#চাতরমহুলের_ঠাকুর_দেবী

#প্রথমাংশ

নীহাররঞ্জনকৃত উদ্ধৃতিতে ‘সদুক্তিকর্ণামৃতে’র একটি শ্লোকে গ্রাম্য লৌকিক দেবদেবীর পূজার একটি ভালো বিবরণ পাওয়া যায়–


তৈস্তৈর্জীরোপহারৈগিরি কুহরশিলা সংশ্রয়ামর্চয়িত্বা
দেবীং কান্তারদুর্গাং রুধিরমুপতরু ক্ষেত্রপালায় দত্বা।
তুন্বীবীণা বিনোদ ব্যবহৃত সরকামহ্নি জীর্ণে পুরাণীং
হালাং মালুরকৌষের্যুবতি সহচরা বর্বরাঃ শীলয়ন্তি।।


অর্থাৎ :
গ্রাম্য নানা অধিবাসীবৃন্দ নানা উপাচার উৎসর্গ দিয়া  কান্তারদুর্গার পূজা করে, গাছতলায় ক্ষেত্রপালের পূজা করে, এবং দিনের শেষে তাহাদের যুবতী সহচরীদের লইয়া তুন্বীবীণা বাজাইয়া নাচগান করিতে করিতে বেলের খোলায় পান করিয়া আনন্দে মত্ত হয়।

আমাদের দেশে যত রকম জিনিসের অপব্যাখ্যা হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম একটি হলো লোকধর্ম।  বিভিন্ন রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য তথাকথিত বুদ্ধিজীবী মানুষরা বারবার লোকধর্মকে  অনাচারবাদী ,বিকৃতরুচি ইত্যাদি বলে অপব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু তাঁরা এটাই ভুলে গেছেন লোকের ধর্ম কিন্তু আদিম প্রাচীন এবং অবশ্যই সনাতনী….. লোকসংস্কৃতির একটি প্রাচীনতম প্রধান উৎস লুকিয়ে রয়েছে প্রাচীন লোকধর্ম এবং লোকদেবতাকে ঘিরে । যেদিন থেকে মানুষ  আত্মরক্ষার তাগিদে কিংবা ভয়-ভীতি অথবা যে কোন কারনেই হোক মনে আদি শক্তিকে শ্রদ্ধা জানাতে শুরু করল  তখন থেকেই লৌকিক দেবতার জন্ম হল ।সমাজবিজ্ঞানীদের মতে এটা অনেকটা সত্য হলেও এটা ঠিক যে লোকসংস্কৃতির মঞ্চে দাঁড়িয়ে প্রাচীন ঐতিহ্যর যেদিকে তাকানো যায় সেদিকেই দেখা যায় লৌকিক দেবতার সাক্ষাৎ বা প্রচ্ছন্ন প্রভাব। প্রতিটি অঞ্চলের অধিকাংশ লোক উৎসব, লোকসংস্কৃতি,  লোকবাদ্য, লোকনৃৃত্য , লোক শিল্প, লোক গীতি, লোককথা, লোক অর্থনীতি গড়ে উঠেছে কালে কালে গড়ে উঠেছে লোক দেবতাদের অবলম্বন করে।

পুরুলিয়ার বুধপুর মন্দিরের সুপ্রাচীন পাষাণ দেব মূর্তি….গ্রাম দেবতা হিসাবে পূজিত…

 

মাটিতে দাঁড়িয়ে বা বসে পূজা অনুষ্ঠানটি অনুষ্ঠিত হয়, কৃতজ্ঞতা জানানো হয় সেই মাটির প্রতি। তাই গান শোনা যায়,

