চার্চে শিশুদের উপর যৌন নির্যাতনের নিন্দা করা পোপ এবং কার্ডিনালদের দুর্দান্ত অভিনয়ের পরিচয়। সামগ্রিকভাবে চার্চের শিশু-নির্যাতন কেবল অসমর্থিত অভিযোগ নয়, সত্যিকারের অপরাধ এবং দৃঢ় বাস্তব ।

ডেভিড ইয়ালোপ ২০১২ সালে বই লেখেন “বিয়ন্ড বিলিফ: দ্যা ক্যাথলিক চার্চ এন্ড দ্যা চাইল্ড আবউস স্ক্যান্ডাল”। বইটিতে ক্যাথলিক চার্চের জঘন্য অপরাধগুলির বিশ্লেষণ করা হয়, পোপ  প্রথম জন পলের সন্দেহজনক মৃত্যু থেকে ভ্যাটিকানের আর্থিক তছরুপ আর কি নিপুণভাবে ভগবান ও চার্চের মহত্বের মোড়কে তাদের ঢাকা দেয়া হয়, তার রোমহর্ষক বিবরণ। আর আগেও ডেভিড ইয়ালোপ সাদ্দাম হুসেন, ফ্লাইট ১০৩ বোম্বার, কলম্বিয়ার ড্রাগ কার্টেল, সিসিলিয়ান মাফিয়া এবং কুখ্যাত অপরাধী কার্লোস দ্যা জ্যাকালের মতো অত্যন্ত বিপজ্জনক লোকের তদন্ত করেছেন।

বইটি উৎসর্গ করা হয় চার্চের দ্বারা আক্রান্ত শৈশবহীন বাচ্চাদের। শুরুতেই তিনি বলেন যে “এই সমাজে অনেক মানুষই একা। সংগতবিহীন বাচ্চা কে চার্চে পাঠাবেন না।” ছয় বছর পর তার এই বাক্য চার্চ নিজেই আইন করে বাস্তব করে দেয়

হাতের পাঁচটা আঙুলের মতন সবাই সমান নয়। তাই কয়েকজন পাদ্রী হয়তো বা নিজেকে সামলাতে না পেরে অন্যায়ের রাস্তাতে হাটতে পারে, কিন্তু ইয়ালোপের মূল বক্তব্য আরো গভীর। চার্চ সুনিপুণভাবে এইসব ঘটনা কে ধামাচাপা দেয় কেন? আর তা যদি প্রবল আকারে কারখানাজাত পণ্যপ্রস্তুতের মত পর্যায়ে হয়, তাহলে তা মোটেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরঞ্চ পুরো চার্চের পরিকাঠামোকেই অপরাধের কাঠগড়াতে দাঁড় করাতে হয়। ইয়ালোপ সরাসরি আঙ্গুল তুলেছেন পোপ জন পল দ্বিতীয় এবং পোপ বেনেডিক্ট ষষ্ঠ-এর দিকে, এই অপরাধ কে প্রশ্রয় ও আড়াল করার জন্য।

এক বিলিয়ন ক্যাথলিকদের এই দুই নেতা এমনভাবে ঘুরে বেরিয়েছে যেন কিছুই হয় নি। ২০১০ এই বই বেরোবার পর যে খুব টনক নড়েছে, তাও বলা যায় না; ২০১৯ এ পোপ ফ্রান্সিস ও পিছিয়ে আসেন তার কাছের যৌন-নিগ্রহকারী নররাক্ষসদের তালিকা টি ভাগ করার থেকে, পাছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের শাস্তি দিতে স্পেশাল ট্রাইবুনাল বসায়।

ধুরন্ধর গোয়েন্দা ইয়োলোপ দেখাচ্ছেন এই বিকৃতি-মনস্কতা নতুন কিছু নয়, সেই দ্বিতীয় শতাব্দীতেও এর ফিসফিস শোনা গেছিলো। ১৭৭ আব্দের বিশপ অ্যাথেনাগোরাস-এর লেখনী, ৩০৫ সালের এলভিরার কাউন্সিলের কার্যবিবরণী, ৩১৪ সালের আনক্রিয়া কাউন্সিলের কার্যবিবরণী,  চতুর্থ শতাব্দীর  ইংল্যান্ডের পেনিতেন্শিয়াল অফ বেড, ১০৫১ আব্দের পিটার ডেমিয়ানের লেখা “বুক অফ গোমরহ”, ১১৪০ সালের গ্রাটিয়ানের ডিগ্রী, সব ব্যক্তি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সময়ে প্রচেষ্টা করে সহোদরদের  দ্বারা বাচ্চাদের উপর যৌন নির্যাতন বন্ধ করতে বা এই ব্যাপারে উর্ধ্বতনদের দৃষ্টিগোচর করতে। তবে উর্ধ্বতনদের তরফ থেকে যথাযথ প্রতিক্রিয়া বা তাৎপর্যপূর্ণ কোনও পদক্ষেপ কোনোকালেই ছিল না।

ইয়ালাপ চার্চের অভ্যন্তরে এমন একটি “গোপন ব্যবস্থা” সম্পর্কে উল্লেখ করছেন যা এই অপরাধগুলিকে জনমানসে  আসতে বাধা দেয় এবং প্রতি পদক্ষেপে  রাষ্ট্রশক্তিকে নিষ্ক্রিয় করে যাতে দোষীদের উপযুক্ত শাস্তিলাভ না হয়।

গোপন ব্যবস্থা

ডেভিড ইয়ালাপের চার্চের অভ্যন্তরে বন্ধু এবং বিশ্বস্ত লোকের মাধ্যমে ভ্যাটিকানের অনেক পদক্ষেপ প্রকাশ করেছেন যাতে নিগ্রহকারীরা একরকম পরিণাম ছাড়াই অপরাধ করে যেতে পারে। বিশ্বাস করা যায় যে বাচ্চাদের প্রতি অকৃত্রিম উদ্বেগ এবং কিছু করতে না পারার নিজের অসহায়ত্বের কারণে তারা ইয়ালোপকে সাহায্য করেছিল।

ইয়ালোপ চার্চের গোপন ব্যবস্থা সম্পর্কে বলছেন (পৃ:১১-১২);

