এত মানুষ পথে! দল নেই, রং নেই, জলবায়ু ধর্মঘটের বিশাল মিছিল! এ যেন এক অন্য কলকাতা

কলকাতা থেকে সুইডেনের দূরত্ব কত দূর? মানচিত্র বলছে, ৬৭৫০ কিলোমিটার। কিন্তু শুক্রবারের মধ্য কলকাতার সবুজ মিছিল বলল, মানচিত্রের দূরত্ব যতই থাক, তাকে এই মুহূর্তে পরোয়া করছে না হৃদয়ের সঙ্গে হৃদয়ের দূরত্ব। কারণ সেই সুইডেনেরই কিশোরী কন্যা গ্রেটা থুনবার্গ, আজ এই শহরের হাজার দেড়েক মানুষের লিডার। পথনির্দেশক। জীবনেও চোখে না দেখা, ইন্টারনেটে ভাসা-ভাসা জানা সেই মেয়েটির কথাই তাঁদের নাড়িয়ে দিয়েছে। তারা ভয় পেয়েছে। তাই পথে নেমেছে।

ভয় পৃথিবীর সব গাছ ফুরিয়ে যাওয়ার। ভয় সমুদ্রগুলো সব প্লাস্টিকে ভরে যাওয়ার। ভয় প্রশ্বাস নিতে না পারার। গ্লোবাল ওয়ার্মিং সম্পর্কে এমনটাই জেনেছে তারা। জেনেছে, মানুষের লোভের জন্য গাছ-জল মরে যাওয়া আর মানুষের স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য যন্ত্রপাতির ধোঁয়া বাড়তে থাকা– এই সব মিলিয়ে একটু একটু করে ধ্বংস করে ফেলছে পৃথিবীকে। আর জেনেছে, পৃথিবীর এই ধ্বংস হয়ে যাওয়া আটকাতেই গলা তুলেছে গ্রেটা থুনবার্গ।

দুনিয়ার রাষ্ট্রনেতাদের উদ্দেশ্য করে গ্রেটা ধমকে দিয়েছে, কেন তাঁরা পৃথিবীকে রক্ষা করার জন্য কিছু করছেন না! কেন বন্ধ করছেন না প্লাস্টিক উৎপাদন, কেনই বা নিষিদ্ধ করছেন না গাছ কাটা। কেন প্রতিনিয়ত নতুন নতুন বাড়িঘর-কলকারখানার ভিড়ে চাপা পড়ে যাচ্ছে অসংখ্য বনভূমি, কেন নাগরিক জীবনের ভয়াবহ দূষণ গিয়ে সমুদ্রের জলে মিশে মেরে ফেলছে মাছ-কচ্ছপ-তিমি-হাঙর!

এই সব কেন আজ ছুঁয়ে ফেলেছিল শহর কলকাতাকেও। জলবায়ু ধর্মঘটের মিছিল নেমেছিল কলেজ স্ট্রিট থেকে সুবোধ মল্লিক স্কোয়ার পর্যন্ত। অসংখ্য ব্যানারে, প্ল্যাকার্ডে ছেয়ে গিয়েছিল আকাশ, দাবি উঠেছিল পৃথিবীকে বাঁচাতে হবে। এই সঙ্কট থেকে রক্ষা পেতে হবে। স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়েদের কচি গলা স্লোগান তোলে, সেভ আর্থ! সেভ নেচার! সেভ ফিউচার!

এবং সেই মিছিলেই পা মেলান জাতীয় পরিবেশ আন্দোলনের অন্যতম মুখ, মেধা পাটেকর! দেশের নানা প্রান্তেই প্রকৃতি রক্ষার কাজে দেখা যায় তাঁকে। দেখা গেল আজও। কলকাতা শহরের এই মিছিলকে যেন আরও একটু দৃঢ় করে দিল তাঁর পদক্ষেপ, তাঁর কথাবার্তা। স্কুলপড়ুয়া এবং যুবসমাজকে এগিয়ে আসতে দেখে তিনি আশা রাখলেন, যে পৃথিবী বাঁচানোর এই লড়াই এগিয়ে যাবেই।

এ শহরে মিটিং-মিছিল নতুন নয়। লেগেই থাকে বলা যায়। কিন্তু সে সবের সঙ্গে আজকের এই মিছিলের দূরত্ব লক্ষ যোজন। এই মিছিলের কথা শুনে বিরক্ত হতে ভুলে যাচ্ছেন পথচারীরা। একটা সময়ে যখন মিছিল সুবোধ মল্লিক স্কোয়ার পৌঁছয়, তখন ভিড় এতই বাড়ে, যে আগাম সতর্কতা স্বরূপ অথিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। পথঘাট অবরুদ্ধ হয়ে যাক। সে হোক, সবুজের দাবিতে পথে নামা এ শহরের সৌন্দর্যই যে আলাদা!

