কিন্তু কেন এই বিধিনিষেধ? তা কি শুধুমাত্র আধ্যাত্মিক কারণে? না‚ একদমই না। এর সাথে জড়িয়ে রয়েছে অর্থনীতি ও সামাজিক সুরক্ষার বিষয়টিও। আসলে হিন্দু সংস্কৃতির যাবতীয় নিয়ম রীতিই যৌক্তিক ও মূলগতভাবে বিজ্ঞানসম্মত। শুধুমাত্র সাধারণ মানুষকে সহজে মানানোর জন্যই সেসবের সাথে আধ্যাত্মিকতা জুড়ে দেওয়া হয়েছিল। যেমন সেই কোনো সুপ্রাচীন প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই হিন্দুরা পরিবারের কারও মৃত্যুর পর অশৌচ পালন করে আসছে। এতদিনে হয়তো অনেকের মনেই প্রশ্ন উঠত কেন এই অশৌচ পালনের বিধান? কিন্তু যেই করোনা আসল আর কোয়ারেন্টাইন – আইসোলেশন ইত্যাদি শব্দের সাথে আমরা পরিচিত হলাম‚ তখনই আমরা বুঝতে পারলাম মৃতের বাড়িতে অশৌচ পালনের বিধান কেন দিয়েছিলেন আমাদের পূর্বপুরুষরা। আগে যখন বিজ্ঞান এর উন্নত ছিলো না তখন অপঘাত বাদে বেশিরভাগ মৃত্যু রোগের কারণেই হত। আর সেই রোগ যাতে ছড়িয়ে পড়ে মহামারির আকার না নেয় সেই কারণেই চালু হয়েছিল অশৌচ এর ব্যবস্থা।
ঠিক একইভাবেই যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত ভাবেই নিষিদ্ধ হয়েছিল গোহত্যা। কারণ একটি মৃত গরুর থেকে একটি জীবিত গরু সমাজের জন্য অনেক অনেক বেশী প্রয়োজনীয়!
বিশ্বাস হল না? চলুন যুক্তি দিয়েই দেখা যাক।
একটি সুস্থ গরুর ওজন ধরলাম প্রায় সাড়ে তিন কুইন্টাল। কিন্তু, যখন এটি কাটা হয়, তখন মাত্র 70 কেজি মাংস পাওয়া যায়। এখন এক কেজি গরুর মাংস রপ্তানি করে পাওয়া যায় কমবেশি ৫০ টাকা। অর্থাৎ একটি আস্ত গরুর মাংস থেকে আসছে প্রায় ৩৫০০ টাকা। হাড়ের জন্য ২০০০ টাকা আর রক্তের জন্য খুব বেশী হলে ১০০০- ১২০০ টাকা। অর্থাৎ একটা গরু মেরে কসাইয়ের উপার্জন হচ্ছে খুব বেশী হলে ৭০০০ টাকা। এর বেশী কখনোই নয়। তাও তো এটা শুধুমাত্র সুস্থ ও পূর্ণবয়স্ক গরুর হিসাব। নাহলে টাকার অঙ্ক আরও কমে যাবে।
এখন দেখা যাক একটি জীবিত গরুর থেকে তার মালিকের কি পরিমাণ উপার্জন হতে পারে?
একটা গরু প্রতিদিন ১০ কেজি গোবর আর ৩ লিটার গোমূত্র দেয়। এই ১ কেজি গোবরকে সঠিক পদ্ধতিতে ব্যবহার করলে তা থেকে ৩৩ কেজি সার পাওয়া সম্ভব। না অবাক হবেন না। গোহত্যা নিবারণ সংক্রান্ত একটি মামলায় রাজীব দীক্ষিত এই সমস্ত তথ্যই সরাসরি প্রমাণ সহকারে পেশ করেছেন। আমিও আমার নিবন্ধের শেষে একটি ওয়েবসাইটের লিঙ্ক দিয়ে দেব‚ যেখানে সেই মামলার যাবতীয় বিবরণ তথ্য সহকারে পেয়ে যাবেন।
তো যেখানে ছিলাম। গোবরের উপকারীতা।
গরুর গোবরে রয়েছে ১৮ ধরনের মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট। এগুলির সবকটিই কৃষি জমির জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন। যেমন – ম্যাঙ্গানিজ, ফসফরাস, পটাসিয়াম, ক্যালসিয়াম, আয়রন, কোবাল্ট, সিলিকন ইত্যাদি। অন্যদিকে বাজার চলতি কৃত্রিম সারগুলোতে মাত্র তিনটি পুষ্টি উপাদান আছে। অর্থাৎ এই গোবর সার যেকোনো কৃত্রিম সারেং থেকে ৬ গুন বেশী কার্যকরী।