ধর্মীয় যৌন-নির্যাতনকারীকে রক্ষা করার গোপন ব্যবস্থাটি অন্তত সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম দিকের মতো নিপুনভাবে কার্যকর ছিল যখন পিয়েরিস্ট অর্ডারের প্রতিষ্ঠাতা ফাদার জোসেফ ক্যালাসানজ তাঁর যাজকদের দ্বারা শিশুদের যৌন নির্যাতনকে জনসাধারণের জ্ঞান হওয়ার থেকে আটকে রেখেছিলেন  এরকমই একটি পেডোফাইল , সুপ্রতিষ্ঠিত ভাল-সংযুক্ত ভ্যাটিকানের  সদস্য ফাদার স্টেফানো চেরুবিনি তার অপরাধগুলি ঢাকতে এতটাই সফল ছিলেন যে তিনি অর্ডারের প্রধান  হয়ে যান  ইতিহাসবিদ কারেন লাইব্রিচ হিসাবে, ‘ফলেন অর্ডার’- এ দেখিয়েছেন, সপ্তদশ শতাব্দীর গোপনীয় ব্যবস্থার আধুনিক কালের সাথে সামঞ্জস্য আছে, যার মধ্যে রয়েছে “এড়ানোর জন্য পদোন্নতি” – নির্যাতনকারীকে তার শিকার থেকে যে কোনো প্রকার দূরে রাখার কৌশল

এই গোপনীয় ব্যবস্থাটি কীভাবে কাজ করে তা বহিরাগতদের কাছে একটি ধাঁধা হয়ে উঠতেই পারে, তবে অভ্যন্তরীণ লোকেদের মধ্যে যারা সম্পূর্ণ নির্বোধ নয়, তারা জানে বা অন্তত অনুমান করতে পারে যে এটি কীভাবে কাজ করে।

জর্জ অগাস্টিন (এই প্রবন্ধের রচয়িতা) একজন ধার্মিক ক্যাথলিক হিসাবে বড় হয়েছিলেন, যিনি  শৈশবে প্রতি রবিবার গির্জাতে  যেতেন, আবাসিক কনভেন্ট স্কুলে পড়াশুনা করেন, আরএনএস এবং এনসির একজন ধর্মীয় সংবাদদাতার সহকারী হিসাবে কাজ করেছিলেন, চার্চের ইতিহাস সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল এবং তাই ইয়ালোপের লেখার সাথে একমত।

বহিরাগতের সুবিধার জন্য,অগাস্টিন গোপন ব্যবস্থাটির পটভূমির ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছেন। এমন একটি সংস্থার কল্পনা করুন, যার মধ্যে দুই ধরণের সদস্য রয়েছে: প্রথমত ধর্মাচারীরা যারা শীর্ষে পোপের সাথে শ্রেণিবদ্ধ সংগঠন পরিচালনা করেন এবং দ্বিতীয়টি সাধারণ সদস্য যারা আর্থিক এবং অন্যান্য সুবিধাগুলির বিনিময়ে প্রথম গ্রুপের দ্বারা আধ্যাত্মিক সেবা গ্রহণ করেন। এই সংগঠনের সদস্যপদের বাধ্যতামূলক অবশ্যিকতা হলো মৌলিক বিশ্বাসের এবং সন্দেহাতীত আনুগত্যের বাধ্যবাধকতা। কিন্তু সমস্ত সদস্যকে কিছু অবিশ্বাস্য সুযোগ-সুবিধার প্রতিশ্রুতি দেয়, যেমন সহবাসীর বিরুদ্ধে আপনি জেনেশুনে বা না বুঝে যে পাপ করেছেন, তার থেকে মুক্তি এবং মৃত্যু পরবর্তী জীবনের জগতে নিরাপদ উত্তরণ; যার কোনোটাই অবশ্য পরীক্ষণীয় নয়।

সংগঠনের প্রতিদিনের পরিচালনা প্রথম সদস্যরা গোপনীয়তার সাথে পরিচালনা করেন, তবে সমস্ত সদস্যকেই  মধ্যযুগীয়, একচেটিয়া আইন (ক্যানন ল’) কে অনুসরণ করার আহ্বান জানানো হয়। তাদের কে এই কোডের আনুগত্যের ও গোপনীয়তার শপথ নিতে হয় যে প্রতিষ্ঠানের চার দেয়ালের অভ্যন্তরে যা হয়, তা যেন  বহির্বিশ্বের কাছে প্রকাশ না পায়। চার্চকে বদনাম হতে দেওয়া গর্হিত কাজ। সমস্ত সদস্যের ভগবান ও যাজকদের ওপর আস্থা রাখা উচিত, কোনও সদস্যের দ্বারা করা অপরাধ যতই মারাত্মক হোক না কেন, যেমন কোনও বিশপের দ্বারা প্রব্রাজিকা নানের ধর্ষণ (যা হয়েই থাকে এবং সন্দেহাতীত ভাবে নিন্দনীয়), চার্চ এবং তার মর্যাদা সবার ঊর্ধ্বে এবং অপরাধী লৌকিক বিচার থেকে পালিয়ে গেলেও সমস্ত সদস্যেদের সর্বদা তাকে রক্ষা করা উচিত!

এই পুরো চার্চ গোষ্ঠীর মধ্যে ন্যায়বিচার এবং নীতিশাস্ত্রের সর্বোচ্চতা ওপর থেকে নীচ, সবাইকে মেনে চলতে হয় আর এর মধ্যে এককভাবে প্রশংসিত ও সর্বভাবে অপেক্ষিত হল “আনুগত্য” । তাদের আনুগত্যের ধারণাটি উপকথাসুলভ সিসিলির গ্যাংস্টার  এবং মাফিয়ার থেকেও নির্মম।

এখানে ক্যাথলিকদের “আনুগত্য” বলতে কী বোঝানো হয়েছে তা বোঝাতে অগাস্টিন সিস্টার লুসি কালাপুরাকে উদ্ধৃত করেছেন, যিনি সম্প্রতি ভারতে এক ক্যাথলিক চার্চ থেকে বরখাস্ত হয়েছিলেন। তার অপরাধ? তিনি আরেক প্রব্রাজিকা নানের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন যাকে একজন বিশপ ধর্ষণ করেছিল বলে অভিযোগ করা হয়েছিল। সিস্টার কালাপুরা তার ঊর্ধ্বতনদের “অমান্য” করার জন্য চার্চ থেকে বরখাস্ত হয়েছিলেন এবং ভ্যাটিকানের কাছে তার আবেদনটি অক্টোবরে ২০১৯ সালে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল।

