দ্বিতীয় পর্ব

যক্ষের বিরহ চলে অবিশ্রাম অলকার পথে

          পবনের ধৈর্যহীন রথে

বর্ষাবাষ্প-ব্যাকুলিত দিগন্তে ইঙ্গিত-আমন্ত্রণে

          গিরি হতে গিরিশীর্ষে, বন হতে বনে।

সমুৎসুক বলাকার ডানার আনন্দ-চঞ্চলতা

তারি সাথে উড়ে চলে বিরহীর আগ্রহ-বারতা

          চিরদূর স্বর্গপুরে,

ছায়াচ্ছন্ন বাদলের বক্ষোদীর্ণ নিশ্বাসের সুরে।

নিবিড় ব্যথার সাথে পদে পদে পরমসুন্দর

          পথে পথে মেলে নিরন্তর।

বারো বৎসর ভবদেব নাগিলার বিরহে অতিক্রান্ত করলেন। গুরু সুস্থিতির আশ্রমে কঠিন সংযমেও তিনি নিজের মন ও মস্তিকে নাগিলার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করলেন। ক্রমে তিনি যৌবনের প্রান্ত সীমায় উত্তীর্ণ হলেন। কালক্রমে ভবদেবের অগ্রজ ভ্রাতা মহামুনি ভবদত্ত প্রায়োপবশেনে দেহত্যাগ করেলেন। 

জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার মৃত্যুর পর কিছুদিন অতিবাহিত হল। অগ্রজের মৃত্যুতে ভবদেব বড় কষ্ট পেলেন। এই সঙ্ঘে তাঁর নিজের বলতে সেভাবে কেউ রইল না। অবশ্য সন্ন্যাস তাঁর কোনোদিন ঈপ্সিত বিষয়ও ছিল না। সন্ন্যাস তাঁর স্বেচ্ছায় হলে আপন পর ইত্যাদি চিন্তা মনে আসত না। কেবল অগ্রজের মান রাখার জন্যই এই পথে আসা।একাকিত্বে দিন অতিবাহিত করতে করতে একদিন তিনি ভাবলেন , ” এই যে একলা ভাব, এই যে মনের মধ্যে গুমরে মরা কষ্ট, এই যে নিশ্চল , নিশ্চুপ জীবন;  একে এক ও একমাত্র নাগিলাই পূর্ণতা দিতে পারবে। তাছাড়া ভ্রাতার মৃত্যুর পর সেই সব সন্ন্যাস জাতীয় প্রভাবও আমার মধ্যে নেই। কেবল অগ্রজের আগ্রহে এককালে আমি হঠকারী হয়ে বন্ধন নিয়েছিলাম, সেসব বন্ধন থেকে আজ আমি মুক্ত। অপূর্ব সুন্দরী নাগিলার প্রেম ও বিবাহ ভেঙে যাওয়ার সেই কাতর দৃষ্টি আমি আজও ভুলতে পারিনি। সে বড় অভাগিনী। সে কি আমায় ভুলে গেছে ? সে কি এখন বিবাহিতা ? কোনো অন্য সংসারে হয়ত সেই এখন এক ও একমাত্র কর্ত্রী। হয়ত কোনো রাজার ঘরের রাণী। নাকি আমার সেই উপেক্ষার পর সে মরেছে?  দূর দূর….ছাই হোক এসব সন্ন্যাস। আর কতকাল আমি বিরহ জ্বালায় জ্বলব? আমি সঙ্ঘ ত্যাগ করব ।  গ্রামে ফিরে গিয়ে নাগিলার অন্বেষণ করব। যদি , খুঁজে পাই তবে সে যে অবস্থায় থাকুক তাকে নিয়ে পুনশ্চ আমি সংসারী হব। “

 আমি     কার পথ চাহি এ জনম বাহি,

                   কার দরশন যাচি রে!

