নববর্ষ দখল এবং বাঙালির সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ

ইদানীং একটা নতুন মত খুব মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে যে বঙ্গাব্দের সূচনা করেন মোগল বাদশা আকবর। এই মতটা বহুদিন ধরেই মূলধারায় আসার চেষ্টা করছিল। বাংলাদেশি মুসলমানদের একটা অংশ এই মতের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হলেও এপার বাঙ্গলায় এর মূল মদতদাতা হলেন বামপন্থী বুদ্ধিজীবীরা এবং অবশ্যই নিজের ইতিহাস না জানা হিন্দু বাঙালিরা। নিজস্ব নববর্ষের এই বিকৃত ইতিহাসই তারা সাদরে গ্রহণ করেছে। বাঙালির লিখিত ইতিহাস না থাকা এবং যেটুকু আছে, সেটুকুও খুব একটা সহজলভ্য না হওয়াতেই বাঙালির মনে নিজের ইতিহাস নিয়ে একটা শূন্যস্থান তৈরি হয়েছে। এই শূন্যস্থানের সুযোগকে কাজে লাগিয়েই ফাঁকা মাঠে গোল দিতে চাইছে ‘আকবর বঙ্গাব্দের প্রতিষ্ঠাতা’ তত্ত্ব।
বঙ্গাব্দ যে আকবর চালু করেননি, এটা ধরতে পারার জন্য কোনও বড়ো ইতিহাসবিদ হতে হয় না। বোধশক্তি সামান্য প্রয়োগ করলেই এই কাণ্ডজ্ঞানহীন মিথ্যার পাঁচিল হুড়মুড়িয়ে ধসে পড়বে। বঙ্গাব্দ অনুযায়ী নববর্ষ পালিত হয় পয়লা বৈশাখ। এই পয়লা বৈশাখ বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুসারে কখনো ইংরেজির ১৪ই এপ্রিল আবার কখনো পড়ে ইংরেজির ১৫ই এপ্রিল। একই সময়ে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে নববর্ষের উৎসব পালিত হয়। কেরালাতে যার নাম বিশু, তামিলনাড়ুতে পুথান্ডু, পঞ্জাবে বৈশাখী, অসমে ভাস্করাব্দ শুরুর উৎসবে পালিত হয় রঙালী বিহু, ত্রিপুরার উপজাতিদের মধ্যে বৈসাগু ইত্যাদি। তো এখন প্রশ্ন হলো, ভারতের এতরকম নববর্ষ একই সময়ে প্রায় একই দিনে পড়ছে কীভাবে, যদি আকবর কেবলমাত্র বঙ্গাব্দটুকুই চালু করে থাকেন? এবং আরও প্রশ্ন হলো, আকবরের রাজধানী দিল্লির কাছেই পঞ্জাব। অথচ পঞ্জাবের বৈশাখীর প্রচলন করেন আকবর। এমন কোনও মত প্রচলিত নেই। যেখানে দিল্লি থেকে পঞ্জাব অনেক কাছে। তাহলে মোগল বাদশা আকবর ঘরের পাশে পঞ্জাবে বৈশাখী চালু না করে উত্তর ভারত, মধ্যভারত পেরিয়ে সোজা বাঙ্গলায় এসে বঙ্গাব্দ চালু করলেন কেন?
দিল্লির আশেপাশের অঞ্চল দিয়ে শুরু করলেন না কেন? আরও মজার ব্যাপার হলো, দিল্লি এবং তৎসংলগ্ন উত্তর ভারত এবং মধ্য ভারতের বিস্তীর্ণ এলাকায় বর্ষপঞ্জি হিসেবে বিক্রম সংবৎ চালু না করে শুধুমাত্র বাঙ্গলাতেই কেন আলাদা একটা বঙ্গাব্দ চালু করতে গেলেন? বাকি ভারতে কেন নয়? কারণ যে কোনও রাজা যখন কোনও নতুন অব্দ চালু করবেন, তখন খুব স্বাভাবিকভাবেই গোটা রাজত্বে একই অব্দ চালু করবেন। অতএব, নিজের রাজত্বের বাকি অংশের জন্য আকবর রাখলেন একরকম বর্ষপঞ্জি, আর শুধু বাংলার জন্য বানিয়ে দিলেন বঙ্গাব্দ। এটা মারাত্মক রকম কষ্টকল্পনা হয়ে যাচ্ছে না কি?