 ‘আখড়া বন্দনা করি/ গাঁয়ের গরাম হরি/ তার পরে বন্দনা ব্রজনারী’। 

শুধু মাটি নয়, গ্রাম দেবতাকে এবং ব্রজনারী বলতে ব্রজের নারী নয়, স্থানীয় মহিলাদের স্তুতি করা হচ্ছে, কারণ তাঁদের সাহায্য ছাড়া সকলই অসম্ভব।
সময়ের প্রবাহে বর্তমানে যান্ত্রিক নগরায়ণের প্রভাবে সেইসব আচার-অনুষ্ঠান ক্রমান্বয়ে লুপ্ত বা অনেকটাই চাপা পড়ে গেলেও বাংলার পল্লীগ্রামের কৃষিজীবনে মাঠে লাঙল চালনার প্রথম দিনে, বীজ ছড়ানোর, শালিধান বোনার, ফসল কাটার বা ঘরে গোলায় তোলার আগে নানান ধরনের আচারানুষ্ঠান বাংলার বিভিন্ন জায়গায় হয়তো এখনও প্রচলিত আছে। এই প্রত্যেকটি অনুষ্ঠানই বিচিত্র শিল্পসুষমায় এবং জীবনের সুষম আনন্দে মণ্ডিত। নবান্ন উৎসব বা নতুন গাছের বা নতুন ঋতুর প্রথম ফল ও ফসলকে কেন্দ্র করে যেসব পূজানুষ্ঠান এখনও প্রচলিত, তার মূলেও একই চিত্তধর্মের একই বিশিষ্ট প্রকৃতি সক্রিয়।


রাঢ়ভূমের ঝুমুর গানের প্রকাশ পেয়েছে 

 ‘আখড়া বন্দনা করি গাঁয়ের গরাম কে- 

পরে বন্দনা বেজনারী- মদনে ঝুমুর লাগাই ভারী’ ৷

 
অর্থাৎ গ্রামের রক্ষাকর্তা গরাম ঠাকুর সন্তুস্ত হলেই,গ্রামের মঙ্গল শ্রীবৃদ্ধি হবে ৷ এর বিস্তৃতি রাঢ়ভূম সহ গোটা ছোটনাগপুর অঞ্চল জুড়ে,এমন কি ওড়িষ্যার ময়ূর ভঞ্জে পর্যন্ত বিস্তৃতি আছে ৷ 

বাঁকুড়ার গ্রাম দেবী ও কালীর লৌকিক রূপ রঙ্কিনী মাতার মন্দির

 প্রাচীন রাঢ় বঙ্গের আদি জনজাতিবাসী গ্রামগুলোতে গেলেই দেখা যায় কোথাও না কোথাও সে গ্রামের গ্রামদেবতা  পূজিত হচ্ছেন বা পূজা পাচ্ছেন ।গ্রামদেবতারা , যাঁদের প্রতিক পোড়া মাটির ঘোড়া কিংবা ছোট বড় একটি মাটির বা পাথরের ঢিবি অথবা কোন একটা গাছ।  আর ওই স্থানটি হল তার অবস্থান ক্ষেত্র। কোন মন্দির নেই ,কোনদিনই কোন বাঁধানো বেদী ছিল না।  নিতান্তই নিরাম্বর , সাধারণ সেই দেবতার থান, অথচ নির্দিষ্ট দিনে সারা গ্রামের সর্বস্তরের মানুষ তাঁর পূজা দিচ্ছেন বিচিত্র সব উপাচারের মাধ্যমে , পালন করছেন নানা ধরনের কৃচ্ছসাধন। লোকবিশ্বাস অনুসারে তিনিই গ্রামের অভিভাবক। তিনি গ্রামের রক্ষাকর্তা। গ্রামবাসী তাঁর কাছে যা প্রার্থনা করেন,  তিনি তাঁদের তাই দেন । তিনি খাদ্য, সন্তান, বৃষ্টি, শস্য দান করেন;  মহামারী ,রোগ , মড়ক, দুর্ভিক্ষ থেকে রক্ষা করেন। দুর্বৃত্ত ও হিংস্র পশুর ক্রোধ আক্রমন রোধ করেন । অসন্তুষ্ট হলে আবার ক্ষতিও করেন। তারই কল্যাণ লাভের আশায় তাঁর পূজা । তাঁকে সন্তুষ্ট করতে তাঁর বার্ষিক পূজা, উৎসব। এর থেকেই উপাসকরা পেয়েছেন পূজার আনন্দ। সেই লোক দেবতা গ্রাম দেবতার নামেই তাঁদের জীবনে এসেছে বিচিত্র মানব সম্পদ – লোকসংগীত, লোকনৃত্য,লোকবাদ্য, নানান লোককথা ইত্যাদি ….

