মাথা খেতে তোমার বাড়িতে হাজির হলাম গো আমার বাপচৌদ্দপুরুষ! চিনতেই পারছ, আমি এই চৈত্র মাসের বীভৎস গরমেও রঙের আস্তরে বহুরূপী! আমার অনেক রূপ; তবে, যেটা বললে সহজেই আমায় চিনতে পারবে, সেটা হচ্ছে, আমি তোমার ‘নিকটবর্তী’ কেন্দ্রের প্রার্থী। এখন তোমার বাড়িতে আমি এসেছি অতিথিরূপে। এটা আমার অনুগ্রহ, তোমার সৌভাগ্য। কারণ, দেশটা তো অতিথ্যের, অতিথিপরায়ণতার দেশ। ঐ যে গালভরা একটা কথা আছে না, ‘অতিথি দেব ভব’। সেটা বাগিয়েই আমার এখন চরম আশ তোমার মাথাটি চিবিয়েচুষে খাবার! আমি জানি গুষ্টিশুদ্ধ তুমি লেগে পড়বে আমার সেবায়। আসন পেতে, চামর দুলিয়ে, ঠাকুর ঘরের কাঁসার রেকবিতে নুনমরিচ ছড়িয়ে সাজিয়ে দেবে তোমার সহজ ঘিলু। আমি তারিয়ে তারিয়ে খাব। সে এমন এক সুচারু খাওয়া, যাতে, খাব আমি, তৃপ্ত হবে তুমি!
খাওয়ার আগে বিশিষ্ট একটি উপাদান খুবই দরকারি। ভুড়কিবাজি ঢপগুলতানির স্যালাড, যেটা আমি সঙ্গে করেই এনেছি। সেই স্যালাড আমি খাব না, তোমাকে উপহার দেব, তুমি গদগদ হয়ে প্রসাদের মতো চেটে মাথায় হাত মুছবে। আমি তখন তোমার কাছে ঈশ্বরের পরের স্টেশন।তখন আমি বেহায়ার ঝুলি থেকে তোমায় রূপকথা শোনাব। শুনে কী যে ভালো লাগবে তোমার! তুমি আপ্রাণ বিশ্বাস করবে দেশে আর গরীব বলে কিছু থাকবে না। তখন আমি একাধারে ঈশ্বর আর তোমাদেরই লোক। নির্বাচন কমিশনে হিসেব দেওয়া আমার কয়েক কোটি টাকার অ্যাকাউন্ট তখন তোমার কাছে জিরো ব্যালান্স-এ খোলা ধনজন যোজনার অ্যাকাউন্ট বলে মনে হবে। আর তুমি প্রশ্ন তুলতে ভুলে যাবে, যে দেশে জনগণকে দু’টাকায় ভর্তুকির চাল দিতে হয়, যার মানে অসংখ্য মানুষের এর চেয়ে বেশি দামে চাল কেনার সামর্থ্য নেই, তার মানে কি দেশটা স্বাধীনতার পর এক ইঞ্চিও এগোয়নি? তুমি ভাবতে পারবে না, যেখানে বিশুদ্ধ জল তোমায় কিনে খেতে হয়, না পারলে আর্সেনিক গিলে মরতে হয়, সে দেশ এগোল কোন দিক দিয়ে? আর ছেলেমেয়ের চাকরি? ওসব কথা তুমি ভাববেই না। তারা তেলেজলে বাড়ছে হাজার-দেড় হাজারি ভাতায়। তুমি ভাবছ, তাও তো কিছু দিচ্ছে, এই বাজারে এটাই কে দেয়! তুমি ভাবতে পারবে না, ভোটের আগে নিয়ম করে চাকরির বিজ্ঞাপনে এত শূন্য পদ ঘোষণা হওয়ার পর, ভোট শেষে সেগুলো ভুয়ো ভোটারের মতো হাওয়া হয়ে যায় কী করে! তুমি ভুলে যাও, তুমি খোদা আর তোমার ওপরই আমি খোদকারি করি। তুমি বুঝতেও পারো না, কখন আমি চাকর থেকে তোমার প্রভু হয়ে উঠি। তুমি জানতেও পার না, কখন তোমার প্রাপ্য আমার অনুগ্রহ হয়ে উঠেছে! কখন আমি তোমার ভগবান হয়ে উঠেছি, কখন আমার দল তোমার দেবস্থান হয়ে উঠেছে। কখন তোমার ডিপি-তে আমি তোমার পরিচয় হয়ে উঠেছি। কখন আমাকে খিস্তি দিলে তোমার গায়ে লাগছে আর তুমি প্রতিখিস্তি করে আমার হয়ে তাই লাঠালাঠি করাটাকেই নিজের কর্তব্য ভাবতে শুরু করেছ! যেখানে তোমাকে আমার ভয় পাবার কথা, আনুগত্য দেখানোর কথা; উল্টে তুমি আমাকে ভয় পাচ্ছ, আমার অনুগত হয়ে উঠেছ; আর সেটাকেই গণতন্ত্র ভেবে ঘোড়ার ঘাস কাটায় মন দিচ্ছ! হবে নাই বা কেন, ভক্তের দেশ ভারতবর্ষ যে! আমার প্রতি আর আমার দলের প্রতি ভক্তির নাম যদি দিই দেশভক্তি, তাহলে তুমি সেটা লুফে নেবে, আমি জানি; নইলে এই গরমে থেবড়ে বসে তোমার গরীব মধ্যবিত্ত তেতো মাথাটি কষ্ট করে খাচ্ছি কেন!