উদাহরণস্বরদপ বলা যায়, রাজা বিক্রমাদিত্যের কথা। বিশাল ছিল তাঁর রাজত্বের পরিসীমা। ভারতবর্ষ ছাড়িয়ে এশিয়ার বিস্তীর্ণ অংশ এমনকী ইউরোপের কিছু অংশে তার শাসনের সীমা। তবে তাঁর সম্পূর্ণ রাজত্বের জন্য তিনি প্রচলন করেন একটিই বর্ষপঞ্জি, যার নাম বিক্রম সংবৎ। মল্লরাজ আদিমল্ল তাঁর গোটা রাজত্বের জন্য চালু করেন মল্লাব্দ। কামরূপরাজ ভাস্করবর্মন তাঁর গোটা রাজত্বের জন্য যে বর্ষপঞ্জি চালু করেন, তার নাম ভাস্করাব্দ। তাহলে আকবর ব্যতিক্রম হবেন কেন? কারণ নিজের রাজত্বের একেক জায়গায় একেক রকম বর্ষপঞ্জি চালু করলে তো রাজকর্মচারীদের পক্ষেও দিন গণনা করা মুশকিল হয়ে উঠবে। এই প্রশ্নগুলো মনে এলেই ‘আকবর বঙ্গাব্দ চালু করেছিলেন’-এর ভিত দুর্বল হতে শুরু করে। কারণ এসব প্রশ্নের কোন গ্রহণযোগ্য উত্তর, ‘আকবর বঙ্গাব্দের প্রতিষ্ঠাতা’ তত্ত্বের তাত্ত্বিকরা এখনো বানিয়ে উঠতে পারেননি।
ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, আকবর সত্যিই এক নতুন বর্ষপঞ্জি চালু করেন। যার কথা আকবরের সমসাময়িক জীবনী এবং ঐতিহাসিকদের লেখায় রয়েছে। তবে সেই বর্ষপঞ্জির নাম ‘তারিখ-ই-ইলাহি’। সেই বর্ষপঞ্জির সঙ্গে এবং তার গণনাপদ্ধতির সঙ্গে বঙ্গাব্দের বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই এবং কণামাত্রও মিল নেই। এমনকী আকবরের কোনও জীবনীতে এমন কোনও তথ্য প্রমাণের উল্লেখ নেই যে আকবর তার রাজত্বের বাকি অংশ বাদ দিয়ে শুধুমাত্র বাংলার জন্য একটা আলাদা বর্ষপঞ্জি গঠন করেন, যার নাম বঙ্গাব্দ। আকবর নিজেও নিশ্চয়ই ভাবতে পারেননি, যে তার মৃত্যুর কয়েক শতক পর তার রাজত্বের এক প্রান্তিক ভূখণ্ডের নববর্ষ প্রতিষ্ঠার কৃতিত্ব তিনি পেয়ে যাবেন। আর সেজন্যই ‘আইন-ই-আকবরি’র রচয়িতারাও আকবরের বঙ্গাব্দ প্রতিষ্ঠার প্রমাণ তো দূরের কথা, উল্লেখ মাত্র এইসব বইতে রেখে যাননি। শুধু সেটুকুই নয়, বাঙ্গলা এবং কামরূপের বহু প্রাচীন মন্দিরগাত্রে এবং তাম্রলিপিতে বঙ্গাব্দের উল্লেখ আছে, যেটা আকবরের সিংহাসনে বসার বহু আগের। যেমন পশ্চিমবঙ্গের মৃন্ময়ীমাতার মন্দির ৪০৪ বঙ্গাব্দে প্রতিষ্ঠিত। এই মন্দির শুধু আকবর নয়, বখতিয়ার খিলজিরও আগমনের আগে প্রতিষ্ঠিত। আকবর যদি বঙ্গাব্দের প্রতিষ্ঠাতা হন, তাহলে আকবরের বহু শতাব্দী আগের মন্দির গাত্রে এবং তাম্রলিপিতে বঙ্গাব্দের উল্লেখ কোথা থেকে এল?
