পশ্চিমবঙ্গের ভােট এবার যেন রামকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। অন্য সব ইস্যুকে ছাপিয়ে দশরথপুত্র শ্রীরামচন্দ্রই ভােটের সবচেয়ে বড়াে তুরুপের তাস। বাঙ্গলার ভােট রাজনীতিতে ‘শ্রীরামচন্দ্র’ এখন ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছেন। বাঙ্গলার হিন্দুরা ‘শ্রীরাম’-এর নাম মন্দিরে বসে করতেন।আসরে হতাে রামনামের চর্চা। কিন্তু এখন বাঙ্গলার রাজনীতিতে শ্রীরাম নিয়ে আলােচনা চলছে মন্দির থেকে ময়দানে, চায়ের ঠেক থেকে বারােয়ারির আড্ডায়, গৃহস্থের বৈঠকখানা থেকে জনবহুল বাজারে, ট্রেনে, বাসে সর্বত্র। যে হিন্দুরা শ্রীরামের নাম মন্দিরের পূজা-অর্চনায় বা হরিনাম কীর্তনে বা রামনামের আসরে করত এবং অল্পসংখ্যক হিন্দুরাই যে রামনামের স্মরণে নিবেদিত থাকত, সেই রামনাম এখন বাঙ্গলার ঘরে বাইরে চর্চার মূল বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে। তাই বাঙ্গলার রাজনীতিতে এখন শ্রীরামই একমাত্র আলােচ্য চরিত্র। আর এই বাতাবরণ তৈরিতে যিনি মুখ্য ভূমিকা নিয়েছেন, তিনি বাঙ্গলার । মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল কংগ্রেসের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। জয় শ্রীরামর উচ্চারণ করলেই তৃণমূল নেত্রী রেগে যাচ্ছেন। রামনাম তিনি শুনতে চান না। এই বাঙ্গলায় যদি কেউ শ্রীরাম বা জয় রাম বা জয় শ্রীরাম বলেন, তাকে তিনি জেলে ভরার নির্দেশ দিয়েছেন।
প্রসঙ্গত, সম্প্রতি সােশ্যাল মিডিয়াতে একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে নির্বাচনী প্রচারে চন্দ্রকোণার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মুখ্যমন্ত্রীর কনভয়ের সামনে ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান দেন কিছু সাধারণ গ্রামবাসী। আর তাতেই চটে গিয়ে কনভয় থামিয়ে রাস্তায় নেমে এসে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘আমাকে গালাগাল দিচ্ছে। সাহস থাকলে সামনে আয়। পালাচ্ছিস কেন?’সংবাদমাধ্যম সূত্রের খবর, এরপর ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান দেওয়ার অপরাধে তিনজনকে আটক করে পুলিশ। ধৃতদের নাম সীতারাম মিদ্দা, সায়ন মিদ্দা ও বুদ্ধদেব দোলুই।
এই ঘটনার কড়া সমালােচনা করে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ। এই সংগঠনের এক শীর্ষ কার্যকর্তা বলেন, “আমরা শুনেছিলাম ব্রিটিশদের রাজত্বে বাঙ্গলায় ‘বন্দে মাতরম’ স্লোগান দেওয়া যেত না। কেউ সাহস করে ‘বন্দে মাতরম্ বললে তাকে জেলে পােরা হতাে। এখন পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুদের জন্য একই রকমের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।‘জয়শ্রীরাম’ বললে জেলে যেতে হচ্ছে।”