     যেন     আসিবে বলিয়া কে গেছে চলিয়া,

                   তাই আমি বসে আছি রে।

অতঃপর ভবদেব রাতের আঁধারে সঙ্ঘ ত্যাগ করে সুগ্রামের পথে চললেন। পথে যেতে যেতেও নাগিলার কথায় ভাবুক হয়ে গেলেন। সকল দেহ, মন, অনুভব জুড়ে কেবল নাগিলা, নাগিলা , নাগিলা। এত বছর ধরে কেবল নাগিলারই নাম ভজন করেছেন। সুগ্রামে উপস্থিত হয়ে গাঁয়ে শেষে আদিযোগী দেবাদিদেবের এক প্রাচীন  মন্দিরে আশ্রয় নিলেন। সন্ন্যাসী দেখে মানুষজন ভিক্ষাও দিচ্ছিল। ব্রতে থেকে শুদ্ধ মনে ব্রত পালন করলে মানুষের মধ্যে সকল চক্রের জাগরণ হয়ে , তাতে মানব দেহে এক দৈব জ্যোতির উন্মেষ ঘটে, কোনো কষ্ট , শোক , তাপ তাকে ভঙ্গুর করতে পারে না।।  সে মূর্তি হয় অন্য। কিন্তু ব্রতে থেকে শুদ্ধভাবে তার পালন না হলেও মানব শরীরে প্রভাব আসে, সেটা ক্লিষ্টতার প্রভাব। ভবদেবেরও সেই দশাই হয়েছিল। সেই কারণে গাঁয়ের প্ৰাচীন মানুষজনও তাঁকে চিনতে পারে নি। 

এই ভাবে মন্দিরের প্রসাদ ও ভিক্ষান্নে কিয়দ্ কাল ভবদেবের অতিবাহিত হল। কিন্তু অতীত কর্মের জন্য লজ্জায় হোক বা সম্মান ক্ষয়ের ভয়ে সন্ন্যাসী ভবদেব কাউকেই সাহস করে নাগিলা অথবা নিজের পরিবার পরিজন সম্পর্কে প্রশ্ন করতে পারলেন না। নাগিলাকে সন্ধান করবেন এরূপ যে ভীষণ পন নিয়ে আশ্রম ত্যাগ করেছিলেন গাঁয়ে পৌঁছে সেই পন সম্মানের ভয়ে অনেকাংশে স্থিমিত হয়ে গিয়েছিল।

দুই তীরে তার বিরহ ঘটায়ে

            সমুদ্র করে দান

অতল প্রেমের অশ্রুজলের গান॥  

গাঁয়ের মানুষ সন্ন্যাসীকে ভক্তি যত্ন করতে লাগলেন ক্রমে। সন্ন্যাসীর খবর কালের নিয়মে সমগ্র গাঁয়ে ছড়িয়ে পড়ল। একদিন প্রাতে সদ্য স্নাতা দুই নারী মন্দির প্রাঙ্গনে উপস্থিত হলেন । একজন অবিবাহিতা যুবতী এবং একজন প্রৌঢ়া। যুবতীটি ভারী সুন্দরী। সদ্য স্নাতা এলো কালো চুলে , প্রসাধন হীন নির্ভেজাল সৌন্দর্য শিশির মাখানো সদ্য প্রস্ফুটিত পদ্মের ন্যায়ই বড় স্নিগ্ধ সেই রূপ। পূজান্তে ভবদেবকে দর্শনের নিমিত্ত মন্দিরের পিছনে গিয়ে দাঁড়ালেন। তখন প্রভাতের তপন আপন রক্তিম আভায় মন্দির ও সংলগ্ন অরণ্যকে ধৌত করে পবিত্র করছেন। 

সন্ন্যাসীকে আপ্যায়নের নিমিত্ত দুই নারী ফলমূল ইত্যাদি নিয়ে সন্ন্যাসী সম্মুখে উপস্থিত হলেন। সন্ন্যাসী যুবতী নারীকে দেখে কম্পিত হয়ে উঠলেন, চক্ষুদ্বয়ে বাষ্পাকুল হয়ে উঠল। এ কি দেখেছেন তিনি ? সেই নববধূ সজ্জায় সজ্জিতা কন্যা আজ কেবলমাত্র শ্বেত বস্ত্র ধারণ করে নিরালঙ্কার , নিরাভরণ হয়ে রক্ত কমল থেকে শ্বেত পদ্মে পরিণত হয়েছেন। সেই শ্বেতময়ী কি এই হতভাগা সন্ন্যাসীকে চিনতে পারছেন? হায়, হায়…! হে আদিযোগী মহাদেব এ তোমার কোন লীলা ?