হ্যাঁ, নিজেদের ভবিষ্যতের স্বার্থেই এই মিছিলে এসেছে তারা। এমনই জানাল শহরের নাম করা এক স্কুলের ছোট ছোট মেয়েরা। তাদের কথায়, যে ভাবে দূষণ বাড়ছে, যে ভাবে সবুজ কমে যাচ্ছে, তাতে তারা নিজেদের ভবিষ্যতের দুর্গতি বুঝতে পারছে। ক্লাস ফোরের এক পড়ুয়ার কথায়, তাকে নিয়মিত ইনহেলার নিতে হয়, পলিউশন থেকে অ্যালার্জির কারণে। এটা রোজ বাড়ছে। বড় হয়ে কোথায় পৌঁছবে, সে জানে না।

অন্য এক স্কুলের ক্লাস সিক্সের পড়ুয়া আবার দেখে ফেলেছে ইন্টারনেটের জনপ্রিয় পরিবেশধর্মী ওয়েব সিরিজ ‘আওয়ার ব্লু প্ল্যানেট’। সেখানে সারা পৃথিবীর পশু-পাখিদের মৃত্যু দেখে সে রীতিমতো আতঙ্কিত। এবং সে বুঝেছে, পশুপাখিদের পরেই পালা তার এবং তার মতো অসংখ্য মানুষের।

কিন্তু এই মিছিলের শেষ কোথায়। হাজার দেড়েক মানুষের এই স্বতঃস্ফূর্ত পথে নামা কোথায় কোন বার্তা পৌঁছবে?

এ বিষয়ে এখনও ধোঁয়া রয়েছে। তবে কিছু যে করতেই হবে, তা সকলের কাছেই পরিষ্কার। হাত গুটিয়ে বসে থাকতে রাজি নন কেউ। বড়রা বলছেন, “আমরা তো পার করে ফেললাম সময়টা। ছোটদের কী দিয়ে গেলাম! পৃথিবীর ধ্বংসস্তূপে ওরা কেমন করে বাঁচবে!”

কলেজপড়ুয়া তরুণতরুণীদের পণ, যা হয়ে গেছে তা হয়ে গেছে। আর গাছ কাটতে দেবেন না তাঁরা। আসন্ন নির্বাচনে তাঁরা দাবি রাখবেন পরিবেশ রক্ষার বিষয়কে অগ্রাধিকার দিতে। তাঁদের কথায়, “ছোটদের জন্য সুন্দর পৃথিবী গড়ে দিয়ে যাওয়া আমাদের দায়িত্ব। দূষণ রুখতে যা হয়, তা-ই করব। গাছ লাগাব যত পারব। জলাজমি বোজাতে দেব না। মানুষকে বোঝাব জল-জঙ্গল রক্ষা করার দায়িত্ব ও প্রয়োজনীয়তা। আমরা চেষ্টা করলে ঠিক পারব।”

হ্যাঁ, চেষ্টা করলে নিশ্চয় সম্ভব। এমনটাই মনে করছেন সকলে। এ দিনের মিছিল বস্তুত কোনও সংগঠিত উদ্যোক্তা বা নির্দিষ্ট ব্যানার বা কোনও একটি দলের ডাকে আয়োজিত হয়নি। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাসিয়ে দেওয়া একটি মিছিলের ডাক যে এত বড় চেহারা নেবে, তা ভাবতে পারেননি কেউ-ই।

২৩-২৭ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্কে বসেছিল রাষ্ট্রপুঞ্জের পরিবেশ সংক্রান্ত অধিবেশন। সুইডেন থেকে একটি ছোট্ট নৌকো নিয়ে, সে অধিবেশনে যোগ দিতে নিউ ইয়র্ক পাড়ি দিয়েছিল গ্রেটা। সেখানেই ধমকে এসেছে তাবড় রাষ্ট্রনায়কদের। এবং সেখানেই ডাক দিয়েছে, বিশ্ব জুড়ে জলবায়ু ধর্মঘটের।

গ্রেটা সেখানে রাষ্ট্রনায়কদের বলেছে, “তোমরা পৃথিবীকে খুন করছো, এত আস্পর্ধা!”

তাই এর বিরুদ্ধে রাস্তায় নামুক সকলে। দাবি তুলুক, পৃথিবীকে তিলেতিলে মারা বন্ধ করার। আগামী প্রজন্মকে বাঁচার পথ করে দেওয়ার। এই চিৎকার যেন পৃথিবীর প্রতিটা কোণায় পৌঁছে যায়, সেটাই চায় গ্রেটা। সে পথে এগোচ্ছে পৃথিবীর অসংখ্য দেশ। প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান, আফগানিস্তান, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই এই মিছিলে। ভারতে ইতিমধ্যেই মুম্বই, দিল্লি, বেঙালুরুতে পালিত হয়েছিল জলবায়ু ধর্মঘট। এবার সে তালিকায় রইল কলকাতাও।

তিয়াষ মুখোপাধ্যায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.