নাসের শেখ , পেশায় মৌলানা ; বয়েস সাকুল্যে ৪৪। তিনি দেখতেও যেমন অদ্ভুত , তার কথাবার্তা , কাণ্ডকারখানা – আরও বেশি অদ্ভূত । উচ্চতা আর কত হবে ? খুব বেশি হলে , মেরে কেটে ৫ ফুট ২ ইঞ্চি ! কিন্তু হলে কি হবে ? এই খর্বাকৃতি মানুষটিই হলেন কলকাতা থেকে ৪০০ কিলােমিটার উত্তরে বাংলাদেশ ঘেঁষা পশ্চিমবঙ্গের মালদা জেলার হরিশচন্দ্রপুর লাগােয়া ‘ কেবল’নামের ছােট্ট একটি শহরের এক প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব । সেখানে একডাকে কে না চেনেন তাকে ?
স্থানীয় এক মসজিদের ইমাম তিনি । মসজিদ সংলগ্ন একটি খারিজি ( সরকারী নিয়ন্ত্রণবিহীন ) মাদ্রাসাও চালান তিনি । তার আরও একটি বৈশিষ্ট হল , বাংলা ও বিহারী মেশানাে এক কিম্ভুতকিমাকার ভাষাতে কথা বললেও ( কেবল এলাকাটির অবস্থান বিহার – বাংলা সীমানায় ) আরবিতে তিনি তুখােড় । মজা করে মডারেট মুসলিমরা যাকে “ ছােটা ভাইকা পায়জামা ঔর বড়ে ভাইকা কুর্তা ” বলেন , ( ছােট ভাইয়ের পায়জামা , যা কিনা সবসময়ই খাটো হওয়ায় গােড়ালির উপর উঠে থাকে ; আর বড় দাদার কুর্তা , অর্থাৎ যে কুর্তা যতদূর সম্ভব হাঁটুর নিচে ঝুলে থাকে ) তেমন ধরণের পােষাকেই তাকে দেখতে অভ্যস্ত । বাদামি হেনা করা চুল , গোঁফ কামানাে একমুখ ঘন দাড়ির মাঝে সুর্মা মাখা চোখদুটিতে যেন সাপের শীতল চাহনি । হাতে জপমালা , আর সমস্ত শরীরময় ছড়িয়ে থাকা আতরের উগ্র গন্ধ যেন খুব সহজেই তাকে অন্যান্যদের মাঝে চিনে নিতে সাহায্য করে । এলাকাবাসী যে মানুষটার কথায় সর্বদা ওঠে আর বসে , সেই ‘ মৌলানা সাহেবে’র কাজই হল বিভিন্ন ইসলামিক ধর্মীয় বিষয় তথা নিকাহ , তালাক প্রভৃতি ব্যক্তিগত ব্যাপারসহ অন্যান্য আরও বহু কিছু ক্ষেত্রে শরিয়তি বিধান দেওয়া ।
নাসের নিজেকে সবসময় ‘সহি মুসলমান ’ বলেই মনে করেন । তাই জীবনে কখনও ছবি তােলেন না । তার গােটা মাদ্রাসা তথা তিন কামরার ঘরের ভিতরে কোথাও কোন ছবি দেখতে পাওয়া যাবে না । তবে হ্যা , একেবারেই যে কোথাও একটাও ছবি নেই তাও নয় , -ছবি একটা আছে বটে , আর তা হল ‘ আল – আজহার আল আসওয়াদ ’ বা ‘ মক্কার কাবা পাথরে’র ।
মাদ্রাসাতে প্রতিদিন যেখানে ৮ থেকে ১৮ বছরের ৭২ টি শিশু একনিষ্ঠভাবে তাদের কোরান সহ অন্যান্য ইসলামিক ধর্মীয় বিষয়ে পাঠ নেয় , সেখানেই রয়েছে ছবিটি । শুনলে অবাক হতে হয় , ছবি যে শুধু তারই নেই তাই নয় , তার তিন স্ত্রী এবং দুই মেয়ে , চার ছেলে কারােরই কোন ছবি নেই । ( প্রথমে তার চার স্ত্রী – ই ছিল , তাদের মধ্যে একটি দু’বছর আগেই গত হয়েছেন । তাই মৌলানা সাহেবের বড়ই ইচ্ছা , সে জায়গায় তিনি অতি সত্বর অন্য কোন এক সুশীলা কন্যার পানিগ্রহণ করেন । সেই মতন খোঁজখবরও নাকি চলছে ) । এমনকি , তার হাতের স্যামসঙের মােবইলখানিতেও সেই পরিবারের একটি ছবিও আপনি পাবেন না ।
“ হাদিস অনুযায়ী , ইসলামে মানুষসহ সব ধরণের ছবি তােলাই নিষিদ্ধ বা হারাম , ” সাবলীল ভঙ্গীতে বলে চলেন তিনি । “ ছবি তােলা তাে বটেই , এমনকি কোন ছবি আঁকাও ইসলামে বৈধ নয় । ” জানিয়ে দিতে ভােলেন না মৌলানা সাহেব ।
তার মতে , মানুষকে ধ্বংস করতে শয়তান যে অস্ত্র পাঠিয়েছে , তার নামই টিভি বা টেলিভিশন । আর সিনেমার কথা তাে মুখে যত না আনা যায় , ততাে – ই মঙ্গল । “ এর চেয়ে বড় শত্রু আর কি – ই বা হতে পারে ? ” গম্ভীরভাবে প্রশ্ন করেন তিনি । “ গান – বাজনা , এমনকি মৃদুস্বরে গুন গুন করে কিছু গাইলেও পরিষ্কার বুঝতে হবে , শরীরের মধ্যে শয়তান ঢুকে পড়েছে । এখানেই শেষ নয় , রীতিমত গর্বের সঙ্গে নাসেরের দাবী , এই গান গাওয়ার অপরাধেই তার বড় মেয়ে সাবেরা খাতুনকে মেরে তিনি বেশ কয়েকটি দাঁত ভেঙ্গে দিয়েছেন । তখন তার বয়েস আর কতই বা ? সাত কি আট ! একদিন নাসেরের কানে এল যে , মেয়ে তার বলিউডের কোন এক জনপ্রিয় হিন্দি গান গাইছে । তা শােনার সঙ্গেসঙ্গেই বেধড়ক্কা পিটিয়ে তাকে উচিৎসহবত শিখিয়েছিলেন নাসের । পাশাপাশি , চিরকালের মত বাড়ির বাইরে বেরুনােও বন্ধ হয়ে গেল ছােট্ট মেয়েটির । কারণ খোঁজ নিয়ে নাসের জানতে পেরেছিলেন যে বাড়ির পাশেই এক পাড়াতুতাে চাচার চায়ের দোকানের সামনে খেলতে গিয়েই সাবেরার এই সর্বনাশ ! একমুখ তৃপ্তিভরা হাসি হেসে এরপরেইনাসেরের স্বগতােক্তি , আজকাল তাে কেবলের ( প্রায় সম্পূর্ণ মুসলিম অধ্যুষিত জনবসতি ) হাতে গােনা কয়েকজন ছাড়া আর কাউকেই এসব গানটান করতেই শুনবেন না । এখন না কেউ এখানে গান শােনে – না কেউ কিছু বাজায় । ”