ভবদেবের কন্ঠরূদ্ধ হয়ে এল । নারীদ্বয়কে কম্পিত কন্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন , ” এই গাঁয়ে আর্যবান্ রাষ্ট্রকূট এবং তাঁর স্ত্রী রেবতী বাস করতেন …তাঁদের দুই সন্তান ছিল…সেই দম্পতি ও তাঁদের পরিবারের কি কোনো সংবাদ দিতে পারেন ? তাঁরা কি জীবিত? ” প্রৌঢ়া উত্তর দিলেন , ” না না ! সে তো বহুকাল হল তাঁরা দেহ রেখেছেন। সেই ছোট ছেলেটা বিয়ের আসর ছেড়ে সন্ন্যাস নিল.. তারপর আর বেশিদিন তাঁরা সেই শোক সহ্য করতে পারেন নি। “

স্নিগ্ধ যুবতীটি অনিমেষ দৃষ্টিতে সন্নাসীকে অবলোকন করছিলেন। ভবদেব অশ্রুসজল নয়নে পুনরায় প্রশ্ন করলেন , ” তাঁর ভাবী স্ত্রী কে সেই কনিষ্ঠ সন্তান বিবাহের দিন ত্যাগ করে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার মার্গ গ্রহণ করেন । সেই কন্যার কি হল ? তিনি কি জীবিত ? তিনি কি অন্য কোনো স্থানে বাস করেন এখন ?”

যুবতী দীর্ঘশ্বাস চেপে রেখে, বিস্ময়ে প্রশ্ন করলেন , ” আপনি কে ? আপনি ….আ… তুমি ভবদেব ? তুমি না ভিক্ষু আশ্রমে ছিলে ? হিসাব অনুসারে তুমি এখন সবে ব্রহ্মচারী শেষ করে কসুল্লাক পর্যায়ে প্রবেশ করবে! “

ভবদেব ভিক্ষাপাত্র খানি ফেলে উঠে দাঁড়ালেন , যুবতীর হস্ত দৃঢ়বদ্ধ ভাবে আপন শীর্ণ করে চেপে বললেন , ” নাগিলা…. নাগিলা…তুমি আমাকে চিনতে পেরেছ ? নাগিলা আমি তোমার ভবদেব নাগিলা। কত দিন , কত দিন হয়ে গেল …তুমি কত সুন্দর নাগিলা! আমি ভুল করেছিলাম । আমাকে ক্ষমা কর। “

নাগিলা কোনো প্রশ্নের উত্তর দিলেন না। অগ্নি প্রশমিত চক্ষে নিজের হাত জোরপূর্বক ছাড়িয়ে নিয়ে ছিন্ন ধনুকের ন্যায় দূরে সরে গেলেন। তখন নাগিলার নিঃশ্বাস চেপে, শান্ত অথচ দৃঢ় কন্ঠে বললেন , ” তুমি এই স্থানে কেন এসেছ ? কেন ? আমাকে ছুঁলে কোন স্পর্ধায় ?”