মের কুলদেবতা বা দেবী কোথাও তিনি কালী, কোথাও ভৈরব বা ভৈরবী, কোথাও বনদুর্গা বা চণ্ডী, কোথাও বা অন্য কোনও স্থানীয় নামে পরিচিত। কিন্তু যে নামেই পরিচিত তিনি হন, পুরুষ বা প্রকৃতি-তন্ত্রেরই হন, সংশয় নেই যে, সর্বত্রই তিনিই প্রাচীন ও আদিম ….শীতলা, মনসা, বনদুর্গা, ষষ্ঠী, নানাপ্রকারের চণ্ডী, নরমুণ্ডমালিনী শ্মশানচারী কালী, শ্মশানচারী শিব, পর্ণশবরী, জাঙ্গুলী প্রভৃতি অজস্র নামে গ্রাম্য দেবতা বিরাজ করেন। এনারা কেউ কুলীন বা কেউ নন…কিন্তু আজও মানুষ এঁদের কেই গ্রামের মধ্যে সব থেকে শক্তিশালী দেবতা মনে করেন।

গরাম পুজো,ঝাড়গ্রাম

 রাঢ় এবং জঙ্গলমহল এলাকায় সবথেকে প্রাচীন দেবতা হচ্ছে গরামঠাকুর বা গ্রাম ঠাকুর বা গেরাম দেবতা। পোড়ামাটির লাল ঘোড়া, হাতি, সুবিশাল শাল প্রাংশু বনসপতি বা  পুরনো কোন গাছ কিংবা পাথরের ডিং তাঁর প্রতীক। যেদিন গ্রাম পত্তন হয়েছিল সেদিন গ্রাম ঠাকুর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। মানে নতুন গ্রাম সূচিত হত সেখানে ভূমি দেবতা, বাস্তু দেবতার পূজা ও প্রতিষ্ঠান করে। এই বনাঞ্চল পূর্বে পাহাড়-পর্বত , ডুংরি, নদ – নদী,ঝর্ণায় পরিপূর্ণ  এবং শ্বাপদসংকুল, হিংস্র জন্তুতে বেষ্টিত ছিল । সেই কোন প্রাচীন কালে যখন মানুষ সবে কৃষি কাজ শিখছে কৃষিজীবী কোন আদিম  সম্প্রদায়ের কৃষি ও গো চারণভূমির অভাব হলে জমির সন্ধানে ঘুরতে ঘুরতে এইসব অঞ্চলে উপস্থিত হয়ে তাদের প্রয়োজনমতো গোচারণ ও চাষের উপযোগী পরিবেশ দেখতে পেলে জঙ্গল পরিষ্কার করে কৃষি ও বাস উপযোগী জমি তৈরি করে গ্রাম পত্তন করে বসবাস শুরু করত। আজকের কথা নয় সে বহুদিন আগের কথা…… সেই যখন মানুষ ধীরে ধীরে সভ্য হচ্ছে….. যখন মানুষ কৌম গঠন করছে …সেখান থেকে গ্রাম তৈরী করেছে সে সময়ের কথা ।


 জঙ্গল পরিষ্কার করে তারা বাসস্থানের জন্য নির্দিষ্ট ভূমির কিছুদূরে অন্যান্য বড় বড় বৃক্ষ সহ জঙ্গলের বাকি অংশ ছেড়ে দিত। কেন ? কারণ তারা যে জায়গাটা পরিষ্কার করেছে সেখানে যে সমস্ত জীব জন্তু , আরণ্যক  প্রাণীরা বসবাস করত তারা যাতে ওইসব জঙ্গলে গিয়ে বাস করতে পারে। আর সেই গহীন জঙ্গলের কিছু অংশ হলো তাদের সেই গ্রামদেবতা থান ।গ্রাম পত্তনের দিনই দেবতাদের প্রতিষ্ঠা করে এক আনন্দের বাতাবরণ সৃষ্টি করা হতো ।


