আজ আদিগুরু শঙ্করাচার্যের জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে অজানা কিছু কথা: বারাণসীতে শঙ্করাচার্য প্রতিষ্ঠিত প্রথম কালী বিগ্রহ

ঈশ্বর বলতে তিনি বুঝেছিলেন এক অদ্বিতীয় নির্বিশেষ ব্রহ্মকে। যে ব্রহ্ম তাঁর দৃষ্টিতে ছিল অবিনাশী, অনির্দেশ্য, সর্ব ইন্দ্রিয়ের অগম্য। তিনি অর্থাৎ সনাতন হিন্দুধর্মের পুনর্জাগরণের পুরোধা পুরুষ শিবাবতার শঙ্করাচার্য। পরব্রহ্মে শক্তির অস্তিত্ব তাঁর কাছে ছিল অলীক কল্পনা। কারণ শ্রুতির কথায় – যে ব্যক্তি ব্রহ্মে বহুত্বের অভাব থাকলেও বহুত্ব দর্শন করে ; সে ব্যক্তি মৃত্যু হতে মৃত্যুতে গমন করে। ”

অদ্বৈত দর্শনের এই মহাকাব্যকে আচার্য শঙ্কর দর্শন করেছিলেন মনে প্রাণে। সনাতন হিন্দু ধর্মের শতছিন্ন, বহুটা বিভক্ত মতবাদকে আনতে চেয়েছিলেন এক অদ্বৈত তত্ত্বের ছত্রছায়ায় আর এ জন্য তাঁকে আসতে হয়েছিল ভারতের তৎকালীন সনাতন ধর্মের পীঠস্থান শিবভূমি কাশীতে। বিধির বিধান হয়ত তাই ছিল। ব্রহ্ম ও শক্তির অভেদরূপের উন্মোচন হবে সেখান থেকেই।

হরিপাদপদ্মতরঙ্গিণী গঙ্গার তীরে মণিকর্ণিকা ঘাটের শেষধাপে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন আচার্য শঙ্কর প্রভাতী সোনা ঝরা আলোয় দ্রুমদল শোভিত স্বর্ণময়ী বারাণসীর শোভা। ঘাটে ঘাটে যোগী, অৰ্চক, পুণ্যার্থীদের ‘হর হর ব্যোম ব্যোম ‘ ধ্বনি। মন্দিরে মন্দিরে ঘন্টাধ্বনির সঙ্গে মিশে সারা পরিবেশে জাগিয়ে তুলেছে এক অপার্থিব অনুভূতির শিহরণ, এক অনির্বচনীয় গাম্ভীর্য। কালের হিসাবে সময়কাল অষ্টম শতকের শেষ দশক।

সৌমদর্শন দিব্যোজ্জ্বল তনুধারী, সর্বশাস্ত্র পারঙ্গম অখণ্ড ব্রহ্মাত্ব বিজ্ঞানে সুপ্রতিষ্ঠিত দ্বাদশবর্ষীয় এই কিশোর সন্ন্যাসীকে ঘিরে কাশীধামে তখন বিরাট চাঞ্চল্য– বিস্ময়ের মাত্রা ততোধিক।

নগরীয় কোলাহলাক্রান্ত পরিবেশ থেকে সামান্য সময়ের জন্য নিজেকে মুক্ত করে আপাত নির্জন এই স্থানে পরম স্বস্তি খুঁজে পান আচার্য শঙ্কর। অতিবাহিত করেন বেশ কিছু সময়। তারপর নিজ আসনে (অবস্থানক্ষেত্র) ফেরার তাগিদ অনুভব করেন। ধীর পদক্ষেপে উঠতে থাকেন তিনি ঘাটের ওপরদিকে।

