সত্যজিতের সব সৃষ্টির পিছনেই ছিল তাঁর নিঃশব্দ উপস্থিতি, অথচ তিনি কাব্যে উপেক্ষিতা

‘চারুলতা’ ছবিতে ভূপতিকে রাতের খাবার বেড়ে দিচ্ছে চারুলতা। মাধবী মুখোপাধ্যায়ের ডুরে শাড়ি-পরা পিঠ আর অনুপম গ্রীবার ফাঁক দিয়ে শৈলেন মুখোপাধ্যায়ের লুচি চিবোতে চিবোতে হঠাৎ বলে ওঠা, – ‘আচ্ছা, তোমার মনে কোনও খেদ নেই তো? এই যে এত খরচা হয়ে যাচ্ছে কাগজটার পেছনে?’

ভুপতিকে চারুর উত্তর – ‘হোক না খরচ। তুমি একটা ভাল জিনিস করছ, তোমার সুনাম হচ্ছে…’

‘আমি তোমাকে একদিন রাজনীতির ব্যাপারটা বুঝিয়ে দেব,কেমন?’, চারুলতার সেই খাবার দৃশ্যের শেষে ভূপতি চারুকে বলে এই কথাটি।

বিজয়া রায়। তিনি তাঁর ব্যক্তিগত স্বরকে আড়ালে রেখে আত্মকথার নাম দিলেন ‘আমাদের কথা’। চিরকালের মেয়েটির মতো নিজের একান্ত বয়ান সমর্পণ করলেন বহুবচনের ছায়ায়। ৪ বছর আগে পার হয়ে গেছে তাঁর শতবর্ষ। প্রায় নীরব থেকেছি আমরা। আজ সত্যজিৎ রায়ের শতবর্ষে সেই পুরুষটিরই সৃজন শরীরের অমোঘ অঙ্গ বিজয়াকে ফিরে দেখা যাক।

“‘সন্দেশ’-এর জন্য ওঁকে টাকা ঢালতে হয়েছিল, একটা জিদ চেপে গিয়েছিল। প্রথম দিকে তো সমানে নিজের টাকা ঢেলে গিয়েছিলেন।… ‘সন্দেশ’-এর পেছনে এত টাকা দিতে হলে কী থাকবে না থাকবে, একবারও চিন্তা করিনি। যেখানে উনি এত উৎসাহ করে কাগজটাকে বাঁচিয়ে রাখবার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন, সেখানে আমি বাধা দেব কেন।” ( ‘আমাদের কথা’/ বিজয়া রায়/ পৃষ্ঠা -২৪৪)

ছেলেবেলায় বিজয়ার বাবার স্বপ্ন ছিল মেয়ে প্যারিসে গিয়ে গান শিখবে। এমনই ছিল সেই মেয়ের গান গাইবার ক্ষমতা। সাহানাদেবীর ( তিনি বলতেন ঝুনুপিসি) কাছে গান শিখেছেন তিনি। অতুলপ্রসাদ সেন তাঁর জ্যাঠামশাই। ছোট পিসি রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্যা বিখ্যাত গাইয়ে কনক দাশ। বিজয়ার ৭ কি ৮ বছর বয়সে কনক নিয়ে গেলেন ভাইঝিকে রবীন্দ্রনাথের কাছে। কলকাতায় চলছিল তখন ‘বর্ষামঙ্গল’। সঙ্গে মেজপিসি সুপ্রভা, সুকুমার রায়ের স্ত্রী। সুপ্রভা নিজেই রবীন্দ্রনাথকে কনকের হয়ে প্রস্তাব দিলেন কনকের জন্য নির্বাচিত দু’টি গান গাইবে বিজয়া। দুঃসাহসী প্রস্তাবে চমকে গিয়েছিলেন কবি, তাঁর সামনে গান দু’টি গাইলেন বিজয়া, খালি গলায়। তারপর বিজয়ার নিজের কথায়, “(উনি) ধীরে ধীরে আমার মাথার উপর হাত রাখলেন, একটু কম্পিত কণ্ঠে বললেন, ‘ঠিক আছে, আজ বিজয়াই গাইবে’।”

রায় বাড়ির বৌ হওয়ার পর সেই গান আর করেননি বিজয়া। কেন থেমে গেল তাঁর গান? কেউ জানে না বা বলে না। বিয়ের আগে হিন্দুস্থান রেকর্ড থেকে প্রকাশিত তাঁর রবীন্দ্রগানে ধরা আছে কণ্ঠের বিরল কারুকাজ আর আবেদন।

সেকালে বহু আলোচিত তাঁর বিয়ের পর শাশুড়ি তাঁকে তরকারি কুটতে কুটতে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি রায়বংশের নাম রাখতে পারবে তো?” ভাইঝি থেকে ‘বৌমা’ হয়ে ওঠা বিজয়া বললেন, “চেষ্টার ত্রুটি হবে না।”