পেশাগতভাবে কৃষক শ্রী রাজীব দীক্ষিত ও তার পরিবার বিগত ১৫ বছর ধরে এই গোবর চাষ করে আসছেন। তারা আদালতে দেখিয়েছেন যে ১ কেজি গোবর থেকে ৩৩ কেজি সার তৈরি হয়। অর্থাৎ ১০ কেজি গোবর থেকে দৈনিক ৩৩০ কেজি সার পাওয়া যেতে পারে। প্রতি মাসে ১ টন সার দিচ্ছে একটি গরু। যা থেকে দৈনিক উপার্জন হতে পারে ১৮০০ থেকে ১৯০০ টাকা। অর্থাৎ বছরে উপার্জন হচ্ছে প্রায় ৭০‚০০০ টাকা।
আর একটি গরুর আয়ু কম করেও ২০ বছর ধরে নিলে একটি গরু সারাজীবনে শুধুমাত্র গোবরের মাধ্যমেই প্রায় ১ কোটি ৪০ লক্ষ টাকা এনে দিতে পারে তার পালককে। আর এই গোবর সে দেবে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত মানুষের উপকার করে যায় গোমাতা।
আমাদের পূর্বপুরুষরা ধর্মগ্রন্থে লিখেছিলেন যে গোবরে লক্ষ্মী থাকে। সেটা যে সত্যিই থাকে‚ তাদের কথায় যে নূন্যতম ভুল ছিলো না – উপরের তথ্যটিই তার প্রমান।
আর সেই সার ব্যবহার করে শস্য উৎপন্ন হয়। যে শস্যে সারা বছর মানুষের পেট ভরে। অর্থ উপার্জন হয়। সমাজে – সংসারে সমৃদ্ধি আসে। পরোক্ষভাবে তাও কিন্তু গোমাতারই দান।
এবার আসি গোমূত্রের কথায়। ৪৮ ধরনের রোগের জন্য গোমূত্র ব্যবহৃত হয়। যেকোন চাষীই অনায়াসে দুই থেকে তিন লিটার গোমূত্র দৈনিক পেতে পারে। এখন এক লিটার গোমূত্র যদি ওষুধ আকারে বিক্রি করা যায় তবে ভারতের বাজারে পাওয়া যায় ৫০০ টাকা। আন্তর্জাতিক বাজারে স্বাভাবিকভাবেই আরও বেশী মূল্য পাওয়া যায়। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ভারত থেকে নিয়মিত গোমূত্র আমদানি করে এবং ডায়াবেটিসের ওষুধ তৈরিতে তা ব্যবহার করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গোমূত্রের তিনটি পেটেন্ট রয়েছে।
মার্কিন বাজারের হিসাবে ধরলে এক লিটার গোমূত্র থেকে ১২০০ থেকে ১৩০০ টাকা অনায়াসে আয় করা সম্ভব। অর্থাৎ, একটি গরু বছরে খুব কম করেও প্রায় ১২ লাখ টাকা উপার্জন করাতে পারে গোমূত্র থেকে। মানে ২০ বছরের জীবনে আসছে দুই থেকে আড়াই কোটি টাকা।
আবার গোবর থেকে মিথেন গ্যাসও তৈরি হয়। বর্তমানে এই গ্যাস গৃহস্থালীর কাজে যথেষ্ট জনপ্রিয়। এছাড়াও একটি চার চাকার গাড়ি যেমন এলপিজিতে চলতে পারে, তেমনি এই গ্যাসেও চলতে পারে। শ্রী দীক্ষিত এটাও আদালতে প্রমাণ করে দেখিয়েছেন।
আর এই গ্যাসে প্রতি কিলোমিটারে খরচ হয় ৫০ থেকে ৬০ পয়সা। যেখানে ডিজেলে খরচ হয় প্রতি কিলোমিটার ৪ টাকা। এছাড়াও মিথেনে চলা গাড়িগুলো থেকে কোনো ধোঁয়া বের হয় না‚ কোনো সীসা নির্গত হয় না আর শব্দও কম হয়। অর্থাৎ পরিবেশ দূষণ হয় নামমাত্র
তাহলে একটি গরুর ২০ বছরের জীবনে প্রতিদিন ১০ কেজি গোবর থেকে কত গ্যাস পাওয়া যেতে পারে আপনারাই ভেবে দেখুন।
আমাদের ভারতে কমবেশি ১৭ কোটি গরু রয়েছে। তাদের গোবর সংগ্রহ করা হলে দেশের ১ লাখ ৩২ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হবে( শ্রী দীক্ষিতের দেওয়া হিসাব)! এছাড়াও আরব দেশগুলোতে বেফালতু গাদাগুচ্ছের টাকা পাঠানো বন্ধ হবে। মার্কিন ডলারে পেট্রোল কেনা কমবে। আন্তর্জাতিক বাজারে রুপি শক্তিশালী হবে।
এবার কি বুঝতে পারছেন কেন বলা হয় গোহত্যা না করতে? মৃত গরুর থেকে জীবিত গরু যে অনেক অনেক বেশী উপকারী‚ তা তো বোঝা গেল?
