পর্ব দুই

সম্ভৎসর প্রতি মঙ্গলবার ছাচিকা দেবীর পূজা হয়। তবে , মাঘী পূর্ণিমার দিন তাঁর পূজা হয় বিশেষভাবে। বর্তমানে মন্দিরে দেবীর মূর্তি নেই। আছে এক প্রাচীন বিষ্ণু মূর্তি। 

ছাচিকা দেবী সম্বন্ধে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানা যায় না। শুধু পাওয়া যায় দুটি মন্ত্র । তার মধ্যে একটি মন্ত্র পশ্চিমবঙ্গের পূজা-পার্বণ ও মেলা প্রথম খন্ড হতে প্রাপ্ত হয়েছি । মন্ত্রটি হল –  

সিন্দুরে আসন , সিন্দুরে বসন , সিন্দুরে সিংহাসন।

এই সিন্দুর দিলাম মা গরাম কি , চণ্ডী কি বিষহরিকি।

আমার হাতের জল ফুল নিয়া শান্ত কর মা। 

অন্য জায়গা যদি যাবে ডাইনে বামে কন্ঠে বসিবে। 

গ্রামবাসীরা এই দেবীকে #ঘরপুড়ি_দেবী বলে মানেন। তাঁদের বিশ্বাস এই দেবী রুষ্ট হলে গ্রাম আগুনে পুড়ে যায়। 

প্রতি মঙ্গলবার বারেক- অভিহিত এক তাঁতি গণেশ সম্প্রদায় এই দেবী মন্দিরের মার্জনাদি কর্মে নিযুক্ত থাকেন। এই কাজের জন্য বর্তমান বারেক পুরুষানুক্রমে প্রাপ্ত সাড়ে চারবিঘা জমি ভোগ করেন। একদা এসব ভোগদখল ছিল নিষ্কর। কিন্তু এখন সেই জমি নিজ নামে রেকর্ড হয়ে যাওয়ায় #বারেক খাজনা দিয়েই ভোগ করেন।

ছাচিকা দেবীর পূজা করেন #মুগঋষি গোত্রের #দাস পদবীধারী একজন ব্যক্তি। তাঁকে বলা হয় মালাকার। তিনি এজন্যে পুরুষানুক্রমে প্রাপ্ত সাড়ে চারবিঘা জমি ভোগ করেন। এই মালাকারের বাস গণেশ পাড়ার বাইরে। 

করঞ্জী গ্রামে সমগ্র ব্রত অনুষ্ঠানটিতে সরাসরিভাবে নয় ব্যক্তি যুক্ত। দুইজন ভক্তিয়ার ( তাঁতি গণেশ – বর্তমান পদবী বসাক) , একজন নিশানিয়া ( তাঁতি গণেশ – বর্তমান পদবী বসাক) , একজন বারেক ( তাঁতি গণেশ – বতর্মান পদবী বসাক ) , দুইজন প্রসাদিয়া ( বৎসরান্তে একজনের দায়িত্ব – এঁরাও তাঁতি গণেশ , বর্তমান পদবী বসাক) , একজন মণ্ডল ( তাঁতি গণেশ – বর্তমান পদবী বসাক) ,  এবং একজন সর্ষেতেলের সরবরাহক। এছাড়াও আছেন একজন মালাকার ( তবে তিনি তাঁতি গণেশ সমাজের নন – তাঁর পদবী দাস )।

ভক্তিয়ারের কাজ ব্রতগান ও নাচ। নিশানিয়া ব্রত উপলক্ষে একটি পাঁচ হাতি কাঁচা বাঁশ লাল ও সাদা কাপড় মুড়িয়ে তার মাথায় ময়ূরের পাখা বেঁধে শোভাযাত্রার পুরোভাগে অংশ গ্রহণ করেন। প্রসাদিয়ার দায়িত্ব আতপ চাল, কলা , দুধ, চিনি , বাতাসা দিয়ে নৈবেদ্য সাজিয়ে বারেকের মাধ্যমে পূজা মন্ডপে পৌঁছে দেওয়া। মালাকার সারা বছর প্রতি মঙ্গলবারের পূজা ছাড়াও এই ব্রতে প্রয়োজনীয় দায়িত্ব পালন করেন। তেল সরবরাহকারী ৫ সের সর্ষের তেল আহুতি হিসাবে দেন। আর মণ্ডল এই ব্রতের প্রয়োজনীয় জ্বালানী , মানে বাঁশ, কাঠ ইত্যাদির যোগান দেন । এছাড়াও মণ্ডল ৩ জোড়া পায়রা ছানা , ৫ ঝুঁকি কলা , ঢাকুন, ধুপধুনুচি , প্রদীপ , হাঁড়ি ,পাতিল প্রভৃতি দিয়ে থাকেন। বাদ্যকরের মজুরী তাঁকেই দিতে হয়। বস্তুত এই পূজা ও ব্রতের মূল দায়িত্ব এখন মণ্ডলের।

