জ্যৈষ্ঠ মাস
সুপারিঃ জ্যৈষ্ঠমাসে প্রতিটি গাছে ১২ কেজি সবুজ পাতা সার, ১২ কেজি কম্পোষ্ট বা গোবর সার, রাসায়নিক সার হিসাবে ২২০ গ্রাম ইউরিয়া, ২৫০ গ্রাম সিঙ্গল সুপার। ফসফেট এবং ২২৫ গ্রাম মিউরিয়েট অফ পটাশ সার দিতে হবে। এই সার বৈশাখমাসেও দেওয়া যায়। পঞ্চম বছর থেকে গাছে পুরো মাত্রায় সার দিতে হবে। দ্বিতীয় বছরের গাছে পুরো মাত্রায় জৈবসার এবং এক তৃতীয়াংশ রাসায়নিক সার দিতে হবে। তৃতীয় ও চতুর্থ বছরের গাছে পুরো মাত্রায় জৈবসার এবং দুই-তৃতীয়াংশ রাসায়নিক সার দিতে হবে। সার দু’দফায় দিতে হবে। সেচের সুবিধা থাকলে ফাল্গুনে (মোট সারের এক তৃতীয়াংশ) এবং আশ্বিনে (বাকি অংশ) সার দিতে হবে। বৃষ্টি নির্ভর হলে প্রাক-মৌসুমীর উপর নির্ভর করে বৈশাখ মাসে এবং আশ্বিনমাসে প্রয়োগ করতে হবে। ফাল্গুনে বা বৈশাখে গাছের গোড়ায় ছিটিয়ে সার দিতে হবে, তারপর আগাছা দমন করে তা মাটির সঙ্গে হালকা খুঁড়ে মিশিয়ে দিতে হবে। আশ্বিনমাসে যে সার দেওয়া হবে তা গাছের চারপাশে ৭৫ সেন্টিমিটার থেকে এক মিটার ব্যাসার্ধের গোলাকার বেসিন করে তার মধ্যে দিয়ে মাটি চাপা দেওয়া হয়। এই বেসিনের গভীরতা হবে প্রায় ২০ সেন্টিমিটার। যারা নতুন গাছ লাগাবেন তারা স্থানীয় ভালো নাটযুক্ত সুপারী জাত অথবা ‘মোহিতনগর’, ‘মঙ্গলা, ‘সুমঙ্গলা’ বা ‘শ্রীমঙ্গলা’ জাত লাগাতে পারেন। মোহিতনগর জাতটি উচ্চ ফলনশীল, গাছ প্রতি সাড়ে তিন থেকে চার কেজি সুপারি ফলে। ভাল নিকাশি জমিতে জ্যৈষ্ঠমাসে এবং এটেল মাটিতে ভাদ্র মাসে চারা লাগান। চারা লাগাতে হবে ২.৭x২.৭ মিটার দূরত্বে। ৬০x৬০*৬০ সেন্টিমিটার মাপের গর্ত খুঁড়ে তাতে এক বছর বয়সী পাঁচ-ছয় পাতার ছোটো চারাগাছ বসান। চারা বসানোর আগে তাতে গোবর সার, বাগানের মাটি ও বালির মিশ্রণ ৪০ সেন্টিমিটার ভরে তারপর সোজাভাবে গর্তে চারা লাগাতে হবে। বর্ষার আগে পর্যন্ত সেচের ব্যবস্থা রাখুন।
পানিফল : জলা জমি? বর্ষায় অন্য ফসল ফলে না? পানিফল হবে। জ্যৈষ্ঠমাস থেকেই প্রস্তুতি শুরু করুন। পতিত জলা জমিতে লাভজনকভাবে পানিফল চাষ করতে জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় থেকে প্রস্তুতি নিন। নিচু জলা, ধানক্ষেত, নয়ানজুলি, পুকুর-ডোবা, বিল-বাওরে চাষ করা যায়। জল স্থির হতে হবে, কিংবা ধীর প্রবহমান। পানিফল লাগানোর ৪ মাস পর থেকে ফসল তুলতে পারবেন এবং ফসল তোলা যাবে পৌষের শেষ এমনকি মাঘ পর্যন্ত। জ্যৈষ্ঠে পানিফলের পরিপক্ক বীজ কাদা