আদিম মানুষের ধর্ম বিষয়ক নানা তথ্যাদি পর্যালোচনা করে বিশেষত পণ্ডিতগণ আদিম মানুষের ধর্মের মূল সম্পর্কে বিভিন্ন প্রচার মত করেন। তাঁদের মতে আদিম মানুষের ধর্মই হলো সনাতনী । সেখানে রয়েছে এনিমিজম ( Animism)  অর্থাৎ বস্তু মাত্রই সজীব ( Ensouled) ।  আদিম  ধারনা প্রস্তুতি রয়েছে শক্তি বা আত্মা বা স্পিরিট । তাই প্রতি বস্তুই সজীব। তার  থেকেই উদ্ভব আদিম তন্ত্রের। সেই যে ….

য এনং বেত্তি হন্তারং যশ্চৈনং হতম্।
উভৌ তৌ ন বিজানীতো নায়ং হন্তি ন হন্যতে || 

যে ইঁহাকে হন্তা বলিয়া জানে, এবং যে ইঁহাকে হত বলিয়া জানে, ইহারা উভয়েই অনভিজ্ঞ। ইনি হত্যা করেন না-হতও হয়েন না।ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচি-
ন্নায়ং ভূত্বা ভবিতা বা ন ভূয়ঃ।
অজো নিত্যঃ শাশ্বতোহয়ং পুরাণো
ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে ।।

ইনি জন্মেন না বা মরেন না, কখন হয়েন নাই, বর্ত্তমান নাই বা হইবেন না। ইনি অজ, নিত্য, শাশ্বত, পুরাণ; শরীর হত হইলে ইনি হত হয়েন না।

গুজরাটের জনজাতির জীবনে গ্রাম দেবতা
ডিব্রু গড় আসাম, মহামায়া দেবীর মন্দির
[

 তাই তারা প্রত্যেক বস্তুকেই সজীব ভাবত। মানুষের মৃত্যু হলেও  আত্মা অবিনশ্বর।  তাই তারা মৃত আত্মাকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করত । মাঝে মাঝে খাদ্য প্রদান করত। এই মৃত আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান আদিম মানুষের সনাতনী ধর্মের মূল কারণ । মানুষের মনে ধর্মাভাবের প্রথম উদয় হলো কৃতজ্ঞতা থেকে । তারা দেখল তাদের চারিদিকে এমন সব বস্তু রয়েছে যা তাদের জীবন দান করে, খাদ্য দান করে ,জল দান করে…. সেগুলিকে তারা  ভয়ও করত , আবার উপকার পেত তাই তাদের কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করত। এভাবেই তারা ইষ্টকারী ও অনিষ্টকারী ক দুই প্রকার আত্মা বা শক্তির ধারণা করত ।তাই তাদের মৃত মাতা-পিতার প্রতি কৃতজ্ঞতা থাকত , তাঁদের শ্রদ্ধা ভক্তি করত ,পূজা করত ,মাঝে মাঝে তাদের জন্য খাবার প্রেরণ করত। এই চারিপাশের বস্তু গত প্রকৃতি অর্থাৎ ভূমি, জল, বাতাস, সূর্য বা আলো,  মহাশূন্য  আকাশ  মানে প্রকৃতির শক্তি ও পূর্বপুরুষের আত্মাকে  পূজাই জগতের প্রাচীনতম এবং সর্বাপেক্ষা ব্যাপক ধর্ম। 