হিন্দুদের রাষ্ট্রীয় মহাপুরুষ শ্রীরামচন্দ্র। যার উপর আপামর হিন্দুদের আস্থা রয়েছে। বাঙ্গলার ঘরে ঘরে যিনি পূজিত হন। সেই রামের নাম নেওয়াকে উনি গালাগালি। বলছেন? এতে বাঙ্গলার হিন্দুরা অবশ্যই অপমানিত বােধ করবেন। ওঁর এজন্য বাঙ্গলি হিন্দুদের কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত।
এই প্রসঙ্গে নরেন্দ্র মােদী বলেন, “জয় শ্রীরাম বললে এখন জেলে ভরছেন দিদি। তিনি কটাক্ষ করে আরও বলেন, দিদিইদানীং এতটাই হতাশ যে ভগবানের কথাও বলতে চান না। শুনতেও চান না। পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি এখন এমন যে কেউ জয় শ্রীরাম বললেও তাকে গ্রেপ্তার করে দিদি জেলে ভরে দিচ্ছেন। স্পিডব্রেকার দিদির অহংকার বেশি।” মােদীজী বলেন, “এবারের লােকসভা নির্বাচনে দিদির পরাজয় নিশ্চিত। তৃণমূল এবার দশটার বেশি আসন পায় কি সন্দেহ রয়েছে। কারণ, দিদির চমক, ধমক আর কোনওটাই কাজ করছে না। বিজেপির জনসভাগুলােতে কাতারে কাতারে জন সমাগম দেখে দিদির পায়ের তলার মাটি সরে গিয়েছে। নিশ্চিন্তে তিনি ঘুমােতে পারছেন না। তার রাতের ঘুম উড়ে গিয়েছে। তাই দিদি এতটাই হতাশ যে, ভগবানের নামও শুনতে চাইছেন না।”
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ‘জয় শ্রীরাম’বলায় পুলিশ তিনজনকে আটক করে। তাদেরইমধ্যে একজন হলাে সীতারাম মিদ্দা। তিনি বিজেপির যুবমাের্চার চন্দ্রকোনা দক্ষিণ মণ্ডলের সভাপতি। সীতারামবাবু বলেন, ‘পুলিশ আমার কাছে জানতে চেয়েছিল, কেন জয় শ্রীরাম বলেছিলাম। তিনি আরও বলেন, ‘জয় শ্রীরাম বলার মধ্যে অপরাধটা কোথায়? এদিকে ওই তিনজনকে আটক করে আনার ব্যাখ্যা দিয়ে পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার অলােক রাজোরিয়া বলেন, এটা ভিভিআইপির নিরাপত্তার বিষয়। মুখ্যমন্ত্রীর গাড়ির সামনে এসে এভাবে কিছু বলা যায় না। তাই জিজ্ঞাসাবাদের জন্যই থানা নিয়ে আসা হয়েছিল।
এই ‘জয় শ্রীরাম’ বিষয় নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মােদী এ রাজ্যে প্রচারে এসে বলেন, ‘জয় শ্রীরাম বলায় দিদি লােককে জেলে ঢােকাচ্ছেন। আমারও মনে হলাে, আমিও দিদিকে সরাসরি জয় শ্রীরাম বললে আমাকেও জেলে ঢুকিয়ে দেবেন। নির্দোষ যাঁরা জেলে রয়েছেন, তাহলে আমি তাদের সেবা করতে পারব। এরই সঙ্গে মমতাকে হুঁশিয়ারি দিয়ে তিনি বলেন, “রামের কাছে বড়াে বড়াে ব্যক্তির অহংকার চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গিয়েছে। আপনার অহংকার কোথায় থাকবে।
একটি নির্বাচনী সভায় তৃমমূল নেত্রী বলেছিলেন, “রামকে ওরা (বিজেপি) ভােটে এজেন্ট করেছে। সেই প্রসঙ্গ টেনে মােদীজী বলেন, “আপনাকে বলে দিচ্ছি, রাম আমাদের মাথার উপরে রয়েছেন। সংস্কৃতিতে রয়েছেন। রাম আমাদের প্রজ্ঞা, প্রেরণা। আমাদের রাজনীতির পথ প্রদর্শক।
