চূর্ণা নামে নদী। তীরবর্তী কালসা নামে গ্রাম। জেলা এর্ণাকুলম। ত্রিচুরের বৃষাচলমের শিবালয়ে ‘ভজনম্’ করলেন সতী সাধ্বী আর্যাম্মা, সঙ্গে তাঁর স্বামী শিবগুরু। দেখা দিলেন স্বয়ং মহাদেব। বললেন, একটা ক্ষীণজীবী প্রতিভাধর সন্তান চাই?না দীর্ঘজীবী মূর্খ বহু সন্তান চাই? আর্যাম্মা বললেন, একটি সন্তানই হোক — সে যেন মেধাবী হয়। মহাদেব স্বয়ং জন্ম নেবেন বলে স্থির করলেন। বৈশাখ মাসে পুনর্বসু নক্ষত্র এক জ্যোতির্ময় বিন্দু এসে মিলল আর্যাম্মার পবিত্র গর্ভে।
লোককথার আশ্চর্য নির্মাণ সরিয়ে রাখি। সপ্তম শতাব্দীর শেষ দিকে দেশে ধর্ম ক্ষেত্রে বিপর্যয় অবক্ষয় আত্মদ্বন্দ্ব আর অহঙ্কৃত আস্ফালন। বৈদিক নিষ্ফল আচার আচরণকেই কর্মানুষ্ঠানের পরাকাষ্ঠা ভাবা, মীমাংসকদের এই যুক্তি ক্ষুরধার বুদ্ধি মেধা মনন আর আধ্যাত্মিক শক্তিতে পরাস্ত করলেন তাঁদের। গুরু গোবিন্দ ভাগবৎ পদ আর পরমগুরু গৌড়পদ তাঁকে বলেন, বহুবিভক্ত হিন্দু সমাজের ব্যক্তিগত , গোষ্ঠীগত আর চিরাচরিত ধ্যান ধারণাকে আঘাত না করে বৈদান্তিক জ্ঞানকে ছড়িয়ে দিতে হবে। বৈষ্ণব শৈব শাক্ত সৌর গাণপত্য আর কৌমার এই পঞ্চোপাসকদের সঙ্গে বিতর্কে লিপ্ত হলেন।
মীমাংসক শ্রেষ্ঠ কুমারিল ভট্ট তাঁর সামনে তুষাণলে আত্মত্যাগ করলেন। কারণ উনি গুরু বৌদ্ধদের সঙ্গে বিশ্বাস-ঘাতকতা করেছে, আর মীমাংসা দর্শন মিথ্যা! মীমাংসক মণ্ডন মিশ্র তর্কে পরাস্ত হয়ে স্ত্রী বিদূষী সরসবতীর সঙ্গে শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেন। নাম হল সুরেশ্বর। যেমন গুরু তেমন শিষ্য।
বৌদ্ধধর্ম তখন অবক্ষয়িত। আভ্যন্তরিক সংগঠন বিভক্ত আর ক্ষয়িষ্ণু নৈতিকতায় তন্ত্র চক্র সহজে বেপথু। কুমারিল ভট্ট তাদের ‘প্রলাপ ভাষিতম্’ বলে নির্জিত করেছেন। শঙ্করাচার্য দক্ষিণ থেকে উত্তর দ্বারা থেকে পুরী, বদরিকা আশ্রম থেকে রামেশ্বরম্ কাঞ্চী থেকে কাশী ঘুরলেন।
শিব ধ্বংস করে, শঙ্করাচার্য শিবাবতার হলেও ভারতের চার ধামে শঙ্করমঠ, সন্ন্যাসীবর্গকে দশটি গোষ্ঠীতে নিয়মিত বিভাজন ভারতবর্ষকে চিরস্থায়ী ধর্ম-ধারায় আনার এমন কৃতিত্ব অবিশ্বাস্য অবিস্মরণীয়।
আর ভারতীয় দর্শন তাঁকে অতিক্রম করতে পারেনি, পারবে কি না জানি না। আর কাব্য শিল্প ? মোহমুদ্গর, ভজগোবিন্দম্ স্তোত্র ? ব্রহ্মসূত্রের ভাষ্য? বৃহদারণ্যক মাণ্ডুক্যোপনিষদের টীকা ? সর্বোপরি ‘সৌন্দর্যলহরী’!
দেহের আবরণ ত্যাগ করলেন মাত্র ৩২ বৎসর বয়সে! আসন্ন শঙ্করের আবির্ভাব দিবসে তাঁর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা॥