ভবদেব আকুল কন্ঠে বললেন , ” নাগিলা এ কথাও তুমি জিজ্ঞাসা করছ ?  এমন কথাও জিজ্ঞাসা করা যায় ? তোমাকে ভুলে আমি গত বারো বৎসরে আমি নিঃশ্বাস গ্রহণ করি নি। নাগিলা তোমায় ভুলে আমি কেমন করে শান্তি পাব ।”

নাগিলা গম্ভীর কন্ঠে বললেন , ” তুমি আশ্রম থেকে এখানে কি করে ? তোমাকে তো এখন অনুমতি দেবেন না তোমার গুরুদেব ? তাহলে …..তাহলে ! তুমি ….তুমি….তুমি আশ্রম থেকে পলায়ন করেছ!  তুমি একটা সম্পূর্ণ জীবন জুড়ে কেবল পলায়ন করতে পার । কাপুরুষ !”

ভবদেব কোনো উত্তর না দিয়ে অবনত মস্তকে দণ্ডায়মান রইলেন। নাগিলা ছুটে মন্দির প্রাঙ্গণ হতে চলে গেলেন। 

সেদিনকার পৃথিবী জেগে উঠেছিল

        উচ্ছল ঝরনায়, উদ্‌বেল নদীস্রোতে,

               মুখরিত বনহিল্লোলে,

তার সঙ্গে দুলে দুলে উঠেছে

        মন্দাক্রান্তা ছন্দে বিরহীর বাণী।

একদা যখন মিলনে ছিল না বাধা

    তখন ব্যবধান ছিল সমস্ত বিশ্বে,

বিচিত্র পৃথিবীর বেষ্টনী পড়ে থাকত

           নিভৃত বাসরকক্ষের বাইরে।

মন্দির হতে গৃহে ফিরে নাগিলা সেদিনের সকল গৃহ কর্ম অসমাপ্ত রেখে প্রৌঢ়ার নিকট বসলেন। তাঁর হৃদয় আকাশে র জলভার কৃষ্ণবর্ণ বর্ষার মেঘের ন্যায়ই ভারাক্রান্ত।  বৃদ্ধা জিজ্ঞাসা করলেন , ” মন ছোট করবে না । যাঁর নামে তুমি এত বছর ভাবী শ্বশুরবাড়ি থেকে তোমার নিজের পিতা মাতার ন্যায় তোমার ভাবী শ্বশুর , শাশুড়ি সেবা করেছ , যে ঈশ্বরকে সাক্ষী রেখে তোমার এই ব্রত তিনিই তোমাকে পথ দেখাবেন।”

অকস্মাৎ নাগিলার দৃষ্টি গৃহদেবতার সম্মুখে রাখা একটি ক্ষুদ্র দুধের পাত্রের উপর পড়ল। নাগিলা সেদিকে তাকিয়ে বাষ্পাচ্ছন্না  চক্ষে বললেন ,  ” একটা কাজ করতে পারবে ঠান বুড়ি? “

বৃদ্ধ প্রৌঢ়া বললেন , ” বল মা। কি কর্ম ?”

নাগিলা বললেন , ” গাঁয়ের মাঠে পার্শ্ব গৃহের শিশুটি কাদা নিয়ে খেলছে একবার ডেকে আনতে পার ? দরকার আছে।”

পরদিবস প্রাতঃ কালে নাগিলা প্রতিদিনের মতো মন্দিরে উপস্থিত হলেন।  দেবাদিদেবের পূজা দান পূর্বক মন্দির প্রাঙ্গনে পুনরায় ভিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে দাঁড়ালেন। ভবদেব সারারাত্রি বিনিদ্রিত হয়ে না জপ , না তপ .. নাগিলার কথা চিন্তা করে  ; প্রভাতে নাগিলা মন্দিরে আসতেই মন্দির প্রাঙ্গনে উপস্থিত হলেন। ভিক্ষার আশায় । এ ভিক্ষা অন্ন ভিক্ষা নয়। এ ভিক্ষা যৌবনের সূচনায় ত্যাগ করা সুন্দরী এবং বতর্মান যুবতী নাগিলাকে আপন দেহ ,মন , সত্তা সকল কিছু দিয়ে পাওয়ার ভিক্ষা। সে ভিক্ষার আকুতি বিগত বারো বৎসর ধরে তাঁর হৃদয়কে বিদীর্ণ করেছে। আজ প্রথম প্রভাতে সেই ভিক্ষা যদি তিনি নাগিলার নিকট যাচেন , তবে নাগিলা তাঁকে ফিরিয়ে দিতে পারবেন না।