শ্রীরামচন্দ্র সনাতন ভারতের আদর্শ, প্রাণপুরুষ। কোটি কোটি ভারতবাসীর আরাধ্য ভগবান। বাঙ্গলা সহ গােটা ভারত রামময়। সেই রামচন্দ্রের জয়ধ্বনি কি গালাগাল ? হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা বলেন, আজ থেকে প্রায় পাঁচশাে বছর আগে ফুলিয়ার গঙ্গার তীরে বসে। কৃত্তিবাস ওঝা রচনা করেছিলেন শ্রীরাম পাঁচালি, যা আজও ‘বাঙ্গলা রামায়ণ’ রূপে বাঙ্গলার ঘরে ঘরে সমাদৃত। হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র আজও বাঙ্গলার গ্রামে-শহরে ভক্তির প্লাবন। বয়ে যায়। ভিখারি ও সাধু-সন্ন্যাসীরা জয়রাম, জয় কৃষ্ণ নাম নিয়ে গৃহস্থের দুয়ারে উপস্থিত হয়। পূজাপার্বণ, উৎসব অনুষ্ঠানে আজও বাঙ্গলার গ্রাম-শহরে ভগবান রাম ও কৃষ্ণের কাহিনি অবলম্বনে যাত্রাপালা সমাদৃত। পাঠ হয় রামগান। যাতে সীতা-বিরহী রাম ও বনবাসী মা সীতার বেদনায় বাঙ্গলায় নারী-পুরুষ আজও আঁচলে চোখের জল মােছে। শ্রীরামচন্দ্র সনাতন ভারতের আদর্শ প্রাণপুরুষ। কোটি কোটি ভারতবাসীর আরাধ্য ভগবান। বাঙ্গলা-সহ গােটা ভারত রামময়। শ্রীরামচন্দ্র পুত্রধর্ম পালন করার জন্য নির্দ্বিধায় রাজসুখ ত্যাগ করে ভিখারি সন্ন্যাসীর জীবন গ্রহণ করেছেন। প্রজার প্রতি রাজধর্ম পালন। করতে সহস্র মাইল বন ও সমুদ্র পার হয়ে জীবনমরণ সংগ্রাম করেছেন। প্রজাধর্ম পালন করতে গিয়ে প্রাণপ্রিয়া পত্নী সীতাকে ত্যাগ করেছেন। তাই শ্রীরামচন্দ্র ভগবান। তিনি ঐতিহাসিক পুরুষ নাকি কাল্পনিক চরিত্র সে বিতর্ক দূরে সরিয়ে রেখেই তার থেকে আমরা অনন্ত আদর্শ শিক্ষা ও গুণে শিক্ষিত হয়ে নিজ পরিবার, সমাজ ও দেশকে সমৃদ্ধ করতে পারি।
ভারতবর্ষে বিজেপি, আর এস এস, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরং দল নিষিদ্ধ নয়। তাই। এই সব দলের সমর্থকরাও ভারতীয় সংবিধানে নিষিদ্ধ নয়। আবার রামনাম, জয় শ্রীরাম ধ্বনি আইন বিরুদ্ধ নয়। ভারতের সংবিধান রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও শােভাযাত্রার অধিকার দিয়েছে সব নাগরিককে। ভারতবর্ষের সংবিধানে। নাগরিকদের স্বাধীন মতামত প্রকাশের অধিকার রয়েছে। অথচ নাগরিকরা সে অধিকার পাচ্ছে না। শাসক দলের নেতা-নেত্রীরা সাধারণ জনগণের সেই অধিকারে বাধা দিয়ে যাচ্ছে। বিগত বেশ কয়েকবছর পশ্চিমবঙ্গের মস্তান, হার্মাদ, গুন্ডরা জোরপূর্বক শক্তিপ্রদর্শন করে সনাতন সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে চলেছে। হিন্দুরা এখন। বিরােধী রাজনৈতিক দলের হামলায় ও সন্ত্রাসে নিজের ধর্ম পালন করতে পারছে না। শ্রীরামচন্দ্রের ধ্বনি তুলতে পারবে না বলে নির্দেশ এসেছে।