পশ্চিমবঙ্গের মানুষ বিজেপিকে জিতিয়েছেন। এ রাজ্যে বহুদিন থেকেই রাজনৈতিক চেতনা, সামাজিক উন্নয়ন, সৎ যোগ্য নেতৃত্বের জায়গা দখল করে নিয়েছিল পেশিশক্তির আস্ফালন, সিন্ডিকেটের অর্থ আর পাইয়ে দেওয়ার নােংরা খেলা। এইসব যুদ্ধাস্ত্রে অনেক বুথ পাওয়া যাবে যেখানে বিজেপি এক জন এজেন্ট ও বসাতে পারেননি, প্রচুর বুথ এমন আছে যেখানে বিজেপি এজেন্টকে আধঘণ্টার মধ্যে মেরে ধরে, ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সেই সব বুথেও বিজেপি জিতেছে। মানুষ জিতিয়েছে। শাসকদলের গুন্ডাবাহিনীর কাছে বিজেপি অনেক জায়গাতেই দুর্বল ছিল। এই অসম পেশিশক্তির লড়াইয়ে সাধারণ মানুষ মাঝখানে দাঁড়িয়েছে। মা-বোনেরা লাঠি, ঝাটা নিয়ে রণংদেহি মূর্তিতে রুখে দাঁড়িয়েছেন, কেন্দ্রীয়বাহিনীর দাবিতে ভোট হতে দেননি সাধারণ ঘরের মেয়েরা। বুকের পাঁজর যেমন ছোট্ট হৃদপিণ্ডকে রক্ষা করে, আপাত নিরীহ ব্রজবাসী যেমন শিশু কৃষ্ণকে রক্ষা করেছিল, তেমনি করেই এবার বিজেপিকে জিতিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষ। এই আশায় যে, ভারতীয় জনতা পার্টি হপিণ্ডের মতো পশ্চিমবঙ্গের সারা শরীর থেকে দুষিত রক্ত বের করে শুদ্ধ রক্তের সঞ্চার করবে। বিজেপি শ্রীকৃষ্ণের মতো কংসের ধ্বংস করবে আর সুশাসন ফিরিয়ে আনবে। এ রাজ্যের মানুষ বিশ্বাস করেছে, এরাই পারবে। কারণ এদের সাধনা আছে। ধুপকাঠি যেমন একটু একটু করে জ্বলে নিজে শেষ হয়ে যায়, আর ঘরটা সুগন্ধে ভরে যায়, তেমন এদের সঙ্গে কিছু মানুষ আছেন যারা দেশের জন্য, মানুষের জন্য নিজের সবটুকু দিয়ে নীরবে চলে যায়।
সাবেক পশ্চিম দিনাজপুরের হিলি থানা। গ্রামের নাম মুরারীপুর। কলেজের প্রথমবর্ষের ছাত্র প্রশান্ত মণ্ডল। পরম বৈভবশালী দেশ গড়ার স্বপ্ন প্রশান্তর চোখে। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের শাখার মাঠে প্রতিদিন ব্যায়াম, ছেলেদের জোগাড় করে শারীরিক কসরত, তারপর প্রার্থনা। এই অপরাধে ১৯৮৪ সালের ১৫ মার্চ শাখার মাঠে আক্রমণ করল বামপন্থী হার্মাদরা। প্রশান্তকে সেখানেই খুন করল হার্মাদরা। কিন্তু তাতে দমানো যায়নি মণ্ডল পরিবারকে। প্রশান্তের দাদা সদ্যের প্রচারক হয়ে গেলেন। একভাই দেশমাতৃকার জন্য প্রাণ দিলেন, আর অন্য ভাই সারাজীবন একটু একটু করে ভক্তি দিয়ে নিজেকে নিঃশেষ করলেন। উত্তরবঙ্গে মানুষ তো এদেরকে দেখেছেন।