তবে এসব বাধা আকবর বঙ্গাব্দের প্রতিষ্ঠাতার তাত্ত্বিকদের টলাতে পারেনি। তাদের মতানুযায়ী আকবর দিল্লির সিংহাসনে বসার পরই বঙ্গাব্দ চালু হয়। এই মতের মুশকিল হলো, আকবর সিংহাসনে বসেন ইংরেজি ১৫৫৬ সালে। তার রাজত্ব চলেছিল ১৬০৫ সাল পর্যন্ত। বর্তমানে ইংরেজি ২০১৯ সাল। যদি ধরে নিই আকবর ১৫৫৬ সালেই বঙ্গাব্দ চালু করেন, তাহলে ইংরেজি ১৫৫৬ সালে হওয়া উচিত ০ বঙ্গাব্দ এবং ইংরেজি ১৫৫৭ সাল হওয়া উচিত বঙ্গাব্দ–১। সেক্ষেত্রে ইংরেজি ২০১৯ সাল হওয়া উচিত ২০১৯ – ১৫৫৬ = ৫৬৩ বঙ্গাব্দ। অথচ আমরা সকলেই জানি ২০১৯ সালের ১৫ই এপ্রিল ১৪২৬ বঙ্গাব্দের শুরু। তাহলে আকবর বঙ্গাব্দের প্রতিষ্ঠা করলে, প্রায় হাজার বছরের পার্থক্য আসছে কীভাবে? তখন ‘আকবর বঙ্গাব্দের প্রতিষ্ঠাতা’-র তাত্ত্বিকরা সব দলে দলে মাথা চুলকাতে লাগলেন। হিসেবের এত বড়ো গোঁজামিল তারা মেলাবেন কীভাবে? তখন তারা নতুন পদ্ধতির আশ্রয় নিলেন। তারা বললেন, মোগল বাদশা আকবর নাকি বঙ্গাব্দ প্রচলন করেন ইসলামের আরব্য নবি হজরত মহম্মদের হিজরতের বছর অনুসারে। হজরত মহম্মদ মক্কা থেকে মদিনার দিকে যাত্রা বা হিজরত করেন ইংরেজি ৬২২ খ্রিস্টাব্দে। এই হিজরত থেকেই ইসলামি বর্ষপঞ্জি হিজরি গণনা শুরু। অর্থাৎ ৬২২ খ্রিস্টাব্দকে শূন্য বঙ্গাব্দ এবং ৬২৩ বঙ্গাব্দকে বঙ্গাব্দ-১ ধরে আকবর বছর গণনা চালু করেন। তাহলে আমরা যদি হিসেব করি, তাহলে এই বছর হওয়া উচিত ২০১৯ – ৬২২ = ১৩৯৭ বঙ্গাব্দ। অথচ এটা ১৪২৬ বঙ্গাব্দ। তাহলে প্রায় তিরিশ বছরের পার্থক্য এল কীভাবে?