এসব কাজের জন্য সকলেই কিছু কিছু নিষ্কর জমি পুরুষানুক্রমে ভোগ করে আসছিলেন। দুইজনের কথা পূর্বেই উল্লেখ করেছি। শ্রদ্ধেয় শিশির মজুমদার নিজে এদের দলিল দেখেছিলেন। সে কথা তিনি তাঁর উত্তরগ্রাম চরিত পুস্তিকায় উল্লেখও করেছেন। তাঁর বক্তব্যানুসারে উক্ত তাঁতি গণেশদের অব্যাহতি পূর্বপুরুষগণ ছিলেন চূড়ামন এস্টেটের রায় চৌধুরীদের প্রজা।  এই করঞ্জী এবং তার ব্রত অনুষ্ঠানাদি এই জমিদারীর অন্তর্ভুক্ত ছিল। 

এখানের ব্রতগান ও পূজা তিন ভাগে বিভক্ত। একভাগ শুক্লা ত্রয়োদশী রাতে ভীম দেউলের পাদদেশে আহূতি জাগানো থান বা যজ্ঞস্থলে অনুষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয় ভাগ শুক্লা চতুর্দশীর রাতে সা- পুকুরের পাড়ে বর্ম বা ব্রহ্মপূজার স্থানে । তৃতীয় ভাগের দুটি অংশ। প্রথমাংশ মাঘী পূর্ণিমার দিন দুপুরবেলা ছাচিকা দেবীর থানে ও অপরাংশ ওইদিন সন্ধ্যার পূর্বে আহূতি জাগানোর থানে পালিত হয়। 

ব্রতগানের অবশ্য ছাচিকা দেবীর স্থানেই সমাপ্তি ঘটে। ভক্তিয়ারগণ তারপর সে পুকুরে গিয়ে স্নানাদি করেন। 

শুক্লা দ্বাদশীর রাতে ভীম দেউলের পাদদেশে আহুতি জাগানো পদ্ধতিতেই এইরকম :

ওইদিন দুপুরে যজ্ঞস্থলের মাটি খুঁড়ে মাঠ থেকে শুকনো গোবর এবং খড়ি কুড়িয়ে এনে জড়ো করা হয়। রাতে সেখানে ব্রতগান ও নাচ করার পর ভক্তিয়ার গর্তের মধ্যে সুরক্ষিত শুকনো গোবর ও খড়িতে আগুন জ্বালান। সেই আগুন একটি খড়ের আঁটি দেওয়া হয়। সমস্ত আগুন পরে তুষ ও মাটিচাপা দিয়ে দুদিন রাখা থাকে। গ্রামবাসীদের বিশ্বাস শত ঝড়জলে সেই আগুন নেভেনা। পূর্বোক্ত অন্য দুই স্থানের ব্রতের আগুন নিভে গেলেও করঞ্জীর ব্রতের আগুন নেভে না। কারণ, করঞ্জী গাঁয়ের বিশ্বাস করঞ্জীই হলো ” কাষ- ব ” ব্রতের মূল এবং আদি স্থান। 

আহুতি জাগানো স্থানের ব্রতগান ও নাচের সঙ্গে ঢাক এবং মেহনা বাজে। #মেহনা উত্তর বঙ্গের এক ধরনের সানাই। গানটি আরম্ভ হলো এরকম :

সর ভায়া হে রাম রাম হে ছিরি বাসুদেবে

স্বর্গে জানে ছিরি বাসুদেবে

পাতালে জানে বাসুকী নাগে

ইথলে হামরা করিমো শুদ্ধ

ইথলে আছে গহকংকলে

পালা পালা তুই গহকংকলে

নাহি পালাব তোমারি বলে।

হামরা যাম গোসাঞি পুরী

গোসাঞি পুরীতে আনব এক কোদাই বাণে

এহ বাণে তোক সিড়াই দিম

ছয় হানিয়ে ভস্ম করিম

জেনে শুনিলে বানরি নামে

দূর পালাইল গহকংকলে।।

শ্রীরাম বাসুদেব এর নাম স্মরণ করে থান শুদ্ধ করার কাজ শুরু হয়। থান শুদ্ধর কথা স্বর্গে বাসুদেব এবং পাতালের বাসুকিনাগ জানেন। থানে আছে মল বা গহকংকলে, ঝিকট খাতরে বা ভাঙ্গা হাঁড়ির টুকরো এবং  দূর্বাঘাস । এগুলি যথাক্রমে কোদাল বা কোদাই , ঝাঁটা ও খুড়পি বা কোলাই দিয়ে পরিষ্কার করার কথা ব্রতের গানে প্রথমেই ব্যক্ত। 

