সাঁওতাল বিদ্রোহ সাধারণভাবে সাঁওতাল হুল নামে পরিচিত ছিল। বস্তুত এটি একটি প্রাদেশিক বিদ্রোহ। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক কর্তৃপক্ষ এবং তৎকালীন জমিদারি পদ্ধতির বিরুদ্ধে পূর্বভারতের বর্তমান ঝাড়খণ্ড অঞ্চলে সাঁওতালরা এই আন্দোলন সংগঠিত করেছিল। এই বিদ্রোহ ১৮৫৫ সালের ৩০ জুন শুরু হয়। ওই বছরের ১০ নভেম্বর ব্রিটিশরাজ সাময়িক আইন জারি করে যা ১৮৫৬ সালের ৩ জানুয়ারি পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল। সামরিক আইন স্থগিত হবার পর ব্রিটিশশাসকের অনুগত সেনাবাহিনী এই বিদ্রোহ অতি নিষ্ঠুরভাবে দমন করে। এই বিদ্রোহের নেতৃত্বে ছিল চার ভাই— সিধু, কানু, চাঁদ ও ভৈরব।এই বিদ্রোহ প্রকৃতপক্ষে ব্রিটিশদের অনৈতিক উপজাতীয় ব্যবস্থা, সুদখোর মহাজন, তৎকালীন ভারতের জমিদারি ব্যবস্থা প্রভৃতির বিরুদ্ধে সাঁওতালদের একটি প্রতিক্রিয়া। এই বিদ্রোহ স্থানীয় জমিদার, পুলিশ, ব্রিটিশ আইন দ্বারা বিকৃত ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে ছিল।
ভারতে ব্রিটিশ আগমনের পূর্বে সাঁওতাল পাহাড়ি জেলার অধিবাসীদের মালভূম, বাবাভূম, ছোটোনাগপুর, পালামৌ, বীরভূম জেলায় বসবাস ছিল। তাদের জীবনযাপন ছিল অরণ্য নির্ভর। তারা জঙ্গলের ছোটো ছোটো অঞ্চল পরিষ্কার করে বসতি স্থাপন করে, শিকার করে নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রেখেছিল। এগুলি ছাড়া তাদের জীবনধারনের আর কোনো উপায় ছিল না। কিন্তু ইংরেজ শাসকের প্রতিনিধিরা বনবাসীদের অধিকারভুক্ত জঙ্গল অধিকার দাবি করলে সাঁওতালরা রাজমহল পাহাড়ে চলে যায়। কিছুকাল পরে ইংরেজরা স্থানীয় জমিদারদের সহায়তায় রাজমহলের জঙ্গলের উপরেও তাদের অধিকার দাবি করে। জমিদার ও মহাজনেরা ঋণ দিয়ে। সাঁওতালদের বিভিন্ন জিনিস বন্ধক নিতে শুরু করল। অসৎ উপায়ে সে ঋণের। পরিমাণ সুদে আসলে এত দাবি করে যে শোধ করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত তারা। জমিদার ও মহাজনশ্রেণীর বেগার শ্রমিকে পরিণত হলো। আসলে বনবাসীদের সরলতা ও অশিক্ষার সুযোগ নিয়ে তাদের শোষণ করা হচ্ছিল। এই অত্যাচার অসহ্য হওয়ায় শেষ পর্যন্ত সাঁওতাল বিদ্রোহ ঘোষণা করে।
শোষণ ও অত্যাচারের প্রতিবাদে ১৮৫৫ সালে সিধু ও কানু মুর্মু ২০ হাজার সাঁওতালকে সঙ্ঘবদ্ধ করে ব্রিটিশদের। বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সমান্তরাল শাসন ব্যবস্থা চালু করে। এই সংগ্রামের জন্য তারা তাদের নিজস্ব আইন তৈরি করে কর সংগ্রহ শুরু করে। কিছুকালের মধ্যে তারা হাতে অস্ত্র তুলে নেয় এবং অনেক অত্যাচারী জমিদার, মহাজন এবং তাদের অনুগত কর্মীদের মৃত্যুদণ্ড নেওয়া হয়।
বিদ্রোহ দমনের জন্য স্থানীয় জমিদার এবং মুর্শিদাবাদের নবাবের সহায়তায়। ব্রিটিশ শাসক বিপুল সংখ্যক সৈন্য পাঠায়। সিধু ও কানুকে গ্রেপ্তার করার জন্য ১০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে।
এই অসমযুদ্ধে বেশ কিছু সাঁওতাল হতাহত হয়। সাঁওতালদের তির-ধনুক প্রভৃতি অস্ত্রশস্ত্র ব্রিটিশ সেনাদের আধুনিক বন্দুক, কামান ও অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্রের সঙ্গে লড়াই করার অনুপযুক্ত ছিল। ১৮৫৫ সালের জুলাই থেকে ১৯৫৬ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত কাহারগাঁও, সুবি, রঘুনাথপুর ইত্যাদি অঞ্চলে বড়োবড়ো সংঘর্ষ ঘটে। এই বিদ্রোহ অতি নিষ্ঠুরভাবে দমন করা হয়। সিধু ও কানুকে হত্যা করা হয়। মুর্শিদাবাদের নবাব যুদ্ধের জন্য যে হাতি পাঠিয়েছিল সেগুলি সাঁওতালদের কুটির ধ্বংসের কাজে ব্যবহার করা হয়। ব্রিটিশ সেনাবাহিনী ও মিত্রশক্তি ব্যাপক। ধরপাকড় ও নৃশংস অত্যাচার চালিয়েছিল। এই যুদ্ধে জড়িত ৬০ হাজার উপজাতিদের মধ্যে ১৫ হাজারের বেশি নিহত হয়েছিল এবং ১০টি গ্রাম ধ্বংস হয়েছিল। সাঁওতালরা কেবলমাত্র গোয়ালা ও লোহার শ্রেণীর সাহায্য পেয়েছিল।
এই বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও পরবর্তী স্বাধীনতা সংগ্রামীদের উপর গভীরভাবে রেখাপাত করেছিল। সাঁওতালদের অস্মিতা ও অস্তিত্বের লড়াই পরবর্তী বিদ্রোহীদের অনুপ্রাণিত করেছিল। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিখ্যাত চিত্র পরিচালক মৃণাল সেন ‘মৃগয়া’ ছায়াছবিটি নির্মাণ করেন। এই বিদ্রোহকে স্মরণ করে আজও সাঁওতালরা হুল দিবস পালন করে।
হুল দিবসে বনবাসী সিধু, কানু, চাঁদ ও ভৈরবদের অবদানকে স্মরণ করে। ১৮৫৭ সালের মহাসংগ্রামের ২ বছর আগে ১৮৫৫ সালে ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে এই সাঁওতাল বিদ্রোহ ভারতের প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলন হিসাবে বিবেচিত হওয়া উচিত।
স্বপন কুমার দাশগুপ্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.