কিন্তু– ! এ কি হল! চলার শক্তি হারিয়ে গেল কেন! কেনই বা সারা শরীর জুড়ে এত ক্লান্তি, এত অবসন্নতা। তার ওপর কণ্ঠে দুরন্ত পিপাসা। বসে পড়েন আচার্য ঘাটের মাঝপথে। নিচে নেমে যে জলপান করবেন, সামর্থটুকুও লুপ্ত তাঁর। বিন্দু বিন্দু স্বেদরাশি ঝরে পড়ে ক্লান্ত শরীর থেকে। কপালে চিন্তায় বলিরেখা, অবসন্নতার চাপে ভারী তাঁর আয়ত দুই আঁখি পল্লব।

সহসা দেখেন শীর্ণকায়া, লোলচর্মা, ল্যূব্জদেহী এক বৃদ্ধা কলসিতে জল নিয়ে উঠে আসছেন উপরদিকে।

একটু জল দেবে মা–নিকটে আসতেই মিনতির সুরে বলেন শঙ্কর বৃদ্ধাকে। শুনে ঝাঁঝিয়ে ওঠেন বৃদ্ধা – সে কি বাছা, এমন শক্ত সমর্থ শরীর তোমার, আর নিচে নেমে জল খাওয়ার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেললে!

শক্তি–! বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে ওঠেন আচার্য। সমস্ত চিত্ত জুড়ে জাগে প্রবল আলোড়ন। নির্বিশেষ ব্রহ্মে তো শক্তির স্থান নেই। এতদিন এই তত্ত্বকে তিনি সত্য বলে জেনেছেন ও জানিয়েছেন। কিন্তু আজ– !

সম্বিত ফিরে পান আচার্য। কী আশ্চর্য– ! কোথায় সেই লোলচর্মা বৃদ্ধা। বরং সামনে তাঁর বিরাজমান, সালঙ্কারা, করুণাদ্রবা ভুবনমোহিনী এক অপরূপা নারীমূর্তি। বুঝতে বাকি থাকে না আচার্যের লোকবরদা ভগবতী জগজ্জননী আদ্যাশক্তিই কৃপা করে তাঁকে এমন স্বীয় অস্তিত্বের উপলব্ধি করালেন। দেবোপম তনু তাঁর শিহরিত হতে থাকে দিব্য অনুভূতির আবেশে। দুচোখ বেয়ে নামে অশ্রুধারা। ভাবাপ্লুত কণ্ঠ হতে নির্গত হয় এক অপূর্ব আত্মনিবেদন–

নজানামি দানং ন চ ধ্যান যোগং

ন জানামি তন্ত্র্যং 0ন চ স্তোত্র মন্ত্রম

ন জানামি পূজাং ন চ ন্যাস যোগং

গতিস্ত্বং গতিস্ত্বং ত্বমেকা ভবানি।

সমুদ্র আর সমুদ্রের তরঙ্গ যেমন অভেদ, মেঘ ও মেঘের বারিবিন্দু যেমন অভিন্ন, পরাশক্তি ও বেদান্তের ব্রহ্ম তেমনি স্বরূপত ভেদরহিত। বিজ্ঞানের শেষে এক মহাবিজ্ঞানের অস্তিত্ব খুঁজে পান আচার্য শঙ্কর। নিজ জীবনে এমন চেতনাদায়ী ঘটনাকে করে রাখতে চান চিরস্মরণীয়। তাই গঙ্গা ও গোদাবরীর (বর্তমানে লুপ্ত) মধ্যবর্তী ভূখণ্ডে বিশাল এক বটবৃক্ষের নীচে পর্ণকুটিরে প্রতিষ্ঠা করেন আদ্যাশক্তি মহামায়ার পাষান প্রতিমা ভদ্রকালী নামে।

এর কয়েক মাস পর একদিন প্রিয় শিষ্য পদ্মপদাচার্য ও মাধবানন্দের ওপর দেবীর সেবার ভার দিয়ে যাত্রা করেন উত্তরাখণ্ডের পথে।পদ্মপাদের প্রার্থনা অনুসারে রেখে যান আপন পাদুকাদ্বয়।

