যেখানেই বাঙালি সেখানেই বাংলা নববর্ষ বা পয়লা বৈশাখ। তবে স্বাধীনতা লাভ করার পর থেকেই বাংলাদেশের ‘পহেলা বৈশাখ’ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ‘পয়লা বৈশাখ’কে আড়ম্বর ও আন্তর্জাতিক প্রচারে টেক্কা দিয়ে যাচ্ছে। মূলত সূর্য সিদ্ধান্ত অনুসারে ভারতীয় সৌর বছর অনুযায়ী বঙ্গাব্দের ও বাংলা বছরের হিসাব। তামিল নববর্ষ ‘পুথণ্ডু’-র সাথে বাংলা নববর্ষ প্রায় প্রতিবারই সমাপপিত হয়। তাছাড়া আরও কিছু দক্ষিণ এশীয় ক্যালেন্ডারের সঙ্গেও বাংলা বছর মেলে। আন্তর্জাতিক গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের ১৪ অথবা ১৫ এপ্রিল বাংলা নববর্ষ যা ভারতের মিথিলা, আসাম, ত্রিপুরা, মণিপুর, উড়িষ্যার নতুন বছর ছাড়াও বহির্ভারতে নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ডের নতুন বছরের সঙ্গেও মিলে যায়।

ভারতের অন্যত্র ‘হিন্দু নববর্ষ’ শুরু হয় চৈত্র মাসের প্রথম দিন থেকে। কিন্তু বাংলার ক্ষেত্রে ঋতুর বিন্যাস হয়েছে বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য গ্রীষ্মকাল, আষাঢ়-শ্রাবণ বর্ষা, ভাদ্র-আশ্বিন শরৎ, কার্তিক-অগ্রহায়ণ হেমন্ত, পৌষ-মাঘ শীত ও ফাল্গুন-চৈত্র বসন্তকাল – এইভাবে। ঋতু বিন্যাসে এক মাসের হেরফের হলেও ভারত ব্যাপী হিন্দু পালা-পার্বণগুলোর তিথি কিন্তু ওলট পালট হয়নি। চৈত্রমাসে বাংলার বাসন্তী বা অন্নপূর্ণা পুজোর নবমীই হল সমগ্র উত্তর ভারতে উদযাপিত রামনবমী। বাংলার বৈশাখ মাসেই পাঞ্জাবের বৈশাখী। আষাঢ় মাসে রথযাত্রার দিনটিও অভিন্ন। আশ্বিনে নবরাত্রির শেষে দশমীর দিনটিই আমাদের দুর্গা দশমী বা বিজয়া দশমী। অবাঙালিরা যেখানে মহালয়ার দিন ঘট স্থাপন করে প্রতিপদ থেকেই পুজো শুরু করে, বাঙালিরা সেখানে একই বৃত্তের পঞ্চমীর দিন অধিবাস দিয়ে পুজো শুরু করে। মকর সংক্রান্তির দিনও হয় সমাপতিত। বারোয়ারি সরস্বতী পুজোর চল অবাঙালি অঞ্চলে তেমন জনপ্রিয় না হলেও পঞ্চমী তিথি নিয়ে বিভ্রাট নেই। ফাল্গুন মাসে বাঙালিরা যে পূর্ণিমায় দোল উৎসব পালন করে, হিন্দীভাষীরা তার ঠিক পরের দিন প্রতিপদে একই উপকরণ নিয়ে খেলে হোলি। গণনায় কোনও বিবাদ নেই, মানে পূর্ণিমার দিন পূর্ণিমা বলেই সারা ভারতে স্বীকৃত, আর অমাবস্যাটাও ঠিক একই চান্দ্র কলার নিয়ম মেনে আবর্তিত হয়।
এত বালখিল্য গৌরচন্দ্রিকার কারণ, ইদানিং বাঙালি সাংস্কৃতিক উৎসব আর হিন্দু ধর্মীয় উৎসবের মধ্যে বিবাদ লাগাতে কয়েকটি বিশেষ পক্ষ বিশেষ সক্রিয়, এবং তাতে তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের যথেষ্ট সমর্থনও পাচ্ছে। আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য বজায় রেখেও যে সর্বভারতীয় নাড়ির বন্ধন অটুট রাখা যায়, বা রাখা দরকার, সেটাই এই তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণীর রচনা লিখে বোঝাতে চাইলাম।


