পশ্চিমবঙ্গে গত পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রাক্কালে বীরভূমের লাল মাটির বুক কাঁপিয়ে তৃণমূল নেতা অনুব্রত মণ্ডল হুমকি দিয়েছিলেন, ভোটে ‘চড়াম চড়াম’ শব্দ তুলে ঢাক বাজবে। ঢাকের চামড়াটা যে তৃণমূল বিরোধীদের পিঠের চামড়া সেটা স্পষ্ট করে বলেননি কিন্তু ইঙ্গিতটা অস্পষ্ট ছিল না। আর বলেছিলেন, ভোটাররা ভোট দিতে এলে গুড়বাতাসা খাওয়ানো হবে। সেই অনুব্রতই এবার সাংসদ নির্বাচনের আগে দলীয় কর্মীদের হাতে পাঁচন (কাঁচা বাঁশের লাঠি) তুলে দিয়ে বলেছেন, ঝামেলা করলে পাঁচনের বাড়ি পড়বে পিঠে। তা সে বিরোধী দল কিংবা কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী যেই-ই হোক না কেন। এখানেই থামেননি অনুব্রত। ভোটারদের নকুলদানা বিলোচ্ছেন ভোটের প্রচারে বেরিয়ে। নকুলদানার যে আরেক নাম দেশি বোমা আর বন্দুকের ছররা— সে তো কারো অজানা নয়।
বঙ্গ রাজনীতির সংস্কৃতির ময়দানে অনুব্রত এক নয়া অনুসঙ্গ। আসলে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে শিষ্টাচার আর সৌজন্যবোধের এহেন অবলুপ্তির মূল অনুঘটকের কাজ করেছেন তৃণমূল কংগ্রেসের দলনেত্রী। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই যিনি মানুষের মনে মোদী বিরোধিতা তীব্র করে তুলতে একটি অঙ্গরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়ে গোটা ভারত যুক্তরাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীকে হিটলার, স্ট্যালিন— এমনকী গব্বর সিংহ আখ্যায় ভূষিত করতেও দ্বিধা করেননি। গত পাঁচবছর ধরে প্রধানমন্ত্রীকে কোমরে দড়ি দিয়ে জেলে ভরবেন বলে শাসাচ্ছেন। আর নিঃসন্দেহে মুখ্যমন্ত্রীর সেই ‘রাজনৈতিক সৌজন্যবোধ’-এর সঙ্গে তাল ঠুকতেই বোধহয় কলকাতার মতো ঐতিহ্যশীল শহরের অর্ধশিক্ষিত প্রথম নাগরিক মহানাগরিক ফিরহাদ হাকিম দক্ষিণ কলকাতা লোকসভা কেন্দ্রের বামপন্থী প্রার্থী অতি উচ্চ শিক্ষিতা অধ্যাপিকা ড. নন্দিনী মুখোপাধ্যায়ের মতো জনগণগ্রাহ্য এক ভদ্রমহিলাকে রকবাজ ইভটিজারদের ভাষায় ‘কে তুমি, নন্দিনী’ বলে অশ্লীল ইঙ্গিত করতেও দ্বিধা করেন না। গোটা বাঙ্গলার রাজনৈতিক ময়দানে আজ তাই শুধু অসাংবিধানিক ভাষাই নয়, অশ্লীল ভাষার বান ডেকেছে।
এর কারণটা অবশ্য ঐতিহাসিক। পাশ্চাত্যের জাতিরাষ্ট্রগুলি ল্যাটিন ভাষা ও ধর্মীয় প্রভাবের আধিপত্যমুক্ত হয়ে যে শ্রমে ও সদিচ্ছায় জাতিরাষ্ট্র গড়ে তুলেছিল এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পত্তন করেছিল সেই ধারা ঔপনিবেশিক চরিত্র থেকে মুক্ত হতে ভারতীয় উপমহাদেশকে সাহায্য করেনি। ফলে আদর্শগত বিপ্লবের পথে স্বাধীনতা অর্জনের বদলে শাসকদের সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতে হস্তান্তর ঘটানোর ফলে আকাঙ্ক্ষিত সমাজ পরিবর্তনও ঘটেনি। পরিণতি হলো : সমাজে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটেনি। সৌজন্যবোধ ঐতিহ্য ভুলে ভিন্ন পথে পা বাড়িয়েছে। আমরা কি কেউ ভুলতে পারব বা অস্বীকার করতে পারব যে ভারতবর্ষের বিভাজনের মধ্য দিয়ে গঠিত দুটি নতুন দেশ ভারত এবং পাকিস্তানের স্বাধীনতা এসেছিল দুটি রাজনৈতিক সংগঠন কংগ্রেস এবং মুসলিম লিগের মধ্যে তীব্র দ্বন্দ্ব এবং সংঘাতের মধ্য দিয়ে এবং দুটিই পৃথগন্ন হয়েছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আশীর্বাদের দাক্ষিণ্যে। সেখান থেকেই জন্ম নিয়েছে বিদ্বেষ-বিরূপতা, সংহিতার সংঘাত। রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে শুদ্ধ রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেনি।
আসলে এই মূল্যবোধহীন এবং শিষ্টাচারহীন রাজনৈতিক সংস্কৃতি ব্যক্তিগত অহংবোধ এবং রাজনৈতিক অদূরদর্শিতারই পরিচায়ক। আদর্শের অভাব,নীতির অভাব এবং রাজনৈতিক অস্তিত্বের সংকট থেকে উদ্ভূত এই অপসংস্কৃতির রাজনীতি ভয়ংকর ভাবে অপরিশীলিত। ফলত সংসদে দাঁড়িয়ে জনপ্রতিনিধিদের ভাষা এতটাই অসংযত হয়ে ওঠে কখনও কখনও তা কার্যবিবরণীতে উল্লেখ করা থেকে বিরত থাকতে হয় স্পিকার মহোদয়কে। অসহিষ্ণুতা, স্থূল আচরণ, অযৌক্তিক বিতর্ক এবং অকারণ আক্রমণ প্রতি মুহূর্তে আজকের রাজনীতিকে পদদলিত করছে। কেউ একটিবার ভেবে দেখেন না, বিশ্ব রাজনীতির দরবারে ভারতীয় রাজনৈতিক মহলের এই আচরণ কোন বার্তা বয়ে নিয়ে যাচ্ছে! ভদ্রতা, বিনয়, সদাচার রাজনীতি থেকে অন্তর্হিত হওয়ার পিছনে মূল দায় অবশ্যই অগ্রজ রাজনীতিবিদদের যাঁরা বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে অনুধাবন না করে উড়িয়ে দিয়েছেন। ফলে বীতশ্রদ্ধ পরিশীলিত মেধাবী ও বৌদ্ধিক জনগণ নিঃশব্দে রাজনীতির দরজাগুলিকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেছেন নিজের পথে। রাজনীতির পথে হাঁটেননি।
ভোট এসে গেছে। রাষ্ট্রের নতুন সরকার গঠনের ভোট। শুরু হয়ে গেছে জোরদার প্রচার। দেওয়াল লিখন, পোস্টার এসব গতানুগতিকতার বাইরে গিয়ে ডিজিটাল মিডিয়ার দেওয়ালে দেওয়ালে গান, ছড়া, ব্যঙ্গচিত্রের মাধ্যমে স্লোগানের আস্ফালন। এখনই উন্মুক্ত মন নিয়ে চিন্তাভাবনার দরকার কোন ভাষায় রাজনৈতিক স্লোগানকে বিধৃত করবেন রাজনীতিবিদরা ! মিথ্যা কলঙ্কের দায় বিপক্ষের ঘাড়ে চাপানো থেকে নিবৃত্ত থেকেও কীভাবে রাজনৈতিক জয়ের স্বাদ পাওয়া যায়। রাজনৈতিক সংস্কৃতির ইতিহাস থেকে কলঙ্কিত অধ্যায়গুলির অনুসরণ না করে কীভাবে আরও একবার নিজেদের মানসিকতাকে টয়লেট-রাজনীতির প্রকোপ থেকে মুক্ত করে, এযাবৎ গড়ে ওঠা ভুলগুলোকে পরিত্যাগ করে, অগ্রজদের ভুলগুলিকে সংশোধন করে নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করা যায়, রত হওয়া যায় বিপরীত পথের চর্চায় আর শুভযাত্রার উন্মোচন করা যায় চৈতন্যের শুদ্ধতার পথে।
সনাতন রায়