রামনবমীতে শােভাযাত্রা করা যাবে না। আর যদিও বা শােভাযাত্রা বের হয়, তাতেও নানা বাধা নিষেধ। ২০১৬ সালে বাঙ্গলার শাসকনেত্রী হঠাৎই চিৎকার করে বলতে শুরু করেন, রামনবমীর নামে ওরা দাঙ্গা বাধাতে চাইছে। এটা বাঙ্গলার সংস্কৃতি নয়। শােভাযাত্রাকারীরা কোথাও হাঙ্গামা করেনি কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের আক্রমণ করা হয়েছে। চন্দননগরের উর্দি বাজারে রামনবমীর শােভাযাত্রীরা আক্রান্ত হয়েছেন। ২০১৭ সালেও আবার তৃণমূল শাসকচিৎকার শুরু করে। শােভাযাত্রীদের উপর আক্রমণ করা হয় পুরুলিয়ার বাগমুণ্ডির হুড়ুমদা ও সিন্ধি গ্রামে। উত্তর ২৪ পরগনার খড় দা ও টিটাগড়ে। আসানসােলের পাণ্ডবেশ্বরে। হুগলির ভদ্রেশ্বরে ও তেলেনিপাড়ায়, কলকাতার গার্ডেনরিচ ও কালিন্দি-সহ আরও অনেক জায়গায়। গত বছর আসানসােলের ঘটনা তাে বীভৎস আকার নেয় হনুমান জয়ন্তীতে। সমস্তটাই বাইরে থেকে জেহাদি আক্রমণ। অথচ শাসক আক্রমণকারীদের। বিষয়ে উদাসীন। এছাড়াও কোথাও রথযাত্রায় বাধা ও নিষেধাজ্ঞা, কোথাও দুর্গাপুজোর শােভাযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা। দুর্গাপুজোর বিসর্জনের শােভাযাত্রায় নানা বিধি নিষেধ। নাগপাশের মধ্যে ওরা হিন্দু ধর্মের আবেগ ও ধর্মীয় নিয়মনীতিকে বেঁধে রাখতে চাইছে। বাধা দিয়ে, হামলা করে, সন্ত্রাস চালিয়ে হিন্দুত্বের ভাবাবেগকে হিন্দুবিরােধী রাজনৈতিক দল ও সেই সব দলের নেতা-নেত্রীরা দেশে অরাজকতার পরিবেশ। তৈরি করতে চাইছে। তাই ভারতীয় সনাতন সংস্কৃতিকে ধ্বংস করতে তারা উঠেপড়ে লেগেছে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং জয় শ্রীরামধ্বনি শুনে ক্ষুব্ধ হয়ে কনভয় থামিয়ে নেমে তাড়া করেছেন। বলছেন, আমাকে গালি দেওয়া। জয় শ্রীরাম ধ্বনিকে উনি গালিতে পরিণত করলেন। আসলে তৃণমূল নেত্রীর ‘রামফোবিয়া হয়েছে। তাই তিনি বলেন, আমি বিজেপির স্লোগান বলব না। বাঙ্গলার মুখ্যমন্ত্রীর কাছে শ্রীরাম ধ্বনি এখন ব্রাত্য হয়ে গিয়েছে। এই কথা বলে এক ধর্মপ্রাণ ভক্ত বলেন। যে, “রাম’নাম শুনলে, যে শ্রীরাম ধ্বনি উচ্চারণ করলে মানুষের পাপ থেকে মুক্তি ঘটে, সেই শ্রীরাম ধ্বনি বাঙ্গলার মুখ্যমন্ত্রী বলতে চান না, আবার যারা সেই রামনাম করতে চাইছে, তাদেরও তিনি গ্রেপ্তার করতে চাইছেন, এটা ভাবাই যায় না। উনি পাগল হয়ে গিয়েছেন, নাকি ওনার মতিভ্রম ঘটেছে যে এই জাতীয় মন্তব্য করছেন। বাঙ্গলার মানুষ অনেক আশা ভরসা করে বামফ্রন্ট সরকারকে তাড়িয়ে মমতা ব্যানার্জিকে জিতিয়েছিলেন। বাঙ্গলার জনগণ তাঁকেমুখ্যমন্ত্রী করেছিলেন অনেক স্বপ্ন নিয়ে, কিন্তু এখন যা করছেন, তাতে হিন্দুরা রীতিমতাে আতঙ্কে রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গটা পাকিস্তান বাংলাদেশ হয়ে গেল নাকি? হিন্দুরা বলছেন, আমরা ক্রমশ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। আমাদের দেবদেবীদের পূজার্চনার করা ও শােভাযাত্রা বের করার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হচ্ছে। সর্বোপরি শ্রীরাম ধ্বনি উচ্চারণে বাধা দেওয়া হচ্ছে। আমাদের ধর্মীয় স্বাধীনতার উপর আঘাত করা হচ্ছে। এটা কোনও ভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।
