গর্জ গর্জ ক্ষণং মূঢ় মধু যাবৎ পিবাম্যহম্
ময়া ত্বয়ি হতে অত্রৈব গর্জিষ্যন্তি আশু দেবতা।
অর্থাৎ—মা দুর্গা মহিষাসুর বধের প্রাক্কালে অসুরের উদ্দেশে বলছেন, “আমি যতক্ষণ মধুপান করছি ততক্ষণ ওরে মূঢ় তুই গর্জন করে নে, তারপরেই আমি তোকে বধ করব এবং তখন দেবতাকুল আনন্দে গর্জন করবে।”
স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন জাগে—মা দুর্গা অসুর বধের প্রাক্কালে মধুপান করছেন কেন? মধু শক্তি প্রদানকারী, শক্তি বর্ধনকারী ও শক্তি পুনরুদ্ধারে প্রকৃতিজাত এক অমূল্য সম্পদ। মহিষাসুরের সঙ্গে যুদ্ধে দেবীর যে শক্তি ক্ষয় হয়েছে তা পুনরুদ্ধারে অসুর বধের প্রাক্কালেই তিনি মধুপান করছেন।
সৃষ্টির আদিতে মধুর সৃষ্টি। পুরাণ, বেদ-বেদান্ত, উপনিষদ সর্বত্রই এর উল্লেখ পাওয়া যায়। আর আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে মধু জীবনদায়ী ওষুধ হিসাবে গ্ৰাহ্য হয়। মধুকে বলা হয় সর্বরোগহরা। কখন ও প্রত্যক্ষ ভাবে কখনও বা পরোক্ষভাবে অনুপান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। জন্মের সময় সদ্যোজাতের মুখে ও মৃতপ্রায় রোগীর মুখে মধু দেওয়া ভারতীয় সমাজের প্রাচীন রীতি। মৃতপ্রায় রোগীকে মধুর সঙ্গে মকরধ্বজ ও মধুসহস্বর্ণসিন্দুরও খাওয়ানো হয়ে থাকে। মাতৃগর্ভের নিরাপদ আশ্রয় থেকে বেরিয়ে বাইরের জগতে টিকে থাকার লড়াইয়ে সদ্যোজাতের এই অমৃত রসের যে বড়ই প্রয়োজন। আর মৃত্যুপথযাত্রীকে মধু দেওয়া হয় মৃত্যু যন্ত্রণা সামায়িক লাঘবের জন্য, আরও কিছুক্ষণ বাঁচিয়ে রাখার জন্য। দুটি ক্ষেত্রেই মধুর অবদান অপরিসীম। এছাড়াও মধুর আছে একাধিক ঔষধি গুণ। আছে মনুষ্য শরীরের নানাবিধ রোগ নিরাময় ও উপশম ক্ষমতা। কিন্তু তার আগে জানতে হবে মধু কী। কীভাবেই বা তার সৃষ্টি! কেনই বা মধু বা অমৃতরস কৃত্রিমভাবে তৈরি করা যায় না।
॥ মধু সৃষ্টির রহস্য ॥
কোটি দশেক বছর আগে উদ্ভিদ ও পতঙ্গকুলের মধ্যে একটা দেওয়া-নেওয়ার সম্পর্ক তৈরি হয়। পতঙ্গকুল, বিশেষতঃ মৌমাছি, ফুলের পরাগ গায়ে মেখে অন্য ফুলে গিয়ে যখন বসে তখন পুরুষ ফুলের পরাগরেণু স্ত্রী ফুলের গর্ভমুণ্ডের সংস্পর্শে আসে। এইভাবে বয়ে আনা পরাগরেণু বা পোলেন ধীরে ধীরে ডিম্বাণুর কাছে পৌঁছে নিষিক্ত হয়,তৈরি হয় বীজ। পরিবর্তে পতঙ্গকুল, বিশেষতঃ মৌমাছি, সংগ্ৰহ করে পুষ্পরস বা নেকটার যা মূলতঃ সুক্রোজ, ফ্রুক্টোজ বা গ্লুকোজ রূপের বিশুদ্ধ শর্করা এবং পরাগরেণু বা পোলেন যা তার খাদ্যে প্রোটিনের উৎস। এই খাবারের আর্কষণেই পতঙ্গ বা বিশেষতঃ মৌমাছি ফুলে ফুলে ঘুরে বেড়ায়। এই ঘুরে