মেনে নেওয়া গেল মেরুকরণ হয়েছে কিন্তু কেন হয়েছে তা স্বীকার করবেন না?

লোকসভার নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি’র এই ফল হবে তা সম্ভবত এরাজ্যের রাজনৈতিক দল বা পণ্ডিতরা বুঝতে পারেননি। তাই ভোটের ফল বেরোতেই একরকম দিশেহারা হয়ে তাঁরা এর কারণ অনুসন্ধান করতে শুরু করেছেন। বাম হ্যাংওভারে আক্রান্ত ভোট-পণ্ডিতদের বেশিরভাগ একটি কারণ আবিষ্কার করেই যাবতীয় আলোচনাকে সীমাবদ্ধ রাখতে চাইছেন বা নির্দিষ্ট দলের নেতা বা নেত্রীর লজ্জা নিবারণ করার চেষ্টা করছেন তা হল– মেরুকরণ। অর্থাৎ রাজ্যের ভোটাররা হিন্দু ও মুসলমান এই দুই পরিচয়ে বিভক্ত হয়ে ভোট দিয়েছেন।

অন্য সব ইস্যুকে এই একটি কারণ দেখিয়ে তাঁরা লঘু করে দিতে চাইছেন। ভাবখানা এমন– যথেষ্ট উন্নয়ন করা সত্ত্বেও, দক্ষ প্রশাসন চালানো সত্ত্বেও, সমাজের সমস্ত স্তরের মানুষের সমস্ত চাহিদা পূরণ করা সত্ত্বেও স্রেফ মেরুকরণ শাসক তৃণমূল-সহ অন্য অ-বিজেপি দলগুলোকে হারিয়ে দিল। খবরের কাগজের অফিসে বসে বা টিভি চ্যানেল-এর স্টুডিওতে বসে সাধারণ মানুষকে তাঁরা যতটা বোকা ভাবেন মানুষ বোধহয় ততটা বোকা নয়। বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ, মেরুকরণ হতে পারে, তবে একমাত্র কারণ কখনওই নয়। এই বাস্তবটা স্বীকার করলে যেসব দল বিপর্যস্ত বা যেসব রাজনৈতিক ভাষ্যকাররা বিপন্ন বোধ করছেন তাদের ভবিষ্যৎ ভালো হবে।

এবার মেরুকরণ নিয়ে আর একটু স্পষ্ট আলোচনা করা যাক। বিজেপি বিরোধীদের বক্তব্য– বিজেপি ও সঙ্ঘ পরিবার তাদের বিভিন্ন কার্যক্রমের সাহায্যে পরিকল্পিতভাবে হিন্দুদের এক মেরুতে নিয়ে যাওয়ার ফলেই এই ধর্মীয় মেরুকরণ হয়েছে। প্রশ্ন হল, আর এক মেরুতে মুসলমান ভোট কীভাবে পুঞ্জীভূত হল? অনেকেই চটজলদি বলবেন সেটা প্রতিক্রিয়া। কিন্তু অভিজ্ঞতা কী বলে? প্রক্রিয়াটি কারা শুরু করেছিলেন? স্বাধীনতার পর থেকেই সংখ্যালঘু ভোট ব্যাঙ্ক– এই তত্ত্বটি এদেশে কোনও রাখঢাক না করেই আলোচনা করা হয়ে থাকে। সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকায় মুসলিম প্রার্থী দেওয়া এক রকম রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বিভিন্ন ধর্মগুরুদের দিয়ে ভোট দেওয়ার ফতোয়া জারি করা খুব প্রাচীন ঘটনা নয়। ধর্মীয় সম্প্রদায়ের চাপে পরে আইন বদলানোর উদাহরণও আছে।

এর পর দলিত পরিচয়ে আর এক ধরনের মেরুকরণ শুরু হয়। আর এদেশের বড় বড় সমাজবিজ্ঞানী বা বুদ্ধিজীবীরা জাত পাতের রাজনীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিতে দ্বিধাবোধ করেননি। আজ বিছিন্নভাবে কোথাও কোথাও হিন্দু ভোট বিজেপি’র দিকে যেতেই মেরুকরণ নিয়ে হাহাকার পড়ে গেছে। দেগঙ্গা, কালিয়াগঞ্জ থেকে শুরু করে ভোটের আগে ডায়মন্ড হারবারে যেসব ঘটনা ঘটেছে মূলধারার গণমাধ্যম ‘সম্প্রীতির স্বার্থে’ প্রকাশ না করলেও সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে তা ঠিক বা ভুল ভাবে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে। এছাড়া প্রতিনিয়ত গ্রাম গঞ্জে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে আর সেগুলো সামলাতে পুলিশ ও প্রশাসন এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে যা এক বিরাট জনগোষ্ঠীকে অন্য জনগোষ্ঠী থেকে ক্রমশ বিছিন্ন করেছে।

যাঁরা অনেক কিছু বোঝেন তাঁরা এটুকু বুঝলেন না যে ধৈর্যের একটা সীমা আছে। এপার বাংলার কয়েক কোটি মানুষের শিকড় ওপার বাংলায়। তাঁরা শুনতে ও দেখতে পান কীভাবে ওপার বাংলায় সংখ্যালঘুরা অত্যাচারিত হচ্ছে। সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে যারা বসবাস করেন তাদের অভিজ্ঞতা আরও তিক্ত। আবার কি ঘর ছাড়া হতে হবে- এই আশঙ্কাও অনেককে তাড়া করে।

যে পণ্ডিতরা মনে করেন যে তথাকথিত ‘কোর ইস্যু গুলি’ অর্থাৎ শুধু অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানই মানুষের একমাত্র চিন্তার বিষয় তাঁরা বোধহয় খেয়াল করেননি যে মানুষ ভাবতে শুরু করেছে– যদি মান-ইজ্জত নিয়ে বাঁচা না যায় তাহলে গ্যাসের দাম দু’ টাকা কমলে আর স্বল্প সঞ্চয়ে আধ শতাংশ সুদ বাড়লে কী যায় আসে! এক শ্রেণির সমাজবিরোধী ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায় থেকে রাজনৈতিক লড়াইয়ের আড়ালে যেভাবে জেহাদ চালিয়ে গেছে সেটিও আর এক জনগোষ্ঠীকে ক্রমশ ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। শাসকদল এই জনগোষ্ঠীর আবেগ ও নিরাপত্তাহীনতাকে উপেক্ষা করেছে।

তাই যদি সত্যিই মেরুকরণ ঘটে থাকে তার দায় অ–বিজেপি দলগুলো অস্বীকার করতে পারে না। মেরুকরণ তাঁদের বিরুদ্ধে যেতেই তাঁরা ত্রাহি রব তুলছেন। প্রতিক্রিয়া সব সময়ে তাৎক্ষণিক হয়তো হয় না, কিন্তু ক্রিয়া হবে অথচ প্রতিক্রিয়া হবে না– বিজ্ঞান তো তা বলে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.