“ অথচ এই একদশক আগেও এখানকার ঘরে ঘরে হরদম গান – বাজনা চলত । পাপী ও টাকফিরে ( মুসলমান অথচ যারা শারিয়া আইন মানেন না ) ভর্তি ছিল পুরাে এলাকাটাই । এরা সিনেমায় যেত , গান শুনতাে , অনেকে আবার নাচতেও ! মেয়েদের বােরখা পরার বালাই ছিল না , চায়ের দোকানে ছেলেদের সঙ্গে প্রায়ই মেয়েদেরও বসে বসে আড্ডা দিতে দেখা যেত ! অসহ্য ! কেবল ’ একেবারেই মুশরিকে ( যারা মূর্তিপূজার মত মহাপাপ করে ) ছেয়ে গিয়েছিল । এক সুফি পীরের মাজারেও নাকি যেত এরা , যা কিনা ইসলামের নজরে ভয়ঙ্কর অন্যায়ই শুধু নয় , হত্যাযােগ্য অপরাধও বটে ! ” চঞ্চল হয়ে ওঠেন মৌলানা সাহেব ।
এক স্ত্রীকে এরপর ‘ চা’ তৈরির ফরমায়েশ করলেন নাসের । অথচ আশ্চৰ্য্য , প্রত্যুত্তরে রান্নাঘর থেকে কোন সাড়া পাওয়া গেল না । সবুজ দুটি চেয়ার , এবং বিছানা লাগানাে বসার ঘরটিতেও কোন মহিলাকেই আসতে দেখা গেল না । না এল তার কোন স্ত্রী , অথবা তার মেয়েদের মধ্যে কেউ । কেবলমাত্র কিছু পরে তার দুই ছােট ছেলে বেরিয়ে এসে তাকে ‘ আদাব ’ জানালাে । নাসের ব্যাখ্যা করে জানালেন সহি ইসলামে ঘরের মেয়েদের যে শুধুই ঘরের বাইরে বের হওয়া বা বহিরাগত কোন পরপুরুষের সামনে আসা বারণ , তাইনয়- এমনকি তাদের কণ্ঠস্বরও সেই সব অপরিচিতের কানে ঢােকা একেবারেই অনুচিত ।
এই ফাকে ইসলামে ‘হারাম’ও ‘ শিরক’কি বস্তু , তাই নিয়েই মিনিট পাঁচেক ধরে চলল সংক্ষিপ্ত পর্যালােচনা । আর সে সবের শাস্তি নিয়ে খুঁটিনাটি বিষয়ে তিনি যখন আমাদের কিছু বােঝাচ্ছেন , এমন সময় বড় বাসন জাতীয় কোন ধাতব পাত্রে হাতা বা খুন্তি জাতীয় কিছু একটা দিয়ে তিনবার মৃদু আঘাতের শব্দ কানে ভেসে এল । পরে বােঝা গেল এটা একটা সংকেত , যা দিয়ে বুঝে নিতে হবে ‘ চা ’ তৈরি । অতএব নাসেরের এক ছেলে ভিতরে ঢুকে আমাদের জন্য গ্লাস ভর্তি জল এবং কাপে করে চিনি দেওয়া দুধচা আর সঙ্গে কিছু ভাজা চানা নিয়ে এল । নাসের তার জলের গ্লাসটি তুলে নিয়ে পুরাে জলটা শেষ করলেন , কিন্তু একবারে নয় ; ঠিক তিনবারে ! কারণ , সুন্নাহ ( নবী মহাম্মদ তার দৈনন্দিন জীবনে যে যেকাজ ঠিক যে যেভাবে করতেন , তাকেই অবিকল একই উপায়ে যুগযুগ ধরে অনুসরণ করার নীতি ) অনুসারে এইভাবেই নাকি জলপানের নিয়ম ।
নাসেরের খাবার ধরণটিও ভারি অদ্ভুত । বুড়াে , তর্জনী ও মধ্যমা , কেবলমাত্র এই তিন আঙ্গুলের সাহায্যেই তিনি খাবার খাচ্ছিলেন । জানা গেল নবীজী যেহেতু এইভাবেই খাদ্যগ্রহণ করতেন , তাই আর সকল মুসলমানেরও ঠিক এইভাবেই খাওয়ার অভ্যাস করা উচিৎ । আমরা যেমন গরম চা – এ চুমুক দেবার আগে তাতে ফু দিই , তিনি কিন্তু একবারের জন্যেও তেমনটি করলেন না । প্রশ্ন করায় উত্তর এল “ যা আপনি খাচ্ছেন , তার গন্ধ শোঁকাও যে ইসলামে নাজায়েজ । ” কিন্তু এগুলাে মেনে চলার যৌক্তিকতা কোথায় ? এর ব্যাখ্যা আর মিলল না তার কাছে । শুধুমাত্র খাবার শেষে ওই তিন আঙ্গুল কেন চেটে পরিষ্কার করতে হবে , সে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তার যুক্তি , ইসলামে এক কণা খাবার নষ্ট করাও গুনাহ ।
এবারে আসুন , দেখে নেওয়া যাক এই সালাফির বীজ কিভাবে ভারতবর্ষের বুকে ধীরে ধীরে মহীরূহে পরিণত হয়ে চলেছে ।
জন্মসূত্রে নাসের কিন্তু আদপেই কেবল – এর বাসিন্দা নন । কিংবা তার আসল নামও নাসের ছিল না । কথায় কথায় উঠে আসে এক অজ্ঞাত ভয়ঙ্কর ইতিহাস ।
পূর্ব মালদার ছােট্ট ও অখ্যাত গ্রাম্য এলাকা লস্করহাটের এক ক্ষুদ্র , দরিদ্র ও প্রান্তিক কৃষক পরিবারে তার জন্ম । পাঁচ ছেলে ও তিন মেয়ের মধ্যে তিনিই ছিলেন সবচেয়ে ছােট । নাম ছিল তার শিমূল , শিমূল খান । শিক্ষাদীক্ষা বিহীন এই নিরন্ন পরিবারেই শিমূলের বেড়ে ওঠা । শিশু বয়সের পাঠও স্থানীয় একটি মাদ্রাসাতেই । আর এখানেই একজন মেধাবী ছাত্র হিসেবে মাদ্রাসার আলেমদের নজরে পড়ে যান তিনি । আট বছর বয়েসে মালদারই গাজোলে অপর একটি বড়াে মাদ্রাসায় তাকে সরিয়ে আনা হয় । অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই ইসলামিক বিষয়ে চোস্ত হয়ে ওঠার কারণে মাত্র ১২ বছর বয়েসেই তাকে আরও বড় একটি বৃত্তির ব্যবস্থা করে ভারত । বিখ্যাত ইসলামিক হাফেজ ( পন্ডিত ) মৌলানা হাফিজ মুহাম্মদের কাছে শিক্ষালাভ করতে ভূপাল পাঠানাে হয় । পরবর্তী তিনবছর ধরে , সেখানে ইসলামিক সাহিত্য ও দর্শনের উপর চলে তার অক্লান্ত পঠনপাঠন । পরীক্ষায় দেখা যায় অসামান্য কৃতিত্বের সঙ্গেই জুনিয়র হাই মাদ্রাসার গণ্ডি অতিক্রম করেছেন । নাসের । ফলস্বরূপ এবারে ভারতশ্রেষ্ঠ দেওবন্দ দার – উল উলুমে ঠাই মিলে যায় তার । পরবর্তী লক্ষ্য , সেখানে আরও ব্যাপক ও গভীরভাবে ইসলামিক ধর্মীয় বিষয়ে জ্ঞানলাভ । সেখানেই এক বরিষ্ঠ উলেমা তার নাম পরিবর্তনের বিষয়ে তাকে উৎসাহিত করেন । “ শিমুল ( বাংলার একধরণের উৎকৃষ্ঠ তুলা বিশেষ ) নামটি ইসলামিক না হওয়ায় বড়দের কথামত আমি আমার নাম পরিবর্তন করে শেষে ‘ নাসের ’ – ইহয়ে গেলাম । আর এটাও তাে ঠিক যে , ‘ শিমুল ’ নামটি আদপে একটি হিন্দু নাম – ই বটে , আর কোন হিন্দু বা কাফেরের নামে একজন মুসলমানের নামকরণ কখনই বাঞ্ছনীয় নয় । যদিও এর মধ্যে আমি আমার বাব – মা বা পরিবারের অন্যান্য গুরুজনদের কোন দোষ দেখতে পাই না , তারা তাে ছিলেন নেহাতই অশিক্ষিত এবং অজ্ঞ , বলে চলেন নাসের ।