বেড়ানো বা নাচানাচিতে তো শক্তির প্রয়োজন। এইভাবে ঘণ্টাখানেক উড়তে মৌমাছির যা শক্তি খরচ হয় তা তারা সংগ্ৰহ করে প্রায় ২০ মিলিগ্ৰাম শর্করা থেকে। এই সময়ে নিজের প্রয়োজন মিটিয়েও বাড়তি কিছু নেকটার বা পুষ্পরস তারা সংগ্ৰহ করে, যা নিজের শরীরের মধ্যে শোধিত করে মধু রূপে মৌচাকের প্রকোষ্ঠে জমা করে অসময়ের জন্য। আর প্রয়োজনীয় নেকটার যতক্ষণ না সংগ্ৰহ হচ্ছে, ততক্ষণ তার ফুলে ফুলে ওড়া বন্ধ হয় না। ফলে তাদের সহায়তায় উদ্ভিদের পরাগমিলনও নিবিড়ভাবে সুসম্পন্ন হয়। কিন্তু পুষ্পরস বা নেকটার কীভাবে মৌমাছির শরীরে শোধিত হয়ে মধুর রূপ নেয় তা আজও অজানা। মধু সৃষ্টির রহস্য আজও রহস্যই। তবে দুটি বিষয়ে বুঝতে অসুবিধা হয় না মধু কেন প্রকৃতিজাত মহার্ঘ এক বস্তু এবং কেন কৃত্রিমভাবে তৈরি করা যায় না এই মহৌষধি।
মৌমাছি ও মধু উৎপাদন
পৃথিবীতে ২০হাজারের মতো প্রজাতির মৌমাছি রয়েছে। তার মধ্যে ৭৮৫টি শস্যক্ষেত্রে পাওয়া যায়। বাক্সবন্দী করে যে মৌমাছিগুলি পালন করা হয় তা মূলত তিন প্রজাতির। প্রথম প্রজাতি হল এপিস মেলিফেরা, এটি এদেশের নয়, ইউরোপ থেকে আমদানি করা। দ্বিতীয় প্রজাতিটি এপিস সেরানা যা এশিয়াঞ্চলেরই মৌমাছি। এছাড়া হুলবিহীন এক ধরনের ছোটো আকৃতির মৌমাছিও বাক্সবন্দী করা যায়। এরা ছোট ছোট ফুলের পরাগমিলনে বা আজকাল আচ্ছাদনের মধ্যে যে সব ফসলের চাষ হচ্ছে (Protected cultivation) তাদের পরাগমিলনে খুব কার্যকরী। সাধারণ গাছের কোটরে,পরিত্যক্ত বাড়ির ইটের ফাঁকে এরা বাস করে থাকে। কিন্তু এটাই সব নয়। পোষ মানানো যায় না এমন মৌমাছির মধ্যে রয়েছে ডাঁশ মৌমাছি। বড়ো গাছে যে মস্ত আকৃতির মৌচাকগুলি আমরা দেখি যেখানেই থাকে ডাঁশ মৌমাছি। বৈজ্ঞানিক নাম এপিস ডরসাটা। এরাও ফসলের পরাগমিলনে খুব কার্যকরী। আর আছে ছোট আকৃতির চাক বাঁধা মৌমাছি এপিস ফ্লোরিয়া।
মধু উৎপাদনে সবচেয়ে এগিয়ে এপিস মেলিফেরা। এক বছরে বাক্সপ্রতি মধু উৎপাদন করে প্রায় ৪০ কেজি। অন্যদিকে এপিস সেনারার মধু উৎপাদন হার বাক্সপ্রতি বছরে ৪ কেজি’র মতো। অক্টোবর-নভেম্বর মাস থেকেই ফসলের খেতে বা জঙ্গলে এপিস মেলিফেরার বাক্স বসানো শুরু হয়। গাছে গাছে পুষ্পরস উৎপাদন শুরু হলেই মৌমাছি তা সংগ্ৰহ করতে শুরু করে। শুরু হয় ইউক্যালিপটাসের ফুল থেকে। তারপর পরপর আসে সর্ষে, কালো জিরে, ধনে, লিচু ইত্যাদি। সুন্দরবনের খলসে, গরান, ক্যাওড়া ও তিল গাছের ফুলের নেকটার থেকে খুব ভালো মধু পাওয়া যায়। নভেম্বর-ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি-মার্চের শেষ পর্যন্ত আমাদের রাজ্যের মৌপালকরা সুন্দরবনেই থাকেন।