বাহুল্য আচার্য শঙ্কর পরবর্তী কালে সারা ভারতে চার মঠে (জ্যোতি, গোবর্ধন, শারদা ও শৃঙ্গেরী) যে শ্রীযন্ত্র আবশ্যিকভাবে স্থাপন করেছিলেন, ভগবতী ভবানীর প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস ও অনুরাগ তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।

কেটে যায় এরপর আরও কয়েক বছর। পদ্মপাদ চলে গেছেন রামেশ্বরে। মঠের দায়িত্ব মাধবানন্দের ওপর। ব্রতী হলেন মাধবানন্দ গুরু প্রণীত অদ্বৈতবাদ আন্দোলনকে দৃঢ়তর করার, সেই পর্ণকুটিরকে কেন্দ্র করে। সঙ্গে পেলেন শঙ্কর অনুরাগী সন্ন্যাসীদের। ভারতের পশ্চিমপ্রান্তে শারদামঠের সঙ্গে ইতিমধ্যে যুক্ত হয়ে এই পর্ণকুটির আশ্রমের নাম হয় সারদা বিন্দুমঠ।

প্রায় ৮০০ বছর। কালের খেয়ায় এগিয়ে চলে সারদা বিন্দুমঠে ধীরগতিতে। দেবী ভদ্রকালীকে কেন্দ্র করে। শারদা মঠের সঙ্গে সংযুক্তি তখন ছিন্ন। সে বিযুক্তি ১৪২৬ সালে বাংলায় তন্ত্রসাধনার পথিকৃৎ তন্ত্রাচার্য সর্বানন্দের সেই মঠে আসার পর।
মনে হয় সর্বানন্দের সাধন ধারায় (তন্ত্রমত) প্রভাবিত হন তৎকালীন মঠাধীশ দণ্ডিস্বামী হরিহরানন্দ তীর্থ। সম্ভবত সেই সময় হতে নামী সম্প্রদায়ের মধ্যে তন্ত্রসাধনার প্রসার ঘটে। আর সেই কারণে মঠের নাম বদলে হয় সুমেরু বিন্দুমঠ। মঠের সন্ন্যাসীরাও তন্ত্রের বামমার্গকে আশ্রয় করেন।

কেটে যায় এইভাবে আরও তিন দশক। মঠের অধ্যক্ষ ও ভদ্রকালীর সেবক তখন বাংলা হতে আগত মহাদেবনান্দ তীর্থ। এসেছিলেন তিনি পলাশীর যুদ্ধের (১৭৫৭ খ্রি:) আগে। মহাদেবানন্দের ব্যক্তিত্ব ও সাধন প্রভায় তখন আকৃষ্ট শক্তি অনুরাগী তৎকালীন কাশী নরেশ বলবন্ত সিং। তিনি কাশীকে অযোধ্যার করদ রাজ্য থেকে মুক্ত করে স্বাধীন রাজ্য হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেন ১৭৬১ সালে।

১৭৮১ সালে মঠের ভাগ্যকাশে আসে আরও বিপুল পরিবর্তন। ১৭৭০ সালে ২২আগস্ট কাশী নরেশ বলবন্ত সিংহের মৃত্যুর পর সিংহাসনে বসেন পুত্র চৈত সিং। ১৭৭৫ সালে চৈত সিং ইংরেজদের সঙ্গে বিবাদ ও সংঘর্ষে জড়িয়ে কাশী হতে পালাতে বাধ্য হন। বিরোধের সূত্রপাত তাঁর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজস্ব কর্তা ওয়ারেন হেস্টিংসের সঙ্গে।

