১৯৬৭ সাল। বাংলার মসনদে তখন কংগ্রেস। মুখ্যমন্ত্রী নিপাট ধুতি পাঞ্জাবি পরা ভদ্রলোক প্রফুল্লচন্দ্র সেন। তার প্রধান সহচর রাজ্য কংগ্রেস সভাপতি অতুল্য ঘোষ। রাজ্য জুড়ে তখন চলছে খাদ্যাভাব। ১৯৬৫-র খাদ্য আন্দোলনের রেশ তখনও কাটেনি। কী কুক্ষণেই প্রফুল্ল সেন বলে ফেলেছিলেন, ভাত না মিললে কাঁচাকলা খান। পুষ্টিগুণ একই। ভোটের বাজার তখন তুঙ্গে। প্রফুল্লবাবু আরামবাগের মঞ্চে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করছেন। এমন সময় মঞ্চের সামনে এক ঘর্মাক্ত কৃষক। কাঁধে লাঙল জোয়াল। সপাটে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন মুখ্যমন্ত্রীকে, “সেনবাবু আপনি কাঁচাকলা খেয়ে এই লাঙল জোয়াল কাঁধে দশ পা যেতে পারবেন? আমরা রোদে জলে লাঙল চালাই। আমাদের ভাত না হলে চলে?” গোটা জমায়েত স্তব্ধ।
পরদিন প্রায় সব সংবাদপত্রেই প্রথম পাতায় বেশ সাজিয়ে গুজিয়ে বেরোল খবরটা।
আবার একদিন আরামবাগ থেকে গৌরহাটির পথে যাচ্ছেন প্রফুল্লচন্দ্র সেন, দ্বারকেশ্বর নদীর বাঁকে গির্জাতলা। তার জিপের মুখোমুখি ব্রেক কষল আর একটা জিপ। প্রায় ধাক্কা লাগে লাগে। সামনের জিপ থেকে নেমে এলেন অজয় মুখার্জি।
বাংলা কংগ্রেস নেতা এবং পরবর্তীকালে যিনি দু’দফায় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর দায়ভার সামলেছেন। অজয় মুখার্জিকে দেখে জিপ থেকে নেমে এলেন প্রফুল্লচন্দ্র সেনও। খাদির ধুতির খুঁটে ঘর্মাক্ত ঘাড় মুছে অজয় মুখার্জিকে বললেন হাস্যমুখে, ‘অজয়, ভোট করতে এসে চেহারাটার কী হাল করেছ? দেখেছ আয়নায়? তুমিই জিতবে।’ তারপর দুই বন্ধুর কোলাকুলি এবং যে যার গন্তব্যে যাত্রা।
পরদিন এ খবরও বেরিয়েছিল সব সংবাদপত্রেই। আর দাদাঠাকুর সেই যিনি খবরের কাগজ চালাতেন হাসিমুখে আর ভোটের সময় ভোটরঙ্গের গান বেঁধে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে সেই গান শুনিয়ে কাগজ বেচতেন— ভোট দিয়ে যা আয় ভোটররা…, তিনি বলছেন, “এম এল এ কথার পুরো অর্থ জানো না? তা শুনে নাও। পরের কাজে ভাতা মেলে। ভাড়া মেলে। এ মেলে। সে মেলে। তা মেলে। সব মেলে। তাই এম এল এ।”এসবও বেরোত বাংলা কাগজে। সেকালে।
আর একালে?
বাংলা সাংবাদিকতা যখন দুশো বছর পার করে দিয়ে আরও একশোর পথে যাত্রা শুর করেছে, তখন এই ২০১৯-এর ভোটবাজারে সেই বাংলা সাংবাদিকতার হাল কেমন?