এবং আরও প্রশ্ন হলো, হিজরত দিয়েই যদি আকবর বঙ্গাব্দ গণনা শুরু করতে চান, তাহলে বঙ্গাব্দের গণনাপদ্ধতি হিন্দু সূর্যসিদ্ধান্ত মতে কীভাবে হলো? যিনি হিজরতের মত গুরুত্বপূর্ণ ইসলামি ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখতে আস্ত বঙ্গাব্দ চালু করলেন, সেই বঙ্গাব্দের গণনাপদ্ধতির সাথে ইসলামি হিজরি বর্ষপঞ্জির কিছু সঙ্গতি থাকা উচিত। শুধু তাইই নয়, বঙ্গাব্দের মাসের নাম বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ এবং বারের নাম সোম, মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি ইত্যাদি কীভাবে হতে পারে? এই সমস্ত মাসের নাম এবং বারের নাম সারা ভারতের প্রায় সমস্ত হিন্দু বর্ষপঞ্জিতেই এক। হিজরত অনুসারে এ কেমন বর্ষপঞ্জি চালু করলেন আকবর, যার গণনাপদ্ধতি চান্দ্রমাস অনুসারে হলো না, বারের নাম শুক্র-শনি থেকে জুম্মা-আল সাবাত হলো না। মাসের নামও বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ থেকে মাহে রমজান- রবিউল আওয়াল ইত্যাদি হলো না। বঙ্গাব্দের সমস্ত কিছুই যে ভারতের অন্যান্য হিন্দু বর্ষপঞ্জির মতো রইল, যার জাজ্বল্যমান প্রমাণ এই একই সময়ে তামিল নববর্ষ পুথা থেকে মালোয়ালি নববর্ষ বিশু, কামরূপের নববর্ষ ভাস্করাব্দ ইত্যাদি পড়া। গণনা পদ্ধতি একই রকম না হলে তো আর ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের এতগুলো হিন্দু নববর্ষ এই একই সময়ে পড়তে পারে না। তাহলে, এ কেমন নতুন বঙ্গাব্দ চালু করলেন আকবর, যার কোনকিছুই বাকি ভারতের অন্যান্য হিন্দু বর্ষপঞ্জির থেকে আলাদা হলো না, সবটুকুই একই রয়ে গেল ? কিছু যদি নাই পাল্টায় তাহলে হিজরতের অনুপ্রেরণায় আলাদা বর্ষপঞ্জি তৈরির মানে কী?
তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, গোঁজামিল ইতিহাস দিয়ে সহজ সরল অঙ্কের হিসেব বা যুক্তির হিসেব, কোনটাই মিলছে না। তাহলে আসল সত্যি কী? কে করলেন বঙ্গাব্দের প্রতিষ্ঠা ? এর উত্তর দিতে গিয়ে আমরা আবার অঙ্কের হিসেবে ফিরে যাব। এতক্ষণে এই ব্যাপারটুকু নিশ্চয়ই স্পষ্ট হয়ে গেছে, যে ইংরেজি বছর এবং বাংলা বছরের মধ্যে অনেক বছরের ফারাক আছে। সেটা কত বছর? ২০১৯ -১৪২৬ করলে পাই ৫৯৩ সাল। অর্থাৎ বাংলা বর্ষপঞ্জি চালু হয় ৫৯৩ সাল নাগাদ। এই সময়ে এমন কেউ বাংলার সিংহাসনে বসেন, যিনি এই বর্ষপঞ্জি চালু করেন। ইতিহাস বলছে, ওই বছরই বহু খণ্ডে বিভক্ত বাংলাকে একত্রিত করে সিংহাসনে বসেন মহারাজ নরেন্দ্রাদিত্য শশাঙ্ক। মহারাজ শশাঙ্ক ছিলেন ঘোর শৈব, তাই শৈবদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বার সোমবারে তিনি সিংহাসনে আরোহণ করেন। হিসেব করলে দেখা যায়, প্রথম বঙ্গাব্দের শুরুর দিনটিও ছিল সোমবার।