সুন্দরবনের সোনাখালির অজগ্রাম উত্তর মোকামবেড়িয়া। গরিব ঘরের ছেলে ছিল অভিজিৎ সরদার। অনেক কষ্টে বিএসসি পাশ করেছিল দারুণ ভালো নম্বর নিয়ে। গ্রামে মৌলবাদীদের অত্যাচার বন্ধ করবে, গ্রামকে স্বাবলম্বী করবে, গ্রাম থেকে মেয়ে অপহরণ বন্ধ করবে এমন অনেক স্বপ্ন নিয়ে আর এস এস সংগঠনে যোগ দিয়েছিল লালু ওরফে অভিজিৎ সরদার। তার যোগ্য নেতৃত্বে জড়ো হয়েছিল অনাদি নস্কর, পতিতপাবন সরদার আর সুজিত সরদারের মতো তরতাজা যুবক। ২০০১ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি একদিনে ভারতমায়ের সেবায় বলিদান হলো চার চারটে প্রাণ। জেহাদিরা ঠাণ্ডা মাথায় আনার হোসেনের বাড়িতে খুন করল চারজন প্রতিবাদী, নিঃস্বার্থ, সমাজসেবী ছেলেকে। দক্ষিণবঙ্গের মানুষ দেখেছেন এই মতে যারা বিশ্বাস করেন, এই আদর্শ মাথায় নিয়ে যারা চলছেন তারা প্রয়োজনে নিজের প্রাণটাও দিতে পারেন। রাজ্যের মানুষ দিনের পর দিন এদের দেখছেন, এই আদর্শের প্রতি ভরসা করেছেন।
গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে এ রাজ্যে গণতন্ত্রকে থেঁতলে দেওয়া হয়েছে। বিজেপি এই নারকীয় পরিস্থিতিতেও কাজ করেছে। ব্লকে ব্লকে কাজ করেছে, গ্রামে পঞ্চায়েতে পঞ্চায়েতে মানুষের সংগঠন তৈরি করেছে। ঘরবাড়ি ছেড়ে যুবকরা গ্রামে গ্রামে গিয়ে বিস্তারক হিসাবে কাজ করেছে। কত ছেলেকে মেরে মাথা ফাটিয়ে, হাত-পা ভেঙে রাস্তার ধারে ফেলে রেখে গিয়েছিল। তবু সেইসব ডাকাবুকো ছেলেরা মাটি কামড়ে থেকে কাজ করেছে। তৈরি করেছে। শক্তিকেন্দ্র। এক একটি মণ্ডলে একত্রিত করেছেশত শত কোটিবদ্ধ দেশভক্ত সাহসী নারীপুরুষ। বিজেপির জয়ের পরতে পরতে লেগে আছে এদের ঘাম আর রক্তের দাগ।
পঞ্চায়েত নির্বাচনের তিনটি স্তরই বিরোধী শূন্য হবে এমনই দাবি ছিল শাসকদলের। এমন বিকৃত রুচির দাবি কোনও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কোনও দল করতে পারে? কিন্তু এই ভয়ানক কংসের মতো আসুরিক প্রতিপক্ষের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিল বিজেপি কর্মীরা। বাঁকুড়ার রানিবাঁধের সাঁওতাল পরিবারের ছেলে অজিত মুমু। দারুণ সাহসী ছেলে। স্ত্রী ঊর্মিলাকে বলে গিয়েছিল ভাত রান্না করে রাখতে পঞ্চায়েতের মনোনয়ন পত্র জমা দিয়ে এসেই খেতে বসবে। অজিত মুর্মু আর তার জনা কুড়ি সহযোগীর উপর বোমা, পিস্তল, ধারালো অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে শাসকদলের দুষ্কৃতীরা। রানিবাঁধে গত বছর ৫ এপ্রিল প্রাণ দিলেন অজিত মুর্মু। সেই শুরু, তারপর সারা রাজ্যে ৫৪ বিজেপি আর এস এস কর্মী গত এক বছরে প্রাণ হারিয়েছেন। তাদের বলিদানের বেদীমূলেই আজ বিজেপির জয়ের ভিত্তি তৈরি করেছে। এই দেওয়াল লেখা যদি আজকের বিজেপি নেতৃত্ব পড়তে না পারে তাহলে কপালে দুঃখ আছে!