এক কথায় হাস্যকর। সমস্ত লজ্জা, সমস্ত ঘৃণা, সমস্ত ভয় আর আত্মসম্মান মুছে ফেলা এক নির্লজ্জ নগ্ন অচেনা অজানা ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির বিপরীতমুখী একটি ব্যবসায়িক কঙ্কাল যে শুধু শাসকের তল্পিবাহকেরই দায়িত্ব নিতে পারে। সামাজিক দায়বোধকে উপেক্ষা করে দু’কানকাটা বেহায়ার মতোই।
ইতিহাস অবশ্য বলে, ভোট বাজারে বাংলা সংবাদপত্রের মহীরুহরা চিরকালই নাকি শাসকের ধামাধরা ভূমিকাই পালন করেছে। কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও প্রমাণিত সত্য যে মুষ্টিমেয় মিডিয়াকে শাসকদল টাকার জোরে কিনে নেয় ঠিকই কিন্তু ২০১৯-এর মতো সমস্ত বাংলা মিডিয়াকে কিনে নেওয়ার স্পর্ধা কংগ্রেস সরকারও কখনও নেয়নি—এমনকী সেই যুগেও, যখন দু-চারটি মিডিয়ার উপস্থিতিই ছিল ভরসা। বিশেষ করে এমন একটা পরিস্থিতিতেও যখন বাঙ্গলার বুকে ত্রিমুখী/চতুর্মুখী লড়াই জমজমাট।
বাংলার সংবাদমাধ্যমের গতিপথ এখন একমুখী। বাংলা মিডিয়ার সম্রাট আনন্দবাজারগোষ্ঠী থেকে শুরু করে একদা সম্পূর্ণ বামপন্থী ঘরানার সংবাদপত্র আজকালও। দু’শো পাঁচশো কপি ছাপা হয় এমন বাংলা দৈনিকগুলি আরও বেশি মাত্রায় একপেশে। এমনকী প্রায় সব টেলিভিশন চ্যানেলও ক্যালকাটা নিউজের মতো ২/১টি টিভি চ্যানেল ছাড়া সবাই সরকারের বশংবদ। কিছুটা স্বেচ্ছায়, কিছুটা বাধ্যতায়। কারণ বাংলা মিডিয়া আজ স্বেচ্ছাচারী মমতা সরকারের তীব্র রাজনৈতিক চাপে অস্তিত্বরক্ষার সংকটেশয্যাশায়ী। প্রচারসর্বস্ব মুখ্যমন্ত্রী বিজ্ঞাপনের কঁপি খুলে নিজস্ব শ্রীমুখ সহ হাস্যকর সব সরকারি বিজ্ঞাপন জনগণের টাকায় বিলোবার জন্য বসেছেন। হাঁটুমুড়ে। আর তাকে ঘিরে হাত পেতে দাঁড়িয়ে গেছেন ‘দিগগজ’ সব সম্পাদককুল আর ‘প্রবীণ ও নমস্য’ সব সাংবাদিকরা যাঁরা মনে করেন, ব্যবসাটাই মুখ্য, বাকি সব গৌণ। অর্থাৎ ভিক্ষাপাত্র হাতে সংবাদমাধ্যমগুলির মালিকরা পায়ের বুড়ো আঙুল থেকে মাথার চুল বিকিয়ে দিয়ে বসে আছেন। ফলে বাংলা মিডিয়ার মাঝিরা যখন হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছেন, এই সরকারের তরী নিমজ্জমান, আয়ু ক্রমশ ক্ষীয়মাণ, তখনও তারা খবরের ৭০ শতাংশই নিবেদন করছেন শাসকদলের কল্যাণে। যাতে সরকারটাকে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট থেকে ফিরিয়ে আনা যায়। ফলত লক্ষণীয়, আনন্দবাজার গোষ্ঠী তার শ্ৰেণীচরিত্র (সরকার বিরোধিতা) পাল্টাতে বাধ্য হয়েছে। আজকাল রাতারাতি বামপন্থা ছেড়ে তৃণমূলের না বাম না ডান, বলা যায় ধান্দাবাজি এবং সুযোগসন্ধানী পন্থার সমর্থক হতে