকারীদের শাস্তি দিতে হবে। তপনদা জাতীয় মহিলা কমিশনের প্রতিনিধিদের আনার ব্যবস্থা করলেন। লালুদের কেবল এটাই ছিল অপরাধ।
২০০১ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি পাঁচজন স্বয়ংসেবককে আনোয়ার হোসেনের বাড়িতে বিকেল বেলা তুলে নিয়ে যায়। একমাত্র বিকর্ণ নস্কর কোনও ক্রমে বেঁচে বের হয়ে আসে। বাকি চার জন মানে অভিজিৎ সরদার, পতিতপাবন নস্কর, সুজিত নস্কর আর অনাদি নস্কর খুন হয় ওই জল্লাদদের হাতে। (Case No- 13 (2) 2001, Basanti P.S.)
সেদিন ওদের অপহরণের খবর আমরা তপনদাকে আধঘণ্টার মধ্যেই জানাই। সঙ্গে সঙ্গে তপনদা এসপিকে বলে পুলিশ পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। কিন্তু পুলিশ পৌঁছবার আগেই ওদের হত্যা করে জেহাদিরা। সেই রাতে আর সোনাখালি পৌঁছানো সম্ভব ছিল না। পরেরদিন ভোরের ট্রেনে ক্যানিং স্টেশনে আমরা মিলিত হলাম। তপনদা, তাপস বারিক আরও কয়েকজন। বিকর্ণও এসেছিল টেশনে। সেখান থেকে নদী পার হয়ে ডকঘাটে পৌঁছাবার পরে তপনদা সকলকে জোর করে খাইয়ে দিলেন। সকলের মন ভীষণ খারাপ। কেউই খেতে চাইছিল না। তপনদা সেদিন একটা অদ্ভুত কথা বলেছিলেন, “আমরা এখানে শোক করতে আসিনি। লড়াই করতে এসেছি। লড়াইয়ের জন্য যেভাবে তৈরি হতে হয় সেটাই করো।”
তিন নম্বর সোনাখালির বটতলায় নামার পরেই তপনদাকে জড়িয়ে ধরলেন পতিতপাবনের বাবা। জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদছেন তিনি, আমাদেরও চোখে জল, কিন্তু তপনদা স্থির ভাবে তাকিয়ে আছেন। সেই যে তপনদা সোনাখালিতে নামলেন, টানা ২০ দিন মাটি কামড়ে পড়েছিলেন। সেখান থেকে একটি পুস্তিকা বের হয়েছিল, ‘সোনাখালিতে বলিদান চার স্বয়ংসেবক লড়াই চলছে’। সত্যি বলতে কি এই ঘটনাতে তপনদা প্রকৃত অর্থেই স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল এক করে দিয়েছিলেন। জাতীয় তপশিলি জাতি ও উপজাতি কমিশনের (তখন সেটাই নাম ছিল) অধ্যক্ষ দিলীপ সিং ভুড়িয়া এলেন। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের কার্যকরী সভাপতি অশোক সিংঘল এসেছিলেন।
হিন্দুরা মনোবল পেতে শুরু করল। যেখানে চারজনকে জেহাদিরা হত্যা করেছিল, সেখান থেকে আনোয়ার হোসেন আর তাদের সহযোগী জল্লাদদের সপরিবারে বাড়িছাড়া করল জাগ্রত হিন্দু সমাজ। সোনাখালির বলিদান বাগদা থেকে গোসাবা পর্যন্ত হিন্দুদের সামনে লড়াইয়ের আদর্শ হয়ে উঠল। তপন ঘোষের নাম হিন্দুদের মধ্যে সঞ্জীবনী মন্ত্রের মতো কাজ করত। গ্রামে গ্রামে প্রতিরোধ গড়ে উঠতে লাগল। কিন্তু ততদিনে সিপিএম, সেই সঙ্গে বামফ্রন্ট মৌলবাদীদের হাতের পুতুল হয়ে গিয়েছে। হত্যাকারীদের বাঁচানোর জন্য জেলা বামফ্রন্ট সর্বশক্তি লাগিয়েছিল। তাই কেস ডায়েরি থেকে সর্বত্র রাখা হয়েছে ছিদ্র। আজও শাস্তি পায়নি হত্যাকারীরা।