॥ মৌমাছির নাচ ॥
নতুন কোনও জায়গায় চাক বাঁধলে বা বাক্স বসালে, শ্রমিক মৌমাছিদের প্রথম কাজই হল scouting বা ফুল খোঁজাখুঁজি করা। নেকটার এবং পোলেন দুটোই তো তারা সংগ্ৰহ করে ফুল থেকে। তবে সব ফুল থেকে সবকিছু পাওয়া যায় না। ফলে এই খোঁজাখুঁজির কাজটা যথেষ্ট শ্রমসাধ্য। বাক্স বা চাকে ফিরে এসে অন্য মৌমাছিদের এই ফুলের সন্ধান তারা দেয় নেচে নেচে। যাকে বলে মৌমাছির নাচ। তখন তারা মূলত দুটো কাজ করে। কোমর দুলিয়ে নাচতে নাচতে তারা এক বিশেষদিকে যাতায়াত করতে থাকে। সূর্যের সঙ্গে বিশেষ কোণ তৈরি করে তারা সাথীদের খাদ্যের উৎসের দিকে নির্দেশ করে দেয়। আর এই নৃত্যরতা মৌমাছিগুলি বিভিন্ন সময় ধরে যাতায়াত করে অন্যদের দূরত্বটাও বুঝিয়ে দেয়। একে বলে ওয়াগ্ল নাচ। আর খাদ্যের উৎস যদি খুব কাছাকাছি থাকে তবে গোল হয়ে নাচ। যে ফুলগুলি তারা পরিদর্শন করে আসে, তার গন্ধও গায়ে মেখে আসে। সেই গন্ধ সাথী মৌমাছিদের খাদ্যের উৎস সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট ভাবে বুঝতে সাহায্য করে। কার্ল ভন ফ্রিঙ্ক ১৯৬০ সাল নাগাদ মৌমাছির এহেন নৃত্যবার্তাকে ব্যাখ্যা করতে সমর্থ হন
॥ মৌমাছির খাদ্য ॥
মৌমাছি তো নেকটার বা পুষ্পরস সংগ্ৰহ করে খাদ্য হিসেবেই। কিন্তু নেকটার থেকে সে যেমন কাজকর্ম, ওড়াউড়ির শক্তি পায়, তাতে প্রোটিনের চাহিদা কিন্তু মেটে না। সেটা মেটে পরাগরেণু বা পোলেনের মাধ্যমে। মৌমাছির গায়ের লোমে আটকে যাওয়া পোলেন যেমন পরাগমিলনের কাজে লাগে তেমনি কিছু পোলেন জিভ দিয়ে ভিজিয়ে জড়ো করে পিছনের পা-জোড়ায় থাকা কোটরে বা পোলেন বাস্কেটে জমা করে মৌচাকে ফিরে আসে। পোলেনগুলি আবার মধুতে ভিজিয়ে নিয়ে চাকের মধ্যে নির্দিষ্ট প্রকোষ্ঠে জমা করে। একে বলা হয় পোলেন ব্রেড বা রুটি।
॥ আমাদের শরীর ও মধু ॥
১০০ গ্ৰাম মধুতে ২৭% কার্বোহাইড্রেট, ১৫% ক্যালরি, ১% ডায়াটারি ফাইবার, ২% ভিটামিন রাইবো-ফ্লেবিন, ১% ভিটামিন সি, ১% ভিটামিন বি-৬, ৪% মিনারেলস–ম্যাঙ্গানিজ, ২% আয়রন, ২% কপার থাকে। মধু–
● শক্তি ও পুষ্টিকর খাদ্যের উৎস।
● মাংসপেশীর ক্লান্তি দূর করে।
● রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে
● ঠাণ্ডা লাগা ও ঠাণ্ডা লেগে সর্দি-কাশিতে দারুণ কাজ করে।
● ক্ষত ও কাটা নিরাময়ে কাজ করে।
● ছোটোখাটো পোড়াতেও লাগানো যায়।
● অনিদ্রা দূর করে।
● ত্বকের নানা রোগ নিরাময় করে ও ত্বককে উজ্জ্বল করে।
● ওজন কমাতে এক অপরিহার্য উপাদান।
● হজম শক্তি বাড়ায়।