তবে তাতেও কি রেহাই আছে? বেশ কিছু বছর ধরে এক নতুন তত্ত্বের উদ্ভব হয়েছে, বা বলা ভালো নতুন ইতিহাস রচিত হয়েছে। বাংলা নববর্ষ নাকি মুঘল বাদশা আকবরের দান। গত শতাব্দী তো দূর, এক দশক আগেও এই ইতিহাস কেউ ঘুণাক্ষরে জানত না। তাহলে এই চাঞ্চল্যকর ইতিহাসের উৎস? ঐতিহাসিক আর কেউ নন, স্বয়ং অমর্ত্য সেন। ২০০৫-এ প্রকাশিত ‘The Argumentative Indian’ বইতে তিনি এই দাবি করেন। এরপর বিভিন্ন বক্তৃতায় প্রচার শুরু করেন। অবশ্য এই তত্ত্বের জনক অমর্ত্য নন; সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। বেশ মনোগ্রাহী তথ্যচিত্র তৈরি করে বাঙ্গালীকে ঝিনুকে করে গেলানো শুরু হয়। ক্রমে দশে চক্রে ভগবানে যা হয় আর কী! ‘বঙ্গাব্দের প্রতিষ্ঠাতা যে আকবর’, ইতিহাসের এই সামান্য তথ্যটি না জানার জন্য বুদ্ধিজীবীদের খোঁটায় আপামর বাঙ্গালী সেই তত্ত্বই মগজস্থ করতে শুরু করে। বাঙ্গালী এমনিতে পেটরোগা হলেও মোগলাই খানা ভালোবাসে। তাই গদগদ চিত্তে ‘মোগলাই বাংলা নববর্ষ’-এর কাঁঠালের আমসত্বকেই পরিপাক করতে সচেষ্ট হয়। প্রতি বছর নববর্ষের সময় পত্রপত্রিকায় এই নিয়ে বেশ লেখালিখির ধুম পড়ে যায়। আমি নিজেও বাদ যাইনি, যদিও লেখার মধ্যে ইতি গজ কেতায় আসল ইতিহাসটাও আলগা করে জুড়ে আকবর বাদশার সঙ্গে বঙ্গাব্দের ভাব ভালোবাসা দেখিয়ে গোঁজামিল মেলানোর চেষ্টা করেছি।

আকবরপন্থীদের গণনা বেশ ভজকট। খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে আকবর ‘তারিখ-ই-ইলাহী’ নামে একটি সৌর বর্ষপঞ্জী নাকি চালু করেন। কিন্তু তার ভিত্তিবর্ষ ছিল ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ, আকবরের শাসনকালের প্রথম বছর। অর্থাৎ তারিখ-ই-ইলাহী শুরুই হয় তার ২৯তম বর্ষ থেকে। ওদিকে ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ ছিল ৯৬৩ হিজরী। আকবরপন্থীদের মতে ১৫৫৬ খৃষ্টাব্দকে ৯৬৩ বঙ্গাব্দ ধরে, ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে তারিখ-ই-ইলাহীর সাথে সাথে বঙ্গাব্দও চালু করেন আকবর, যার নামকরণ হয় ‘ফসলি-সন’। অর্থাৎ ‘ফসলি-সন’ বা বঙ্গাব্দ শুরু হয় তার ৯৬৩ + ২৯ = ৯৯১তম বর্ষ থেকে। চান্দ্রবর্ষ হওয়ায়, হিজরী ততদিনে আবার এক বছর এগিয়ে গেছে। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দ ছিল ৯৯২ হিজরী। সুতরাং এই বছর থেকে যুক্ত হল ২৯তম তারিখ-ই-ইলাহী ও ৯৯১ ফসলি-সন বা বঙ্গাব্দ। কিছু বোঝা গেল?
