উনিশ শতকে বাঙ্গালির নবজাগরণের সঙ্গে হিন্দুত্বের ভাবনা অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িত ছিল। বামপন্থী ঐতিহাসিকেরা বিষয়টি অনেকেই অস্বীকার করতে পারেননি। বিদেশি ভাবধারায় লালিত পালিত হয়ে বাংলার ‘নবজাগরণ’কে তারা মানতে চাননি। গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো বাঙ্গালির নবজাগরণে হিন্দুত্বের ধ্যান-ধারণা জড়িত থাকায় বিষবৎ তারা একে পরিত্যাজ্য করেছিলেন। স্যার সৈয়দ আহমেদ খাঁ যখন মুসলমান সমাজকে ধর্মীয় গণ্ডিতে আবদ্ধ করে ভারতবর্ষের মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চেয়েছিলেন, তখন মহম্মদ শহিদুল্লাহ প্রমুখ ইসলামিক বুদ্ধিজীবী নিজস্ব ধর্মভাবনার ঊর্ধ্বে তাদের সামাজিক চিন্তনকে উঠতে দেননি।
বামপন্থা রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আচার্য যদুনাথ সরকার, রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতো স্বদেশ-সচেতন ঐতিহাসিকদের অপসারিত করে তপন রায়চৌধুরী, ইরফান হাবিব, রোমিলা থাপারের মতো বামপন্থী ঐতিহাসিকরা জাঁকিয়ে বসে ভারতের ইতিহাস রচনার নামে হিন্দুত্ব তথা ভারতীয়ত্বের ভাবনাকেই অপমানিত করতে শুরু করলেন। সেকুলারিজমের ধুয়ো তুলে ইসলাম বা খ্রিস্টধর্মের মতো হিন্দুধর্মকেও তারা সেমেটিক ধর্মে পরিণত করে দিয়েছিলেন। এই প্রবণতাই আজকের দিনে ভয়ংকর আকার ধারণ করেছে। মুসলমান সমাজ খাঁটি মুসলমান পেয়েছে কিন্তু হিন্দুসমাজ সেকুলার নামে মুসলিম তাবেদার ক্লীবলিঙ্গই উপহার পেয়েছে। এতে মুসলমান সমাজের ক্ষতি হয়নি, কিন্তু হিন্দুধর্মের সার্বভৌমিকতাকে অস্বীকার করায় ভারত তথা বঙ্গ ভাগ হয়েছে, সাম্প্রদায়িকতার আগুনে দেশটা আজও পুড়ে মরছে আর সাম্প্রদায়িকতার ইন্ধন দাতারা ‘সেকুলার’-এর ছদ্মবেশে হিন্দুধর্মের ঔদার্যকে ধূলিসাৎ করতে উদ্যত।
ভুলে গেলে চলবে না ১৯০৫ সালে কার্জনের বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্তকে বাঙ্গালি রুখে দিতে পেরেছিল, সামগ্রিকভাবে মুসলমান সমাজের সাহায্য না পেলেও মৌলবি লিয়াকত আলির মতে কয়েকজন ব্যতিক্রমী ভূমিকা নিয়েছিলেন। সেদিন সদ্যোজাত মুসলিম লিগ আর জন্ম না হওয়া কমিউনিস্ট পার্টির বলা বাহুল্য এমন কোনো শক্তি ছিল না যা দিয়ে ব্রিটিশের বঙ্গভঙ্গ চক্রান্তকে মদত দেওয়া চলত। অথচ মাত্র বিয়াল্লিশ বছরের মধ্যে খেলা ঘুরে গেল। মুসলিম লিগ আর কমিউনিস্ট ঐক্য দাবি তুলল ‘পাকিস্তানের দাবি মানতে হবে, তবেই ভারত স্বাধীন হবে।” উনিশ শতকে নবজাগরণের কালে হিন্দুধর্ম যে সার্বভৌমিকতার দৃষ্টান্ত রেখেছিল, বিংশ শতাব্দীতেও তা বজায় রাখতে পারলে দেশভাগের যন্ত্রণা-বেদনা বাঙ্গালির জন্য বরাদ্দ থাকতো না।