● খুব ভালো অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট ও অ্যান্টিসেপটিক।
● পদ্ম মধু চোখের অসুখে অপরিহার্য। অন্ধত্ব রোধ করবার ক্ষমতা রাখে।
● শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে।
● রক্তে খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে ভালো কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়ায়।
● চিনির একমাত্র প্রাকৃতিক বিকল্প।
● খেলাধুলার মান বাড়ায়।
বিশুদ্ধ মধুতে আছে এনজাইম, প্রোটিন, মিনারেলস্ ও অ্যামাইনো অ্যাসিড যা মধুতে থাকা শক্তির উৎস যা মানুষের শরীরের Energy level-কে নিয়ন্ত্রণ করে। মধুতে নিহিত আছে ফ্রুক্টোজ, সুক্রোজ বা গ্লুকোজ রূপের বিশুদ্ধ শর্করা। প্রয়োজনে শক্তি প্রদান বা বৃদ্ধি করে, কখনও শক্তি পুনরুদ্ধারে কাজ করে। শারীরিক কসরতে মানুষের শরীরে শর্করার মাত্রা কমে যায়। সেই সময় এক চামচ মধু হৃতশক্তি ফিরিয়ে দেয়। মাংসপেশীর ক্লান্তি দূর করে। এছাড়া মধুতে মিথাইলগ্লাইঅক্সাল (Mithylglyoxal) নামের একটি উপাদান আছে যা মানুষের রোধ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। শিশুদের মধু খাওয়ানোর এটি একটি অন্যতম কারণ। বহু গবেষণার পর জানা গেছে, নিয়মিত পরিমাণ মতো মধু সেবন রক্তে শর্করার মাত্রা (Blood sugar) কমিয়ে ইনসুলিনের মাত্রা বাড়ায়। মধু মধুমেহ বা ডায়াবেটিক রোগীদের ওজন কমাতে ও ব্লাড লিপিড্ (Blood lipid) নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। রক্তে ভাল কোলেস্টেরলের (good cholesterol) মাত্রা বাড়ায়। ২০১১ সালের একটি গবেষণা বলেছে, মধু উচ্চ রক্তচাপ কমাতেও সাহায্য করে।
কাশিকে দমিয়ে রাখার জন্য বিশেষতঃ রাতের বেলার কাশিতে মধুর কোনও বিকল্প নেই। শুধু কাশি কমে না, ভালো ঘুমও হয়। শিশুদের জন্য খুব উপকারী। গরম লেবুর জল ও মধুর মিশ্রণ ঠাণ্ডা লাগলে দারুণ কাজ দেয়। গলায় ও বুকে জমে থাকা সর্দিও বার করে দেয়। বর্ষাকালে বৃষ্টিতে ভিজে এসে বা শীতকালীন বৃষ্টিতে ভিজে এসে সঙ্গে সঙ্গে ১ চামচ মধু খেয়ে নিলে ঠাণ্ডা লাগে না। জ্বর এলেও তা দুদিনে নিয়ন্ত্রণে এসে যায়। একটি গবেষণা বলেছে, মানুকা মধু টন্সিলাইটিসের অব্যর্থ ওষুধ। মানুকা মধুতে থাকা মিথাইলগ্লাইঅক্সাল(Methylglyoxal) টনসিলের জন্য দায়ী স্ট্রেপটোকক্কাস ব্যকটেরিয়াকে মেরে দেয়। ঈষদুষ্ণ গরম জলের সঙ্গে মধু পান করা টনসিলের জন্য অনবদ্য। মধু প্রাথমিকভাবে অ্যাজমাজনিত কাশি ও শ্বাসকষ্ট কমাতেও সাহায্য করে। অ্যাজমার (Asthma) ওষুধ তৈরিতে মধু অন্যতম উপাদান।