স্বাধীন ভারতেও এত বড় বড় অপরাধের অপরাধীরা শাস্তি পাচ্ছে না, সেটা তপনদাকে অস্থির করে তুলত। সেই সমাধানের সূত্র খুঁজতেই তিনি সংগঠন ছেড়েছেন, নতুন সংগঠন বানিয়েছেন আবার ভেঙেছেন, সমাধান পাওয়ার আশায়। সরকার পরিবর্তন হল কিন্তু হিন্দুদের উপর অত্যাচার কমল না। তপনদা রাজনীতির বাইরে থেকে হিন্দুদের বাঁচাতে চাইলেন। কিন্তু সীমান্তবর্তী এলাকায় অপরাধীরা, মৌলবাদীরা আরও বেশি করে রাজনৈতিক সহায়তা পেতে লাগল। হিন্দু মেয়েরা আবার লাঞ্ছিত হতে শুরু হলেন।
তপনদা হিন্দু সংহতি প্রতিষ্ঠা করলেন। হিন্দু সংহতিরও মূল শক্তি হয়ে উঠল ওই অঞ্চলের ছেলেরা। তপনদার নামের জাদু কাজ করত। তপনদা যখন উত্তরভারতে বজরং দলের দায়িত্ব নিয়ে ছিলেন, তখন দিল্লি, কাশ্মীর-সহ উত্তর ভারতের বিরাট অংশের সাহসী, প্রতিবাদী মানুষ তাঁর ভক্ত হয়ে উঠেছিল। ধীরে ধীরে সারা পৃথিবীর বাংলাভাষী হিন্দুদের মধ্যে তপনদা বাংলায় হিন্দু অস্তিত্বের ‘আইকন’ হয়ে উঠলেন। নতুন সরকার আগের থেকে আরও হিন্দুবিরোধী হয়ে উঠল। বাম-জমানায় হাতির দু’রকম দাঁত ছিল। একটা দেখানোর দাঁত আর দুপাটি চিবিয়ে খাবার দাঁত। ধবধবে ধুতি পড়া গজদন্তের মতো বামনেতাদের দেখে বোঝা যেত না শাসনে বা গোসাবায় যারা পার্টি চালাচ্ছেন, তাঁদের আসল চেহারাটা কেমন। নতুন সরকারের দেখানোর দাঁত আর খাবার দাঁত একই। অনেকটা হায়নার মতো। বহু অপরাধের অপরাধী, উগ্র সাম্প্রদায়িক নেতারা ক্ষমতার একেবারে সামনে চলে এলেন। স্বাধীন ভারতে এত হিন্দুবিরোধী সরকার আর আসেনি। সীমান্ত এলাকার যারা লিস্টেড ক্রিমিনাল সেইসব মৌলবাদীরা অবাধে কলকাতায় ক্ষমতাসীন দলের নেতা-নেত্রীদের সঙ্গে মঞ্চে বসতে শুরু করলেন। আর তাদের পাশবিক অত্যাচারের প্রতিবাদ করত যে সামান্য দুই চারজন সাহসী যুবক তাদের মিথ্যে মামলাতে ফাঁসানো শুরু হল। তপনদা এমন সব ছেলেদের বৃদ্ধ বাবা-মা, অসহায় স্ত্রী-পরিবার, সংসার চালানোর ভার নিজের কাঁধে নিতেন।
২০১৩ সালের অক্টোবর মাসে গোসাবার পাঠানখালির বটতলি গ্রামের মামণি মণ্ডল (নাম পরিবর্তিত) নামে তপশিলি জাতিভুক্ত পরিবারের নাবালিকাকে গণধর্ষণ করা হল (Case No. 238 (10) 2013, Goshaba P.S.)। প্রতিবাদে মুখর হয়ে গণআন্দোলন গড়ে তুলেছিল রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের ছেলেরা। তাঁদের প্রচেষ্টায় ২০১৭ সালের ১৭ অক্টোবর বটতলী গ্রামে আসেন ন্যাশনাল কমিশন ফর শিডিউল কাস্টের প্রতিনিধিরা। এই প্রতিরোধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সুন্দরবন জেলার আরএসএসের কার্যবাহ সঞ্জয় সিনহা। সঞ্জয়ের বাড়িও ছিল পাঠানখালিতে। কমিশন চলে যাওয়ার কয়েকঘণ্টার মধ্যেই মৌলবাদীরা সঞ্জয়ের বাড়ি আক্রমণ করে, সব কিছু লুঠ করে, ভেঙেচুরে জ্বালিয়ে দেয়। সঞ্জয় সিনহারা স্বামী-স্ত্রী দুজনেই স্কুলশিক্ষক। দুটো কোলের শিশুকে নিয়ে এই তপশিলি দম্পতি পাটক্ষোতের মধ্যে লুকিয়ে সে যাত্রায় প্রাণে বাঁচেন (case no. 230/17, date 17/10/2017, Goshaba P.s.)। আজও অপরাধীর শাস্তি পায়নি, এই তপশিলি জাতিভুক্ত পরিবার ঘর এখনও ফিরতে পারেনি।