এছাড়া গোহত্যা করলে গরুর প্রজননও ধাক্কা খায়। গোহত্যা বন্ধ করে প্রজনন বাড়ালে আমরা আমরা গ্যাসও রপ্তানি করতে পারব। জ্বালানি নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না। আমরা আমাদের বাচ্চাদের বেশি দুধ খাওয়াতে পারব‚ আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বলশালী হবে।
হ্যাঁ এবার একটা প্রশ্ন উঠতেই পারে তবে কি গোহত্যা নিষিদ্ধ করলে মুসলমানরা কোনো ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার হবেন? গোহত্যা কি তাদের ধর্মীয় অধিকার কিংবা ধর্মীয় কর্তব্যের মধ্যে পড়ে?
উত্তর হল যে একেবারেই না। কর্তব্য তো না‚ ধর্মীয় অধিকারও নয়।
কোরান শরীফ কিংবা হাদিস খুলে দেখুন‚ কোত্থাও লেখা নেই যে মুসলমান হতে গেলে গোহত্যা করা আবশ্যক কর্তব্য। আপনি এমন কোনো দলিল দেখাতে পারবেন না যেখানে লেখা আছে গোহত্যা ইসলামের মৌলিক অধিকার!
যাইহোক‚ রাজীব দীক্ষিতের যে মামলার কথা প্রথম দিকে বলেছিলাম তার রায় কোর্ট দিয়েছিল ২৬ শে অক্টোবর‚ ২০০৫ এ। সেই রায়ের একটি অনুলিপি পাওয়া যাবে
www.supremecourtcaselaw.com সাইটে।
এই রায় দিয়ে আক্ষরিক ইতিহাস সৃষ্টি করেছে আদালত।
রায়ে আদালত বলেছেন, গরু হত্যা সাংবিধানিক অপরাধ এবং ধর্মীয় পাপ। গবাদি পশু রক্ষা ও লালন-পালন করা হল প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য। এটা সরকারের দায়িত্ব। কিন্তু নাগরিকদেরও তা করা উচিত।
এখন পর্যন্ত যেসব সাংবিধানিক দায়িত্ব ছিলো (যেমন জাতীয় পতাকাকে সম্মান করা, বিপ্লবীদের সম্মান করা, দেশের অখণ্ডতা ও ঐক্য বজায় রাখা ইত্যাদি ), তার সাথে এখন গোরক্ষাও সাংবিধানিক দায়িত্ব হিসাবে সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।
এই প্রসঙ্গে আরেকটি বিষয় বলি আপনাদের! ১৯৯৮ সালে ভারত পরমানু বোমার পরীক্ষা করার পর অন্যান্য শক্তিশালী দেশগুলো ঈর্ষান্বিত হয়ে ভারতের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। কিন্তু সেই নিষেধাজ্ঞার প্রায় কোনো প্রভাবই ভারতের উপর পড়ে নি। পরবর্তীতে এই নিয়ে বিভিন্ন দেশে‚ বিশেষত আমেরিকায় অনেক গবেষণা হয়। যে একটি দেশ সারা দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েও কিভাবে এমন দৃঢ়তার সাথে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। আসলে ভারতের আছে তিনটি প্রধান শক্তি –
১. ঐতিহ্যগত কৃষি
২. পরিবার ব্যবস্থা
৩. ভারতীয় নীতি মূল্যবোধ
গো পালন ও গো রক্ষা এই তিনটির সাথেই ওতোপ্রতভাবে জড়িত।
আর এই তিনটি জিনিস যতদিন ভারতে থাকবে ততদিন হাজারও আক্রমনের মাঝেও ঠিক অটল হয়ে থাকবে ভারত। তাই এই তিনটি ব্যবস্থা ধ্বংস করতেই বিভিন্নভাবে উঠেপড়ে লেগেছে বিদেশী শক্তিগুলো। তা সে মিডিয়ার মাধ্যমে হোক‚ বিভিন্ন ধ্বংসাত্মক মতাদর্শ ছড়ানোর মাধ্যমে হোক‚ শিক্ষার নামে কুশিক্ষা দিয়ে হোক বা চটজলদি লাভের লোভ দেখানো হোক। ভারতকে ধ্বংস করার কোনো চেষ্টাই তারা বাকি রাখেনি।
গোহত্যা বৃষ্টি ও গোহত্যার পক্ষে প্রচার সেই ভারত বিরোধী কর্মকাণ্ডেরই অংশ মাত্র।
এই ষড়যন্ত্র সম্পর্কে আমাদের সবাইকে অবশ্যই সতর্ক থাকতেই হবে।
সৌভিক দত্ত