হাওড়া রেল স্টেশনে কয়েকজন যাত্রী কৌতুক করে বলেন, শ্রীরাম ধ্বনি উচ্চারণ করতে নিষেধ করা হলে শ্রীরামপুর রেলস্টেশনে যাতায়াতের জন্য টিকিট কাটার সময় কী বলব? ওই স্টেশনের নামে তাে শ্রীরাম শব্দটি রয়েছে। আবার কিছু ধর্মপ্রাণ ভক্ত বলেন, এবার শেষে কি শ্রীরামকৃষ্ণের নাম উচ্চারণ করা যাবেনা? কারণ সেখানেও তাে শ্রীরাম শব্দটি রয়েছে। আবার যাঁরা রামঠাকুরের ভক্ত, তাঁরা বলেন, আমরা কি আমাদের গুরু শ্রীরামঠাকুরের নাম উচ্চারণ করতে পারবাে না? কারণ সেখানেও তাে শ্রীরাম ধ্বনি হয়েছে। বাঙ্গলা সাহিত্যের শিক্ষকরা বলেন শ্রীরাম শব্দটিকে যদি বিশ্লেষণ করা হয়, তাহলে ঠিক এমন দাঁড়ায়—
শ্রীরাম = শ্ + র্ + ঈ + র্ + আ + ম্ + অ এর মধ্যে মূল অক্ষর ‘র্’ ‘ম্’ এবং ‘অ’ স্বরধ্বনি রয়েছে। ঠিক তেমনি ‘বন্দেমাতরম্’ শব্দটি বিশ্লেষণ করলেও দেখা যায়—
ব্ + অ + ন্ + অ + ব + এ + + আ + ত + অ + র + অ + ম্।
এই শব্দের মধ্যে মাতরম্’-এর মধ্যেও ‘র’ম্ এবং অ স্বরধ্বনি রয়েছে। অর্থাৎ ‘রাম’ শব্দের সঙ্গে ‘মাতরম্’ শব্দের মিল রয়েছে। এক্ষেত্রে কি ‘বন্দে মাতরম্’-এর উচ্চারণের সময় ‘রাম’ ধ্বনির অংশটি কি বাদ দিতে হবে? কেন না বন্দে মাতরম্’শব্দের মধ্যেও ‘রাম’ শব্দের ধ্বনি লুকিয়ে রয়েছে। তাই ‘রাম’ ধ্বনি উচ্চারণে বাধা এলে ‘বন্দেমাতরম্’ শব্দটিকে কি উচ্চারণ করা যাবে?
‘শ্রীরাম’ ধ্বনি উচ্চারণ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর এহেন মন্তব্যের জেরে বাঙ্গলার রাজনীতিতে নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়েছে। চলছে ব্যঙ্গ, চলছে কৌতুক, আবার চলছে সিরিয়াস আক্রমণ। এ বিষয়ে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মিডিয়া বিভাগের এক কার্যকর্তা জানান, ‘একটি বিশেষ শ্রেণীকে খুশি করতেই এসব বলছেন উনি।রাজ্যে লােকসভা ভােট চলছে। মুখ্যমন্ত্রীর এইসব বক্তব্যের প্রভাব নিশ্চয় ইভিএমে পড়বে। বাঙ্গলার হিন্দুদের কাছেরাম শুধু দেবতাই নন, রাষ্ট্রীয় পুরুষ।
শ্রীরাম চরিত্র সম্বন্ধে বঙ্গবাসীর সশ্রদ্ধ । অবধারণা যথার্থভাবে ফুটে উঠেছেরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ভাষা ও ছন্দ কবিতায়। শ্রীরামচন্দ্র হিন্দুর মননে শ্রেষ্ঠ ক্ষত্রিয়। তিনি বিষ্ণুর অবতার। তার রাজ্য ধর্মরাজ্য। তাই সেখানে মানুষের শােক, দুঃখ, গ্লানি কম। রামরাজ্য কেমন, তার বর্ণনা রয়েছে শ্রীবাল্মীকি রামায়ণে।
“রাঘবশ্চাপি ধর্মাত্মা প্রাপ্য রাজ্যমনুত্তমম্। ঈজে বহুবিধৈর্যজ্ঞৈঃ সসুহৃজজ্ঞাতিবান্ধবঃ॥ … রামাে রামাে রাম ইতি প্রজানামভবন কথাঃ। রামভুতং জগদভুদ রামে রাজ্যং প্রশাসতি॥”