এখ্যান পরবে মাতোয়ারা ঝাড়গ্রাম, গরাম পুজো


  প্রকৃতির নানা বিভূতির মানুষ তার শক্তির অনুরূপ বা তার চেয়েও বহুগুনে বড় শক্তির যখন প্রত্যক্ষ পরিচয় পেল তখন তাদের মধ্যে ধর্মভাবের উদ্ভব ঘটল । তাদের চেয়েও বড় শক্তি আছে বলে যদি আদিম মানুষ বিশ্বাস না করতো তাহলে তাদের মনে ধর্মের কথা উঠতো না । আসলে জেনে হোক বা না জেনে আদিম মানুষ প্রকৃতপক্ষে পূজা করেছিল শক্তির।প্রকৃতপক্ষে তারা পূজা করেছিল সেই প্রকৃতি, সেই পৃথিবীর…. তাঁদের নিকট প্রকৃতি ছিল মাতৃ স্বরূপ ও আকাশ ছিল পিতৃ স্বরূপ।  প্রকৃতপক্ষে প্রয়োজনের তাগিদেই স্বার্থবুদ্ধি প্রেরণায় আরম্ভ হয় পূজা, আর আসে পূজার মূলেও রয়েছে মানুষের আশা, আকাঙ্খা। তাই বলা যেতে পারে উচ্চতর শক্তির পূজাই ধর্ম । সেদিনের পূজা ছিল ক্রিয়াপ্রধান। সেদিনের প্রধানত জনগত, ব্যষ্টিগত নয়। ব্যষ্টির ক্ষেত্রে অবশ্য দেবতার কাছে প্রার্থনা, মন্ত্র, স্তব, মানত করা চলত। পূজার অনুষ্ঠান ছিল কিন্তু সমষ্টিগত। পূজার প্রধান অনুষ্ঠান ছিল ভোজ। স্থান বিশেষে সমস্ত গোষ্ঠী বা কৌম ভোজে যোগদান করত। সময়ে সময়ে নাচে গানে , আনন্দে মেতে উঠত। নাচতে নাচতে অনেকের ভাব লেগে যেত …..তখন মানুষ ভাবতো তার ওপর দেবতা ভর করেছেন। 


 যাহোক অনেক কথা বললাম,  রাঢ় অঞ্চলে এইরূপ লৌকিক দেবদেবী অসংখ্য পাওয়া যায় । প্রায় প্রতিটি প্রাচীন গ্রামেই এঁদের অবস্থান । প্রতি গ্রামে একটি বা একাধিক গ্রাম দেবতা থাকেন এবং সেই গ্রামের মানুষের নিকট তাঁরা পূজা পেয়ে থাকেন। এঁরা একান্তই  আড়ম্বর হীন গ্রাম্য দেবদেবী। রাঢ় অঞ্চলে এই গ্রাাম্য লৌকিক দেবদেবীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নাম হল-  গরাম দেবতা , ব যাঙ্গুলী, জাহের এরা , লৌকিক রূপে শিব , দেবী আদ্যাশক্তির কোনো লৌকিক রূপ, কালীর লৌকিক নানা রূপ – রংকিনী, খেলাই চন্ডী, দুয়ারসিনি, শেলহ্যানা বুড়ি, ধান্যশুয়ারী ইত্যাদি।

এখ্যান পরবে মাতোয়ারা ঝাড়গ্রাম, গরাম পুজো


 আজ আমরা যাব রঘুনাথপুর ২ নম্বর ব্লকের চেলিয়ামা গ্রামে। এর অন্তর্গত চাতরমহুল মৌজাতে এমনি কয়েকটি গ্রাম্য দেবদেবী দেখা যায়, যেমন- গরাম দেবতা, মহামাঞ, গুসাই ঠাকুর, ডুংরি থান, ঢাঙ্গামহুল ইত্যাদি। এই কয়েকটি গ্রাম দেবদেবীর পূজা বছরে দুই বার হয়। একবার আষাঢ় মাসে ও একবার মকর সংক্রান্তির পরেরদিন ১ লা মাঘ। প্রথম পূজা আষাঢ়ী  পূজা ও দ্বিতীয়টি মাঘী পূজা নামে পরিচিত ।  
আষাঢ় মাসের পূজা গুলি সেই মাসেরই দ্বিতীয় ও তৃতীয় সপ্তাহের মধ্যেই শেষ করা হয়। এর জন্য অবশ্য কোনো নির্দিষ্ট তারিখ, বার ,তিথি ,নক্ষত্র প্রয়োজন হয় না ।পূজার উপকরণও খুব সামান্য – সিঁদুর, ধূপ ধুনো ,ঘি, আতপ চাল ইত্যাদি এবং বলির জন্য  কয়েকটি জীব – রাঢ় ভাষায় এদের পাহুড় বলে। এসব পাহুড়গুলি সহ পূজার উপকরণ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি এবং ব্যবস্থাদি যা কিছু করনীয় ,বর্তমানে চাঁদা আদায় করে সমষ্টিগত ভাবে ষোলআনার পূজা কমিটিকেই করতে হয় ।