ব্যাপারটা বোঝার জন্য আন্তর্জালকে উপলব্ধ নানা সূত্র ঘেঁটে আমি একটা যোগসূত্র তৈরির চেষ্টা করি। মানে ঐ বঙ্গাব্দের সঙ্গে হিজরীর ভাবভালোবাসার ফরমুলা তৈরি কী! মুঘলরা ইসলামিক চান্দ্র মাস অনুযায়ী খাজনা আদায় করত যার সাথে ঋতু ও মৌসুমি বর্ষণের কোনও সম্পর্ক নেই। ফলে কৃষকদের ফসলের মরশুম ছাড়া অসময়ে খাজনা দিতে নাভিশ্বাস উঠে যেত। তাই আকবর চলতি ক্যালেন্ডারের উন্নতি ঘটানোর আদেশ দেন। আকবরের অর্থমন্ত্রী তোডরমলকেই অনেক ঐতিহাসিক এই নতুন বর্ষ গণনার নেপথ্য রূপকার মনে করেন। গৌড়রাজ শশাঙ্ক প্রণীত বাংলা ক্যালেন্ডারই পরে মুঘল বাদশা জালালুদ্দিন মহম্মদ আকবর রাজস্ব আদায়ের সুবিধার জন্য তোডরমলের সাহায্যে কিছু রদ বদল করে গ্রহণ করেন। সৌর ও চান্দ্র ক্যালেন্ডারের সংমিশ্রণ হল এই নতুন হিসাব। এর প্রথমে এর নামকরণ হয়েছিল ফসল-ই-সন’ যার অর্থ ‘ভালো ফসলের বছর’। এটাই কালক্রমে পরিচিতি পায়। অর্থাৎ বঙ্গের প্রচলিত গণনাকেই গ্রহণ করে মোগলাই শীলমোহর মেরে দেন শাহেনশা। সেই সময় বাংলা নববর্ষ চালু হয় ১০ বা ১১ই মার্চ ১৫৮৪ সাল থেকে, তবে গণনা শুরু হয় ৫ নভেম্বর ১৫৫৬ খ্রীস্টাব্দ বা ৯৬৩ হিজরি সাল থেকে যেদিন আকবর পাণিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে হিমুকে পরাস্ত করে দিল্লীর তখ্‌ত নিশ্চিত করেছিলেন। এবার বোঝা গেল? আমি নিজেই কিন্তু বুঝিনি।

এবার আসি সহজ পাটীগণিতে। আশা করি বোঝা যাবে। এই বছর ২০২০ খ্রিস্টাব্দ যদি ১৪২৭ বঙ্গাব্দ হয়, তাহলে বঙ্গাব্দের প্রথম বছর ২০২০ – ১৪২৬ অর্থাৎ ৫৯৪ খ্রিস্টাব্দ হওয়ার কথা। ষষ্ঠ শতকের শেষ দশকে গুপ্ত সাম্রাজ্যের সামন্তরাজা শশাঙ্ক নিজেকে গৌড়বঙ্গের স্বাধীন সার্বভৌম শাসক হিসেবে ঘোষণা করেন। মহারাজা শশাঙ্ক স্বাধীন নৃপতি হিসেবে তাঁর শাসনকালের সূচনাকে স্মরণীয় করে রাখতে সূর্যসিদ্ধান্তভিত্তিক বর্ষপঞ্জী অনুসারে বঙ্গাব্দের প্রচলন করেন। এই ব্যাপারে সুনীলকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘বঙ্গাব্দের উৎস কথা‍’ শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছেন, “সৌর বিজ্ঞান ভিত্তিক গাণিতিক হিসাবে ৫৯৪ খ্রিষ্টাব্দের ১২ এপ্রিল, সোমবার, সূর্যোদয় কালই বঙ্গাব্দের আদি বিন্দু।‍” ঐতিহাসিক সূত্র অনুযায়ী শশাঙ্কের রাজ্যাভিষেকের দিন ছিল ঐ বছরটাই। অতএব সহজ পাটীগণিত ও প্রামাণ্য ইতিহাস মেলালে গৌড় রাজ শশাঙ্ককেই বঙ্গাব্দের জনক বলে অনায়াসে সনাক্ত করা যায়।