 থান শুদ্ধির পরে ওখানেই ভক্তিয়ার সুর পাল্টে গায় – 

ওহে হে ধর ধর ভুইঞাদের হাতের তামুক খাও।

ওহে তাহা হৈতে চাহি হামরা ওসতাল ধান ।

ওহে একথা শুনিয়া ভুইঞাদের না থাকিল রৈয়া।

ওহে মেলাভৈর ফালায় ষাট বাষেট কোশে।।

ওহে কতেকদূর যাইতে কতেকদূর যায়।

ওহে কতক দূর যাইতে কতেক পন্থ পায়।।

ওহে কতেক দূর যাইতে কুন্তীমার নাগ্য পায়।

ওহে কুন্তীমাক দেখিয়া দিল দণ্ড পরণাম।

ওহে বসিবাক দিলরে উত্তম সিংহাসন এশিরে বন্দিয়া।।

ওহে বসিল ভুইঞাদের ‘ নেপেটি পাড়িয়া।

ওহে কোথা হইতে আইলেন বাছা কোথা তোরা যাও।।

ওহে তাহা হইতেই চাহি হামরা ওসতাল ধান। 

ওহে একঝাড় ওসতাল ধান্য দেবের বরে।

ওহে তাহা দিতে না পার‍্যেছে আমার পরাণে।

ওহে তপ্ত পৈলাতে যেমন দড়শালের তেল

ওহে সেই মতন ভুইঞাদেবের কর্দ জ্বলি গেল।।

ওহে ওসতাল ধানের তোল ভুইঞাদেব করিল গমন।

ওহে একঝাড় ওসতাল ধান ধামরি মারিল টান

ওহে একটানে ওথাঙিল ঝাড় ছয় সাত

ওহে ইলুয়া কোলাইয়া তখন ভুইঞা ভাড বান্ধে

ওহে ভাড নোঞিয়া তখন ভুইঞা ভা-ল যায়

ওহে কতেক দূর যাইতে কতেক দূর যায়

ওহে কতেক দূর যাইতে থলির নাগ্য পায়।

ওহে এতগুলা ওসতাল ধান কিবা করিস কাজ।

ওহে আরগোলা ওসতাল ধান ঠাঁইয়ে ঠাঁইয়ে থো। 

ওহে আরগোলা ওসতাল ধান বাহুরাইয়া দিল।

ওহে সেইগোলা ওসতাল ধান পিরথিমি ঢাকিল।।

এই গানে উল্লিখিত কয়েকটি শব্দের কথা ব্যাখ্যা করি। ১. ওসতাল , শব্দটি বারংবার এসেছে গানে। ওসতাল হল একধরনের ধান। যা পূর্বে উত্তরবঙ্গে চাষ হতো। পূর্বে মানে কয়েক বছর আগের কথা বলছি না। সে অনেক অনেক আগের কথা  বলছি। এখন সেই ধান বিলুপ্ত।

২. মেলাভৈর , অর্থাৎ দীর্ঘ পদক্ষেপ । 

৩. পৈলা , অর্থাৎ কড়াই।

৪. কর্দ অর্থাৎ কাদা ভাবার কারণ নেই। কর্দ অর্থাৎ ক্রোধ।

৫. তোল ,অর্থাৎ তরে বা জন্য।

৬.ওথাঙিল , অর্থাৎ উঠাইল।

৭. ইলুয়া কোলাইয়া , অর্থাৎ ইলুয়া ঘাস পাকিয়ে।

৮. ধামরি ,অর্থাৎ ধামা বা ধামা জাতীয় বস্তু।

৯. থলি , অর্থাৎ স্থলি

১০. নাগ্য ,অর্থাৎ নাগাল।

১১. বাহুরাইয়া ,অর্থাৎ ছড়িয়ে ছিটিয়ে

১২. পিরথিমি অর্থাৎ পৃথিবী।

উক্ত ভাবে তার দোহার সহযোগে গান গেয়ে চলেন। ওসতাল ধানের পর আসে চামপার মকচ  বা চাঁপার কলার মোচার কামনা । তাও অবশেষে প্রাপ্ত হয় এবং ওহে সেগোলা চামপার মকচ পিরথিমি ছাইল বলেও জানানো হয়। তারপর  একিভাবে গামার কাঠ, কুশকাটা বাঁশ , কোপিলা গাইয়ের গোময় বা গোবরের কামনা করা হয়।  ধান , কলা ,কাঠ, বাঁশ , গোবর সেই কোন আদি অন্ত কাল হতে মানব জীবনের গুরুত্বপূর্ণ এবং অপরিহার্য বস্তু এসব ব্রতকথা তারই প্রমাণ দেয়।

তারপর উত্তুরমার কাছে চাওয়া হয় সোনার শিকিয়া বা দড়ি , গড়াইং বা ভাঁড় , কোদাই ও পিডই। এসবই উত্তুরমা গ্রাম কামারের কাছ থেকে নির্মাণ করিয়ে নিয়ে আসেন। 

ক্রমশঃ

©দুর্গেশনন্দিনী

তথ্যঃ ১. উত্তর গ্রামচরিত

২. পশ্চিমবঙ্গের পূজা-পার্বণ ও মেলা -১ ম খণ্ড

৩. মধুপর্নী শারদীয়া

৪. বিরাট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.