দেখতে দেখতে ধীরে ধীরে দেওবন্দেও নাসেরের সুখ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগল । ক্রমে সেখানেই তিনি পরিচিত হলেন হজরত মৌলানা পীর মাওদুদির সঙ্গে । মাওদুদির ছিলেন সৌদি আরবের পৃথিবীবিখ্যাত ইসলামিক ইউনিভার্সিটির স্কলার তথা নিঃসন্দেহে এক পিওর সালাফিস্টও ( সালাফি প্রচারক ) বটে । ( সালাফি সম্পর্কে প্রতিবেদনটির অন্তিম অংশে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা হয়েছে । )
ঘটনাচক্রে এবারে সেই মাওদুদি – ই স্বয়ং তাকে নিজের কাছে রেখে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশুদ্ধ সালাফি মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন । পরিণামে পরবর্তীকালে “ আহল – ই – হাদিস ” নামের সালাফি আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন নাসের , ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি থেকেই সৌদি আরবের পৃষ্ঠপােষকতায় যা উত্তর ভারতের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ব্যাপক প্রচার , প্রসার ও বিস্তার লাভ করে আসছিল । এরপরের অধ্যায়টুকু নিয়ে আর বিশেষ মুখ খুলতে চাইলেন না নাসের । অর্থাৎ দেওবন্দ পরবর্তী পর্যায়ে তিনি কোথায় কোথায় গেলেন , বাকিকিকরলেন । সেসবের বেশিরভাগটাই তিনি চেপে যেতে চাইলেন বলেই মনে হল । তবে কথাপ্রসঙ্গে এরমধ্যেই একটা সময়ে যে তিনি তবলীগি জামাতের হয়ে দেশজুড়ে ধর্মান্তরকরণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন পরিষ্কার হয় তাও ।
অবশেষে বছর সাতেক আগে মালদার কেবলের একটি স্থানীয় মসজিদের মৌলানা হিসেবে নিয়ােজিত হন নাসের । শুরু হয় তার কাজ । পাশাপাশি একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে আরম্ভ হয় এলাকার সমস্ত মুসলমান অভিভাবকেরা যেন তাদের সকল বাচ্চাদের সেখানে পাঠান , তারজন্য সকলকে বােঝানাের কাজটিও । আর সেই থেকেই ক্রমশ বদলে যেতে থাকে কেবলের সামগ্রিক চেহারাটা ।
পুরুষেরা অদবকায়দা ও বেশভূষায় তাদের মৌলানাকে অনুসরণ করতে শুরু করেন । দাড়ি গোঁফে এখন আর তাদের চেনাই দায় । বাড়ির মেয়েদের মধ্যে শুধু যে কালাে বােরখার প্রচলন শুরু হল তাই নয় , তারা পথেঘাটে বেরুনােও বন্ধ করে দিলেন । এমনকি এখানকার পাঁচ বছরের মেয়েদেরও এখন হিজাব পরিয়ে রাখাটাই দস্তুর । এলাকারই গিয়াসুদ্দিন বাবার বিখ্যাত মাজার বা দরগাটিতেও এখন তাদেরকে আর আগের মতন যেতে দেখা যায় না । মুয়াজ্জিনের আজান ছাড়া আর সমস্ত সুর , যা এককালে কেবলের আকাশ বাতাস মাতিয়ে রাখত ; সব যেন কেমন নিঝুম হয়ে গেল । আরও মারাত্মক ব্যাপার হল , এখন থেকে এলাকার সংখ্যালঘু হিন্দুদের তারা এড়িয়ে চলতে শুরু করলেন । সেখানেই শেষ নয় , তাদের সঙ্গে একপ্রকার কথাবার্তা বলা – ই তারা প্রায় বন্ধ করে দিলেন ।
বাস্তবে এখানকার এই ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল , নাসের আসারও বেশ কিছুদিন আগে থেকেই । “ তখন এখানকার মুসলিমরা আমাদের বেশ বন্ধুই ছিলেন । যথেষ্ট উদারও ছিলেন তারা । আমাদের পূজা – পার্বণে দিব্যি তারা আমাদের বাড়ি আসতেন , প্রসাদও খেতেন । আমরা হিন্দু – মুসলিম উভয়েই সুন্দরভাবে বাস করতাম , মাজারে গিয়ে প্রার্থনা করতাম । এরপরই হঠাৎ – ই একদিন গ্রামে কিছু বাইরের মুসলমান এসে হাজির হলেন । তাদের ইয়া বড় বড় দাড়ি , যাদের কাউকেই চিনতাম না আমরা । ” আর এর পরেই বাধল যত গণ্ডগােল ।
স্থানীয় মুসলিমদের নিয়ে আড়ালে আবডালে মিটিং করার পাশাপাশি এলাকার বাড়ি বাড়ি ঘুরে ইসলাম ধর্মের নামে কি যেন সব প্রচার শুরু করলেন তারা । না জানি কোথা থেকে এলাকার মসজিদ সংস্কারের নামে গ্রামে প্রচুর টাকা ঢুকতে শুরু করল । সেই টাকায় এখানকার মসজিদের পুরাে ভােল পাল্টে গেল । নতুন করে সাজানাে হল সেটিকে । নয় নয় করে বছর সাতেক হবে , মসজিদে এলেন এক নতুন ইমাম । সেই থেকে এলাকার সবকিছুই যেন খুব দ্রুত বদলে যেতে লাগল । চেনা মুসলমানেরাই যেন হঠাৎ – ইভীষণ অচেনা হয়ে গেলেন । আজ তারা এতটাই কট্টর যে , আর আমাদের সঙ্গে ভালভাবে কথাটুকু পর্যন্ত বলতে চান না । উল্টে কোথা থেকে “ কাফের – টাফের ” বলে ঘৃণা করেন , যা আমরা সত্যিই আগে কোনদিনই শুনিনি পর্যন্ত । আজ আর তারা আমাদের বাড়িতে আসেন