সম্প্রতি একটি ভিডিও সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন যে তিনি যখন চার্চে যোগ  দিয়েছিলেন তখন তিনি শপথ নিয়েছিলেন আনুগত্যের। ঠিক কেমন ছিল সেই শপথ? সমস্ত আদেশ বিনা প্রশ্নে মান্য করতে হবে;  যদি তাকে শিকড় উপরে করে দিয়ে গাছ লাগানোর আদেশ দেওয়া হয়, তবে তাকে বিনা প্রশ্নে তাই করতে হবে। সিষ্টার কালাপুরা এই উদাহরণটির মন থেকে মেনে নেন নি, তিনি মনে করতেন তার আনুগত্য শুধুই ভগবানের প্রতি যিনি লোকেদের দিয়েছেন বিবেক, ভালো আর মন্দের মধ্যে বিচার করার জন্য। তার বিবেকের কাছে তিনি অনুগত, তাঁর মতে উদ্ভিদকে ঠিক ভাবে না বসালে যে তার সাথে ন্যায়বিচার হয় না।

চার্চ পাপ বলতে বোঝে “সিন্”; দশটি আদেশ অর্থাৎ টেন কমান্ডমেন্টস থেকে বিচ্যুতি। কিন্তু এর থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় পাপস্বীকার !  সুতরাং, কেউ যদি কল্পনা করে যে সে তার প্রতিবেশীর শিশুকে যৌন নির্যাতন করার মতো কোনও নৃশংসতা করেছেন, সেটা যতই কষ্টসাধ্য কল্পনা হোক, সে কিন্তু ধর্মযাজকের কাছে গিয়ে তার কাছে স্বীকার করতে পারেন এর থেকে অব্যাহতি পেয়ে থাকেন। সে যে ভগবানের কাছে অঙ্গীকার করে এসেছে, যে ভগবান ভালোবাসার প্রতীক, পাপময় দুনিয়ার সর্বপবিত্রতা, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রশক্তির কাছে তা নস্যি। ধর্মযাজক তাকে কোনোদিনও পুলিশের হাতে তুলে দেবে না, সে যে নিজের পাপ শিকার করে পরোক্ষে চার্চের উপকার করছে। পাপ স্বীকারের প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে তাকে দিতে হয় জরিমানা। এই ধরণের জরিমানা বিক্রি করেই খৃষ্টানরা বানিয়ে ফেলেন রোমের সুবিখ্যাত সেন্ট পিটার’স বাসিলিকা।

ডেভিড ইয়ালোপ বইতে বলছেন যে সবচেয়ে গুরুতর “পাপ” এর শাস্তি ছিল এক্সকমুনিকেশন, অর্থাৎ একঘরে করে দেওয়া (পৃ: ৮ )। চার্চে এই শাস্তি প্রকৃতপক্ষে বিরল ঘটনা ছিল, পরবর্তী বছরগুলিতে সংরক্ষিত ছিল কমিউনিস্টদের জন্য, তবে শিশুদের উপর যৌননির্যাতনকারীদের চার্চ থেকে  বহির্গমন এখনও অজানা। খ্রিস্টীয় মধ্যযুগীয় ইউরোপে, এর অর্থ এই ছিল যে আক্রান্ত ব্যক্তিকে সত্যই পুরো সমাজ ত্যাগ করতে হবে। সাধারণ প্রায়শ্চিত্ত গুলির মধ্যে ছিল পাপমোচন উপবাস, কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ও বিলাসিতাকে  নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ত্যাগ করা।

লেখকের অভিজ্ঞতা

জর্জ অগাষ্টিনের জন্ম ক্যাথলিক পরিবারে, তাই তিনি কনফেশনের ব্যাপারে জানতেন ছোট থেকেই, কিন্তু পারিবারিক জীবনে কেউ তাকে কোনোদিনও যাজকের কাছে পাপ-স্বীকার করতে চাপ দেয়নি। কিন্তু কৈশোরে তাকে পাঠানো হয় কনভেন্ট স্কুলে যেখানে প্রত্যেক বুধবারে নির্দিষ্ট যাজকের কাছে কনফেশন করা ছিল বাধ্যতামূলক। যাজকটি ছিলেন পার্শবর্তী কলেজের অর্চক। বেড়ে ওঠার এই সরল পর্যায়ে কারুরই কোনো লক্ষণীয় পাপের ইতিহাস ও সংলগ্ন পাপবোধ অনুতাপ থাকে না, কিন্তু সারিতে দাঁড়িয়ে স্বীকারোক্তি-কক্ষে ঢুকে কেউ তো যাজকের মুখে বলতে পারে না যে সে নিষ্পাপ, তাই অগাস্টিন বানিয়ে বানিয়েই নিজের কান্ডকারখানা বিবৃত করতেন।

বন্ধুদের মারধর করা, শিক্ষকদের নিন্দা, মেয়ে সহপাঠীদের নিয়ে চর্চা এবং সর্বোপরি সেই কাজ যেটা বাকি এই পাপেদের এক সুতোতে বাধে; মিথ্যে কথা বলা ছিল অগাস্টিনের পাপ। সাজা বলতে ভগবানের কাছে নুয়ে ১০ বার “হেইল মেরি” বা ৫ বার “আওয়ার ফাদার” আওড়ানো।

কিন্তু কনফেশনের পর অগাস্টিন মানসিক ভাবে মুক্ত-বিহঙ্গ। তিনি যত খুশি পাপ করতে পারেন, পাপের ঝোলা ভরলে পরের বুধবারের বাধ্যতা কমে।

এই জাতীয় পরিবেশে, প্রত্যেক যাজক যিনি একটি শিশুকে যৌন নির্যাতন করেন তাদের নিয়মিত ক্ষমাপ্রার্থনার রাস্তা ছিল এবং উপর দিকে পোপ পর্যন্ত এটি সমস্ত ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। ১২ বছর বয়সে প্রথম যৌন নির্যাতনের ঘটনাটি যখন অগাস্টিনের গোচরে আসে, যখন তার বয়সের একটি ছেলে কোচিনের সেন্ট অ্যালবার্ট স্কুলে একটি বিশেষ ক্যাথলিকের জন্য ৩ দিনের রিট্রিট-এ  বলেন যে রাতের বেলা তাকে একজন যাজক অনুপযুক্তভাবে ছুঁয়ে ছিলেন । সেই ছেলেটি আরো জানায় যে এই ধরনের রিট্রিটগুলোতে এই জিনিসগুলি অতি সাধারণ ব্যাপার। ভয়ার্ত অগাস্টিন পিতামাতাকে কোনও কারণ না দিয়ে এইসব রিট্রিটগুলোতে যাওয়া বন্ধ করে দ্যান এবং তার পর থেকে প্রতিটা অনুপস্থিতির জন্য স্কুলের প্রধান শিক্ষককে আর্থিক জরিমানা দ্যান। এই প্রথম ঘটনাটি ছিল সতর্কবাণী যা তাকে ভাল অবস্থানে দাঁড় করিয়েছিল যখন পরের ঘটনাটি ঘটে।