১৭৮১ সালে হেস্টিংস বলবন্তের দৌহিত্র ডুমরওয়ের (বিহার) জায়গীরদার মহীপনারায়ণ সিংকে বসান কাশীর রাজসিংহাসনে। কিন্তু হেস্টিংসের সীমাহীন লোভ ও দাবি মেটাতে গিয়ে বিরোধ বাধে মহীপনারায়ণের সঙ্গে। যুদ্ধ বাধে। বন্দী হন মহীপনারায়ণ। কিন্তু বন্দিদশা আসার আগেই মহাদেবানন্দের কৃপায় মহীপনারায়ণের অলৌকিকভাবে মুক্তি ঘটে যায়। কৃতজ্ঞ মহীপনারায়ণ পরবর্তী মঠাধীশ স্বয়ংপ্রকাশনন্দকে বরণ করেন গুরুপদে। তারপর থেকে মঠের পরিচিতি হয় রাজগুরু সুমেরু মঠ নামে। সেইসঙ্গে যুক্ত হয় রাজানুকূল্য।

১৮০২ সালে (১৭৯৪ শক) মহীপনারায়ণের বিপুল দানে বলবন্তের জীর্ণ মঠের জায়গায় গড়ে ওঠে বর্তমান লাল বেলেপাথরের মঠটি। সবরকম সহযোগিতা দেন প্রয়াত মহীপনারায়ণের উত্তরাধিকারী রাজা উদিতনারায়ণ। মঠাধীশ তখন মহাদেবানন্দ শিষ্য পুরুষোত্তম তীর্থ। পরবর্তী মঠাধীশ নিগমানন্দ তীর্থকে গুরুপদে বরণ করেন মুলুটির (বীরভূম) জমিদার বসন্ত রায় আর তখন থেকে বাংলার শ্রেষ্ঠ তন্ত্রপীঠ বীরভূমের সঙ্গে মঠের আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। মঠাধীশরা তখন থেকে সম্ভবত তন্ত্রের কৌলাচারে আগ্রহী হয়ে হয়ে ওঠেন।

নিগমানন্দ তীর্থের পর পার হয়ে যায় আরও দুই শতাব্দী। নানা বিপর্যয়ের মধ্যে মঠের অস্তিত্বকে বিশেষত দেবী ভদ্রকালীর সেবাকে কোনভাবে টিকিয়ে রাখেন স্বামী ব্রহ্মানন্দ তীর্থ, ভবানন্দ তীর্থ প্রভৃতি মঠাধ্যক্ষরা।

বিংশ শতকের শেষভাগে মঠের দায়িত্ব নেন ব্রহ্মনিষ্ঠ, বিদগ্ধ বেদান্তবাদী সন্ন্যাসী দণ্ডিস্বামী আনন্দবোধ আশ্রম। তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় আবার ফিরে আসে মঠের হৃত গৌরব। রক্ষা পায় শৈবভূমির বুকে শঙ্করাচার্যের স্থাপিত শক্তিসাধনার স্থানটি। স্বামী আনন্দবোধ আশ্রম এখন আর দেহে নেই, তাঁর স্থলাভিত্তিক হয়েছেন শিষ্য অদ্বৈতবোধ আশ্রম।

বর্তমানে মঠটি কালের প্রভাবে কাশীর গণেশ মহল্লায় শীর্ণ গলিপথের মধ্যে। যে গলিপথে স্বনামধন্য চিত্রপরিচালক সত্যজিৎ রায় ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ চলচ্চিত্রের বহু চিত্রগ্রহণ করেছিলেন। গলিপথ ধরে সামান্য এগোলেই বাঁহাতি লাল বেলেপাথরের মঠটি। রাজ্য সরকারের আগ্রহের অভাবে অবহেলিত। অথচ এখানেই আছেন শঙ্করাচার্য প্রতিষ্ঠিত ১২০০ বছর পেরিয়ে যাওয়া দেবী ভদ্রকালীর মূর্তি। তৎসহ শঙ্করাচার্য সেবিত শিবলিঙ্গ ও তাঁর চরণ পাদুকা। জানিনা বর্তমান হিন্দুত্ববাদী কেন্দ্রীয় সরকার ও প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর এ বিষয়ে জানেন কিনা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.