না , এমনকি সেই মৌলানার কথামত তারা হিন্দুদের দেবদেবীর দিকে ভুলেও তাকান না , প্রসাদ খাওয়া তাে অনেক দূর । ফলে বর্তমানে আমাদের এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্পর্কটা এক চরম অবিশ্বাসের চেহারা নিয়েছে । মনােমালিন্য এমন যায়গায় গিয়ে পৌঁছেছে যে , আমাদের আর একমুহূর্ত এখানে থাকতে ইচ্ছে করে না । কখন যে কি হয় ? কে জানে ! -এক নিঃশ্বাসে বিষগ্নবদনে নিজেদের মানসিক যন্ত্রণার ছবিটা ভেতর থেকে নিঙড়ে বার করে আনলেন এলাকারই এক ছােট মুদি দোকানের মালিক কেশব চন্দ্র দাস । বলার সময় তার কণ্ঠে আক্ষেপ ঝরে পড়তে লাগল বার বার । জানা গেল ‘ কেবল ’ এলাকাটি ধীরে ধীরে আজ প্রায় হিন্দুশূন্য । নেহাত উপায় নেই , নইলে সাকুল্যে আর মাত্র ডজন দু’য়েক হিন্দু পরিবার কোনমতে টিকে আছে সেখানে ।
বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয় , কেশব যে মৌলানার কথা বলছিলেন , তিনি নাসের ছাড়া আর কেউই নন । এখানে তার পা দেবার দুবছর আগে থেকেই তবলীগি জামাতের প্রচারকেরা মাসের পর মাস ধরে এলাকায় ঘাঁটি গেড়ে স্থানীয় মুসলিমদের মধ্যে ঘুরে ঘুরে সালাফি মতবাদ প্রচার করতে শুরু করেন । আর অবাক কান্ড , এলাকাবাসীরাও যেন অতি সহজেই এর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ক্রমেই নিজেদের সালাফি মতবাদে উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন । সহি মুসলমান হবার দৌড়ে রীতিমত প্রতিযােগিতা শুরু হয়ে যায় তাদের মধ্যে । প্রচুর যাকাৎ ( ইসলামিক অনুদান ) উঠতে থাকে এলাকা থেকে , আনুমানিক প্রায় সাত লক্ষ টাকা ব্যয়ে নতুন আঙ্গিকে তৈরি করা হয় সেখানকার পুরানাে মসজিদটিকে । ঢেলে সাজানাে হয় তা । তার পরপরই মসজিদ কমিটির মাথারা সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিয়ে তাদের পুরানাে ইমামকে সরিয়ে যে জায়গায় মৌলানা নাসেরকে বহাল করেন । সেই শুরু , ক্রমেই পালটে যেতে থাকে কেবলের আশেপাশের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকার সামগ্রিক চালচিত্রটি ।
আক্ষরিক অর্থেই তারা যেন হারিয়ে ফেললেন তাদের বর্ণময়তা । পুরুষেরা এবার থেকে কেবলই সাদা পােষাক ( যেমন নাসের পরেন ) এবং মহিলারা কালাে বােরখার অন্তরালে নিজেদের আবদ্ধ করতে শুরু করলেন । দোকানে দোকানে লিপস্টিক বা নেলপালিশ বিক্রি বন্ধ হয়ে গেল । এক এক করে প্রতিটি বাড়ি থেকে সরে গেল সব ছবি । হাতে গােনা যে । ক’জনের কাছে টিভি ছিল , তারাও ইসলামিক ধর্মীয় চ্যানেল । ( যেমনঃ জাকির নায়েকের পিস টিভি ) ছাড়া আর সব দেখা বন্ধ করে দিলেন । এমনকি উঠতি বয়েসের ছেলে ছােকড়ারাও মােবাইলে গান শােনা বন্ধ করে দিল , অন্তত প্রকাশ্যে তাে বটেই । এলাকার সরকারী স্কুল ছাড়িয়ে বেশিরভাগ অভিভাবকেরাই তাদের শিশুদের নাসেরের মাদ্রাসায় পাঠাতে শুরু করলেন । ডাক্তার , ইঞ্জিনিয়ার বা টিচার নয় , তাদের এখন একটাই স্বপ্ন ; কিভাবে বিভিন্ন সালাফি সেমিনারে তাদের ছেলেরা যােগ দিতে পারে , আর মেয়েরা হয়ে উঠতে পারে ঘাের সংসারী ।
পরিবর্তনের হাওয়া যে কোথায় গিয়ে ঠেকেছে , পেশায় স্থানীয় ব্যবসায়ী নবাব বিশ্বাসের কথাতেই তা পরিষ্কার । একটা সময় সিনেমাপাগল এই লােকটি ছিলেন অন্ধ শাহরুখ ভক্ত । উৎসব – পার্বণে কখনাে সখনাে দু’এক টোক পানেরও অভ্যাস ছিল তার , আর এইসব হালাল টালালের সে ধার ধরতেন না কখনাে । তার বড় মেয়ে’তাে ( ২৬ ) রীতিমত জিক্স পরেই রাস্তাঘাটে চলাফেরা করত । এমনকি বছর কয়েক আগে নিজের পছন্দেরই এক ছেলেকে বিয়েও করে সে । আর আজ ? এককালে যে নবাব মনেপ্রাণে চাইতেন যে তার ছেলেরা ( ২৪,২২ ) ডাক্তার বা পুলিশ অফিসার হােক , আর আজ বড় ইচ্ছে , যদি তারা একবার নাসেরের মতই সালাফি প্রচারক হতে পারে । আল্লাহের কাছে তার এখন শুধু একটাই প্রার্থনা , বড়টি যেন সৌদির মদিনা ইউনিভার্সিটিতে ইসলাম নিয়ে পড়ার সুযােগ পায় , একমাত্র যেখানেই যে সহি মুসলিম বা ওয়াহবি’জমের সঠিক শিক্ষা দেওয়া হয় । তার স্ত্রী রুকসানা একটা সময় শাড়িই পরতেন , পরিবারের সঙ্গে ঘুরতেও যেতেন ছুটির মরসুমে । এই বাংলার পাহাড় থেকে সমুদ্র বহু জায়গায় তােলা সে সব ছবি সুন্দর করে সাজিয়ে রাখতে ভালবাসতেন শােবার ঘরে । আর এখন এই ঘরই তার সব । ছ মাসে মাসে কদাচিৎ কোন কারণে যদি বা তাকে ঘরের চৌকাঠের বাইরে পা মাড়াতে হয় , কালাে বােরখাই তার একমাত্র সম্বল । আর বেড়াতে যাওয়া ? সে যে স্বপ্নেরও অতীত । সুমী ( ১৯ ) ছিল তাদের আদরের ছােট মেয়ে । সে ছিল নবাবের চোখের মণি । একটা সময় তার খুব ইচ্ছে ছিল , মেয়ে হবে তার বিরাট বড় স্কুলমাস্টার ; অনেক পড়াশুনা করবে , বাচ্চাদের পড়াবে । অথচ দেখা গেল , গতবছরেই পাশের জেলা মুর্শিদাবাদের বহরমপুরের বছর পঁয়ত্রিশের এক মৌলভীর সঙ্গে তার নিকা করিয়েছেন তিনি । একটি সন্তানের পর সে এখন পুনরায় সন্তানসম্ভবা ।