সেবার মায়ের নির্দেশে সে তার প্যারিশ গির্জা প্রাঙ্গণে (সেন্ট ফ্রান্সিস অ্যাসিসি ক্যাথেড্রাল, কোচিনে) অপেক্ষা করছিযেন তার ছোট ভাইয়ের জন্য। তার ছোট ভাই চার্চে প্রবেশের জন্য তার ক্যাটেকিসম (ধর্মের প্রশ্নোত্তরে শিক্ষাদান)  ক্লাস চলছিল। একজন নবীন যাজক তার সাথে কথোপকথনের জন্য এগিয়ে আসে এবং তিনি কি করছেন তা অনুসন্ধান করেন। কথবার্তার মাঝেই অগাস্টিনকে জড়িয়ে ধরেন এবং চুম্বনে আবদ্ধ হন, যা তাৎক্ষণিকভাবে তার সেই ভয়ঙ্কর স্মৃতির পুনরুত্থান করে। তারপরে সেই যাজক তাঁকে  সাথে তাঁর ঘরে যেতে বলেন, যা সে প্রত্যাখ্যান করে। ভাগ্যক্রমে সেই সময় এক দল লোক কাছের একটি বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে আসে, তাদের মধ্যে অগাস্টিন খুঁজে পান নিজের ভাইকে, যা তাঁর এই আপত্তিকর পরিস্থিতির থেকে পালানোর রাস্তা তৈরী করে দেয়।

তার পরেও অনেকবার কোচিন সিটিতে (যেখানে তিনি থাকতেন), তৃতীয় পক্ষের অনেককেই এই জঘন্য যৌন নির্যাতনের মধ্যে দিয়ে যেতে শুনেছেন। কিছু যাজকদের যৌন নির্যাতনের শিকার স্বজনদের হাতে মারধর খাওয়া ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। যাজকরা তাদের গীর্জা থেকে নিঃশব্দে নিখোঁজ হতেন  এবং নতুন লোকেরা উপরক্তের দায়িত্ব গ্রহণ করতেন। কিন্তু লক্ষ্যের বিষয়; কোনো ঘটনাতেই চার্চ বা প্রতিষ্ঠানের চার দেয়াল থেকে বেরোতে পারে নি।

ডেভিড ইয়ালোপ এই গোপনীয়তার প্রক্রিয়াটি শ্রেণিবদ্ধ উচ্চ পদে অধিষ্ট যাজকদের নির্দিষ্ট আচরণে লিপিবদ্ধ করেছেন। সব ক্ষেত্রেই এরকম কিছু ঘটে: কোনও শিশু তার বাবা-মায়ের কাছে অভিযোগ করে, বা বাবা বা কোনো শুভাকাঙ্খী কোনওভাবে এই অপব্যবহার সম্পর্কে জানতে পারেন এবং অপরাধীর চেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ যেমন বিশপ বা প্যারিশের প্রধান যাজকের  কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। বিশপ বা প্রবীণ যাজক ধৈর্য সহকারে  সহানুভূতিতে সমস্ত কিছু শোনেন, তারপরে বাবা-মা এবং ক্ষতিগ্রস্ত মানুষটিকে পাপীর জন্য তীব্রভাবে প্রার্থনা করতে বলতেন, যাতে সে ঈশ্বরের রাস্তাতে প্রত্যাবর্তন করে!  গাইড পীড়িতদের যে কোনো প্রলোভনের বিরুদ্ধে এবং এইরকম পরিস্থিতিতে সংযম বজায় রাখার জন্য সতর্ক করে দ্যান। তারপরে ভুক্তভোগীদের  প্রার্থনা করে অপেক্ষা করতে হয় যত দিন না ঈশ্বর শাস্তির বিধান দ্যান, যদি না তারা অন্যথায় সিদ্ধান্ত নিয়ে পুলিশকে ফোন করেন।

ইয়ালোপ এমন একটি গোপন নথি উল্লেখ করেছেন যা সম্প্রতিই প্রকাশিত হয়েছে, তবে যা চার্চের তথাকথিত দ্বিতীয় সংস্কার (ভ্যাটিকান II) এর শেষে, ১৯৬২ সালে প্রসূত হয়েছিল। এই নথিটি, ‘ইন্সট্রাকশন্স অন দি ম্যানার অফ প্রসেডিং ইন কেসেস অফ সলিসিটেশন’, তৎকালীন পোপ জন XXII- এর অনুমোদনে প্রিফেক্ট অফ দি হলি অফিস, কার্ডিনাল আলফ্রেডো ওটাভিয়ানি প্রকাশ করেন। এটি সেইসব যাজকদের গোপনে বিচারের ব্যবস্থা করে যার বিরুদ্ধে স্বীকারোক্তি শুনে  জজমানের কাছ থেকে যৌন অনুগ্রহ চাওয়ার অপরাধে অভিযুক্ত।

ইয়ালোপ লিখছেন: “দলিলটি সম্প্রতি আইনজীবীদের দ্বারা ‘প্রতারণা ও গোপনীয়তার একটি নীলনকশা’ হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে, যদিও কৈফিয়তদানকারী স্যাক্রামেন্টের দোহাই দিয়েছেন। এই পদ্ধতি অবশ্যই ‘ধর্মীয়’ অপরাধকে ও অপরাধীকে দেশের ফৌজদারি আইনের উর্ধে রাখে এবং  গোপনীয়তার অনুগ্রহ রাখে। স্বীকারোক্তিমূলক বাক্সে বা বাইরে যে সকল ধর্মঘটিত পেডোফিলিয়া ঘটেছে তাতে ভ্যাটিকান বহু শতাব্দী ধরে ঠিক করে রাখা এই অবস্থানটি থেকে নড়েনি এক চুল। ”( পৃ; ১২-১৩)