কোথাও সামান্য পুড়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে সেই জায়গাটা কলের জলের তলায় রেখে ঠাণ্ডা হলে মধু লাগিয়ে দিলে খুব উপকার হয়। কোনও কাটা-ছেঁড়া বা ক্ষত হলেও প্রথম অবস্থাতেই যদি মধু লাগিয়ে দেওয়া যায় তাহলে তা সেপটিক হয় না, ইনফেকশন বা জীবাণু সংক্রমণের ভয় থাকে না। ক্ষত বা পোড়ার দাগও সহজে মিলিয়ে যায়। দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত সারাতে মধুর জুড়ি মেলা ভার। এমনকি পেটের আলসার নিরাময়ে মধু সাহায্য করে।
যাঁরা অনিদ্রায় ভোগেন তাঁরা শুতে যাওয়ার ঠিক আগে ১ টেবিল চামচ মধু খেয়ে শুয়ে পড়ুন। খুব তাড়াতাড়ি ঘুম এসে যাবে। অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা বা Anxity-তে যাঁরা ভোগেন তাঁদের ক্ষেত্রে অনিদ্রা বা Insomnia একটি সাধারণ রোগ। গরম চায়ের সঙ্গে মধু মিশিয়ে রাতে শুতে যাওয়ার আগে নিয়মিত খেলে দুশ্চিন্তা বা উদ্বেগ দূর হয়ে ঘুম ভাল হতে বাধ্য।
ত্বক পরিচর্যায়, ত্বকের নানা রোগে ও ত্বকের ঔজ্জ্বল্য রক্ষায় মধুর অবদান অপরিসীম। প্রত্যেকদিন পুরো মুখে মধুর একটা হালকা প্রলেপ লাগিয়ে ৩০ মিনিট রেখে জল দিয়ে মুখ ধুয়ে ফেলুন। মধু রোমকূপের ময়লা টেনে বার করে মুখকে পরিষ্কার রাখবে। মধু, দই ও বেসনের মিশ্রণ মুখে লাগালেও উপকৃত হবেন। মধু মূলতঃ ত্বকের চারটি রোগ—ব্রণ, কালো ছোপ, বয়সের ছাপ বা কুঁচকানো ত্বক, বলিরেখা, ঔজ্জ্বল্যহীনতার বিরুদ্ধে লড়তে পারে। কারণ মধুতে আছে অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট, অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল, অ্যান্টিইনফ্ল্যামেটারি উপাদান যা ব্রণ ও ব্রণের দাগ মেলাতে, কালো ছোপ দূর করতে, বয়সের ছাপ, বলিরেখা ও কুঁচকানো দূর করতে খুব সাহায্য করে।
চার ফোঁটা লেবুর রস, ১ টেবিল চামচ শুদ্ধ মধু ও ১ চিমটে হলুদের মিশ্রণ মুখে লাগিয়ে ২ মিনিট রেখে ধুয়ে ফেলতে হবে, কালো ছোপ দূর হবে ও ত্বক উজ্জ্বল হবে।
১ টেবিল চামচ মধু, সমপরিমাণ পাকা পেঁপে ও দই একসঙ্গে মিশিয়ে প্রলেপটা মুখে লাগিয়ে ৩০ মিনিট রেখে গরম জলে প্রলেপ ধুয়ে নিয়ে হাল্কা করে মুছে নিতে হবে। বয়সের ছাপ ও কুঁচকানো দূর করতে এই মিশ্রণের কোনও তুলনা নেই।
টক দই, বেসন ও মধুর প্রলেপ ত্বকের পক্ষে খুব ভাল। ১ টেবিল চামচ সদ্যপাতা দই আর ১-১/২ টেবিল চামচ মধুর মিশ্রণ প্রতিদিন মুখে লাগিয়ে ১৫ মিনিট রেখে ঈষদুষ্ণ গরমজলে ধুয়ে ফেললে খুব তাড়াতাড়ি ফর্সা হয়ে যাবেন।
শীতকালের ফাটা, শুষ্ক ঠোঁট রাতে শুতে যাওয়ার আগে থকথকে করে মধুর প্রলেপ লাগিয়ে সারা রাত রাখতে পারলে ঠোঁট নরম ও পাতলা দেখাবে।