প্রতিদিন একটু একটু করে ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এই বাগদা, বনগাঁ, গাইঘাটা, স্বরুপনগর, বাদুরিয়া, বসিরহাট, হাসনাবাদ, সন্দেশখালি, হিঙ্গলগঞ্জ, ক্যানিং, বাসন্তী আর গোসাবা ভারতবিরোধী শক্তির হাতে চলে যাচ্ছে। প্রশাসন দেখেও দেখছেন না। গত মার্চ মাসে বসিরহাটের থেকে এনআইএ লস্কর-ই-তৈবার জঙ্গি তানিয়া পারভিনকে গ্রেপ্তার করে। ওই জঙ্গি আইএসআইএসের সক্রিয় সদশ্য ছিল বলেও খবরে ম প্রকাশ পায়। ধীরে ধীরে বেড়ে চলেছে স্লিপার সেল। যেমন ২০১৪ সালে বর্ধমানের খাগড়াগড়ে এমনই একটা স্লিপার সেলে ইম্প্রোভাইসড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস বিস্ফোরণে বাংলাদেশের অনুপ্রবেশকারী শাকিল আহমেদ মারা যায়। গত মার্চ মাসের ঘটনা প্রমাণ করছে, বাংলাদেশ সীমান্তের এই বিঞ্জীর্ণ অঞ্চল কীভাবে দেশবিরোধী গতিবিধির আখড়া হয়ে উঠছে। এর বিরূদ্ধে একমাত্র প্রতিবাদ করছেন এই অঞ্চলের তপশিলি জাতিভুক্ত কিছু সাহসী যুবক। যাঁদের বুকে আছে তপন ঘোষের অভয় বাণী, ‘মাটি বাপের নয়, মাটি দাপের…’। সেই কারণে জেহাদিচক্র আর চোরাচালান কারীরা এদের মেরে ফেলার বাহানা খোঁজে। কখনও পঞ্চায়েত নির্বাচনের নামে কখনও বা লোকসভা নির্বাচনের নামে, কখনও বা কোনও কারণ ছাড়াই। বিগত লোকসভা নির্বাচনের পরেই মারা হল প্রদীপ মণ্ডল আর দেবদাস মণ্ডলকে (case no. 141/19 dt. 09/06/19, Nazat P.S. adding Sec.3(2)(v) SCIST (Prevention of Atrocity) Act 1989, 142/19 dt 09/06/19, Nazat P.S.)। এই প্রদীপরা মারা যাওয়ার পরে তপনদা আবার গর্জে উঠেছিলেন। কারণ, প্রদীপ আর দেবদাস দু’জনেই ছিল তপনদার হাতে তৈরি একান্ত স্নেহধন্য যোদ্ধা।
কেউ যদি হিঙ্গলগঞ্জের এই সব যোদ্ধাদের বাড়িতে যান তবে বুঝবেন, দারিদ্র্য কাকে বলে। বাড়িতে হয়তো একটাই মাত্র ধাতব বাসন আছে, ভাত ফোটাবার। এরা এই দারিদ্রতার মধ্যেও লড়াই করছে। ভারতমায়ের শরীরে এ যেন জীবাণু না-ঢোকে সেই প্রতিজ্ঞা নিয়ে প্রাণ দিচ্ছে। আমরা বুঝতে পারছি না যে, সন্দেশখালি সীমান্ত ধরে বা গোসাবার নদীপথে যদি দেশবিরোধী বিষ ঢোকে তো কলকাতাও সুরক্ষিত থাকবে না, দিল্লিও বাঁচবে না। তাই আজ আমাদের ভাবার সময় এসেছে। এখনও যদি দুই ২৪ পরগনার সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার তপশিলি জাতি ও উপজাতিভুক্ত মানুষের লড়াইটা কেবল এই অসহায় মানুষগুলির উপরে ছেড়ে দেওয়া হয়, তবে পশ্চিমবঙ্গ অচিরেই পশ্চিমবাংলাদেশ হবে। বা তার থেকেও খারাপ কিছু হবে।
আজ তপনদার প্রয়াণ এই অকুতোভয় মানুষটির সারা জীবনের এই সংগ্রামটাই মনে করিয়ে দিচ্ছে। কেন সারা পৃথিবীর শুভবুদ্ধিসম্পন্ন বাংলাভাষী মানুষ এক সঙ্গে বলবেন না, এতবছর ধরে চলা ওই গরিব পিছিয়েপড়া হিন্দুদের উপর প্রতিটি বর্বরচিত অপরাধের অপরাধীরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পাক। এই জল্লাদদের শাস্তি হলেই তপনদার আত্মা শান্তি পাবে।
ড. জিষ্ণু বসু
লেখক– প্রান্ত কার্যবাহ, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