বন্যার দ্বার উন্মুক্ত

রিতা মিলা নাম এক বিতাড়িতের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের  লস অ্যাঞ্জেলেসে একজন আইনজীবী প্রথম ‘পাদরি অপব্যবহার’ মামলা দায়ের করলে ১৯৮৪ সালে। গোপনীয় ব্যবস্থাটি প্রথম আঘাত পায় এতে। তরুণীর  স্বীকারোক্তা ফাদার সান্টিয়াগো টামায়ো স্বীকারোক্তিমূলক অনুষ্ঠানে রিতাকে  বুঝিয়েছিলেন যে “ঈশ্বর চান তাঁর পুরোহিতদের খুশী করার জন্য আপনি নিজের ক্ষমতায় সব কিছু করুন। এটি আপনার কর্তব্য” (পৃ; ১৪ )। তিনি যখন ১৮ বছর বয়সী ছিলেন, টামায়ো তার সহযাজকদেরও খুশী করার জন্য তার উপর চাপ সৃষ্টি করেন এবং শেষ পর্যন্ত তাকে সাত জন যাজককে খুশি করার জন্য রাজি করিয়ে ছিলেন। তাদের মধ্যে একজন তাকে গর্ভবতী করে ফেলেন। ফাদার টামায়োও সহযাজকদের কাছ থেকে ৪৫০ মার্কিন ডলার সংগ্রহ করেছিলেন এবং ফিলিপিন্সের বিশপ আবায়া কে ওই শিশুর দেখাশোনা ও শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তা দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। রিতাকে সন্তানের জন্ম দেওয়ার জন্য ফিলিপিন্সে পাঠিয়েছিলেন। তবে এই আর্থিক সহায়তা কার্যকর হয় নি এবং রিতা তার ক্যালিফোর্নিয়া ডায়োসিসের বিশপ ওয়ার্ডের কাছে ফিরে আসেন। তিনিও সাহায্য প্রত্যাখ্যান করলে রিতা এবং তার মা আদালতে যান। বিধিবদ্ধ সময়-সীমা শেষ হয়ে যাওয়াতে মামলাটি আদালত খারিজ করে দ্যায়।

মামলার বিষয়ে ইয়ালোপ লিখেছেন: “১৯৪৮ সালে যখন অ্যাটর্নি গ্লোরিয়া অলরেড একটি সংবাদ সম্মেলন ডেকে এই মামলার দিকে মনোনিবেশ করার জন্য বলেন যে সাতটি যাজক সবাই নিখোঁজ হয়েছেন । এই ধরনের ক্ষেত্রে ভ্যাটিকানের নির্দেশিত যথাযথ পদক্ষেপগুলি অনুসরণ তো করা হয়ই নি; বরঞ্চ লস অ্যাঞ্জেলেস আর্চডিয়োসিকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত তাদের সবাইকে দেশ ত্যাগ এবং বিদেশে থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল …। চিঠিপত্রগুলি নির্দেশ করে যে আর্চডোসিস নিয়মিতভাবে রিতাকে নয়, ফিলিপিন্সে লুকিয়ে থাকা অপব্যবহারকারীদের কাছে অর্থ প্রেরণ করেছিল। “(পৃ;১৫)

বিশপ রজার মাহোনি এবং কার্ডিনাল তীমথি ম্যানিংয়ের মতো লোকেরা যারা অপরাধীদের প্রশ্রয়  ও সহায়তার জন্য দায়ী ছিলেন কেউই শাস্তি পান নি। চার্চের “কার্ডিনাল ডিসিপ্লিন” বিভাগীয় প্রধান রাটজিংগার যিনি পুরো ঘটনাটা অদক্ষ ও নির্জীব ছিলেন পরে পোপ বেনেডিক্ট ষষ্ঠ হিসেবে উত্থিত হন।

তার পরের গুণধর হলেন লুইজিয়ানার ভার্মিলিওনের ফাদার গিলবার্ট গৌথের, যিনি বেদীনিষ্ঠ  ছেলেদের, অল্টার-বয়দের অন্যায় সুবিধা গ্রহণ করা এমনকি বিভিন্ন যৌনকর্মের ছবি তোলার অভিযোগ অভিযুক্ত ছিলেন। তিনি যে চারটি প্যারিশে নিযুক্ত ছিলেন তার মধ্যে তিনি শতাধিক ছেলের শ্লীলতাহানি করেছিলেন। লুইজিয়ানার আর্চবিশপ ফিলিপ হান্নান তাকে আচ্ছাদন করার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তাকে ৪.২ মিলিয়ন ডলার প্রদান আর্থিক জরিমানা দিতে হয়।

যদিও পোপ জন পল দ্বিতীয় ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন যে প্রাথমিকভাবে যৌন নির্যাতন শুধুমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই  একটি উদ্বেগজনক ঘটনা, তবে শীঘ্রই আয়ারল্যান্ড, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং যুক্তরাজ্য, আয়ারল্যান্ড, বেলজিয়াম, অস্ট্রিয়া এবং জার্মানি সহ ইউরোপের দেশগুলিতে শত শত মামলা প্রকাশিত হয়েছিল। অন্যান্য জায়গাগুলিতে ক্যাথলিক যাজকরা সাধু ছিলেন এরকম মনে করার দরকার নেই, আমাদের লক্ষ্য করা উচিত যে এই জায়গাগুলিতে গোপন ব্যবস্থা অব্যাহত ছিল এবং অব্যাহত রয়েছে।

**********

ইয়ালোপ ২০১০ সালের আগস্টে লিখিত প্রবন্ধের প্রথম পৃষ্ঠায় আমাদের বলেছেন যে “১৯৮৩ সালে ষড়যন্ত্রের উদ্ঘাটন শুরু হওয়ার পর থেকে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের চার্চের একাই আর্থিক ব্যয় ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং বেড়েই চলেছে। আয়ারল্যান্ডে ব্যয় ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি।  বিশ্বের অন্যান্য অংশে কমপক্ষে আরও ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করতে হবে। লেখক ইঙ্গিত দেয় যে এই অর্থের যথেষ্ট অংশ আইনজীবীদের কাছেও গেছে। প্রকৃতপক্ষে, চার্চের দ্বারা যৌন নিপীড়নের ঘটনাগুলি প্রশমিত করার জন্য যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়েছে তা অজানা। এই দেশগুলির বিচার ব্যবস্থার উচ্চ পদগুলিতে অবস্থিত চার্চ-বিশ্বাসীদের দ্বারা অনেকগুলি মামলা বাতিল করা হয়েছিল। একটি নির্দিষ্ট উদাহরণ হলো নিউ অরলিন্সের ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি হ্যারি কানিক সিনিয়র একটি অপরাধী যাজককে দু’বছরের জন্য দায়ের করা ফাইলগুলি দমন করেছিলেন কিন্তু অবশেষে ওই যাজক যখন এই আচরণে হাতেনাতে ধরা পড়েছিলেন, তখন তিনি একটি টিভি সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেছিলেন যে তিনি অপরাধী পুরোহিতের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেন নি কারণ তিনি “হোলি মাদার চার্চকে বিব্রত করতে” চান না (পৃ; ৩৪)।