পশ্চিমবঙ্গের মানুষ বহুদিন সুশাসন দেখেনি। নিষ্ঠুর রাজনৈতিক ধান্দাবাজি, দলদাস পুলিশ-প্রশাসন আর সিন্ডিকেট সর্বস্ব নেতা-নেত্রীর অত্যাচার থেকে মুক্তি চায় পশ্চিমবঙ্গ। মানুষ মন থেকে চায়। সারদাকাণ্ডে যারা অপরাধী তারা জেলের ভেতর থাকুক। যে গরিব মানুষগুলো সর্বস্বান্ত হয়েছেন, যারা সব হারিয়ে আত্মহত্যা করেছেন, যে এজেন্টরা ঘর ছেড়ে পালিয়েছেন, গণপ্রহারে মারা গেছেন—এত মানুষের কান্না, এত পাপের বিচার হবে না? শিক্ষকদের এ রাজ্যে চরম অপমানজনক অবস্থা। শিক্ষা এখানে প্রহসনে পরিণত হয়েছে। আর উচ্চশিক্ষার মান একেবারে তলানিতে ঠেকেছে। এ রাজ্যে শিল্পস্থাপন বহুদিন বন্ধ হয়ে গেছে। মানুষের হাতে কাজ নেই। ক্ষেতে ফসলের দাম নেই, গ্রাম থেকে শহরে কোথাও মহিলারা সুরক্ষিত নয়। মানুষ এই নরকের থেকে মুক্তি পেতে বিজেপিকে ভোট দিয়েছেন।
২০১৯ লোকসভা নির্বাচন দুটো আদর্শের লড়াই ছিল। শক্তিশালী নেতৃত্ব, দেশপ্রেম, দুর্নীতির সঙ্গে আপোশহীন লড়াই করেছেন নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী। তিনি নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর আজাদ হিন্দ বাহিনীর কৃতিত্বের মর্যাদা দিয়েছেন। পূর্ববঙ্গ থেকে আসা হিন্দু উদ্বাস্তুদের সমস্যার চিরস্থায়ী সমাধানের ব্যবস্থা করেছেন। ‘সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট বিলের মাধ্যমে। বিগত এনডিএ সরকার পশ্চিমবঙ্গের মানুষের জন্য যত বড়ো উপকার করেছে, তা স্বাধীন ভারতবর্ষে কোনো কেন্দ্রীয় সরকার করেনি। তাই পশ্চিমবঙ্গে উত্তর থেকে দক্ষিণে, পূর্ব থেকে পশ্চিমে সব জায়গার সাধারণ মানুষ তা অনুভব করেছেন। যেখানে তারা ভোট দিতে পেরেছেন সেখানেই বিজেপিকে ভোট দিয়ে জিতিয়েছেন। ডায়মন্ডহারবারের মতো কিছু লোকসভায় সেই ভয়ে গ্রামকে গ্রাম হিন্দু ভোটারদের তাড়িয়ে দিয়েছে শাসক দল।
পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুরা একযোগে বিজেপিকে ভোট দিয়েছেন, কিন্তু সেটা মুসলমানের বিরুদ্ধে নয়। ভোট দিয়েছেন। জেহাদি সন্ত্রাসের বিপক্ষে। ১০ হাজারের বেশি খারিজি মাদ্রাসাকে অনুমোদন দিয়েছিল বর্তমান রাজ্য সরকার। সেখানেই তৈরি হয়েছে সিমুলিয়ার মতো সন্ত্রাসের আতুড়ঘর। সেখান থেকেই খাগড়াগড়ের মতো বিস্ফোরক তৈরি কারখানার পরিকল্পনা হয়েছিল।
২০১৪ সালের এই ইপ্রোভাইস এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস তৈরির কারখানা যখন সামনে এল তখন থেকেই রাজ্যের মানুষ মন ঠিক করা শুরু করেছে। ২০১৬ সালের কালিয়াচকের আক্রমণে লুঠ হয়ে গিয়েছিল একটা আস্ত পুলিশ থানা। ভারত – বাংলাদেশের সীমান্তের কাছে এত সাংঘাতিক জেহাদি ঘটনায় রাজ্যবাসী স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এ রাজ্যের শিক্ষিত, মুক্তমনা, দেশপ্রেমিক মুসলমান সমাজ গত ৫ বছরে দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সাহসী। ভূমিকা গ্রহণ করেছেন। তিন তালাকের মতো অমানবিক মধ্যযুগীয় প্রথাকে তুলে দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদী সরকার। সেই আন্দোলনের সূচনা এ রাজ্য থেকেই হয়েছিল। এ রাজ্যের দেড় শোর বেশি সহৃদয় মুসলমান নারী-পুরুষ নিজেদের খরচে দিল্লিতে গিয়ে ‘তিন তালাক’ অবলুপ্তির দাবিতে ধরনা দিয়েছেন। তাদের কেউ অধ্যাপক, অধ্যাপিকা, কেউ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, কেউ উচ্চপদস্থ সরকারি আধিকারিক। কাজী নজরুল ইসলামের বাঙ্গলায় সৈয়দ মুজতবা আলির বাঙ্গলায় এই মুখগুলোই দেখতে চায় এ রাজ্যের মানুষ। তা না করে অন্য ভোট ব্যবসায়ী দলগুলির মতো বিজেপিও যদি মৌলবাদী মুসলমান, দাগি আসামিদের দলে এনে ভোট আশা করে তবে, ওই মৌলবাদীদের সঙ্গে একই আস্তাকুঁড়ে স্থান হবে বাঙ্গলা বিজেপির।
আজ এই বিজেপির বিজয়রথ যাত্রার দিনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই কবিতার লাইনগুলো বারবার মনে পড়ছে। যেখানে সবার নাচন কোঁদন দেখে অন্তর্যামী হাসছিলেন। এই রথযাত্রার অন্তর্যামী তো জনতা জনার্দন। তিনি হাসছেন না তো?
অপরাধীদের সঙ্গে লড়াইয়ের জন্য অপরাধীদেরই প্রয়োজন, এটি অর্থহীন সর্বনাশা যুক্তি। এতকাল সঙ্ঘের লড়াই, শ্যামাপ্রসাদের লড়াই, জনসঙ্ঘের লড়াই, ভারতীয় জনতা পার্টির লড়াই নিঃস্বার্থ কার্যকর্তারা লড়াই করেছেন। আজও জিততে হলে সেই লড়াই করে আত্মবলেই জিততে হবে। হিলির প্রশান্ত মণ্ডল কিংবা সোনাখালির অভিজিৎ সরদার সমাজবিরোধী গুন্ডা ছিলেন নাকি? প্রশান্তর সহজ সরল জীবনের জন্য গ্রামের সবাই ঠাকুরদা বলে সম্বোধন করত। গ্রামের বাচ্চারা পরীক্ষা দিতে যাওয়ার আগে অভিজিতের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে স্কুলে যেত। যেন অভিজিতের মতো ভালো ছেলে হতে পারে মোকামবেড়িয়ার অন্য বাচ্চারা।
আজকের লড়াই জেতার জন্যও শত শত প্রশান্ত মণ্ডল, অভিজিৎ সরদার, অনাদি, পতিতপাবন, সুজিতরা টকটকে লাল রক্ত দিতে প্রস্তুত হয়ে আছে। একবার ডাক দিয়ে দেখুন না! তা না করে যদি ভাড়াটে গুন্ডা, জেহাদি নরপিশাচ, দাগি আসামিদের দলে নেন, তবে এতকালের এত তপস্যা বৃথা হয়ে। যাবে। এ রাজ্যের মানুষ আপনাদের মুখের দিকেই তাকিয়ে আছেন। একবার ভারতমাতার সামনে দাঁড়িয়ে বলুন না– ‘জয় লোভে, যশ লোভে, রাজ্য লোভে অয়ি, বীরের সদগতি হতে ভ্রষ্ট নাহি হই।’
সারা বঙ্গভূমি বরমাল্য নিয়ে আপনাদের জন্যই দাঁড়িয়ে আছে। আপনারা আত্মবলোকন করুন।
ড. জিষ্ণু বসু

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.