এখন নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদের অত মাথা খাটিয়ে বানানো কঠিন তত্ত্বকে ফেলে কেন সহজ পথ ধরব? শুধু কি পথটা সহজ বলেই? ঐতিহাসিক সূত্রগুলো কী বলছে? এর জন্য সর্বাগ্রে তোডরমল প্রণীত ‘আইন-ই আকবরী’র কথাই ধরা যাক। স্বীকার করে নিচ্ছি নিম্নলিখিত তথ্য ও বিশ্লেষণ – কোনওটাই আমার নিজস্ব নয়; সংগৃহীত মাত্র। অপরিচিত সেই লেককের ক্ষুরধার বিশ্নষণ অনেকাংশে ধার করেই নীচের যুক্তিগুলো তুলে ধরছি:
প্রথমত: ‘আইন-ই-আকবরী’-তে ৩০ পাতা জুড়ে বিশ্বের ও ভারতের বিভিন্ন বর্ষপঞ্জীর কালানুক্রমিক বিবরণ রয়েছে। সব শেষে রয়েছে তারিখ-ই-ইলাহী। কিন্তু ‘বঙ্গাব্দ’ বা ‘ফসলি-সন’ বা ‘বাংলা সন’-এর কোনও উল্লেখ নেই। আকবর সত্যিই ‘বঙ্গাব্দ’ বা ‘বাংলা সন’ প্রবর্তন করে থাকলে আইন-ই-আকবরীতে তার উল্লেখ থাকবে না, এ কি সম্ভব?
দ্বিতীয়ত: ‘আইন-ই-আকবরী’-তেই স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে আকবর হিজরী সন নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না বলেই ‘তারিখ-ই-ইলাহী’র সূচনা করেন। একই সঙ্গে তিনি যদি সত্যিই ফসল-ই-সন বা বঙ্গাব্দেরও সূচনা করতেন, তাহলে তার ভিত্তিবর্ষ নিজের প্রবর্তিত তারিখ-ই-ইলাহী সাথে অভিন্ন না রেখে অপছন্দের হিজরীর সাথে মেলালেন কেন?
তৃতীয়ত: আকবরের শাসনকালে মোগল সাম্রাজ্যে বাংলা, ইলাহাবাদ, অযোধ্যা, আগ্রা, পাটনা, মূলতান, কাবুল ইত্যাদি মোট বারোটি সুবা ছিল। তাহলে শুধুমাত্র বাংলার জন্য পৃথকভাবে বিশেষ একটি বর্ষপঞ্জী তৈরি করতে গেলেন কেন?
চতুর্থত: বাংলাকে তখন কার্যত শাসন করছেন প্রতাপাদিত্য, কেদার রায়ের মত প্রবল পরাক্রান্ত বারভুঁইঞারা। মুঘগলদের সঙ্গে তাঁদের লাগাতার বিরোধ। মুঘল অধিকৃত বাংলার রাজধানী রাজমহল বঙ্গীয় রাজনীতির ভরকেন্দ্র যশোহর বা শ্রীপুর থেকে অনেকটাই দূরে। মুঘলদের দৃষ্টিকোণে বাংলায় তখন জঙ্গলরাজ চলছে। প্রতাপাদিত্য তো বারবার মুঘলদের বশ্যতা অস্বীকার করে নিজের নামে মুদ্রা পর্যন্ত চালু করেছিলেন। সেই পরিস্থিতিতে বিচক্ষণ প্রশাসক আকবর বেছে বেছে বাংলার জন্যই কেন একটি নতুন বর্ষপঞ্জী প্রণয়ন করার ঝক্কি নেবেন, যেখান থেকে খাজনা আদায়ের নিশ্চয়তাই কম?