ইয়ালোপ লিখছেন, “ক্যাথলিক চার্চের অর্কেস্ট্রেটেড কভার-আপ সত্ত্বেও, গির্জার শ্রেণিবদ্ধ, ধর্মপ্রাণ ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি, বিচারক এবং পুলিশ আধিকারিকদের দ্বারা চার্চের পবিত্র নামটি রক্ষার চেষ্টা এবং মিডিয়ার উপাদানগুলির দ্বারা ইচ্ছাকৃত দমন সত্ত্বেও সত্যটি বেরিয়ে আসছিল এবং কেবল উত্তর আমেরিকাতেই নয়। অপব্যবহার একটি মহাদেশেই সীমাবদ্ধ ছিল না। এমনকি গত পাঁচ বছরে আমি যে প্রমাণ পেয়েছি তার নিতান্তই একটি অংশের মুখোমুখি হওয়া হল অন্ধকারের হৃদয় ভ্রমণ করা ” (পৃ; ৩৪-৩৫)

পৃথক যাজক ব্যতীত, ইয়ালোপ এমন পুরো মণ্ডলীর নাম রাখেন যারা বেশ কয়েকটি দেশে শিশুদের উপর যৌন নির্যাতনের ঘটনাতে অভিযুক্ত, যেন মনে হয় এই অপব্যবহার তাদের অনুসরণ করা প্রয়োজনীয় শৃঙ্খলার অংশ। খ্রিস্টান ব্রাদার্স কংগ্রেগেশন (১৮০২ সালে প্রতিষ্ঠিত) তাদের একটি (পৃ; ৩১)। লিজিওনারিস অফ ক্রাইস্ট (১৯৪১ সালে প্রতিষ্ঠিত) অন্য আরেকটি এবং এটির শুরু থেকেই তার অশুভ প্রকৃতির পক্ষে দাঁড়িয়েছে। শিশুদের বিরুদ্ধে মারাত্মক অপরাধগুলি তখনই প্রকাশিত হয়েছিল যখন এর ভুক্তভোগীরা পূর্ণবয়স্ক হয়েছিল, সুতরাং এই অপরাধগুলি দীর্ঘদিন ধরে চলেছিল।

লিজিওনারি অফ ক্রিস্ট প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ফাদার মার্সিয়াল ম্যাকিয়েল দেগোলাডো, যিনি এর প্রথম সুপিরিয়র জেনারেল হয়েছিলেন। মেক্সিকো এবং লাতিন আমেরিকার অন্যান্য অংশে তাঁর প্রচার দক্ষতা প্রদর্শিত হয়েছিল বলে তাকে অত্যন্ত বিশ্বাস করতেন পোপ জন পলI তিনি পোপের এর প্রিয় ছিলেন। তাঁর মিশনের বিবৃতিটি ছিল “সমাজে খ্রিস্টের সাম্রাজ্য প্রসারিত করা … আমাদের মৌলিক লক্ষ্য হ’ল সকল মানুষকে ভালবাসা জানানো এবং খ্রিস্টকে অন্যের সাথে ভাগ করে নেওয়া, শিক্ষার ক্ষেত্রে দরিদ্রদের সেবা ও প্রচারের ক্ষেত্রে অ্যাপোসোলেট এবং সংস্থাগুলির সাথে ভাগ করে নেওয়া।” ( পৃ; ১৩৩)

অর্ডার বানানোর সময় ম্যাকিয়েল সেই শিশুদের ক্রমাগত  নিপীড়ন করেছিলেন যাদের  তিনি ওই কাজে নিয়োগ করেছিলেন। তিনি ১৯৪০-এর দশক থেকে ৬০ এর দশক; তিন দশক ধরে এই অপরাধ করে চলেছিলেন (পৃ; ৭১)। নিপীড়িতদের মধ্যে নয়জন ১৯৮৯ সালে তাঁর বিরুদ্ধে এসেছিলেন এবং দশম নিপীড়িত তাঁর বিরুদ্ধে বেরিয়ে এসে ১৯৯৯ সালে ভ্যাটিকানে অভিযোগ জানিয়েছিলেন। দশমজন ইতিমধ্যে তাঁর শেষশয্যায়  ছিলেন তবে তাকে এই পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হন কারণ পোপ জন পল দ্বিতীয় একটি বিবৃতিতে সেই কুব্যেক্তিকে  “যুবকদের পক্ষে কার্যকারী একটি গাইড” হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন (পৃ; ৭৫)। অন্য ভুক্তভোগীরা ম্যাকিলের বিরুদ্ধে ক্যানন আইনে মামলা দায়ের করেছিল এবং ক্ষতিপূরণ বা ক্ষমা চায়নি, কেবল ম্যাকিলের যৌন দুর্ব্যবহারের জন্য চার্চের জবাবদিহি চেয়েছিল, তবে ভ্যাটিকান ২০০১ সালে “কারণ বা বিশদ না জানিয়ে” তদন্ত থামিয়ে দিয়েছিল (পৃ; ৭৫)।