করা নিচু জলা জমিতে বুনতে হবে। জলের যোগান থাকলে বৈশাখেও বোনা যায়। জৈবসার, ডিএপি, মিউরিয়েট অফ পটাশ ইত্যাদি ছড়িয়ে শুকনো জমিতে ভালোভাবে মেশাতে হবে। প্রাক-মৌসমের বৃষ্টির জল জমলে তাতে পরিপক্ক বীজ বোনা হয়। বীজ অঙ্কুরিত হয়ে চারা গজায়। ৩০ থেকে ৫০ সেন্টিমিটার গভীর জলযুক্ত মূল জলাশয়ে চারার দূরত্ব থাকবে ৪০ থেকে ৬০ সেন্টিমিটার। আষাঢ় থেকে আশ্বিনের মধ্যে চারা লাগাতে হয়। অনেকে নিচু জমিতে আউশধান তুলে পানিফল লাগান। আবার পানিফল তুলে জল শুকোলে পাঁক জমিতে পুঁই-এর বীজ ফেলেন। পানিফলের চারা লাগানোর দু-মাস পর ফুল চলে আসে, ফুল আসার বিশ দিন বাদে ফল তোলার উপযুক্ত হয়। সুতরাং আশ্বিনের প্রথমে রোপা চারায় অগ্রহায়ণের শেষ থেকে ফল তোলা শুরু হয়ে যায়। পানিফলের প্রতিটি গাছ অনধিক এক ডজন শাখা ছাড়ে। দেরীতে রোপণ করলে শাখার সংখ্যা কমে গিয়ে ফলন কম হয়। কখনো অর্ধেক সংখ্যক শাখা তৈরি হয়। প্রতিটি শাখা থেকে অনধিক ৭টি পানিফল তোলা যায়। সুতরাং সঠিক সময়ে রোপিত একটি গাছ থেকে ৮০টির মত ফল চয়ন করা যায়। এই ফলগুলি দেরীতে লাগানো গাছের চাইতে সাইজে বড় হয়। ১ বিঘা জল-জমিতে পানিফল চাষের খরচ প্রায় পাঁচ হাজার টাকা এবং আয় ৩০ হাজার টাকা, সুতরাং লাভ ২৫ হাজার টাকা।
পেঁয়াজ ও বর্ষাকালেও পেঁয়াজ চাষ করা যাবে। জ্যৈষ্ঠমাস থেকেই প্রস্তুতি নিন। লাভজনক ভাবে বর্ষাকালে পেঁয়াজ চাষ করতে পারবেন। আশ্বিন-কার্তিক মাস থেকে বাজারে পেঁয়াজের দাম চড়তে থাকে। তাই বেশী আয় করতে বর্ষাকালে চাষ শুরু করুন। বীজতলা তৈরি করে জ্যৈষ্ঠের মাঝামাঝি সময় থেকে বীজ বুনুন। আষাঢ় মাস জুড়েই বীজ বুনতে পারবেন। এক বিঘাতে পেঁয়াজ লাগাতে হলে এক কাঠা জমিতে বীজ তলা তৈরি করতে হবে। এজন্য এক কেজি বীজ লাগবে। বীজতলার মাটি শোধন করুন। জৈবসারের সঙ্গে জীবাণু-সার ট্রাইকোডার্মা ভিরিডি মিশিয়ে বীজতলায় দিন। তামা-ঘটিত ছত্রাকনাশক দিয়েও বীজতলা শোধন করা যায়। যেন নিকাশের বন্দোবস্ত থাকে, মাটি ঝুরঝুরে থাকে, সারাদিন অফুরন্ত আলো পায়। বীজতলায় প্রয়োগ করুন (১০x৩ ফুট মাপের উঁচু বীজতলা) ২২৫ গ্রাম ইউরিয়া, ৫০০ গ্রাম সিঙ্গল সুপার ফসফেট এবং ২৫০ গ্রাম মিউরিয়েট অব পটাশ। বীজতলায় দুই ইঞ্চি দূরে সারিতে বীজ ফেলুন। গভীরতা হাফ-ইঞ্চি হওয়া দরকার। বীজ বোনার পর মাটি বা জৈবসার ছড়িয়ে ঢেকে দিতে হবে। তার উপর ঢাকা পড়বে খড়ের পরত। হালকা সেচ দিতে হবে ঝারি দিয়ে। অঙ্কুর বেরোতে শুরু করলে ঢাকা সরিয়ে নিন। বর্ষা বেশি হলে বাঁশের ফ্রেম বানিয়ে পলিথিন চাপান। এক দেড় মাসের চারামূল জমিতে লাগান।