পঞ্চমত: পাঞ্জাব থেকে দাক্ষিণাত্য, গুজরাত থেকে অসম, মণিপুর, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া হয়ে সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া যেখানেই ভারতীয় সংস্কৃতি পৌঁছেছে, সব জায়গাতেই বর্ষ শুরু পয়লা বৈশাখে। দিল্লীর বাদশা কি নিজের সাম্রাজ্যের বাইরে ঐ সুবিস্তীর্ণ অঞ্চলেও নিজের ফসল-ই-সন চালু করেছিলেন? তাঁর সামন্ত বা করদ রাজা না হয়েও সুদূর থাইল্যান্ড, কাম্বোডিয়া কি দাক্ষিণাত্য আকবর প্রণীত বর্ষপঞ্জী মেনে নিয়েছিলেন? খুব কষ্ট কল্পিত ভাবনা নয়?
ষষ্ঠত: বঙ্গাব্দ যে আকবরের অনেক পূর্ববর্তী, তার প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণও রয়েছে। নিতীশ সেনগুপ্তর বই ‘The Land of two Rivers’ বইয়ে উল্লেখ রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার ডিহারগ্রাম ও সোনাতপন গ্রামের হাজার বছরেরও প্রাচীন টেরাকোটার শিব মন্দিরের গায়ে বঙ্গাব্দের কথা খোদিত রয়েছে। আকবরের তখন জন্মও হয়নি।
‘আইন-ই-আকবরী’-তে ‘বঙ্গাব্দ’ বা ‘বাংলা সন’ তো দূর, ‘ফসল-ই-সন’-এর কথাও বলা নেই। চান্দ্র বর্ষপঞ্জী হিজরী সন মরশুমের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় বলে রাজস্ব আদায়ে সমস্যা হচ্ছে এবং তার জন্যই মুঘল সম্রাটকে সৌর বর্ষপঞ্জী প্রণয়ন করতে হয়েছিল, এমন উল্লেখও নেই। আর প্রণয়নের পর সঠিক রাজস্ব আদায় হচ্ছে, সে কোথাও বলা নেই। কিন্তু তারিখ-ই-ইলাহী প্রণয়ন করেছিলেন এটা ঐতিহাসিক সত্য। তাহলে কেন করতে গেলেন?
আকবরের আমলের সরকারি দলিলে অনুযায়ী হিন্দুস্থানের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের বর্ষপঞ্জীগুলোর মধ্যে পুরোপুরি সামঞ্জস্য ছিল না। এই অমিলটুকু ঘুচিয়ে সামঞ্জস্য বিধান করতেই নতুন বর্ষপঞ্জী ‘তারিখ-ই-ইলাহী’র সূচনা হয়। আগেই উল্লেখ করেছি, বাস্তবিকই বাংলা বর্ষ ও হিন্দু বর্ষের শুরু ভিন্ন। হিন্দু বর্ষপঞ্জীতে যেখানে চৈত্র মাস দিয়ে বছর শুরু হয়, বাংলসহ উত্তর-পূর্ব ভারত, পাঞ্জাব তথা দাক্ষিণাত্যে সেখানে বছর শুরু হয় বৈশাখ মাসে, যদিও তিথি নক্ষত্র গণনায় গরমিল ছিল না। সম্ভবত উত্তর-পশ্চিম ভারত আর পূর্ব কি দক্ষিণ ভারতে বর্ষার আগমণের ব্যবধান থেকেই বর্ষশুরুর এই হেরফের। যাইহোক, তা শাসনকালের তিন দশকের মাথায় গিয়ে সুশাসক আকবরের হঠাৎ এই সমস্যার কথা মনে হল, আগে কেন নয়? অনেক গবেষকের মতে, আসলে ঠিক দেড় বছর আগে অক্টোবর ১৫৮২-তে পোপ অষ্টম গ্রেগরী পূর্বতন জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের সংস্কার সাধন করে নতুন গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার প্রণয়ন করে ইউরোপে বেশ খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর নাম অনুসারেই আন্তর্জাতিক সৌর ক্যালেন্ডারকে ‘গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার’ (Gregorian Calendar) বলা হয়। নিরক্ষর আকবরও ঠিক তেমনই বুদ্ধিবৃত্তির ক্ষেত্রে খ্যাতিমান হতে চেয়েছিলেন। তাই মধ্য এশিয়ার সমরকন্দের গুরগানি গণনাপদ্ধতিকে ভিত্তি করেই আকবরের জ্যোতির্বিদ ফতুল্লাহ শিরাজী তারিখ-ই-ইলাহী বর্ষপঞ্জী তৈরি করেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে অবশ্য মরশুম ও ফসলের সঙ্গে হিজরী গণনার গরমিলের কারণটা উড়িয়ে দিচ্ছি না। মুসলিমদের চিরাচরিত হিজরী অব্দের সরাসরি সমালোচনা করতে না পারলেও হয়তো তোডরমল প্রমুখ পণ্ডিতরা বিজ্ঞানসম্মত বর্ষপঞ্জীর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন। হয়তো বাদশার খ্যাতির বাসনা ও প্রয়োজনীয়তার মিশ্র ফলশ্রুতিই তারিখ-ই-ইলাহির অবতারণার কারণ।


এখন আকবর বঙ্গাব্দ প্রচলন করেন, এই তথ্যটি অমর্ত্য সেন পেলেন কোথা থেকে? এর উত্তর পেতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে অর্ধ শতাব্দী, ১৯৬০-এর দশকের পাকিস্তানে। ভাষা আন্দোলনে রক্তক্ষয়ী সাফল্যের জেরে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা ও পূর্ব-পাকিস্তানের সরকারী ভাষা হিসাবে বাংলা তখন প্রতিষ্ঠিত, যদিও রবীন্দ্রসাহিত্য সেখানে নিষিদ্ধ। বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়ে মুক্তিযুদ্ধ – পুরো পরিক্রমাটাই হিন্দু বাঙ্গালীর রক্ত পিচ্ছিল পথ বেয়ে। ১৯৬৪-তেও তেমনই এক নারকীয় গণহত্যায় হাজার হাজার বাঙ্গালী হিন্দুর লাশে ছেয়ে গেছে ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ, লুঠপাট করা হচ্ছে হিন্দুদের সম্পত্তি। ঢাকেশ্বরী কটন মিলের মালিক পর্যন্ত পথের ভিখারী। বাঙ্গালী হিন্দুকে ধনেপ্রাণে উদ্বাস্তু করার পর এবার সাংস্কৃতিকভাবে ছিন্নমূল করার পালা। কোনও ঐতিহাসিক গবেষণা ছাড়াই ১৯৬৬ সালে ঢাকার বাংলা একাডেমিতে ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে ‘পঞ্জিকা সংস্কার কমিটি’ তার ৪ নং সুপারিশে সিদ্ধান্ত নিল আকবরই বঙ্গাব্দের প্রবর্তক। এই ‘পঞ্জিকা সংস্কার কমিটি’ প্রচলিত বাংলা পঞ্জিকার খানিক রদবদল, যেমন মাসের দিনসংখ্যা পাল্টে দেওয়া ইত্যাদি করে যে নতুন পঞ্জিকা প্রস্তাব করল, সেটাই বর্তমানে বাংলাদেশের জাতীয় ক্যালেন্ডার। এখানেই ১৪ই এপ্রিলের দিনটিকে ‘পহেলা বৈশাখ’ হিসাবে নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। কিন্তু পূর্ব-পাকিস্তান থাকা কালীন এই ক্যালেন্ডার প্রণয়নের সুযোগ ছিল না।