অলিভ অয়েল গরম করে তার সঙ্গে সমপরিমাণ মধু মিশিয়ে অল্প ভেজা চুলে ভাল করে লাগিয়ে ১৫ মিনিট রেখে শ্যাম্পু করে নিলে চুলপড়া বন্ধ হয় ও চুলের গোড়া শক্ত হয়।
অশোধিত মধু (Raw Honey) জলের সঙ্গে মিশিয়ে (৯ ভাগ মধু ও ১ ভাগ জল) মাথার খুলিতে খুব ভালো করে ম্যাসাজ করে করে লাগিয়ে ৩ ঘণ্টা রেখে ধুয়ে ফেলতে হবে সপ্তাহে একবার। শীতকালের নাছোড়বান্দা খুসকি পালাবার পথ পাবে না।
১ টেবিল চামচ মধু যে কোনও গরম পানীয়ের সঙ্গে রাতে শোয়ার আগে খেয়ে শুলে ওজন কমতে বাধ্য। মধুর মধ্যে থাকা বিশুদ্ধ শর্করা এই কাজটি করতে সাহায্য করে।
মধুর অ্যান্টিঅক্সিডান্ট গ্যাস, অম্বল কমিয়ে হজমশক্তি বাড়ায়, মুখের ঘা সারায়, গলার ইনফেকশন কমায়।
মধুতে থাকা ফেনোলিক কম্পাউন্ডস(Phenolic compounds) ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে। মধু ক্যান্সার দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে বাধা দেয়। পাশাপাশি থাকা ক্ষতিগ্রস্ত কোষগুলিকে ধ্বংস করে সুস্থগুলিকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচায়। অশোধিত মধু ও গরম মধু ক্যান্সার রোগের চিকিৎসায় বেশি কার্যকরী।
মধুর অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট গুণাবলী হার্টকে সুরক্ষিত রাখে। রক্তে খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে পরোক্ষে হার্টের স্বাস্থ্য ভাল রাখে।
মধুর অ্যান্টিমাইক্রোবায়াল (Anti maicrobial) গুণাবলি নানা ধরনের গ্যাস্ট্রিক সারিয়ে তোলার ক্ষমতা রাখে। এক টেবিল চামচ অশোধিত (Raw) মধু পাকস্থলীতে জমে থাকা অতিরিক্ত গ্যাস বার করে দেয়।
মধু যে কোনও ইনফেকশন বা জীবাণু সংক্রমণ রোধ করে। পুরাকালে মধুই ছিল একমাত্র জীবাণু সংক্রমণ প্রতিরোধকারী মহৌষধি।
সবশেষে ভাবলে বিস্ময় লাগে যে-মধুর এত অজস্র গুণ, যে-মধুর ওষধি গুণ অপরিসীম, সেই মধু কৃত্রিম ভাবে তৈরি করা যায় না। সম্পূর্ণভাবে উদ্ভিদকুল ও পতঙ্গকুলের উপর নির্ভর করতে হয় মানুষকে সৃষ্টির আদি থেকে। প্রকৃতিজাত এ এক মহার্ঘ সম্পদ। তাই বোধহয় মধুকে বলা হয় Nectar of Gods অর্থাৎ ঈশ্বর প্রদত্ত অমৃতরস। আর সেই কারণেই বোধহয়, আমাদের হিন্দুশাস্ত্রানুসারে সকল দেব-দেবীর পূজার প্রারম্ভে মধুপর্ক (মধু, দই, ঘি ও শর্করার মিশ্রণে তৈরি মহার্ঘ) নিবেদনের মাধ্যমে পরমেশ্বর বা পরমেশ্বরীকে আহ্বান করা হয়। উচ্চারিত হয় সেই মহামন্ত্র:—
ওঁ মধুপর্কং মহাদেবী/মহাদেব ব্রহ্মাদৈঃ পরিকল্পিতম্।
ময়া নিবেদিতাং ভক্ত্যা গৃহান পরমেশ্বরী/পরমেশ্বর।
দেবরানী কর