আমি যখন তাঁর দুয়ারে ভিক্ষা নিতে যাই   তখন যাহা পাই

              সে যে আমি হারাই বারে বারে ॥

তিনি যখন ভিক্ষা নিতে আসেন আমার দ্বারে

বন্ধ তালা ভেঙে দেখি আপন-মাঝে গোপন রতনভার,

হারায় না সে আর ॥

প্রভাত আসে তাঁহার কাছে আলোক ভিক্ষা নিতে,

সে আলো তার লুটায় ধরণীতে।

তিনি যখন সন্ধ্যা-কাছে দাঁড়ান ঊর্ধ্বকরে,  তখন স্তরে স্তরে

ফুটে ওঠে অন্ধকারের আপন প্রাণের ধন–

মুকুটে তাঁর পরেন সে রতন ॥

না স্নান, না আচমন …অশুচি , অশুদ্ধ অবস্থায় ভবদেব ভিক্ষাপাত্র খানি হস্তে নিয়ে ব্যগ্রভাবে প্রসারিতকরে দুই পা সম্মুখে অগ্রসর হয়ে উচ্চারণ করতে গেলেন , “

ভগবতী ভিক্ষাং দেহী …”

কিন্তু তার পূর্বেই একটি ছোট্ট ছেলে এসে নাগিলার সুমুখে দাঁড়াল। তার পরনে  ছিন্ন বস্ত্র। সবে স্নান করে এসেছে। মাথার চুল , বস্ত্র থেকে জল ছুঁইয়ে পড়ছে। হাত জোড় করে বালকটি নাগিলাকে বললে , ” মা , মা গো কিছু খেতে দাও , একটু অন্ন দাও মা। কাল থেকে কিছুই খাইনি। শুনেছি তুমি প্রতিদিন সকালে এই মন্দিরে খাবার ও ধন দান কর। …. আমি কাল রাত্রে কেবল কিছু দুধ খেয়েছি মাত্র!”

 নাগিলা কিছু ভিক্ষা নিয়ে বালকটির হাতে দিতে গেলে , বালকটি বলল, ” দাঁড়াও মা, তোমার দেওয়া ভিক্ষা খাবার আগে কাল রাত্রির খাওয়া দুধ টুকু আমি মন্দিরের বাইরে বমন করে আসি। তারপর তোমার ভিক্ষা ও অর্থ নেব। তোমার ভিক্ষা ও ধন গ্রহণ এবং খাওয়ার পর পুনরায় সেই বমন করা দুধ টুকু আমি গিয়ে চেটে খাব।”

এসব কথা শুনে বড় ঘৃণা উৎপন্ন হল ভবদেবের। ছিঃ , কি নিম্ন চিন্তার বালক। প্রভাত কালে এমন বাক্য শুনলে…. ছিঃ ছিঃ। ভবদেব সব শুনে বালককে বললেন , ” ওহে বালক, এ কেমন মূর্খ এবং নিম্ন রুচির কথা বলছ ? তোমার গৃহে কি কোনো শিক্ষা দান হয় নি ? যে দুধ তুমি বমন করবে সেই দুধ তুমি পুনরায় চেটে খাবে ? কি ঘৃণিত কথা ? তুমি দরিদ্র হতে পারো তা বলে …! ছিঃ ছিঃ!”

ভবদেব কতৃর্ক সেই ধিক্কার ও টিপ্পনী শুনে শান্ত কন্ঠে নাগিলা বললেন, ” বালকটি ভুল কি বলেছে ? হে সন্নাসী তুমি যদি বহু বৎসর পূর্বে ত্যাগ করে যাওয়া অবিদ্যা স্বরূপ ষড়রিপুর সংসারে ফিরতে চাইতে পার ,তবে শিশুটি কিভাবে ভিক্ষা গ্রহণের পর নিজের বমন করা দুধ চেটে খেতে পারবে না ? যাকে ত্যাগ করা যায় বা যা ত্যাগ করে সন্ন্যাসী হওয়া যায় , তাকে পুনশ্চ গ্রহণ করে নিজের শরীরে ও জীবনে ধারণ করা যায় এত তুমিই শিখিয়েছ। তুমি সেই জন্যই তো রাত্রি অন্ধকারে আশ্রম ত্যাগ করে অপরাধী, চোর , কাপুরুষের ন্যায় পলায়ন করেছ। তুমি পারলে শিশুটির কি অপরাধ ?”

ভবদেব নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। একটি টিট্টিভ পাখি প্রভাতের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে কোথায় যেন উড়ে গেল। সূর্যদেবের তেজ আজ যেন অসহনীয় হয়ে উঠছে ভবদেবের নিকট। আশ্রমিক জীবনে নাগিলার নাম নিয়ে করা নানা কর্মের কথা চিন্তা করে তাঁর বিবেক আজ কি প্রচন্ড দংশন করছে। কেউ যেন জোর করে আজ তাঁর অভ্যন্তরের মুখখানি দর্পনে দেখিয়ে ধিক্কার দিয়ে বলছেন, ” দেখ , দেখ ভবদেব। তুমি কত কুৎসিত। কত বিশ্রী….আদিদেব নটরাজ রূপে অপ্সমারকে দমন করতে পেরেছিলেন , কিন্তু তোমার মতো নিম্ন মনোবৃত্তির মানুষজন সেই সব দুষ্ট শক্তিদের ধারণ স্থল। …” ভবদেবের কপাল, গন্ডদেশে বিন্দু বিন্দু স্বেদ জমে উঠল। 

 নাগিলা দৃপ্ত কন্ঠে বললেন , ” শোনো ভিক্ষু , শোনো সন্ন্যাসী ; তুমি এত দুর্বল আমি জানতাম না। জানতাম না তোমার মস্তিককে পাগল হস্তী পরিচালনা করে। তোমার সন্ন্যাস মার্গে নানা পন্থে বহু ব্যক্তি চলে মুক্তি লাভ করেছেন। তুমি ভালো করে জানো যে জন্ম এবং মৃত্যুর চক্র থেকে মুক্তিলাভ করার এক অন্যতম পথ হল সন্ন্যাস । সে তুমি যে পন্থ বা মার্গে সন্ন্যাস গ্রহণ করো না কেন ? “

হায় রে ভিক্ষু, হায় রে,

নিঃস্বতা তোর মিথ্যা সে ঘোর,

       নিঃশেষে দে বিদায় রে।

ভিক্ষাতে শুভলগ্নের ক্ষয়

       কোন্‌ ভুলে তুই ভুলিলি,

ভাণ্ডার তোর পণ্ড-যে হয়,

       অর্গল নাহি খুলিলি।

আপনারে নিয়ে আবরণ দিয়ে

       এ কী কুৎসিত ছলনা;

জীর্ণ এ চীর ছদ্মবেশীর,

       নিজেরে সে কথা বল না।

হায় রে ভিক্ষু, হায় রে,

       মিথ্যা মায়ার ছায়া ঘুচাবার

             মন্ত্র কে নিবি আয় রে।

ভবদেব বিস্মিত হলেন । তিনি এত বৎসর আশ্রমিক জীবনে যে শিক্ষার সারাংশ টুকু উপলব্ধি করতে পারেন নি, আজ নাগিলা কত সহজে সেই টুকু বলে দিলেন। 