বাধ্য হয়েছে। বর্তমান যাঁর সম্পাদক এবং মালিক ছিলেন বরুণ সেনগুপ্তের মতো অকুতোভয় সাংবাদিক, সেই বর্তমানও আজ শাসকদলের সর্বশ্রেষ্ঠ মোসাহেবে পরিণত হয়েছে। এই সংবাদপত্রে প্রায় নিত্যদিন যখন খবর বেরোয় ছবি বেরোয় এক তৃণমূল বিধায়কের যিনি ওই সংবাদপত্রেরই বরিষ্ঠ সাংবাদিক ছিলেন দীর্ঘদিন তখন কিন্তু সাপ্তাহিক বর্তমানের প্রাক্তন সম্পাদক এবং কলামনিস্ট এবার ভোটে প্রার্থী হলেও তাকে নিয়ে লেখা হয় যৎসামান্যই। টেলিভিশন চ্যানেলগুলি এখন প্রকৃত অর্থেই বোকা বাক্সের সম্মান রক্ষা করছে। কারণ রাজনৈতিক খবরের ঝুলি থেকে বেড়াল মাঝে মধ্যে উঁকি মারলেও, রাজনৈতিক আলোচনাগুলি যে নিতান্তই সাজানো চিত্রনাট্য তা বুঝতে কোনও বঙ্গসন্তানেরই আর বাকি নেই। তাই এবিপি আনন্দে দিনের পর দিন পাউডার মেখে এসে বসেন বিজন সরকার নামক অর্ধশিক্ষিত অকালপক্ক শিক্ষক যিনি যুক্তিতর্কে যুক্তির ধারই মানেন না। ইতিহাসেও গণ্ডমূর্খ। তাই প্রেসিডেন্সি কলেজের এক প্রাক্তন অধ্যাপক প্রতিদিন ৩/৪টি কোটেশন মুখস্থ করে আসেন আর সন্ধ্যার অবসরটা যাপন করেন এক চ্যানেল থেকে অন্য চ্যানেলে ঢুঁ মেরে।
আসলে বাংলা সংবাদমাধ্যম এখন রাহুগ্রস্ত। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নামক এক স্বৈরাচারিণী যেমন ভাবে তার দলের সমস্ত নেতা ও কর্মীদের অর্থবশে রসেবশে রেখে সকলের মুখে লিউকোপ্লাস্ট আটকে দিয়েছেন, সেই ভাবেই বাংলা সংবাদমাধ্যমেরও চোখে ঠুলি আর মুখে মাস্ক বেঁধে দিয়ে বসিয়ে রেখেছেন গত ৮ বছর ধরে। ঠিক এই মুহূর্তে তাই মনে পড়ে আমেরিকান সংবাদ বিশ্লেষক বেন হেগ বাগদিকিয়ান-এর প্রবন্ধ The Press and Its crisis of Identity-র কয়েকটা লাইন। তিনি বলেছেন, “আজকের বৃহৎ সংবাদপত্র পুঁজির মালিকরা নিঃসন্দেহে সম্মানীয়। তবে পুলিৎজার ও স্ক্রিপস আজ আর তাঁদের আমলের মতো করে সংবাদপত্র চালাতে পারতেন না। এর কারণ তারা খারাপ লিখতেন তা নয়, তাদের লেখাগুলো আজকের দিনের মাপকাঠিতে বড়ো বেশি বৈপ্লবিক ও বিদ্রোহী বলে গণ্য হতো।” (Ref. Mass Media in a Free Society, Ed. by Warren K. Agree)
বেন হেগের এই বক্তব্য বোধহয় আজকের বাংলা সংবাদমাধ্যম সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি প্রযোজ্য। তা যদি না হতো, তাহলে আজ অনুব্রত মণ্ডল সংবাদমাধ্যমে নয়, ঠাঁই পেতেন ধাবার মাঠে। ফিরহাদ হাকিমকে লুকোতে হতো ভাগাড়ে। আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিচয় হতো ২০১৯-এর ভোট রাজনীতির কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী।
সুজাত রায়