নবজাগরণের সময় বাঙ্গালির হিন্দুত্বের রূপটি খুব সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছিল। একদিকে ছিলেন সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র। তাঁর উপন্যাসে দেশভক্তির চেতনা ছিল, পরবর্তীকালে প্রচার ও নবজীবন পত্রিকায় তাঁর রচিত প্রবন্ধাবলীতে হিন্দুত্বের দর্শনের আভাস পাওয়া যায়, বিশেষ করে কৃষ্ণচরিত্রে তিনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে মনুষ্যরূপে দেখতে চেয়েছিলেন। এই সময়কালীন বঙ্কিমচন্দ্র প্রচারিত হিন্দুধর্মে ঈশ্বরের কোনও অস্তিত্ব ছিল না। তিনি পাশ্চাত্য দার্শনিক কোঁতের দর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন। চার্বাক দর্শনেও ঈশ্বরের স্থান নেই। কিন্তু এর পুরো সত্তাই হিন্দুধর্মের সঙ্গে জড়িত। বঙ্কিম-বান্ধব চন্দ্রনাথ বসু ‘হিন্দুত্ব’ নামে হিন্দুধর্মের ইতিহাসও লিখেছিলেন।
একদিকে শশধর তর্কচূড়ামণি সমসময়ে কলকাতা ও বাঙ্গলা জুড়ে যে হিন্দুধর্মের প্রচার করছিলেন, তার ধর্মব্যাখ্যায় বৈজ্ঞানিকতার ছোঁয়া ছিল। হিন্দুধর্মের নীতি-নিয়মগুলিকে তিনি বৈজ্ঞানিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আধুনিকতার নামে শশধর তর্কচূড়ামণিকে আজ বক্রোক্তির মুখে পড়তে হয়, কিন্তু যাঁরা এটা করেন তাদের ইতিহাসবোধ নেই। কারণ এক সময় কলকাতার যুবকবৃন্দ যাদের মধ্যে স্বামী বিবেকানন্দ (তখন নরেন্দ্রনাথ দত্ত)-ও ছিলেন দলে দলে ধাবিত হয়েছিলেন তার বক্তৃতা শোনবার জন্য। খোদ বঙ্কিমচন্দ্র অ্যালবার্ট হলে তার বক্তৃতা শোনবার ব্যবস্থা করেছিলেন। ধর্মচর্চার ক্ষেত্রে বঙ্কিম-শশধরের মতানৈক্য অবশ্যই ছিল বিশেষ করে ধর্মে ঈশ্বরের অস্তিত্বকে মান্যতা দিয়েছিলেন তর্কচূড়ামণি। কিন্তু এঁরা দুজনেই ছিলেন হিন্দু ধর্মৰ্চার একনিষ্ঠ সেবক।
অন্যদিকে আদি ব্রাহ্মসমাজ একেশ্বরবাদী হিন্দুধর্মের প্রচার করেছিল, শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস সমস্ত উপাসনা-পদ্ধতি নিরীক্ষণ করে বুঝেছিলেন—সব ধর্ম আসবে-যাবে, হিন্দুধর্ম থাকবে। সুতরাং হিন্দুধর্মের সুবিশাল ব্যপ্তি, ‘নানা মত নানা পথ’ একে ভারতীয়ত্বের প্রতিশব্দে পরিণত করে তুলেছিল বাঙ্গালির নবজাগরণ কালে। শুধু ধর্মীয় চেতনাই নয়, রাজনারায়ণ বসুর পরামর্শে নবগোপাল মিত্র, মনমোহন বসু, সত্যেন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ হিন্দুমেলার পত্তন করে বাঙ্গালির জাতীয় ঐক্যকে সুদৃঢ় করেছিলেন সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের মাধ্যমে।
আজকে যারা বাঙ্গালির ‘সেন্টিমেন্টের’ ধুয়ো তুলে সেকুলারিজমের নামে হিন্দুধর্মকে আক্রমণ করতে উদ্যত তাঁরা হয় ইতিহাস জানেন না, নয়তো কায়েমি স্বার্থসিদ্ধির জন্য ইতিহাস ভোলাতে চাইছেন।
একলব্য সোম