গির্জার প্রতি তাঁর পরিষেবার জন্য ভ্যাটিকানের এক  প্রিয়তম ব্যক্তি, ম্যাকিয়েলকে যাজকতন্ত্রের  উপরের অংশের স্তরক্রম দ্বারা প্রতি পদক্ষেপে সহায়তা করা হয়েছিল এবং প্রশ্রয় দেয়া হয়েছিল। ১৯৮২ এবং ২০০৬ দুই ব্রহ্মমুহূর্তে এই অপরাধীদের শাস্তি দেয়ার দায়িত্বে থাকা রাটজিংগারের  কেবল ম্যাকিয়েলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অস্বীকার করে ক্ষান্ত হন নি, বরং তদন্তকে “পবিত্র পিতাকে কোনওরকম বিব্রতকর পরিস্থিতির হাত থেকে বাঁচাতে” বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন (পৃ; ১৩৩)। ইয়ালোপ আমাদের নিশ্চিত শর্তেই  বলেন যে পোপ জন পল দ্বিতীয় ম্যাকিয়েলের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের কথাও জানতেন, স্বেচ্ছায় তাঁর বিরুদ্ধে নালিশ করা শপথপত্রগুলি উপেক্ষা করেছিলেন এবং কার্ডিনাল গ্রোয়ার এবং ম্যাকিয়েল সহ অন্যান্য সক্রিয় পেডোফাইলদের বহু বছর ধরে সুরক্ষিত করে রেখেছিলেন (পৃ; ১৩৩)। ভ্যাটিকানের সহায়তায় ম্যাকিয়েল একটি বৃদ্ধ ব্যক্তির মৃত্যু বোরন করেছিলেন, তবে নতুন কঙ্কালগুলি কক্ষ ভেঙে গুটিগুটি বেরোতে থাকে। ইয়ালোপ লিখেছেন, “… অল্প বয়স্ক ছেলেদের উপর যত্নের নামে ন্যস্ত করা অবিচ্ছিন্ন নির্যাতন ছাড়াও সুযোগবুঝে মহিলাদের সাথে যৌন সম্পর্কেও লিপ্ত হয়েছিলেন । একটি ত্রিশ বছর বয়সী মেয়ে, মাদ্রিদে তাঁর স্বাচ্ছন্দ্যময় মধ্যবিত্ত জীবন থেকে আত্মপ্রকাশ করেন যেখানে তাঁর বাবার সৌজন্যে তিনি অনেক আবাসিক সম্পত্তির মালিক হয়েছিলেন, যিনি তার জন্য তহবিল সরবরাহ করেছিলেন “(পৃ; ১৩৪)। প্রতিষ্ঠাতার মৃত্যুর সময়, এই অর্ডারের ২৫ মিলিয়ন ডলার মূল্যের সম্পত্তি ছিল এবং এর বার্ষিক বাজেট ছিল ৬৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার!

ম্যাকিয়েল হ’ল একজন দুর্বৃত্ত অপরাধীর আদর্শ উদাহরণ; যিনি ক্যাথলিক চার্চের পক্ষে আর্থিক ও আধ্যাত্মিক সাম্রাজ্যের প্রসার ঘটানোর পক্ষে দক্ষ কাজ করেছিলেন এবং যার জন্য তিনি পর্যাপ্ত পরিমাণ পারিশ্রমিক ও সম্মানিত হয়েছিলেন এবং যার “সেবায়” কমপক্ষে দু’জন পোপ তার অপরাধ ক্ষমাঘেন্না করে ভুলে গেছেন। ঘটনাবলীতে পরিষ্কার এই পোপ এবং চার্চ নামক প্রতিষ্ঠানে বিপুল সংখ্যক শিশু ক্ষতিগ্রস্থ জীবনের একেবারেই মূল্য নেই।

অপরাধের রাজ্য

ডেভিড ইয়ালোপ এই বইটি লিখেছেন প্রায় ১০ বছর কেটে গেছে, কিন্তু বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে প্রায় প্রতিদিনই চার্চের যৌন নির্যাতনের ঘটনার সংখ্যা বেড়ে চলা অব্যাহত রয়েছে। এটি আমাদের জানায় যে চার্চ অপরাধ থামাতে বা ভক্তদের বোঝাতে কিছুই করেনি যে এটি একটি বিচ্যুতি, যাজকদের সাধারণ আচরণ নয়। পরিস্থিতির অদ্ভুতভাবে আলাদা  – শিশুদের বিরুদ্ধে অপরাধ করা হয় যাদেরকে প্রথমে নিজের বিরুদ্ধে সমস্ত অপরাধের জন্য নিজেকে দোষী মনে করার শর্তযুক্ত করার পাঠ দেয়া হয়, স্বীকারোক্তিমূলক বাক্স, সমাজে প্রতিষ্ঠানের অসন্তুষ্টি রোধ করার জন্য চার্চের চারপাশে সাবধানে নির্মিত আবহমণ্ডল –

  • অপরাধগুলি বেরিয়ে আসা থেকে রোধ করে
  • যদি এই অপরাধ গুলো বাইরে আসে, তারা অপরাধীদের এবং তাদের ভুক্তভোগীদের জীবনে কোনও বিচার চাইতে গেলে খুব দেরিতে আসে
  • প্রকৃত অপরাধের একটি সামান্য অংশই আজও প্রকাশিত হয়
  • এবং আদালত পর্যন্ত যে সমস্ত অপরাধ গড়ায়, তাদের অপরাধীদের একটি ভগ্নাংশের যথাযথভাবে শাস্তি হয়।

অপরাধীদের পাশাপাশি যারা চার্চের অভ্যন্তরে তাদের জন্য যারা দায়বদ্ধ বা তাদের শাস্তি দেওয়ার জন্য নিযুক্ত, তাদের সবাই এই একনিষ্ঠ ধার্মিকতার হাওয়া তুলে অগণিত উপায়ে সমস্ত অভিযোগ রোধ করে থাকেন। যেমনটি আমরা দেখেছি, চার্চে শিশুদের উপর যৌন নির্যাতনের নিন্দা করার ক্ষেত্রে পোপ এবং কার্ডিনালদের দুর্দান্ত অভিনয় দক্ষতা সত্ত্বেও সামগ্রিকভাবে চার্চের নৈতিক অপরাধবোধ সত্য এবং কেবল অসমর্থিত অভিযোগ নয়। তদুপরি, ইয়ালোপ এই অপরাধীদের ছাড়ার জন্য বিভিন্ন দেশে পুলিশ বাহিনী ও বিচার বিভাগের সদস্যদের উল্লেখ করেছেন।

২০১৪ সালে ধর্মীয় যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে বড় ঘোষণা করার পরেও পোপ ফ্রান্সিস নিজে তার পূর্বসূরীদের পদক্ষেপে হেঁটেছেন এবং তাঁর যাজকদের এবং বিশপদের অপরাধের থেকে আড়াল করেছেন। শিশু নির্যাতনের চেয়ে যেগুলি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় বা তার চেয়ে বেশি অগ্রাধিকার পায় সেগুলি হ’ল চার্চের সুসমাচার প্রচার করে অসহায় বাচ্চা ও মহিলাদের দোহাই দিয়ে অর্থোপার্জন করা।

বৈষয়িক লাভ নিয়ে চার্চের অবিচ্ছিন্ন নির্লজ্জ ব্যস্ততা তার পদস্থ যাজকতন্ত্রের মধ্যে নৈতিক অসচ্চরিত্রতা উত্সাহিত করছে, সংবেদনশীল, অকেজো বিশ্বাসীদের মধ্যে বুক চাপড়ানো  ছাড়া ‘উন্নত’ বিশ্বেও জোয়ার ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো কোনও ব্যবস্থা নেই যার মাধ্যমে তারা এই পুরো ব্যবস্থাটাকে নিয়ন্ত্রণে আন্তে পারেন । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি এবং এর মতো দেশেই যা অসম্ভব, তা বিশ্বের অন্য প্রান্তে কিভাবে সম্ভব হয় ?