‘আকবর বঙ্গাব্দের প্রতিষ্ঠাতা’, এই মতের প্রধান প্রবক্তা হলেন বাংলাদেশের শামসুজ্জামান খান, সৈয়দ আশরাফ আলি, সিরাজুল ইসলাম, আহমেদ জামাল প্রমুখ। এনাদের মধ্যে কেউ কেউ আবার আকবরকে বাদ দিয়ে আলাউদ্দিন হুসেন শা-কে বঙ্গাব্দের প্রবর্তক বলে মত দিয়েছেন। এখানে মনে রাখা দরকার, হুসেন শাহের রাজত্বকালে ইংরেজি ১৪৯৪ থেকে ইংরেজির ১৫১৯ সাল পর্যন্ত। ইনি বঙ্গাব্দের প্রবর্তক হলে বঙ্গাব্দের বয়স ৫০০ বছরের বেশি হবে না। তাহলে কেন বাংলাদেশের মুসলমান ঐতিহাসিকরা বারেবারে এরকম অবাস্তব দাবি তুলছেন? কেন তারা বাঙ্গলার ভূমিপুত্র নরেন্দ্রাদিত্য শশাঙ্ককে বাদ দিয়ে বঙ্গাব্দ প্রতিষ্ঠার সম্মান তুলে দিতে চান অবাঙ্গালি আকবর কিংবা বহিরাগত হুসেন শাহের হাতে? তারা কি বাঙ্গালির ক্ষমতার উপর এতটুকু আস্থা রাখতে পারেন না, যে কোনও বিদেশি বহিরাগতর সাহায্য ছাড়াই বাঙ্গালি নিজেই নিজের বর্ষপঞ্জি তৈরি করতে পারে? কারণ সেক্ষেত্রে আকবর বা হুসেন শা আসার আগে, বাঙ্গালির এতকাল যাবৎ চাষবাস, পূজার্চনা, বিয়ে, পারলৌকিক কাজ ইত্যাদি বর্ষপঞ্জি ছাড়াই কীভাবে সম্পন্ন হয়েছিল? যেখানে বাংলার বিভিন্ন অংশে আকবরের বহু শতাব্দী আগে থেকেই নানান বর্ষপঞ্জি প্রচলিত। মল্লাব্দ, বুদ্ধাব্দ, বঙ্গাব্দ, চৈতন্যাব্দ ইত্যাদি সম্পূর্ণভাবেই বাঙালির সৃষ্ট বর্ষপঞ্জি। বাঙ্গালিকে কৃতিত্ব দিতে কিসের এত অনীহা বাংলাদেশের শ্যামসুজ্জামান – সিরাজুল – আহমেদ জামালদের? যে বাঙালি জাতির বয়স পাঁচ হাজার বছরেরও বেশি, নিজেদের জন্য সামান্য একটা বর্ষপঞ্জিও তারা তৈরি করতে পারবে না, এমন কথা এরা ভাবলেন কীভাবে?
একটু তলিয়ে ভাবলেই বাংলাদেশের ঐতিহাসিকদের আকবর বা হুসেন শা-কে বঙ্গাব্দ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে জড়িয়ে দেবার মরিয়া চেষ্টার কারণটা বোঝা যায়। খুব বেশি দশক আগের কথা নয়, যখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি এরশাদ বাঙালির চিরাচরিত বর্ষ গণনা পদ্ধতিকে উলটেপালটে একটি নতুন কৃত্রিম বর্ষগণনা পদ্ধতি আবিষ্কার করে সেটিরও নাম রাখেন বঙ্গাব্দ। এবং এই কৃত্রিম বঙ্গাব্দকে “বাংলাদেশের জাতীয় বর্ষপঞ্জি” হিসেবে ঘোষণা করেন। এখানে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, বাংলাদেশের জনসংখ্যার শতকরা ৯২ ভাগ মুসলমান, যাদের প্রধান উৎসব হল ঈদ, মহরম, ফতেহা দোয়াজ দাহম ইত্যাদি। এখন বাংলাদেশে কি এই ঈদ, মহরম এরশাত রচিত কৃত্রিম বঙ্গাব্দ অনুসারে গণনা হয়? উত্তর হলো না। বাংলাদেশে ঈদ, মহরম ইত্যাদি সবই হিজরি গণনা পদ্ধতি অনুসারে হয়। উরস, ইজতেমা কি বঙ্গাব্দ অনুসারে গণনা হয়? বাংলাদেশের ৯২ শতাংশ তাদের সন্তানের আকিকা বা সুন্নত, নিকা কিংবা কবর জিয়ারত কি বঙ্গাব্দ দেখে করেন? আজ্ঞে না, বাংলাদেশের ৯২ শতাংশের কোনও কাজেই লাগে না বঙ্গাব্দ। তাহলে কি কারণে এরশাদ বঙ্গাব্দ-র