“ এখন বুঝি , একটা সময় আমরা কেমন মুশরিকের ( মুসলিম হয়েও কাফেরের জীবনযাপন ) জীবন কাটিয়েছি । না বুঝে , কত অধর্ম আর পাপ – ই না করেছি ! শুধু নামেই আমরা মুসলিম ছিলাম । ওটুকুই ব্যাস ! উনি ( মৌলানা নাসের ) না এলে যে কি হত !! উনিই তাে আমাদের চোখ খুলে দিলেন । হলে ইসলাম কি , আমরা কি জানতে পারতাম ? নাসেরই আমাদের বাঁচিয়েছেন । ওনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ । ” বলিষ্ঠ গড়নের নবাবের অন্তঃস্থল থেকে অকপটে বেরিয়ে আসে এই অভিব্যক্তি । তবলীগি জামাতের শিক্ষায় মুখভরা দাড়ি শােভিত একজন সালাফি প্রচারক হিসেবে নিজেকে উৎসর্গ করতে আজ যিনি বড়ই ব্যকুল ।
“ জীবনে বহু পাপ করেছি , তাই আমার কাছে আজ একটাই রাস্তা সালাফি প্রচার । আমায় মালদা বা তার আশেপাশের মুসলিম ভাইদের মাঝেইসলামিক সালাফি আদর্শ প্রচার করতে হবে । তাছাড়াও মনে প্রাণে এও চাই যে , যতবেশি পারি কাফেরদের ( অমুসলিম ) তাদের নরকের রাস্তা থেকে উদ্ধার করে ইসলামের আলােকিত পথে নিয়ে আসি । ইনশাল্লাহ , ভারত একদিন মুসলিম দেশ হয়ে বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের সঙ্গে যােগ দেবেই । মধ্যপ্রাচ্য থেকে দক্ষিণ এশিয়া এই পুরাে অঞ্চলটাতেই একদিন ইসলামিক খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হবে । আর সে দিনটা খুব বেশি দূরেও নয় ! তখন হাদিস অনুযায়ী , হাতে গােনা নির্দিষ্ট কয়েকটি ছাড় বাদে এখানকার কাফেরদের আর টিকে থাকাই মুশকিল । তাই আগেভাগেই তাদের মুসলমান হয়ে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ । কারণ এটাই যে আল্লার ইচ্ছে ” । স্থির দৃষ্টিতে এক নিঃশ্বাসে বলে চলেন নবাব । অবশ্য এ সবই তার মৌলানা নাসেরের কাছ থেকেই শেখা । আর এটাও ঠিক যে , নাসেরও তার সালাফি কট্টরতার ব্যপারে পুরােপুরি খােল্লামখুল্লা । প্রকাশ্যে মুন্ডচ্ছেদ , অঙ্গচ্ছেদ , পাপী – পরকীয়াকারী ও কাফেরদের পাথর ছুড়ে হত্যা – এসবকিছুকেই তিনি প্রবলভাবে সমর্থন করেন । তার মতে , ইসলামিক উম্মাহ ( বিশ্বব্যাপী কেবলমাত্র মুসলমানদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববােধ ) প্রতিষ্ঠার জন্য নিরলস প্রচেষ্টা তথা ইসলামের বিস্তার ঘটিয়ে ( প্রয়ােজনে বলপূর্বক হলেও ) সারা বিশ্বে ইসলামিক খিলাফতের ( সাম্রাজ্য ) জন্যে পবিত্র জেহাদ , প্রতিটি সহি মুসলমানের অবশ্যকরণীয় কর্তব্য । তাইতাে নাসের আইসিস’কে সম্পূর্ণ সমর্থন করেন । আমেরিকাকে মনে করেন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জালেম ( শয়তান ) । তার আরও বক্তব্য , এদেশের কোন মুসলমানেরই ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যােগদান কার উচিৎ নয় , কারণ তারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ক্ষতিকর । তার মতে পাকিস্তান থেকে আলাদা হওয়ায় বাংলাদেশ তাদের সুমহান ধর্মীয় ঐতিহ্য হারিয়েছে , আর তাইতাে সে দেশে এখন এত প্রাকৃতিক বিপর্যয় । “ আল্লার গজবের মূল্য তাে তাদের চোকাতেই হবে , পুড়তে হবে জাহান্নামের অনন্ত আগুনে । ” রেগে ওঠেন নাসের ।
“ এমন একটা দিন ছিল , যখন প্রায় সারা পৃথিবীটাই ইসলামের ছায়াতলে ছিল , ইনশাল্লাহ সেই সােনালী দিন আবার ফিরে আসতে চলেছে । চারিদিকে মুসলমান দেশগুলির মাঝে এই এক ভারতই কেবল ইসলামিক নয় । তবে এও আর খুব বেশিদিন চলবে না , দেখবেন ভারতও একদিন সেই ইসলামিক রাজ্যে গিয়েই নাম লেখাবে । আর এটা শুধু সময়ের অপেক্ষা মাত্র ” । এবারে বেশ তৃপ্তির হাসি হেসেই কথাগুলাে বলছিলেন নাসের । সঙ্গে আরও যােগ করলেন , “ প্রচুর সংখ্যায় মুসলমানের কারণে পূর্বভারত ইতিমধ্যেই সেই পথে অনেকটাই এগিয়ে গেছে । আর সে জন্য এ অঞ্চলের গত কয়েকদশকে মুসলিম বৃদ্ধির হারকে প্রশংসা না করে পারা যায় না । ”
“ একমাত্র ইসলাম গ্রহণ করলেই ভারতের সব সংকটের অবসান সম্ভব । ইনশাল্লাহ একবার যদি তাই হয় , তবে ভাবতে পারছেন আমাদের লাভ ঠিক কতটা ? দেখবেন পাকিস্তানের সঙ্গে সব শত্রুতা শেষ হয়ে যাবে । মিলিটারি পাের কোটি কোটি ডলারও আর খরচ করতে হবে না । আর সত্যি বলতে কি , তাহলে তাে আমাদের আর্মিরই আর কোন দরকার পড়বে । চারিদিকে তখন শুধুই মুসলমান , সবাই আমাদের বন্ধু হয়ে যাবে । আল্লা তখন আমাদের ইসলামিক ভারতকে বুক দিয়ে রক্ষা করবেন । ” এবারে নাসেরকে সত্যিই যেন বেশ সিরিয়াস দেখায় ।
এখন কথা হল , দেশের মধ্যে কেবল ’ – এর মত স্থান কি শুধু এই একটাই ?
সত্যি বলতে , এই বিপদটা কিন্তু আজ আর ঠিক মালদার ‘ কেবলেই আটকে নেই , বরং তা সংক্রমিত হয়ে পড়েছে সারা দেশের সর্বত্র । সৌদি ওয়াহবিজমের তীব্র বিষে বিষাক্ত এমন । হাজার হাজার কেবল বর্তমানে সারা ভারত জুড়েই মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে । বিশেষ করে সৌদি আরবের বেআইনি পেট্রোডলারের বদান্যতায় আজকের দিনে আসাম ও পশ্চিমবঙ্গের বুকে বিভিন্ন জায়গায় মৌলানা নাসেরের মতনই এমন হাজার হাজার খারিজি মাদ্রাসা ব্যাঙের ছাতার মত যত্রতত্র গজিয়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে । অহর্নিশি সেখানে প্রকাশ্যে ইসলামিক সালাফি মতবাদ প্রচারিত হচ্ছে । প্রচারকরা প্রচুর সংখ্যায় উপস্থিত থেকে সেসব জায়গায় দিনরাত ধরে পুরােদমে তাদের কাজ ( প্রচার ) চালিয়ে যাচ্ছেন । সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার হল , বাংলা ও আসামের মুসলমানদের বেশ বিরাট অঙ্কের একটা অংশ আজ ইতিমধ্যেই এই রাস্তায় সালাফির আদর্শে জীবন পণ করার ব্রত গ্রহণ করেছেন । অথচ ভােটের লােভে এসব বিষয়ে রাজনীতিবিদেরা নীরব । আর তাদের চাপে চোখ বন্ধ করে নিয়েছে স্থানীয় প্রশাসনও ।
সালাফি ইসলামের কালাে মেঘ যে ধীরে ধীরে আমাদের ভাগ্যাকাশ ছেয়ে যাচ্ছে , সকলের কাছেই তা আজ জলের মত পরিষ্কার । দিকে দিকে রাস্তাঘাটের সর্বত্র বােরখা ঢাকা মহিলার সংখ্যা বৃদ্ধি এবং পুরুষদের মধ্যে দাড়ি রাখার চল ও দীর্ঘ কুর্তা সহ খাটো পাজামা পরার প্রবণতা বেড়েই চলেছে । সালাফি ভাবধারার মসজিদের সংখ্যাবৃদ্ধির পাশাপাশি এই ধরণের সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ছড়াবার জন্য মুসলিম মহল্লাগুলিতে নিরলস প্রয়াস চালাতে দলে দলে ময়দানে নেমে পড়েছেন মৌলভী – ইমামদের একাংশ । এছাড়াও মুসলিমদের দৈনন্দিন জীবনের মধ্যেও ইদানীং বেশ কিছু মৌলিক পরিবর্তন হামেশাই লক্ষ্য করা যাচ্ছে । মুসলিমদের মধ্যে বিরাট একটা অংশই আজ আর গান – বাজনার ছায়াও মাড়ান না । নাচ – গান , ছবি তােলা বা ছবি আঁকার মত সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক অভ্যাসের প্রায় সবকিছুতেই দাঁড়ি টেনেছেন তারা । এক এক করে মুসলিম অভিভাবকেরা তাদের শিশুদের সরকারী স্কুল থেকে নাম কাটিয়ে সালাফি মাদ্রাসাগুলির লম্বা লাইনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছেন । এমনকি প্রতিবেশী হিন্দু – সহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে ক্রমেই পারস্পরিক কথাবার্তাও বন্ধ করে দিচ্ছেন তারা । বাড়িয়ে তুলছেন আভ্যন্তরীণ ভেদাভেদ ও অবিশ্বাসের বিষবাষ্প । সবচেয়ে বড় কথা , সালাফি তথা তবলীগি জামাতের প্রচারকেরা নিঃশব্দ ও চুপিসাড়ে হিন্দু , বিশেষ করে তাদের দলিত ও অর্থনৈতিকভাবে অনগ্রসর অংশকে বেশকিছু ক্ষেত্রে লােকচক্ষুর অন্তরালে ধীরে ধীরে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করে চলেছেন । এই ধরণের ধর্ম পরিবর্তনের ঘটনা কোন প্রচারের আলােয় আসে না , বা সদ্য ধর্মান্তরিতেরাও তাৎক্ষণিকভাবে প্রশাসনিক স্তরে কিছু না জানানােয় তাই নিয়ে কোন খোঁজখবর হয় না বা হৈচৈ – ও পড়েনা । আরও মারাত্মক বিষয় হল , এইসব এলাকারই একশ্রেণীর ধর্মান্ধ যুবক বেশ বড় সংখ্যায় আজকাল বিভিন্ন ভারতবিরােধী সন্ত্রাসবাদী ও জঙ্গী সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে ।
ভারতীয় মুসলিম সমাজের এই মারাত্মক ছোঁয়াচে অসুখের খবর “ র ” সহ অন্যান্য গােয়েন্দা সংস্থাগুলির নজরে ইতিমধ্যেই এসেছে । এ বিষয়ে তারাও তাদের আভ্যন্তরীণ তদন্ত রিপাের্ট সরকারের কাছে বেশ করেছেন । ফলস্বরূপ সৌদি আরব – সহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশগুলি থেকে নিয়মিত ভারতের বুকে । ইসলামিক সালাফি প্রচারের জন্য বেআইনি পথে যে প্রচুর পেট্রোডলার ঢােকে সেগুলাে নিয়ে ছানবিন শুরু হয়েছে । অতি সম্প্রতি মােদিজীর নােটবন্দির খেলায় ওই টাকার অনেকটাই নষ্ট হয়েছে । একইসাথে আহল – ই – হাদিস বা তবলীগি জামাত – সহ সমস্ত সন্দেহজনক সালাফি ইমাম ও মৌলানাদের কড়া নজরদারির আওতায় আনার কাজ চলেছে । প্রচারের গণ্ডির বাইরে অত্যন্ত চুপিচুপি হেঁটে ফেলা হচ্ছে এইসব দেশবিরােধী মাদ্রাসা ও সভাসমিতির আর্থিক সংস্থান । কিন্তু তা সত্ত্বেও তদন্তকারী সংস্থাগুলি সকলেই স্বীকার করে নিয়েছেন যে , সামগ্রিকভাবে এর কোনকিছুই যথেষ্ট নয় ।
রাষ্ট্রের পক্ষে ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক এই ধরণের সমস্ত সালাফিস্টদের তদন্তসাপেক্ষ অবিলম্বে গ্রেফতার পূর্বক পুঙ্খানুপুঙ্কু জেরার পাশাপাশি তাদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ প্রচারের অভিযােগ এনে নিচ্ছিদ্র চার্জশিট পেশের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক কঠিন শাস্তিদানের ব্যবস্থা করা উচিৎ । এছাড়াও এই ভয়াবহ সামাজিক বিষ সম্পর্কে সমাজের সকল স্তরেই ব্যাপক প্রচার ও সচেতনতা বৃদ্ধি করতে বৃহত্তর সরকারী উদ্যোগ ও সদিচ্ছারও প্রয়ােজন ।
কিন্তু এখন এই ঝুলি থেকে বেরুনাে বিড়ালের গলায় ঘন্টাটি বাঁধে কে ??
‘ সালাফি ’ বিষয়টা আসলে কি ?