এই নৈতিক অসংযম আরও দৃশ্যমান এবং বিস্তীর্ণ যেখানে সমাজ ও রাজনীতিতে চার্চের আনুপাতিকভাবে বেশি প্রভাব রয়েছে, যদিও আমরা কোনও পরিস্থিতিতে বলতে পারি না যে এগুলি অন্য কোনও জায়গায় অস্তিত্বহীন। লোকে খুব কমই বুঝতে পারে যে ক্যাথলিক চার্চ পুরো মানবতার ঘাড়ে ভর করে তার নিজস্ব সংকীর্ণ অস্তিত্ব এবং স্বার্থপর অর্থলাভের জন্য দাঁড়িয়ে আছে ।

বিশ্ব সংস্থাগুলি যে  ক্যাথলিক ধর্মকে শ্রদ্ধার সাথে বিবেচনা করে তা জাতিসংঘে ভ্যাটিকানকে স্থায়ী পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র হিসাবে ১৯৬৪ সালের ৬থ এপ্রিলে নিয়োগ থেকে বোঝা যায়। ইতালির ফ্যাসিবাদী প্রধানমন্ত্রী বেনিটো মুসোলিনি ভ্যাটিকানকে রাষ্ট্রের মর্যাদা দান করেছিলেন ১৯২৯ সালে ল্যাটরান চুক্তির মাধ্যমে। এই মর্যাদা পেয়েই তারা ‘ইউনিয়ন ক্যাথলিক ডি’এডিউডস ইন্টার্নেশনালসের মাধ্যমে লিগ অফ নেশনসকে প্রভাবিত করতে শুরু করেছিলেন, এমন একটি লবি গ্রুপ যার সদস্যদের মধ্যে প্রধানত লীগ কর্মকর্তা হিসাবে নিযুক্ত ক্যাথলিক কর্মীরা ছিল। তারপরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে, জাতিসংঘ ভ্যাটিকানকে একটি ‘স্থায়ী পর্যবেক্ষক’ হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছিল, অন্তর্ভুক্তির কারণ বিশ্বাস করা যায় গোষ্ঠীটিতে বিপুল সংখ্যক খ্রিস্টান বিশ্বাসীর উত্সাহ এবং ইচ্ছা। কিন্তু ভ্যাটিকানকে দেওয়া এই সম্মান কি ন্যায়সঙ্গত?

২০০৯ সালের জুলাইয়ে শিকাগোর বিশপ রায়মন্ড গোয়ার্টের জবানবন্দিতে  অপরাধের প্রতিরোধের উদ্দীপনা সম্পর্কে লিখেছেন: “আমি জানতাম যে নাগরিক আইন যৌন নির্যাতনকে একটি অপরাধ বলে মনে করে তবে চার্চের ক্যানন আইন আমাকে এই জাতীয় বিষয়গুলি গোপনীয়তা অবলম্বন করতে বলে। ডায়োসিসের মধ্যে যাদের জানার অধিকার ছিল কেবল তাদের ব্যতীত আমি কারও সাথেই মামলাগুলির বিষয়ে কথা বলতাম না। ” ইয়ালোপ একই পৃষ্ঠায় মন্তব্য করেছেন:” চার্চ বিশ্বাস করে যে এটি একটি মহত্তর সংস্থা, মনুষ্যনির্মিত আইনগুলির যার তুলনায় নস্যি, যদিও চার্চের ক্যানন আইনটিও মানব-নির্মিত  “(পৃ; ১৭৫)

চার্চের অভ্যন্তরে এবং এমনকি বাইরের লোকদের এই মৌলিক মনোভাব, “মনুষ্যনির্মিত আইনগুলির চেয়ে উচ্চতর অবস্থানে” থাকার বিষয়টি ব্যাখ্যা করে যে কেন বিশপ এবং যাজকদের বিরুদ্ধে আইনী বিচার চলতে থাকে এবং সমস্ত অপরাধী তাদের যথাযথ শাস্তি থেকে ক্রমে রেহাই পায়। বিশপ গোয়েডার্টের সাথে জড়িত মামলাটি অন্যান্য অনেকের মতোই এই চার্চটি কীভাবে বিকৃত এবং অপরাধী যাজকদের কীভাবে সুরক্ষা এবং সহায়তা করে তা বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছিলো। ইয়ালোপ আমাদেরকে মার্ক পার্লম্যানের কথায় বলেন (যিনি একজন ভুক্তভোগীর আইনি প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন) : “এখানকার কার্যপদ্ধতি থেকে পরিষ্কার হয় যে প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ প্রথমে আসে তারপরে সেই মানুষটি, যে অপরাধী। এবং অদূরে অবহেলাতে কোথাও পরে থাকে অপরাধের শিকার। ”

এখানে এমন একটি সংস্থার চর্চা হচ্ছে যে আইনকে নিজের হাতে নিয়েছে এবং অপরাধ ও নৈতিক লাম্পট্য প্রশ্রয় দিয়েছে। ইন্ডিয়ান ক্যাথলিক চার্চে খুন ও ধর্ষণ সহ অনেক হাই প্রোফাইল অপরাধের খবর পাওয়া গেছে, তবে বিচারব্যবস্থার রাষ্ট্রপক্ষের তাদের আইনের ছাতার তলায় আনার দাঁত নেই এবং আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে অপরাধীদের গ্রেপ্তার করার জন্য কোন আগ্রহ নেই। বেশিরভাগ সরকার এবং রাজনীতিবিদ তাদের দিকে নজর দেয় যেন তারা সাধারণ মানুষের চেয়ে অনেক কিছু বেশি। কেন এই অপরাধমূলক প্রতিষ্ঠানকে রাষ্ট্রের রাজ্যগুলির মধ্যে এত উচ্চ মর্জাদাতে রাখা হয়? তাদের কেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কূটনৈতিক অনাক্রম্যতা দেওয়া হয়? ক্যাথলিক চার্চকে তার জাতিসংঘের মর্যাদা ও সমস্ত সুযোগ-সুবিধাগুলি থেকে বঞ্চিত করে তাদের মানবতাবিরোধী সমস্ত অপরাধের জন্য আদালতের কাঠগড়াতে আনা উচিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.