তা হয়নি লেশমাত্র। তখনও তাঁর মানিক ‘সত্যজিৎ রায়’ হয়ে ওঠেননি, সদ্যোজাত ছেলে রাতে শব্দ করে কাঁদে বলে সারারাত ছেলে কোলে বারান্দায় হেঁটেছেন বিজয়া, স্বামীর রাতের ঘুমের ব্যাঘাত হবে না বলে। ‘পথের পাঁচালী’র জন্য নিজের গয়না বন্ধক দিলেন বিজয়া। আর তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধান রায় সম্পূর্ণ নতুন এক পরিচালককে যে সরকারি অর্থ দিলেন ছবি শেষ করার জন্য, তার আড়ালেও বিজয়ার একান্ত ব্রাহ্মসমাজের সংযোগ। ব্রাহ্মসমাজের বেলা সেন বিজয়ার অনুরোধে বিধান রায়ের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। বিজয়া রায় আত্মকথায় লিখছিলেন যে, ওঁর বেলাদি না থাকলে মানিক ‘সত্যজিৎ রায়’ হয়ে উঠতেন না।

কিন্তু বিজয়া রায় কম কোথায়? ছবির নারী চরিত্রের শাড়ি, গয়না, কস্টিউমের খুঁটিনাটি নজর রাখতেন বিজয়া। ‘সমাপ্তি’ ছবির জন্য অপর্ণাকে বিজয়াই যে বেছে নেন, এ তো সকলের জানা। ব্লাউজ ছাড়া, শাড়ি পরতে অস্বস্তিতে পরা কিশোরী অপর্ণাকে বিশেষ কায়দায় শাড়ি পরান বিজয়া। ‘মণিহারা’-র কণিকা মজুমদার, যিনি ব্রাহ্মসমাজেরই মেয়েই ছিলেন, তাঁকেও নিজের গয়নায় ছবির জন্য সাজিয়েছিলেন বিজয়া। যে ছবিতে গয়না নিজেই একটা চরিত্র।

শ্রমণা গুহঠাকুরতাকে ‘আগন্তুক’ ছবির জন্য ‘বাজিল কাহার বীণা’ শিখিয়ে দেন ছোটদিদু বিজয়া রায়। শ্রমণা বললেন, “তখন ৭০ পেরনো বয়সে ছোট দিদুর টলটলে গলা, নিপাট কারুকাজ অবাক করেছিল।” ছবিতে এই গানে যে পুরনো ব্রাহ্মসমাজের বিরল গায়কি পাওয়া গেল, তাও বিজয়া রায়ের কল্যাণে। ‘জন অরণ্য’ ছবির ‘ছায়া ঘনাইছে বনে বনে’ গানের কণ্ঠশিল্পী রায় পরিবারের একান্ত কাছের মানুষ শর্মিলা রায় পোমো জানাচ্ছেন, বিজয়া রায়ের কণ্ঠের বিরল ‘ভিব্রাটো’-র কথা, আর তাঁর গানের বুদ্ধিদীপ্ত স্ক্যানিং এর কথা।

বিয়ের আগে মুম্বইয়ে ছবি করতে গিয়েছেন বিজয়া। তখন টাকার বেশ টানাটানি। তবুও প্রেমিক মানিকের বহু অনুরোধ সত্যেও আর্থিক সমর্থন নেন নি। এটা সেটা বলে এড়িয়ে গেছেন।

বিস্ময় জাগানো এক স্মৃতি উপহার দিলেন সত্যজিতের শেষ দু’টি ছবির নায়িকা মমতাশঙ্কর। তিনি বললেন, “মানিককাকা রেকর্ড করছেন ‘রাই ধৈর্যং’ কীর্তনের অংশটি। বার বার টেক হচ্ছে আর মঙ্কুকাকিমা বলে উঠছেন, ‘মানিক হচ্ছে না’ বলেই নিজে গেয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন। এ রকম করতে করতে বললেন, ‘ধুস ছাড়ো, পরে করব’, তখন মঙ্কুকাকিমা উঠে গিয়ে মানিককাকার পায়ের ওপর একটা আলতো চাঁটি মারলেন। আমার মনে হল, একজন আছেন জগৎসংসারে যিনি সত্যজিৎ রায়কেও প্রকাশ্যে স্নেহের শাসনে রাখতে পারেন।”

নিজেকে প্রায় আড়ালে রেখে সাত রাজার ধন এক মানিকের জগৎজয়ের আলোটি জীবন দিয়ে জ্বালিয়ে রেখেছিলেন বিজয়া।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.