‘ সালাফি ’ নামের ইসলামের ভয়ঙ্কর রকমের গোঁড়া ও পশ্চাদপদ এই রূপটি এসেছে ‘ সালাফ ’ নামের আরবি শব্দটি থেকে , যার অর্থ ‘ ভক্তিমান পুর্বপুরুষ ‘ । সালাফিস্টরা সর্বদাই প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের পূর্বপুরুষদের মতই ধর্মের ব্যাপারে মারাত্মক আচারনিষ্ঠ তথাসমকক্ষ হবার চেষ্টা করেন । এই বিষয়ে স্বয়ং নবী মুহাম্মদ এবং তার সমসাময়িক পার্শ্বচরবৃন্দই ( আল – সালাফ আল – সালিহ বা তাদের পুণ্যাত্মা পুর্বপুরুষেরাই ) হলেন তাদের একমাত্র পথপ্রদর্শক । একটি হাদিস ( যেখানে নবীর প্রাত্যহিক ক্রিয়াকর্মাদির বর্ণনা আছে ) মতে , যেখানে মহাম্মদ বলেছেন যে তার সমসাময়িক ও পরবর্তী দুটি প্রজন্ম অর্থাৎ নবীর সময় থেকে কেবলমাত্র পরবর্তী তিন প্রজন্মের অনুসারীরাই ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ , আর এই হাদিসটিই হল সালাফিস্টদের এহেন অনুপ্রেরণার উৎসবিন্দু । আর হজরত উল্লেখিত উক্ত তিন প্রজন্মের শিষ্যরাই সামগ্রিকভাবে সালাফ ’ নামে সম্মানিত ।
সালাফি ইসলামের প্রবক্তা হিসেবে যার নাম সর্বপ্রথম উঠে আসে , তিনি হলেন তাকি আদ – দ্বীন আহমেদ ইবন তায়মিয়া ( ১২৬২-১৩২৮ খ্রীঃ ) , যিনি আরবের বাইরের মুসলমানদের অপেক্ষাকৃত নিকৃষ্ট বলেই মনে করতেন । ১৩০৩ খ্রীঃ প্রচারিত একটি ফতােয়ার মাধ্যমে ধর্মপ্রাণ মুসলিম মাত্রেরই ‘ মঙ্গোল’দের হত্যা বাধ্যতামূলক এই মর্মে একটি নির্দেশ জারিও করেন তিনি , যদিও পরবর্তীকালে দেখা যায় যে সেটি শারিয়ার পরিপন্থী হয়ে দাঁড়িয়েছে । তিনি বলেন পবিত্র জিহাদের মাধ্যমে কাফের নিধন প্রতিটি মুসলমানের অবশ্যকরণীয় কর্তব্য । ১২৯৩’এ আসফ – আল – নাসরানি নামক এক খ্রীষ্টান যাজকের বিরুদ্ধে আহমেদ প্রথম মৃত্যুদন্ডের ফতােয়া জারি করেন । নাসরানির অপরাধ , তিনি নাকি মহম্মদ সম্পর্কে কটুক্তি করেছিলেন । আজও ইসলামিক কট্টরপন্থীরা অমুসলিম কাফের , যাদের তারা শত্রু বলে গণ্য করে ; হত্যা করতে উক্ত ফতােয়াদ্বয়ের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে ।
আহমেদ এবং তার অনুসারীরা দামাস্কাসের বুকে মূলত “ ধর্মীয় পুলিশ ” পরিচয়ে সকলের উপরেই নজরদারী চালাতেন । রাস্তার পাশের সরাইখানা থেকে শুরু করে মদের দোকান , সর্বত্র তারা তল্লাশী অভিযান চালাতেন । নির্মম ভাবে হত্যা করতেন নাস্তিকদের । সুফি শেখেদেরও সেখানে নিস্তার ছিল । তার নেতৃত্বে আলওয়াতিস ( প্রাথমিক ইসলামিক কাণ্ডকারখানার বিরুদ্ধাচারণকারী উদারচেতা মুসলিমগণ ) সহ শিয়া , সুফি এবং অ – সালাফিগণকে ইসলামের মাটি থেকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করতে তাদের বিরুদ্ধে লাগাতার সামরিক অভিযানও চালানাে হয় বলে জানা যায় । মুসলমানদের মধ্যে যে বা যারা দরগায় তীর্থ করতে যান , ইসলামের বাইরে গিয়ে নতুন কিছু উদ্ভাবন করতে চান , ( বিদাহ , যা ইসলামে অবৈধ বা হারাম ) , শির ে ( মূর্তিপূজা ) ন্যায় মহাপাপে লিপ্ত বা সর্বোপরি কোন সুফি বা ওয়ালির মাজারে গিয়ে হত্যে দেন , তাদের সকলকেই আহমেদ কাফের বলে তিরস্কার করেন । মুসলিম দেশগুলিতে শারিয়া আইন প্রবর্তনের ক্ষেত্রে সালাফিস্টরাই সর্বপ্রথম অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেন । বহুত্ববাদী সংস্কৃতি তথা তাওয়াশুল ওরফে আল্লা ভিন্ন অন্য কারও প্রতি সামান্য আস্থারও এরা তীব্র বিরােধী । তাদের ধারণা অনুযায়ী , যুক্তি তর্কের আলােকে ইসলামিক মত – খণ্ডন ( আল – কালাম ) পুরােপুরিভাবে নিষিদ্ধ বা হারাম । শুধু কি তাই ? পরিস্থিতি বিশেষে কখনও কখনও ইসলামের প্রচলিত মতবিরােধী বক্তব্য উপস্থাপনার জন্য মূর্তাদদের ( ইসলাম ত্যাগী ) হত্যা পর্যন্ত করা যেতে পারে ।
অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকেই আধুনিক বিশ্বে এই সালাফি মতাদর্শের ঢেউ আছড়ে পড়তে থাকে । এই বিষয়ে উল্লেখযােগ্য ভূমিকা নেন বিশিষ্ট ইসলামিক ধর্মগুরু মহাম্মদ ইবন আব্দ আল – ওয়াহাব ( ১৭০৩-১৭৯২ ) । ইসলামের হৃত গৌরব পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে তিনি তার জীবন উৎসর্গ করেন । সৌদি আরবের অখ্যাত অঞ্চল নাজদ থেকেই প্রাচীন ইসলামিক ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনার তার সে মহান শুদ্ধিকরণের কাজ শুরু হয় । তৎকালীন সময়ে পীর – ফকিরদের পুণ্য অর্জনের লক্ষ্যে প্রায়ই মাজারে গিয়ে উপস্থিত হবার চল ছিল । তিনি এর তীব্র বিরােধিতা করেন । তার মতে , এসবই ছিল মূর্তিপূজার ( বুতপরস্তি ) অঙ্গ মাত্র । আহমেদ ইবন তায়মিয়াকেই তিনি তার জীবনের ধ্রুবতারা রূপে চিহ্নিত করেন ।
সালাফি মতাদর্শ প্রচার ও প্রসারের বিষয়ে ১৭৪৪’এ দিরিয়ার ( বর্তমানের রিয়াধ ) আমীর ( প্রধান শাসনকর্তা ) , মুহাম্মদ বিন সৌদ – এর সঙ্গে ওয়াহবের একটি চুক্তি সম্পাদিত হয় , যার শর্তানুসারে ওয়াহাব সর্বদাই আমীরের পাশে থাকতে অঙ্গীকারবদ্ধ হন । শেষে ওয়াহাবের মেয়ের সঙ্গে সৌদের ছেলে আব্দুল আজিজের বিবাহের বিনিময়ে চুক্তিটির পূর্ণতা প্রাপ্তি ঘটে । আর সেই থেকেই পাকাপাকিভাবে সৌদি আরবের ধর্মীয় বিষয়ক মন্ত্রকটিতে ওয়াহবের বংশধরদের ( যারা আল আশ – শেখ নামে বিখ্যাত ) প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয় । এরপর ওয়াহাবের সাহায্য নিয়ে এক ভয়ঙ্কর রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সৌদি আমীর পার্শ্ববর্তী বিরাট অঞ্চলে তার ক্ষমতা বিস্তার করেন ।