স্বাধীন বাংলাদেশে অতঃপর প্রায় দু’দশক পরে ১৯৮৮-তে মহম্মদ এরশাদের প্রধানমন্ত্রীত্বের সময় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ঘোষিত হওয়ার ঠিক পরের বছরই চালু হল এই নতুন জাতীয় ক্যালেন্ডার। এরশাদ ১৪ই এপ্রিলকে বাংলা নববর্ষ হিসাবে ঘোষণা করে দেন। বাঙালিয়ানা বজায় রাখতে সঙ্গে চালু হয় নববর্ষের দিন পেঁচা ও বাঘের মুখোশ সহকারে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। দিনটা জাতীয় ছুটির দিন হিসাবেও ঘোষিত হল। সংযুক্ত হতে থাকে মুন্সীগঞ্জের ষাঁড়ের লড়াই ও দৌড় প্রতিযোগিতা, চট্টগ্রামে বসে কুস্তির আসর। পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালির পহেলা বৈশাখের সঙ্গে মিলে মিশে যায় ত্রিপুরীদের ‘বৈশুক’, মার্মাদের ‘সংগ্রাই’ ও চাকমাদের ‘বিজু’ যার সম্মিলিত রূপ ‘বৈশাবী’ পালিত হয় চৈত্রের শেষ দিন অর্থাৎ ১৩ই এপ্রিল। পার্বত্য চট্টগ্রামে সেটা ছুটির দিন। সনাতন সংস্কৃতির এই আঞ্চলিক অবশেষগুলো এখনও হাতাতে পারেনি ইসলামিক বাংলাদেশ। ভবিষ্যতে হয়তো সেগুলোরও আরবি সূত্রানুসারে ইতিহাস রচিত হবে ও অমর্ত্য সেন বা তাঁর যোগ্য উত্তরসূরীরা বই লিখে প্রচার করবেন।

এখনও ভারতে হিন্দু পঞ্জিকা অনুযায়ী পয়লা বৈশাখের দিনটি কখনও ১৫ই কখনও ১৪ই এপ্রিলে পড়ে এবং সেভাবেই উদ্‌যাপিত হয়। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের মতো ৩৬৫ দিনে বছর। কিন্তু সূর্যের চারপাশে পৃথিবীর বার্ষিক আবর্তনে নেওয়া বাড়তি ৫ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট ৪৭ সেকেন্ডের হিসাব যেমন গ্রেগরিয়ানে মিলিয়ে দেওয়া হয় প্রতি চার বছর অন্তর লিপ ইয়ারে ফেব্রুয়ারিতে ১ দিন যোগ করে, তার সাথে সাজুয্য রেখে বাংলা ক্যালেন্ডারে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা অ্যাকাডেমির একটি নির্দেশিকা আছে:
১) প্রথম পাঁচ মাস অর্থাৎ বৈশাখ থেকে ভাদ্র হবে ৩১ দিনের
২) বাকি সাত মাস হবে ৩০ দিনের
৩) গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের লিপ ইয়ারে ফাল্গুন মাসটিতে (ইং ফেব্রুয়ারি) বাড়তি ১ দিন যুক্ত হবে।

দেশভাগের সময় সমগ্র বাংলাকে পাকিস্তান গ্রাস করতে পারেনি। আজকের বাংলাদেশও আসলে খণ্ডিত বাংলা। তবে অখণ্ড বাংলাদেশের স্বপ্ন এখনও অটুট। শুধু অখণ্ড নয়, বৃহত্তর বাংলা, যার মানচিত্র নবাব আলিবর্দির সময়কার ‘সুবে বাংলা’র বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, আসাম মিলিয়ে বিস্তীর্ণর ভূখণ্ড। আছে মায়ানমারের আরাকানের দাবিও। এই স্বপ্ন পূরণের জন্য শুধু পশ্চিমবঙ্গের জমির দখল নেওয়া যথেষ্ট নয়, দখল নিতে হবে বাঙ্গালী জাতিসত্তারও। বাংলা ভাষার আরবীকরণ শুরু, আকবরকে