ভবদেব দেখলেন , নাগিলার চক্ষু দুইটি দুঃসহ তেজে প্রদীপ্ত হয়ে উঠেছে পুনরায় । নাগিলা তাঁর দিকে তাকিয়ে বললেন, ” তুমি আমাকে সংসার সুখে সুখী করনি বটে কিন্তু তোমার অপূর্ব ত্যাগের গৌরবে আমি যে চির গরবিনী ছিলাম। তুমি যেদিন তোমার গুরুর সঙ্গে পরিচিত হলে, সেদিনই তোমার গুরু আমাকেও দীক্ষা দিয়েছিলেন। আমি সেই দিন হতে শীলব্রত গ্রহণ করেছিলাম। তোমার গুরু আচার্য সুস্থিতি আমারও গুরু। তাঁরই আদেশে সেদিন হতে তোমার গৃহ ও পিতামাতাকে আপন ভেবে তাঁদের সেবা করেছি।

আজ তুমি নিজে তো নিজের ব্রত ভেঙ্গেইছ , উপরন্তু আমার ব্রতভঙ্গ করে তুমি আমার চিরদিনের সুখ স্বপ্ন ভেঙ্গে দিতে এসেছ ? কেন ? কি ক্ষতি করেছি আমি তোমার? আমাকে তুমি ভোলো নি সে আমার পরম সৌভাগ্য , কিন্তু সেই আমি কি কেবল এই রক্তমাংসের খাঁচাটা ? সেই রক্ত মাংস পিণ্ডের লোভেই কি তুমি বারো বৎসর নিজের সংযম নষ্ট করেছ ? সেই লোভেই কি তুমি সংযম নষ্ট করে পুনরায় এই গ্রামে নিজের বমন চেটে খেতে এসেছ ? “…..

কাঙাল যে জন পায় না সে ধন,

         পায় সে কেবল ভিক্ষা।

চির-উপবাসী মিছা-সন্ন্যাসী

         দিয়েছে তাহারে দীক্ষা।

তোর সাধনায় রত্নমানিক

         পথে পথে যাস ছড়ায়ে,

ভিক্ষার ঝুলি, ধিক্‌ তারে ধিক্‌,

         বহিস নে শিরে চড়ায়ে।

হায় রে ভিক্ষু, হায় রে,

         নিঃস্বজনের দুঃস্বপনের

               বন্ধ,ছিঁড়িস তায় রে।

তখন সূর্যের আলোক অলৌকিক ভাবে মন্দিরের গর্ভগৃহকে আলোকিত করছে। ভবদেব সেই আলোকে আলোকিত অপূর্ব সুন্দর সত্য ধ্যানীযোগী শিবকে দেখলেন। আর তার সুমুখে দণ্ডায়মান শক্তি স্বরূপা নাগিলাকে দেখলেন। কি যে অলৌকিক সে দৃশ্য তিনি দেখলেন ….সে তাঁর অবচেতন মনই জানল। নাগিলা বললেন, ” বাইরের তোমাকে হারিয়ে অন্তরে যে আরও নিবিড় করে পেয়েছি, দীর্ঘ তপশ্চর্যায় প্রেমের এই রহস্যও কি তুমি বুঝতে পারলে না ? বিবাহ পূর্বে যে দেবতা যোগীরূপে কামের বন্ধন ছেদন করে প্রেমের সিংহদ্বার আমাদের সম্মুখে মুক্ত করে দিলেন তাও তুমি উপলব্ধি করতে পারলে না? “

অবনত মুখে দাঁড়িয়ে ভবদেব, যুগপৎ প্রত্যাখ্যানের বেদনা ও অনুশোচনায় তাঁর হৃদয় বিদীর্ণ হয়েছে আজ।

উন্নত কন্ঠে নাগিলা বললেন, যাও যাও , সন্ন্যাসী সন্ন্যাসেই সুন্দর, আপন গুরু গৃহে ফিরে তাঁর নিকট ক্ষমা চাও। যদি কোনো দিন শুনি পুনরায় তুমি রিপুর বশীভূত হয়ে আমার মাংসপিণ্ডের লোভে এই গাঁয়ে এসেছ , তবে আমি নদীতে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণ ত্যাগ করব।” এই বলেই সেই মানবী রূপী দেবী স্বরূপা নাগিলা ধীরপদে চলে গেলেন । আর পশ্চাতে ফিরেও দেখলেন না। 

ভবদেব আশ্রমে ফিরে গেলেন । গুরু সুস্থিতি সকল বিষয় অবগত ছিলেন। স্মিত হেঁসে তিনি শিষ্যের মাথায় হস্ত রাখলেন। তিনি নতুন করে ভবদেবকে জ্ঞান দান করলেন। ভবদেব কঠোর তপশ্চর্যায় হৃদয়ের দুর্বার বাসনাকে জয় করতে ব্রতী হলেন। সময়ের সঙ্গে ভবদেব সিদ্ধি লাভ করলেন এবং অন্তিম জম্বুস্বামীতে পরিনত হলেন। 

এই যে সন্ন্যাস , এখানে প্রকৃত সন্ন্যাস কে  নিয়েছিলেন সেটা আপনাদের বিচার্য । আমি কেবল এই কাহিনীর শেষ করব সন্ন্যাসী বা সাধু কাকে বলে এই কথা টুকু বলে।

” যিনি সদাসত্য কথা বলেন , কৃপালু, কারও অনিষ্ট চিন্তা করেন না, যিনি সকল রিপু জয় করেছেন, যিনি সকল দোষ হতে মুক্ত, যিনি সকলের ভুল বা দোষ দেখিয়ে দিয়েও সকলের প্রতি ক্ষমাশীল , যিনি সকলের উপকার করেন , যিনি সুখে দুঃখে সমবুদ্ধি তিনিই সাধু বা সন্ন্যাসী। যথার্থ সন্ন্যাসী যাঁরা তাঁরা মানুষ, পশু, পাখি, কীট পতঙ্গ , বৃক্ষলতা সকলেরই শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন । তাঁরা সদা সকল শাস্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হন। প্রকৃত সাধু বা সন্ন্যাসী যাঁরা তাঁরা ধৈর্যশীল , গম্ভীরাত্মা ও অপ্রমত্ত হন। ক্ষুধা , তৃষ্ণা, শোক মোহ জরা ও মৃত্যু হয় তাঁদের বশীভূত। তিনি অমানী অথচ অপরকে সম্মান দান করেন। তিনি করুন হৃদয় , দয়ালু ও জ্ঞানবান। প্রকৃত যিনি সন্ন্যাসী তাঁর কোনো প্রতিষ্ঠা নেই। ভিক্ষা এবং আকাশই তাঁর বৃত্তি। ..”

নূতন নূতন বিশ্ব

অন্ধকারের নাড়ি ছিঁড়ে

জন্ম নিয়েছে আলোকে,

ভেসে চলেছে আলোড়িত নক্ষত্রের ফেনপুঞ্জে;

অবশেষে যুগান্তে তারা তেমনি করেই গেছে

যেমন গেছে বর্ষণশান্ত মেঘ,

যেমন গেছে ক্ষণজীবী পতঙ্গ।

মহাকাল, সন্ন্যাসী তুমি।

তোমার অতলস্পর্শ ধ্যানের তরঙ্গ-শিখরে

উচ্ছ্রিত হয়ে উঠছে সৃষ্টি

আবার নেমে যাচ্ছে ধ্যানের তরঙ্গতলে।

প্রচণ্ড বেগে চলেছে ব্যক্ত অব্যক্তের চক্রনৃত্য,

তারি নিস্তব্ধ কেন্দ্রস্থলে

তুমি আছ অবিচলিত আনন্দে।

হে নির্মম, দাও আমাকে তোমার ঐ সন্ন্যাসের দীক্ষা।

জীবন আর মৃত্যু, পাওয়া আর হারানোর মাঝখানে

যেখানে আছে অক্ষুব্ধ শান্তি

সেই সৃষ্টি-হোমাগ্নিশিখার অন্তরতম

স্তিমিত নিভৃতে

দাও আমাকে আশ্রয়।

#সমাপ্ত

©দুর্গেশনন্দিনী

তথ্যঃ Nagila ( Jainsquare.wordpress. com . nagila)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.