আমি জানি, তোমার বাড়ির বাসন মেজে দেব বললে তুমি খুশি হও, নিষিদ্ধ প্লাস্টিকের ব্যাগে তোমার বাজার করে দিতে চাইলেও তুমি খুশি হবে জানি! কারণ, দেশের হালহকিকতের চেয়ে রাত্রে তুমি যখন ঘুমোও তখন তোমার লিঙ্গ কী করে এটা জানতেই বেশি ইচ্ছে করে তোমার, বন্ধুমহলে জানাতেও। চিন ভারতের সীমান্তে কতটা এগোল, পাকিস্তান কতটা পাঁয়তারা মেরে কতটা এগোল আর আমরা তাদের কতটা খেদিয়ে দিয়ে এলাম—এর বাইরে এইসব দেশের জনগণ ও বিরোধী রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে কী প্রশ্ন তুলেছে, কোন লড়াই লড়ছে, জানতে পার? উঁহু, বাংলা মিডিয়ায় সে খবর চলে না। চলতেই দেব না। তোমার মতো মিডিয়ার মাথাও আমায় খেতে হয়। ওটা একটু কস্টলি, এই যা। আমি বলি, ওসব খবরের চেয়ে লেখো কী খেলে বিছানায় বেশিক্ষণ টেকা যায়, লোকে নেবে ভালো। নেয়ও তাই। হুঁ হুঁ বাবা, পাবলিকের পালস বুঝি বলেই না…
আচ্ছা, আজ এত পেটের কথা ওগরাচ্ছি কেন! আরে, এতেই তো মজা! এতে তুমি সব জানবে, বোঝার ভান করবে, কিন্তু সংস্কারের মতোই আমাকে ছাড়তে পারবে না কিছুতেই। এই যেমন এখন আমার ঢপবাজিটা ধরতে পারছ না এমন নয়, তবুও তোমার আমায় বিশ্বাস করতে প্রবল ইচ্ছে করছে। এবারের ঢপের প্রতিশ্রুতির কানাকড়িও যখন রাখব না, আগামী পাঁচ বছর আমার টিকিটিও ছুঁতে দেব না; তারপর আবার তোমার কাছে একগুচ্ছ ঢপ নিয়ে আসব, তখনও তুমি এমনি করে আমায় বিশ্বাস করবে। মজাটা এখানেই! তাই না?
তাছাড়া এই যে নিজের এত কথা শেয়ার করার সাহস পাচ্ছি, তার আর একটা কারণ এটাও যে, এখন তো সবই প্রতীকী। মিছিল প্রতীকী, প্রতিবাদ প্রতীকী, বিরোধীতাও প্রতীকী! এমনকি গালাগালিও প্রতীকী। বলতে কি, পোর্টালের কমেন্টস বক্সে কিংবা সোশ্যাল সাইটে গুষ্টি তুলে ধর্ম তুলে খিস্তি দিয়ে অপছন্দের বিষয়ে প্রতিবাদের নতুন চল এসেছে! কলকাতার ধুলো ধোঁয়া রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করার হ্যাপা অনেক, দায়িত্ব অনেক, যুক্তি জোগানোর দায়ও থাকে! এখানে সে ঝামেলা নেই। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এ পথেই একদিন বাঙালির ক্রমমুক্তি হবে! বাঙালিত্বও তো শুধু এখন একটা মাছভাতের প্রতীকমাত্র! তাই না?
যে দেশের যে রাজ্যে সরকারি হাসপাতাল মাত্রই সুপারস্পেশ্যালিটি, নেতা না ধরলে বেড মেলে না, যেখানে বেসরকারি হাসপাতালে সিজার ছাড়া বেবি হয় না; সেখানে আমার একটাই মন্ত্র, তোমরা আমার চামচা হও, আমি তোমাদের উন্নয়ন দেব! হেউ…উ…শেষেরটা ঢেঁকুর, তোমার মাথা খাওয়ার স্টেজ ওয়ান আপাতত শেষ…জয় গণতন্ত্র!