বঙ্গাব্দের প্রতিষ্ঠাতা সাব্যস্ত করা, খন্ডিত পূর্ববঙ্গের ‘বাংলাদেশ’ নামকরণ, ‘হাজার বছরের বাঙালি’ তত্ত্ব প্রচার, সনাতন ঐতিহ্য বর্জিত নতুন বাংলা ক্যালেন্ডারের প্রণয়ন – এই সবই বাঙ্গালী জাতিসত্তাকে হাইজ্যাক করার এক একটি মাইলফলক কৌশল। এই প্রচেষ্টার সাফল্যের জোরেই আজ পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালী বিশ্বাস করছে আকবরই বঙ্গাব্দের প্রতিষ্ঠাতা।
তবে পাকিস্তান আমলে তাড়াহুড়ো আকবরকে বঙ্গাব্দের প্রতিষ্ঠাতা বানানোর সময় বোধহয় মুসলমান বঙ্গবাসী ভাবেনি শেষ পর্যন্ত পূর্ব-পাকিস্তান ভেঙে আত্মপ্রকাশ করবে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ! এই বিচ্ছেদের পর বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের আবহে মুঘল বাদশা আকবর যেন পাকিস্তানীদেরই নিকটাত্মীয়। তাই বিগত দু’ দশকে বঙ্গাব্দের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে কখনও ‘সুলতান-ই-বাঙ্গালাহ’ আলাউদ্দিন হুসেন শাহর নাম প্রস্তাবিত হচ্ছে, কখনও বা তাঁর ‘বাঙালি’ত্ব নিয়ে সন্দিহান হয়ে মুর্শিদ কুলি খাঁর নাম উঠে আসছে। ‘সুবে বাংলা’র স্বপ্নদর্শীরা যতদিন না তাদের মনমত বঙ্গাব্দের জনক খুঁজে পাচ্ছেন, এমন অনেকে খাঁ-ই আসবেন যাবেন, আর প্রকৃত বাঙ্গালীর ভূগোলের মতো ইতিহাস ভাষা সংস্কৃতি সব হারিয়ে যেতে থাকবে।

শুধু সৌর বছর অনুযায়ী গণনার সূত্রে আন্তর্জাতিক গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের সাথে সঙ্গতির কারণেই নয়, বঙ্গাব্দ আর একটি কারণেও তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলা নববর্ষ বা পয়লা বৈশাখ বাঙালির হালখাতা খোলার অর্থাৎ বাণিজ্যবর্ষ শুরু করারও দিন। সিদ্ধিদাতা গণেশ পুজো দিয়ে বাণিজ্য বর্ষের শুভারম্ভই ঐতিহ্য। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বর্ষ শুরু হয় ১ এপ্রিল থেকে আর বাংলার হালখাতা খোলে ১৪ কি ১৫ এপ্রিল। মিলটা কি নিছকই কাকতালীয়? চৈত্র সেল কি পয়লা বৈশাখ নিয়ে লিখতে বসার আগে এই মিলটা আমিও কোনও দিন খুঁজে পাইনি। বাঙালি ব্যবসায় কাঁচা এখন এই দুর্নাম রটলেও বাণিজ্যে বসত লক্ষ্মী সে কথা অনেক আগেই বুঝেছিল। তাই বছরের শুরুটাই করতে চায় ব্যবসায় পুরোনো হিসাব চুকিয়ে নতুন জমা খরচের খাতা খুলে। এক সময় রাজা জমিদাররা এই দিন প্রজাদের মিষ্টিমুখ করাতেন। রেওয়াজটা আজও আছে। তবে আজকের বাঙালি শুধু মিষ্টিতে সন্তুষ্ট নয়, তার জাত বাবুর্চির রাঁধা নিষ্ঠিবন সিঞ্চিত বিরিয়ানি শিক কাবাবও চাই।

শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায় (Sriparna Banerjee)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.