শ্রীরামচন্দ্রের রাজ্যে সকলে আনন্দিত ছিল ও ধর্মপরায়ণ ছিল। রামকে অনুসরণ করে কেউই পরস্পরকে হিংসা করত না। কোনও দস্যু ছিল না, কোথাও কোনও অনর্থ চোখে পড়ত না। সকলে বিনয়ী ও ধর্মপরায়ণ স্বভাবের ছিল ও পুণ্যময় জীবন অতিবাহিত করত। সকলে ছিল বুদ্ধিমান ও গুণবান। সকলে গুণের সমাদর করত। রামরাজ্যে সকল ব্যক্তি উদারহৃদয়, পরােপকারী, ভক্তিপরায়ণ ছিল। রামরাজ্যের অতি সুন্দর বর্ণনা রয়েছে তুলসীদাস বিরচিত রামচরিতমানসেও। রামরাজ্যে কোথাও অকালমৃত্যু ও রােগব্যাধি ছিল না, সকলে সুন্দর দেহ ও স্বাস্থ্যের অধিকারি ছিল। কেহ দরিদ্র বা দুঃখী ছিল না। কেউ অবুঝ বা কুলক্ষণমুক্ত ছিল না। ত্রিলােকে রামরাজ্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় সকলের মন আনন্দে পরিপূর্ণ হলাে ও যাবতীয় শােক দূরীভূত হলাে। মানুষ পরস্পরের প্রতি সর্বপ্রকার শত্রুতা ভুলে গেল ও রামের প্রভাবে তাদের বৈষম্য হারিয়ে গেল।
রাম শব্দের অর্থ বহুবিধ — কল্যাণ, মঙ্গল, শান্তি প্রভৃতি। বিপরীতে রাবণ শব্দের অর্থ বীভৎস ও ভয়ংকর। আমরা রামায়ণে দেখি নানা দুর্যোগ ও বীভৎসতা অতিক্রম করে শ্রীরামচন্দ্র শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছেন। কাজেই শ্রীরাম শব্দটি কখনই অন্যায়, বিশৃঙ্খলা, দুর্নীতির পক্ষপাতী নয়। তা চিরকালীন, কল্যাণকর। ফলে এমন একটা নাম বা চরিত্র যিনি কেবলমাত্র বাঙ্গলায় নয়, সমগ্র ভারতবর্ষ এবং এমনকী বহির্ভারতেও পরম শ্রদ্ধেয় ও আদর্শের আধার। এহেন শ্রীরাম ধ্বনি উচ্চারণে মানুষের পাপ ক্ষয় হয়। মানুষ আনন্দে ও শান্তিতে থাকতে পারে। শ্রীরামচন্দ্র মর্যাদা পুরুষােত্তম। তাই তাঁর কাছ থেকেই, তার আদর্শ থেকে সংস্কার মুক্তির পাঠ নিতে হয়।
এক্ষেত্রে মানুষ যদি জীবনের উদ্দেশ্য বুঝতে পারতাে, তাহলে সমাজে সংসারে এত অশান্তি থাকতাে না। খণ্ড থেকে অখণ্ডে হাজির হওয়ার জন্য যে বােধ, যে ভাবনা তাই শ্রীরামের কাছ থেকে শিখতে হবে। এনিয়ে রাজনৈতিক তরজা বিতর্ক করা কোনও সুস্থ মানসিকতার লক্ষ্মণ নয়। শ্রীরাম ও জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি নিয়ে বাঙ্গলায় শাসক দল যে লড়াই শুরু করেছে, তা পবিত্রতা ও শান্তিকে নষ্ট করছে। একজন রাজার উচিত অন্য এক ‘আদর্শ রাজা’কে সম্মান করা। কারণ একজন শাসক বা রাজা আর এক রাজা বা শাসকের কাছে রাজার মতােই সম্মান আশা করেন। তাই শ্রীরাম ধ্বনি নিয়ে বাঙ্গলার মুখ্যমন্ত্রীর যে মন্তব্য, তা নির্বাচনের ভােট বাক্সে প্রতিফলিত হবেই— এ নিয়ে কোনও দ্বিমত নেই। কারণ বাঙ্গলার জনগণ শান্তি চায়। আদর্শ চায়। সংহতি চায়। শ্রীরামচন্দ্রের প্রতিষ্ঠিত শান্তি ও সুখের ‘রামরাজ্য’ চায়।
সরােজ চক্রবর্তী
2019-05-17