গণনাপদ্ধতি পালটে দিলেন? বঙ্গাব্দ অনুসারে পূজা-পার্বণ গণনা করেন বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু সমাজ। শিশুর নামকরণ থেকে হাতেখড়ি, বিয়ে থেকে শ্রাদ্ধ, পুজো-পার্বণ থেকে গৃহপ্রবেশ এবং তর্পণ, সবটাই হয় বঙ্গাব্দ মেনে। তবে কি তাদের পূজা-পদ্ধতিতে ব্যাঘাত ঘটানোর উদ্দেশ্যেই ‘বঙ্গাব্দ সংস্কার’-এর নামে এরশাদের এই নববর্ষ দখলের প্রচেষ্টা? আর সেই প্রচেষ্টাকে এগিয়ে নিয়ে যেতেই কি বাংলাদেশের সিরাজুল-আশরাফ আলি-শামসুজ্জামানরা যেনতেনপ্রকারে বঙ্গাব্দের ইতিহাস থেকে হিন্দু বাঙ্গালির নামগন্ধটুকু মুছে দিতে চান ? বঙ্গাব্দ নামটুকু থাকবে, কিন্তু তার চিরচরিত গণনাপদ্ধতি পালটে দেওয়া হবে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে। বঙ্গাব্দ থাকবে, কিন্তু তার প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে থাকবে কোনও মোগল-পাঠানের নাম। তবেই তো হিন্দু বাঙ্গালির কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া যাবে তার নববর্ষ। নববর্ষ দখল সম্পূর্ণ হলে বাংলাদেশের গ্রাসে যাবে হিন্দু বাঙ্গালির এক অমূল্য ইতিহাস।
তাই বাঙ্গালিকে সবসময় সজাগ থাকতে হবে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। আমাদের নববর্ষ, আমদের সংস্কৃতির অমূল্য অংশ। বাঙ্গালির লিখিত ইতিহাস চাই, বাঙ্গালির ইতিহাস খুব সহজলভ্য হওয়া চাই। যে জাতির ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যত দুর্লভ হয়, সেই জাতির ইতিহাস বেদখল হবার সুযোগ তত বাড়ে। উদাহরণ আমাদের সামনেই রয়েছে। নিজের নববর্ষের প্রতিষ্ঠাতাকে নিয়ে হিন্দু বাঙ্গালির অজ্ঞানতাকে কাজে লাগিয়ে আকবরকে বঙ্গাব্দের প্রতিষ্ঠাতা বানাতে চায় একদল সাংস্কৃতিক আগ্রাসী। আর এদেরকে যোগ্য সঙ্গত দিচ্ছে এপারের কিছু বাঙ্গালি-ঘরশত্রু। এই আগ্রাসন ঠেকাতে চাই নিজের ইতিহাস সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান এবং সেই জ্ঞানের ক্রমাগত স্মরণ। ভুলে যাবেন না, কোনও বিদেশি বাদশা নন, বঙ্গাব্দের প্রতিষ্ঠাতা হলেন বাংলার ভূমিপুত্র রাজা শশাঙ্ক। এই ভয়ানক সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের দিনে, যখন মিডিয়ায়, ওয়েবসাইটে, খবরে, ইউটিউবে ক্রমাগত মিথ্যা তথ্য ছড়ানো হচ্ছে বঙ্গাব্দের নামে, তখন বঙ্গাব্দের প্রতিষ্ঠাতা শশাঙ্কের নাম মনে রাখা এবং এই তথ্যটিকে সমস্ত চেনা পরিচিতের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়াটাই হল বাঙ্গালির ‘সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ’। এই সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের অঙ্গীকার দিয়েই শুভ ও মঙ্গলময় হোক বঙ্গাব্দ।
স্মৃতিলেখা চক্রবর্তী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.