পূর্বে অবশ্য অন্য ব্যবস্থা ছিল।  পাহুড় সহ প্রতিটি উপকরণ ও প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ও ব্যবস্থাদির জন্য এক একটি পরিবারকে এক একটি কাজ ও দ্রব্যাদির জন্য একটি পরিবারের হাতে স্থায়ীভাবে পুরুষানুক্রমে ভোগ দখলের নিমিত্ত জমির ব্যবস্থা করা ছিল । এমনকি  চেলিয়ামার মহামায়া বা মহামাঞ পুজোর সময়  গ্রাম হতে একটি ছাগল  বা পাঁঠা পাঠানো হতো,তার জন্যও কিন্তু জমির ব্যবস্থা ছিল ।স্বাধীনতার পর জমিদারি প্রথা বিলোপ হলে উক্ত  প্রথাটি লোপ পায়। 

কাটোয়ার মূলগ্রামের গরাম পঞ্চানন ঠাকুরের পুজো


আষাঢ়ী পূজায়  গরাম দেবতার পূজার প্রাধান্য থাকে বেশি , পূজা কিন্তু যথারীতি প্রতি থানেই হয়ে থাকে । মাঘী পূর্ণিমায় মহামাঞ পূজার প্রাধান্য অনেক বেশি থাকে । একদিনের একটি মেলাও  বসে। নিকটবর্তী গ্রামসমূহ থেকে জাতি-বর্ণনির্বিশেষে, স্ত্রী-পুরুষ ,আবালবৃদ্ধবনিতা প্রত্যেকে এই মেলায় যোগদান করতে আসেন ।মেলায় বিভিন্ন প্রকার মনোহারী দোকান দ্রব্য ছাড়াও নানা খাদ্যের দোকান যথেষ্ট পরিমাণে থাকে। 


এই গ্রামের মধ্যে একটি বিধিনিষেধ এখনও প্রচলিত আছে – আষাঢ়ী পূজায়  গরাম দেবতার পূজা না হওয়া পর্যন্ত কোনো চাষী জমিতে ধান রোপন করতে বা পচন দিতে পারবেন না । এছাড়া গ্রামের পরিবারগুলি বাড়ির শাক সবজি খান না, চুল আঁচড়ান না, মাথায় সিঁদুর দেন না এবং এই ভাবেই তাঁরা কৃচ্ছসাধন করে আসছেন কত কাল, কত না যুগ ধরে।

রাজস্থানের একটি গ্রামে গরাম দেবতার থান। কি অদ্ভুত ? ঠিক এক রকম…পশ্চিম বাংলার রাঢ় অঞ্চলের মত


আষাঢ়ী পূজার পূর্ব দিন লায়া অর্থাৎ পূজারী চুল, দাড়ি , নখ কেটে শুদ্ধ হন ।পূজার পূজার পূর্ব দিন রাত্রে কেবল হবিষ্যন্ন গ্রহণ করেন ।পরের তিনি স্নান করে শুদ্ধভাবে উপকরণাদি সহ নতুন ধুতি পরে গরাম থানে হাজির হন । এর পূর্বেই ৪ থেকে ৫ জন ডোম বা বাজনদার থানে হাজির হয়ে ঢাক, ঢোল , কাঁসর সহযোগে নানা সুরের তালে স্থানটিকে আনন্দ মুখর করে তোলে । 