১৭৪৪ – এর এই বিখ্যাত চুক্তিটিই ছিল রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের উদ্দেশ্যে ধর্মীয় গোঁড়ামির সার্থক ব্যবহার , আজকের দিনে পাকিস্তানের স্বৈরতান্ত্রিক সামরিক শাসকেরা প্রায়ই যার অনুসরণ করে থাকেন । সৌদি আরবের প্রত্যক্ষ মদতে ওয়াহাবি প্রবর্তিত সুন্নি ইসলামের যে ভয়ঙ্কর কট্টরপন্থী তথা চূড়ান্ত মধ্যযুগীয় বর্বরতার নিদর্শন প্রতিমুহূর্তে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেবার ষড়যন্ত্র চলেছে , তাই “ সালাফি ইসলাম ” । বিশ্বব্যাপী সর্বত্র এই সংক্রমণের কাজে ইন্ধন যােগাতে সৌদি সরকার আজ কোটি কোটি ডলার খরচ করছেন ।
নিজের শহর উয়াইয়ানার বুকে হজরত মােহাম্মদের সাক্ষাৎ পার্শ্বচর ( সাহাবা ) জায়েদ ইবন – আল – খাত্তাবের স্মৃতিসৌধ ধ্বংসের পাশাপাশি অবৈধ সম্পর্কের জেরে এক মহিলাকে পাথর ছুঁড়ে হত্যার মধ্যে দিয়ে আরবের মাটিতে প্রথম ওয়াহাবের ধর্মীয় শুদ্ধিকরণ যজ্ঞ শুরু হয় ।
সৌদের মৃত্যুর পর তার পুত্র তথা ওয়াহাবের জামাতা আব্দুল আজিজ বিন মুহাম্মদও ওয়াহাবি মতাদর্শের এক একনিষ্ঠ সমর্থকরূপে আত্মপ্রকাশ করেন । তিনি তার সাম্রাজ্য বিস্তারের ক্ষেত্রে সরাসরি আহমেদ ইবন তায়মিয়া প্রবর্তিত “ হয় ধর্মান্তকরণ – নয় মৃত্যু ” নীতি অবলম্বন করে ‘ টাকফির ’ প্রথার সূত্রপাত ঘটান । এই মারাত্মক প্রথানুযায়ী ‘ সালাফি নয় ’ এমন মুসলমানেদের দিকে দিকে কাফের বা অমুসলমান হিসেবে ঘােষণা করে শিশু ও নারী – পুরুষ সহ নির্বিচারে দলে দলে নির্মমভাবে হত্যা করা হতে থাকে । ১৮০২ খ্রীঃ আব্দুল আজিজের নেতৃত্বে এক বিরাট সেনাবাহিনী পবিত্র শহর ‘ কারবালা ’ আক্রমণ করে তা কজা করে নেয় । এই অভিযানে প্রায় পাঁচ হাজার শিয়া নিহত হন । লুঠ করা হয় মােহাম্মদের নাতি হুসেইন ইবন আলীর পবিত্র দরগা । এছাড়াও এলাকার সমস্ত শিয়াদের নারী ও শিশুদের বন্দী করে তাদের দাসী বানিয়ে তুলে আনা হয় ।
১৯০১ – এ বর্তমান সৌদি আরবের রূপকার , আব্দুল আজিজ নামে সৌদের অপর এক বংশধরের ( পঞ্চম প্রজন্ম ) আমলে সৌদি আরবের পাশ্ববর্তী প্রতিবেশী দুর্বল এবং অ – সালাফি মুসলমান শাসকদের বিরুদ্ধে ব্যাপক ও ভয়ঙ্কর সামরিক অভিযান চালিয়ে তাদের ধ্বংস করা হয় । ওয়াহাবের সালাফি ইসলামের ছত্রতলে সকলকে উদ্বুদ্ধ করার এই ভয়াবহ কর্মকান্ডের চিহ্নস্বরূপ মাত্র দুই বছরের মধ্যেই সেখানে অন্তত চল্লিশ হাজার মানুষকে প্রকাশ্যে জবাই করে হত্যা ( কোতল ) করা সহ সাড়ে তিন লক্ষেরও বেশি অঙ্গচ্ছেদন সম্পন্ন হয় । পরবর্তীকালে বিশ্বজুড়ে সালাফি ইসলাম বিস্তারের লক্ষ্যে ১৯৬১ – তে সৌদি আরবের মাটিতে প্রতিষ্ঠিত হয় কুখ্যাত ‘ ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অফ মদিনা । সারা পৃথিবী থেকে । এখানে মুসলিম ছাত্রেরা সালাফির পাঠ নিতে আসেন । জানলে অবাক হতে হয় যে , এ বছরেও ভারত থেকে এখানে আসা ছাত্রের সংখ্যা ১৬। এছাড়াও পরিসংখ্যান অনুযায়ী বর্তমানে পাকিস্তানের ৪১ জন ও বাংলাদেশের ২২ জন সেখানে সালাফির শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছেন । ১৯৬২ তে এই ইউনিভার্সিটিতেই জন্ম লাভ করে , ‘ ওয়ার্ল্ড মুসলিম লীগ’নামক অপর একটি ইসলামিক শাখা সংগঠন । সারা পৃথিবী জুড়ে ইসলামিক সালাফি ভাবধারা প্রচারের পাশাপাশি এদের অপর একটি বড় কাজ হল ইসলামিক দেশগুলিতে সেকুলারিজমের বিরুদ্ধে নিরন্তর লড়াই চালানাে । এছাড়াও দেশে দেশে মুসলিম ব্রাদারহুড , আহল – ই – হাদিস , জামাত – ই – ইসলামের মত বিভিন্ন চরমপন্থী ইসলামিক জঙ্গি সংগঠনগুলির অনৈতিক কাজকর্মে তারা সর্বপ্রকারে প্রভূত সাহায্য করে থাকে ।
সবচেয়ে চিন্তার বিষয় , এহেন ভয়ঙ্কর ইসলামিক সালাফিজম প্রচারের উদ্দেশ্যে ২০১১ থেকে ২০১৩ বিগত দু’বছরের মধ্যে অন্তত প্রায় আড়াই হাজারেরও বেশি সালাফি ধর্মপ্রচারক আমাদের দেশে প্রবেশ করেছেন বলে জানা যাচ্ছে । শুধু তাই নয় , বিভিন্ন গােপন সভা – সমিতি ও সেমিনারের মাধ্যমে উল্লেখিত সালাফি ভাবধারাকে সারা ভারত জুড়ে মুসলমানদের মধ্যে ব্যাপকহারে ছড়িয়ে দেবার লক্ষ্যে কমপক্ষে সতেরেশাে কোটি টাকার এক বিরাট অঙ্কের প্যাকেজও তাদের সঙ্গেই এখানে ঢুকেছে বলে সূত্রের খবর । এরা ইতিমধ্যেই ভারতীয় মুসলমানদের কি কি করা কর্তব্য নয় , তার উপরে বিভিন্ন প্রচার পুস্তিকা বন্টনের দ্বারা দিকে দিকে নির্দেশ পৌছাতে শুরু করে দিয়েছেন । সেই ফর্দে কিছু কি আর বাকি আছে ? মেয়েদের জন্য বােরখা বাধ্যতামূলক করা থেকে শুরু করে পুরুষদের জন্য গালভরা দাড়ি , নারী পুরুষের মধ্যে অবাধ মেলামেশায় লাগাম পরানাে , পারলৌকিক ক্রিয়াকর্মের সময় চোখের জল ফেলা থাকা , অট্টহাস্য না করা , নাচ – গান থেকে শতহাত দূরে থাকা , এমনই তুঘলকি শর্ত আরও কত কি ! এমনকি বন্ধ টিভি দেখা ।
পরিশেষে এও স্মরণ করিয়ে দেওয়া উচিৎ যে , সিরিয়ার আইসিস থেকে আফগানিস্থান-পাকিস্তানের আলকায়দা , তালিবান , জৈস-ই-মুহাম্মদ , লস্কর-ই-তৈবা কিংবা জামাতুল । মুজাহিদিন বাংলাদেশ-এর মত মানবতাবিরােধী প্রত্যেকটি নিষিদ্ধ সন্ত্রাসবাদী জঙ্গি সংগঠনই এই সালাফি ইসলামকেই তাদের মূলমন্ত্র মেনে চলে ।
অতএব , শিয়রে শমন । ভারত কি পারবে এই চক্রান্ত ব্যর্থ করতে ?
শ্রী নিহারণ প্রহারণ