রজনীগন্ধা ফুল চাষ ঃ যারা চৈত্রের মাঝামাঝি কন্দ রোপণ করেছেন তারা জ্যৈষ্ঠমাসের প্রথমে বিঘা প্রতি ২৫ কেজি ইউরিয়া অথবা ৬০ কেজি খোল প্রয়োগ করুন। যারা বৈশাখ মাসের প্রথমে কন্দ লাগিয়েছেন তারা জ্যৈষ্ঠের শেষে এই চাপান সার দিন। ফুলের গুণগত মান বাড়াতে দরকার মতো ২ শতাংশ জিঙ্ক সালফেট (এক লিটার জলে ২০ গ্রাম) স্প্রে করুন।
বেল ও জুঁই ফুল : জ্যৈষ্ঠ মাসের প্রথমার্ধের মধ্যে বেল ও জুঁই-এর কাটিং বসিয়ে ফেলুন। বেলফুলের ভালো জাত হল রাই, মোতিয়া, ভরিয়া, চীনা, জাপানী প্রভৃতি। জুঁই ফুলের জাত যেমন সিঙ্গল ও ডবল জুঁই। বেলফুলে বিঘাতে সাড়ে ছয় হাজার কাটিং লাগবে,জুঁই-এলাগবে আড়াই হাজার। ৪৫x৪৫ সেন্টিমিটার দূরত্বে বেল আর ৭৫x৭৫ সেন্টিমিটার দূরত্বে জুঁই লাগান। শেষ চাষের সময় বিঘা প্রতি ২ থেকে ৩ টন জৈবসার, ৩৩ কেজি ইউরিয়া, ১২৫ কেজি সিঙ্গল সুপার ফসফেট এবং ৪২ কেজি মিউরিয়েট অব পটাশ প্রয়োগ করুন। চারা লাগানোর দু মাস পর বিঘা প্রতি ৩৩ কেজি ইউরিয়া চাপান সার হিসাবে প্রয়োগ করবেন।
সূর্যমুখী ঃ খরিফ মরশুমে সূর্যমুখী চাষ করতে জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় মাসে বীজ বুনুন। প্রাক-খরিফ মরশুমে যারা সূর্যমুখী লাগিয়েছেন (মাঘ থেকে ফাল্গুনের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত) তারা জ্যৈষ্ঠমাসে ফসলের বৃদ্ধিদশা অনুযায়ী সুযোগ বুঝে শেষ (৭৫-৮০দিন পর) সেচ প্রয়োগ করুন। এই মাসে টিয়াপাখির আক্রমণ হলে মাঠে বেঁধে দিতে হবে সোনালী বা লাল পলিথিনের ফিতে। আর দমন ব্যবস্থা নিতে হবে শুয়োঁপোকার বিরুদ্ধে। যারা খরিফ মরশুমে সূর্যমুখী চাষ করতে চান তারা জ্যৈষ্ঠ থেকে আষাঢ়ের মধ্যে বীজ বুনুন। প্রতি বিঘায় সাড়ে সাতশো গ্রাম থেকে এক কেজি বীজ প্রয়োজন হবে। বীজ শোধন করে লাগাবেন। জমি তৈরির জন্য বিঘা প্রতি দশ কুইন্টাল জৈব সার প্রয়োগ করুন। শেষ চাষের সময় প্রতি বিঘা জমিতে দিন ১২ কেজি ইউরিয়া ৮১ কেজি সিঙ্গল সুপার ফসফেট এবং ২১ কেজি মিউরিয়েট অব পটাশ। খরিফ মরশুমে সান রাইজ, ইসি ৬৮৪১৩, ই.সি ৬৮৪১৪ ইত্যাদি জাত বোনা যেতে পারে। বাজারে পাওয়া যায় সূর্যমুখীর হাইব্রিড জাতও। যেমন সূর্য-৫১,প্যাক -৩৬ ইত্যাদি।

ড. কল্যাণ চক্রবর্তী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.