লায়া প্রথমেই আগুন জেলে গাইয়ের দুধে আতপ চাল সিদ্ধ করে তার থেকে কিছু অংশ নিয়ে গরাম থানের প্রতিটি দেবতাকে উৎসর্গ করেন। স্থানীয় ভাষায় একে  জুড়ি দেওয়া বলে । এরপর যথারীতি বলিদান শুরু হয়। প্রথমে একটি সম্পূর্ণ কাল পাঁঠী বা স্ত্রী ছাগ বলিদান করা হয় । তারপরে এক গাছের নিচে বাঘুৎ দেবতাকে একটি ডিম উৎসর্গ করা হয় । অন্য গাছের নিচে একটি শুকর কে উৎসর্গ করা হয় । এরপর গরাম দেবতার জন্য থানে মোরগ উৎসর্গ করা শুরু হয়। এই মোগরগুলি গ্রামের বিভিন্ন পরিবার থেকে এসে থাকে। এইভাবে গরাম থানে পূজা শেষ হলে দুধে সিদ্ধ চালের অর্থাৎ জুড়ির একাংশ নিয়ে এক লায়া মহামাঞ থানে  গিয়ে যথারীতি জুড়ি উৎসর্গ , পূজা শেষ করেন । এরপর ওই থানে একটি ছাগল বা পাঁঠা উৎসর্গ করা হয়।


 এদিকে গরাম থানে পূজা সম্পন্ন করার পর লায়ারা সামান্য দূরে অবস্থিত এক গাছের নিচে গোঁসাই ঠাকুরের থানে ফুল , জল , জুড়ি সহযোগে পূজা সম্পন্ন করে। একটি মোরগকে উৎসর্গ করেন,  যেটি সমষ্টিগতভাবে অর্থাৎ গ্রামে ষোলআনা থেকে প্রদত্ত হয়। এরপর পূজা সম্পন্ন করেন লায়গণ ফুল, ফল, জুড়ি ইত্যাদি সহযোগে ঢাঙ্গামহুল দেব স্থলে পূজা সম্পন্ন করেন। সমষ্টিগত ভাবে এখানে কোন জীব বলি দেওয়ার প্রথা নেই ।কিন্তু ওই পাড়ায় প্রতি পরিবারে থেকে আসা মোরগকে এখানে উৎসর্গ করা হয়। মাঝে মাঝে ছাগল বলি দেওয়া হয় ।

জঙ্গলমহলে নববর্ষের সাজ এখ্যান ‌যাত্রার গরাম পূজা


আষাঢ়ী পূজা ও মাঘী পূজার মাঝামাঝি অগ্রহায়ণ মাসের প্রথম দিকে এই গ্রামে আরেকটি বিশেষ প্রথা প্রচলিত আছে , সেটিকে চালহইর চাপা নামে অভিহিত করা হয় এবং এটি না হওয়া পর্যন্ত কোনো চাষী এই গ্রামের বহাল ধান কাটতে পারেন না।  নির্দিষ্ট দিনে স্নানাদি সেরে লায়া  গ্রামের নির্দিষ্ট কিছু বহাল জমিতে গিয়ে এক স্থানে দাঁড়িয়ে পা না -উঠিয়ে চারিদিকে ঘুরতে ঘুরতে যতগুলি ধানগাছ নাগালের মধ্যে পান প্রায় সবগুলি কেটে নেন । এইভাবে নির্দিষ্ট সময় জমির ধান কাটার পর কিছু অংশ   অন্যদিকে চাপাতে হয় অর্থাৎ পূজা সহযোগে অর্পণ  গরাম থান , মহামাঞ থান, ও অন্যান্য দেব থানে চাপাতে হয়। অর্থাৎ পূজা সহযোগে অর্পণ করতে হয় ।  বাকী কিছু অংশ ধান আতপ চাল করে  তার গুড়ি করে মহামাঞ পূজার দিনে পিঠে তৈরি করে পাঠাতে হয়…..

গ্রাম দেবতা ও কুলদেবতা রূপে নাগ দেবতার পূজা…দক্ষিণ ভারত



#ক্রমশ
#দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ পুরুলিয়ার লোকসংস্কৃতি 
পুরুলিয়ার লৌকিক দেবদেবী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.